পিআরএসপির সাতকাহন by ড. তারেক শামসুর রেহমান
দ্বিতীয় দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র (সংশোধনী) যা কিনা পিআরএসপি নামে অভিহিত, তা জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে গত ১ নভেম্বর। ২০০৫ সালে তিন বছর মেয়াদি প্রথম দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হয়েছিল। দ্বিতীয় পিআরএসপির মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত। এটি আগামী ডিসেম্বরে চূড়ান্ত করা হবে। এটি বাস্তবায়নে ৩ হাজার ১০৮ বিলিয়ন টাকা সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে।
মহাজোট সরকার এই পিআরএসপির ব্যাপারে যে সিরিয়াস তা সংসদে তাদের আলোচনা থেকেই বোঝা যায়। ওইদিন ২৪ জন সংসদ সদস্য পিআরএসপি নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী নিজে ৩৮ মিনিট এ ব্যাপারে কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী তার স্বভাবসুলভ বক্তৃতা দিয়ে দলের নির্বাচনী ইশতেহারের কথা উল্লেখ করে দারিদ্র্য বিমোচনের অঙ্গীকার করেছেন এবং আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ২০২১ সাল নাগাদ পরিবর্তনের যে অঙ্গীকার সরকার করেছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে সংসদীয় এই কৌশলপত্রে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের আরও জানিয়েছেন, মঙ্গা নামে উত্তরবঙ্গে কোনো শব্দ যেন না থাকে, সেজন্য কৌশলপত্রে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হবে। নদী ভাঙন, খরাপীড়িত অঞ্চলসহ সুবিধাবঞ্চিত এলাকার জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই আশ্বাস কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, তা ভিন্ন প্রশ্ন; কিন্তু খোদ নিজ দল ও শরিক দলের নেতারাও এর কঠোর সমালোচনা করেছেন। অত্যন্ত কঠোর ভাষায় পিআরএসপির সমালোচনা করেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সমালোচনা করেছেন জাসদ সভাপতি ও ‘নৌকা’ মার্কা নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হাসানুল হক ইনুও। তবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সমালোচনা ছিল কঠোর এবং স্পষ্ট। বলেছিলেন—কতগুলো এনজিও, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক এসব প্রেসক্রিপশন দিয়েছে। এটা মহাজোট সরকারের রূপকল্পের পরিপন্থী। এই প্রেসক্রিপশনে আর যা-ই হোক, দারিদ্র্য দূর হবে না। শেখ হাসিনার দিনবদলের অর্থনীতি হবে না। এটা বাস্তবায়ন হলে দেশে দরিদ্র বেড়ে যাবে। মহাজোট সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতা যখন প্রস্তাবিত পিআরএসপিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেন, তখন পিআরএসপি’র ভবিষ্যত্ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। পাঠকদের এখানে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ই একটা খসড়া পিআরএসপি প্রণয়ন করা হয়েছিল। তখন ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলন হয়েছিল। এখন এটাকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩ হাজার ১০৮ বিলিয়ন টাকা। ৩ লাখ ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকার সমতুল্য।
প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন পিআরএসপির মূল লক্ষ্যই দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করা, তখন শুনতে তা ভালোই শোনায়; কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন বাস্তব কথা। তিনি জানেন কারা পিআরএসপি প্রণয়ন করে এবং কাদের স্বার্থ এর দ্বারা রক্ষিত হয়। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শেই তৈরি করা হয়েছিল পিআরএসপি। এ প্রক্রিয়ায় আমাদের কিছু আমলা জড়িত থাকেন বটে, কিন্তু সুবিধাভোগী, অযোগ্য ও ভবিষ্যত্ সুবিধা পাওয়ার আশায় অপেক্ষায় থাকা এসব আমলার করার কিছুই থাকে না। তারা ‘শেখানো বুলি’ শুধু আউড়িয়েছেন। তাই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতে রাজনীতিকরা যখন স্পষ্ট করেই পিআরএসপি’র সমালোচনা করেন, তখন তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায় না।
পিআরএসপি বাস্তবায়নে যে টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা আসবে কোত্থেকে? এজন্য বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বসে আছে। তারা টাকার জোগান দেবে। অবশ্যই তা বিনে সুদে নয়। আর এ দেশের একজন কৃষককে কিংবা যে শিশু জন্ম নিল আজ, তাকেও এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে যার পরিমাণ ১৭ হাজার টাকা। ১৯৭১-৭২ সাল থেকে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে দাতাগোষ্ঠী আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ৫৬১৯০ দশমিক ৯৭৮ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের। এর মাঝে আমরা সাহায্য পেয়েছি ৪৬৪৬০ দশমিক ৮৪৪ মিলিয়ন ডলার। এতে আবার প্রকল্প সাহায্যের পরিমাণ বেশি, ২৯২২৩ দশমিক ৭৮৪ মিলিয়ন ডলার। কেন প্রকল্প খাতে সাহায্য বেশি? বেশি, কারণ এখানে ‘চুরি’ বেশি, সেই সঙ্গে দাতা দেশগুলো- দেশগুলোর ফরমায়েশ মোতাবেক বিশেষ বিশেষ দেশ ও বিশেষ বিশেষ সংস্থার তৈরিকৃত জিনিসপত্র কিনতে হয়। তাদের পছন্দমত ‘উপদেষ্টা’ নিতে হয়। আমরা আমাদের নিজ দেশের ‘উপদেষ্টাদের’ নিয়োগ দিতে পারি না। দাতা গোষ্ঠী যে শর্ত চাপিয়ে দেয়, তা অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন এবং এ দেশের সচেতন শ্রেণী মোটামুটি এটা জানে (পাঠক, আমার সম্পাদিত একটি গ্রন্থ “দেশ : রাজনীতির চার দশক”-এ এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখা হয়েছে, দেখতে পারেন)। তাহলে যে প্রশ্নটা করাই যায় তা হচ্ছে, এত বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে দারিদ্র্য দূর হলো না কেন? কেন এখনও মঙ্গার কারণে, নদী ভাঙনের শিকার হয়ে মানুষ ঢাকায় এসে ফুটপাতে থাকে? পাঠক, বাস্তবতা হচ্ছে অত্যন্ত সুকৌশলে মঙ্গা জিইয়ে রাখা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত আমাদের রাজনীতিবিদরা নন, জড়িত আমাদের কিছু এনজিও, আর ‘সুশীল সমাজের’ কিছু ব্যক্তি। মঙ্গায় রংপুরে যখন মানুষ না খেয়ে থাকে, তখন ওই সব ‘সুশীল’রা ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে সেমিনার করে খেয়ে-দেয়ে বাড়ি চলে যান। সেমিনারের টাকার জোগান দেয় দাতারা। আর তারা বলে দেয় কীভাবে সেমিনারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এনজিও নেতারা জানেন, দাতাদের সন্তুষ্টই তাদের নতুন প্রজেক্ট পেতে সাহায্য করবে। তারা পানও। সোনারগাঁও হোটেলে আবারও একটি সেমিনার করেন, এটা হচ্ছে ‘ফলোআপ’ সেমিনার। দাতারা ওভাবেই টাকা দেয়; কিন্তু রংপুরের ‘নবিতনদের’ দুঃখ আর ঘোচে না। জমি হারিয়ে, কাজ না পেয়ে, খেতে না পেয়ে নবিতন আর কবিতনদের সন্তানরা উপোস থাকে। সোনারগাঁও হোটেলে সেমিনারের কথা নবিতনরা জানে না। তাদের দরকার কাজ। তাদের দরকার তিন বেলা ভাত। নবিতনরা জানে না সংবিধান তাদের অধিকার দিয়েছে বেঁচে থাকার; কিন্তু আমরা যারা শস্লরে মানুষ, ভদ্রলোক, আমরা জানি, সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’ এনজিওরা এসব নিয়ে কথা বলে না। তারা দাতাদের শেখানো বুলিতে ‘রিপোর্ট প্রণয়ন’ করেন মঙ্গা মোকাবিলার। নদী ভাঙনের ওপর ‘গবেষণা’ করে সুশীলদের কেউ কেউ আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির হর্তাকর্তা-বিধাতা; কিন্তু নবিতনরা এখনও রংপুরে মঙ্গার সময় না খেয়ে থাকে, আর অন্য অঞ্চলের নবিতনরা নদী ভাঙনের শিকার হয়ে ঢাকার ফুটপাতে আশ্রয় নেয়।
সিপিডির এক গবেষণা প্রতিবেদনে ২০০৮ সালে বলা হয়েছে, মূল্যসম্ফীতি যেভাবে বাড়ছে তাতে বাংলাদেশের দরিদ্রতা আরও প্রকট হবে। গত আড়াই বছরে সাড়ে আট শতাংশ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। ২০০৫ সালে দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করলেও ২০০৭ সালে এসে তা ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থনীতিবিদ ও কনসালট্যান্ট ড. খলীকুজ্জমানের মতে দুটি বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আর দ্রব্যমূল্য আগের তিন কোটি চরম দরিদ্রের সংখ্যাকে ৫ কোটিতে বাড়িয়ে দিয়েছে। ৭ কোটি লোক বেশি দরিদ্র হয়েছে। আরও প্রায় ৩ কোটি লোক নেমে গেছে দারিদ্র্যসীমার অনেক নিচে। আর ওই সময়ে ড. আবুল বারকাতের মতে, দেড় বছরে ৫০ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ব্দ হয়েছে। তিন লাখ হকার কাজ হারিয়েছে। ১৫ কোটির মধ্যে ১০ কোটি মানুষ খাদ্য সঙ্কটে আছে। ৪ কোটি কোটি তিন বেলার এক বেলা খেতে পারছে না। এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন ২০০৮ সালে তার এক প্রতিবেদনে বলেছিলেন, গত ১৫ মাসে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। অথচ সাধারণ জনগণের আয় বেড়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। দারিদ্র্যসীমার নিচে ৪০ শতাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের আয়ের ৮০ শতাংশই খরচ করছে খাদ্যপণ্য কেনায়। আরেকজন অর্থনীতিবিদ সৈয়দ ইউসুফ আমাদের জানিয়েছেন, দেশের ১০ শতাংশ লোকের হাতে ৯০ শতাংশ জাতীয় সম্পদ। আর ৯০ শতাংশের হাতে রয়েছে ১০ শতাংশ সম্পদ। এই যে পরিসংখ্যান এবং তথ্য যারা দিয়েছেন বা উপস্থাপন করেছেন তারা সবাই মোটামুটি ‘সরকারি দলের সমর্থক’ বলে ধরে নেয়া হয়। এরাই বলছেন, দেশে দরিদ্রতা বাড়ছে। দাতারা যদি এটা ‘স্বীকার’ করে নেন, তাহলে তারা আরও গবেষণা করতে গবেষকদের উত্সাহিত করবেন। আর আমরা তো সবাই মোটামুটি জানি, ড. খলীকুজ্জমান কিংবা আবুল বারকাতের নিজস্ব গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে ‘গবেষণা’ হয়। এরা বেশ গুণী ব্যক্তি নিয়ে সভা-সমাবেশ, পাঁচতারা হোটেলে সেমিনারে দরিদ্রতা নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাই প্রধানমন্ত্রী যখন দারিদ্র্য বিমোচনের অঙ্গীকার করেন, আমি ঠিক আস্থা রাখতে পারছি না সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো। পিআরএসপির ধারণা বিশ্বব্যাংকের, আর তা প্রমোট করছে আমাদের দেশের কিছু অর্থনীতিবিদ যারা বিশ্বব্যাংকের পয়সায় চলেন।
আমি অপ্রচলিত নিরাপত্তা স্লমকি নিয়ে কাজ করি। আমি জানি দারিদ্র্য একটি দেশের নিরাপত্তার জন্য স্লমকিস্বরূপ। বাংলাদেশ এই নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। ইউএনডিপি প্রতিবছর যে ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স’ (ঐউও-এইচডিআই) প্রকাশ করে তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ০.৫৪৭, আর বাংলাদেশের ৫ ভাগ উপরে শ্রীলঙ্কা (০.৭৪৩) অর্থাত্ ভালো। ১৭৭টি দেশের মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪০, আর শ্রীলঙ্কার মাত্র ৯৯। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পরও শ্রীলঙ্কার অবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো। সাধারণত শিক্ষা, গড় আয়ু ও ভদ্রভাবে জীবনধারণের ক্ষমতাকে বিবেচনায় নিয়ে এইচডিআই প্রণয়ন করা হয়। আমরা বলছি মানব নিরাপত্তার কথা। বলছি, ৪টি ক্ষেত্রে নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে দারিদ্র্য (খাদ্য, আশ্রয় ও বস্ত্রের নিরাপত্তা), দুর্যোগ (পরিবেশ ও স্বাস্থ্য), অপরাধ (সন্ত্রাস ও মাস্তানতন্ত্র) এবং রাষ্ট্র (পুলিশ ও নিরাপত্তা)। বাংলাদেশে মানবিক নিরাপত্তার প্রশ্নে অতি দরিদ্র একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। হিসাব মতে, ১৯৮১ সালে ২৬.২ ভাগ জনসংখ্যার দৈনিক আয় ১ ডলারের নিচে ছিল, যা ২০০০ সালে ৩৬.০ ভাগে উন্নীত হয়েছে, দেশের ৫০ ভাগ পরিবার ভূমিহীন হয়েছে। যেখানে ৬ ভাগ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৪০ ভাগ জমি। গ্রামীণ দরিদ্রতার এটা অন্যতম কারণ। মনে রাখতে হবে, খাদ্য কিনতে পারে না এমন হতদরিদ্র ও গরিবের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে ১০ লাখ করে। প্রধানমন্ত্রী যখন সংসদে পিআরএসপি তথা দারিদ্র্য বিমোচনের অঙ্গীকার করছেন, তখন সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে এক অভাবী মানুষ মুস্তারি বেগমের কথা (দিনকাল, ৫ নভেম্বর ২০০৯), যিনি মাত্র ১শ’ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন তার কন্যাসন্তানকে। ঘটনাটি রাজশাহীর বাগমারার হামিরকুত্সা গ্রামের। প্রস্তাবিত পিআরএসপির ৩ লাখ ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা কি মুস্তারি বেগমের দরিদ্রতা ঘোচাতে পারবে? আমি জানি, প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে এবং মুস্তারি বেগম তার সন্তান ফিরে পাবেন। কিন্তু অতীতেও পিআরএসপি হয়েছে; তাতে করে মুস্তারি বেগমদের দারিদ্র্য দূর হয়নি। বিশ্বব্যাংক আর এনজিওদের প্রভাবাধীন পিআরএসপি দিয়ে দারিদ্র্য দূর হবে না। বরং বাড়বে। না বাড়লে তো ঋণ পাওয়া যাবে না। আর তখন এনজিওর নেতারা পাজেরো গাড়িতে চড়তে পারবেন না! নদী ভাঙনের কথা বলে দাতাদের নির্দেশমত বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ব্যক্তি হওয়া যাবে না। একজন এনজিও নেতা (বর্তমানে তার জন্ম দেয়া এনজিও প্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত) দাতাদের কাছ থেকে টাকা এনে ওই টাকায় ছেলেদের বিদেশে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। কুকুরের খাওয়ার বিলও করা হয়েছিল দাতাদের টাকায়। তাই পিআরএসপি নয়, সরকার নিজ উদ্যোগে কর্মসংস্থান বিশেষ করে মঙ্গাপীড়িত এলাকায় কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে, কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে এবং কটেজ শিল্প গড়ায় আর্থিক সহায়তা দিয়ে দারিদ্র্য দূর করতে পারে। এজন্য দাতাদের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই এনজিওর সাহায্য ও সহযোগিতার।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন পিআরএসপির মূল লক্ষ্যই দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করা, তখন শুনতে তা ভালোই শোনায়; কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন বাস্তব কথা। তিনি জানেন কারা পিআরএসপি প্রণয়ন করে এবং কাদের স্বার্থ এর দ্বারা রক্ষিত হয়। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শেই তৈরি করা হয়েছিল পিআরএসপি। এ প্রক্রিয়ায় আমাদের কিছু আমলা জড়িত থাকেন বটে, কিন্তু সুবিধাভোগী, অযোগ্য ও ভবিষ্যত্ সুবিধা পাওয়ার আশায় অপেক্ষায় থাকা এসব আমলার করার কিছুই থাকে না। তারা ‘শেখানো বুলি’ শুধু আউড়িয়েছেন। তাই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতে রাজনীতিকরা যখন স্পষ্ট করেই পিআরএসপি’র সমালোচনা করেন, তখন তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায় না।
পিআরএসপি বাস্তবায়নে যে টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা আসবে কোত্থেকে? এজন্য বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বসে আছে। তারা টাকার জোগান দেবে। অবশ্যই তা বিনে সুদে নয়। আর এ দেশের একজন কৃষককে কিংবা যে শিশু জন্ম নিল আজ, তাকেও এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে যার পরিমাণ ১৭ হাজার টাকা। ১৯৭১-৭২ সাল থেকে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে দাতাগোষ্ঠী আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ৫৬১৯০ দশমিক ৯৭৮ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের। এর মাঝে আমরা সাহায্য পেয়েছি ৪৬৪৬০ দশমিক ৮৪৪ মিলিয়ন ডলার। এতে আবার প্রকল্প সাহায্যের পরিমাণ বেশি, ২৯২২৩ দশমিক ৭৮৪ মিলিয়ন ডলার। কেন প্রকল্প খাতে সাহায্য বেশি? বেশি, কারণ এখানে ‘চুরি’ বেশি, সেই সঙ্গে দাতা দেশগুলো- দেশগুলোর ফরমায়েশ মোতাবেক বিশেষ বিশেষ দেশ ও বিশেষ বিশেষ সংস্থার তৈরিকৃত জিনিসপত্র কিনতে হয়। তাদের পছন্দমত ‘উপদেষ্টা’ নিতে হয়। আমরা আমাদের নিজ দেশের ‘উপদেষ্টাদের’ নিয়োগ দিতে পারি না। দাতা গোষ্ঠী যে শর্ত চাপিয়ে দেয়, তা অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন এবং এ দেশের সচেতন শ্রেণী মোটামুটি এটা জানে (পাঠক, আমার সম্পাদিত একটি গ্রন্থ “দেশ : রাজনীতির চার দশক”-এ এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখা হয়েছে, দেখতে পারেন)। তাহলে যে প্রশ্নটা করাই যায় তা হচ্ছে, এত বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে দারিদ্র্য দূর হলো না কেন? কেন এখনও মঙ্গার কারণে, নদী ভাঙনের শিকার হয়ে মানুষ ঢাকায় এসে ফুটপাতে থাকে? পাঠক, বাস্তবতা হচ্ছে অত্যন্ত সুকৌশলে মঙ্গা জিইয়ে রাখা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত আমাদের রাজনীতিবিদরা নন, জড়িত আমাদের কিছু এনজিও, আর ‘সুশীল সমাজের’ কিছু ব্যক্তি। মঙ্গায় রংপুরে যখন মানুষ না খেয়ে থাকে, তখন ওই সব ‘সুশীল’রা ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে সেমিনার করে খেয়ে-দেয়ে বাড়ি চলে যান। সেমিনারের টাকার জোগান দেয় দাতারা। আর তারা বলে দেয় কীভাবে সেমিনারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এনজিও নেতারা জানেন, দাতাদের সন্তুষ্টই তাদের নতুন প্রজেক্ট পেতে সাহায্য করবে। তারা পানও। সোনারগাঁও হোটেলে আবারও একটি সেমিনার করেন, এটা হচ্ছে ‘ফলোআপ’ সেমিনার। দাতারা ওভাবেই টাকা দেয়; কিন্তু রংপুরের ‘নবিতনদের’ দুঃখ আর ঘোচে না। জমি হারিয়ে, কাজ না পেয়ে, খেতে না পেয়ে নবিতন আর কবিতনদের সন্তানরা উপোস থাকে। সোনারগাঁও হোটেলে সেমিনারের কথা নবিতনরা জানে না। তাদের দরকার কাজ। তাদের দরকার তিন বেলা ভাত। নবিতনরা জানে না সংবিধান তাদের অধিকার দিয়েছে বেঁচে থাকার; কিন্তু আমরা যারা শস্লরে মানুষ, ভদ্রলোক, আমরা জানি, সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’ এনজিওরা এসব নিয়ে কথা বলে না। তারা দাতাদের শেখানো বুলিতে ‘রিপোর্ট প্রণয়ন’ করেন মঙ্গা মোকাবিলার। নদী ভাঙনের ওপর ‘গবেষণা’ করে সুশীলদের কেউ কেউ আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির হর্তাকর্তা-বিধাতা; কিন্তু নবিতনরা এখনও রংপুরে মঙ্গার সময় না খেয়ে থাকে, আর অন্য অঞ্চলের নবিতনরা নদী ভাঙনের শিকার হয়ে ঢাকার ফুটপাতে আশ্রয় নেয়।
সিপিডির এক গবেষণা প্রতিবেদনে ২০০৮ সালে বলা হয়েছে, মূল্যসম্ফীতি যেভাবে বাড়ছে তাতে বাংলাদেশের দরিদ্রতা আরও প্রকট হবে। গত আড়াই বছরে সাড়ে আট শতাংশ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। ২০০৫ সালে দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করলেও ২০০৭ সালে এসে তা ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থনীতিবিদ ও কনসালট্যান্ট ড. খলীকুজ্জমানের মতে দুটি বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আর দ্রব্যমূল্য আগের তিন কোটি চরম দরিদ্রের সংখ্যাকে ৫ কোটিতে বাড়িয়ে দিয়েছে। ৭ কোটি লোক বেশি দরিদ্র হয়েছে। আরও প্রায় ৩ কোটি লোক নেমে গেছে দারিদ্র্যসীমার অনেক নিচে। আর ওই সময়ে ড. আবুল বারকাতের মতে, দেড় বছরে ৫০ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ব্দ হয়েছে। তিন লাখ হকার কাজ হারিয়েছে। ১৫ কোটির মধ্যে ১০ কোটি মানুষ খাদ্য সঙ্কটে আছে। ৪ কোটি কোটি তিন বেলার এক বেলা খেতে পারছে না। এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন ২০০৮ সালে তার এক প্রতিবেদনে বলেছিলেন, গত ১৫ মাসে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। অথচ সাধারণ জনগণের আয় বেড়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। দারিদ্র্যসীমার নিচে ৪০ শতাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের আয়ের ৮০ শতাংশই খরচ করছে খাদ্যপণ্য কেনায়। আরেকজন অর্থনীতিবিদ সৈয়দ ইউসুফ আমাদের জানিয়েছেন, দেশের ১০ শতাংশ লোকের হাতে ৯০ শতাংশ জাতীয় সম্পদ। আর ৯০ শতাংশের হাতে রয়েছে ১০ শতাংশ সম্পদ। এই যে পরিসংখ্যান এবং তথ্য যারা দিয়েছেন বা উপস্থাপন করেছেন তারা সবাই মোটামুটি ‘সরকারি দলের সমর্থক’ বলে ধরে নেয়া হয়। এরাই বলছেন, দেশে দরিদ্রতা বাড়ছে। দাতারা যদি এটা ‘স্বীকার’ করে নেন, তাহলে তারা আরও গবেষণা করতে গবেষকদের উত্সাহিত করবেন। আর আমরা তো সবাই মোটামুটি জানি, ড. খলীকুজ্জমান কিংবা আবুল বারকাতের নিজস্ব গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে ‘গবেষণা’ হয়। এরা বেশ গুণী ব্যক্তি নিয়ে সভা-সমাবেশ, পাঁচতারা হোটেলে সেমিনারে দরিদ্রতা নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাই প্রধানমন্ত্রী যখন দারিদ্র্য বিমোচনের অঙ্গীকার করেন, আমি ঠিক আস্থা রাখতে পারছি না সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো। পিআরএসপির ধারণা বিশ্বব্যাংকের, আর তা প্রমোট করছে আমাদের দেশের কিছু অর্থনীতিবিদ যারা বিশ্বব্যাংকের পয়সায় চলেন।
আমি অপ্রচলিত নিরাপত্তা স্লমকি নিয়ে কাজ করি। আমি জানি দারিদ্র্য একটি দেশের নিরাপত্তার জন্য স্লমকিস্বরূপ। বাংলাদেশ এই নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। ইউএনডিপি প্রতিবছর যে ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স’ (ঐউও-এইচডিআই) প্রকাশ করে তাতে বাংলাদেশের অবস্থান ০.৫৪৭, আর বাংলাদেশের ৫ ভাগ উপরে শ্রীলঙ্কা (০.৭৪৩) অর্থাত্ ভালো। ১৭৭টি দেশের মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪০, আর শ্রীলঙ্কার মাত্র ৯৯। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পরও শ্রীলঙ্কার অবস্থা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো। সাধারণত শিক্ষা, গড় আয়ু ও ভদ্রভাবে জীবনধারণের ক্ষমতাকে বিবেচনায় নিয়ে এইচডিআই প্রণয়ন করা হয়। আমরা বলছি মানব নিরাপত্তার কথা। বলছি, ৪টি ক্ষেত্রে নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে দারিদ্র্য (খাদ্য, আশ্রয় ও বস্ত্রের নিরাপত্তা), দুর্যোগ (পরিবেশ ও স্বাস্থ্য), অপরাধ (সন্ত্রাস ও মাস্তানতন্ত্র) এবং রাষ্ট্র (পুলিশ ও নিরাপত্তা)। বাংলাদেশে মানবিক নিরাপত্তার প্রশ্নে অতি দরিদ্র একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। হিসাব মতে, ১৯৮১ সালে ২৬.২ ভাগ জনসংখ্যার দৈনিক আয় ১ ডলারের নিচে ছিল, যা ২০০০ সালে ৩৬.০ ভাগে উন্নীত হয়েছে, দেশের ৫০ ভাগ পরিবার ভূমিহীন হয়েছে। যেখানে ৬ ভাগ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ৪০ ভাগ জমি। গ্রামীণ দরিদ্রতার এটা অন্যতম কারণ। মনে রাখতে হবে, খাদ্য কিনতে পারে না এমন হতদরিদ্র ও গরিবের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে ১০ লাখ করে। প্রধানমন্ত্রী যখন সংসদে পিআরএসপি তথা দারিদ্র্য বিমোচনের অঙ্গীকার করছেন, তখন সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে এক অভাবী মানুষ মুস্তারি বেগমের কথা (দিনকাল, ৫ নভেম্বর ২০০৯), যিনি মাত্র ১শ’ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন তার কন্যাসন্তানকে। ঘটনাটি রাজশাহীর বাগমারার হামিরকুত্সা গ্রামের। প্রস্তাবিত পিআরএসপির ৩ লাখ ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা কি মুস্তারি বেগমের দরিদ্রতা ঘোচাতে পারবে? আমি জানি, প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে এবং মুস্তারি বেগম তার সন্তান ফিরে পাবেন। কিন্তু অতীতেও পিআরএসপি হয়েছে; তাতে করে মুস্তারি বেগমদের দারিদ্র্য দূর হয়নি। বিশ্বব্যাংক আর এনজিওদের প্রভাবাধীন পিআরএসপি দিয়ে দারিদ্র্য দূর হবে না। বরং বাড়বে। না বাড়লে তো ঋণ পাওয়া যাবে না। আর তখন এনজিওর নেতারা পাজেরো গাড়িতে চড়তে পারবেন না! নদী ভাঙনের কথা বলে দাতাদের নির্দেশমত বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ব্যক্তি হওয়া যাবে না। একজন এনজিও নেতা (বর্তমানে তার জন্ম দেয়া এনজিও প্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত) দাতাদের কাছ থেকে টাকা এনে ওই টাকায় ছেলেদের বিদেশে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। কুকুরের খাওয়ার বিলও করা হয়েছিল দাতাদের টাকায়। তাই পিআরএসপি নয়, সরকার নিজ উদ্যোগে কর্মসংস্থান বিশেষ করে মঙ্গাপীড়িত এলাকায় কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে, কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে এবং কটেজ শিল্প গড়ায় আর্থিক সহায়তা দিয়ে দারিদ্র্য দূর করতে পারে। এজন্য দাতাদের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই এনজিওর সাহায্য ও সহযোগিতার।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments