বাংলাদেশের অগুনতি কালিদাস by মোহাম্মদ নুরাল হক
স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় বসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্যটি অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ যথার্থই বলতে হয়। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আবদুল জলিল কর্তৃক লন্ডনে প্রদত্ত বোমা বিস্ফোরণসদৃশ কিছু তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী তার অনেক কথার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্তব্য করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কিছু লোক আছে যারা গাছের যে ডালে বসে সে ডালই কাটে’ (দৈনিক আমার দেশ, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯)।
পাঠকদের একটু স্মরণ করে দিতে চাই, ‘গাছের একই ডালে বসে সেই ডাল কাটার’ মতো সাড়া জাগানো ঘটনাটি কিন্তু সত্যি সত্যিই ঘটেছিল অনেক অনেক দিন আগে ভারতের মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী শহরে কালিদাস নামক এক ব্যক্তি কর্তৃক। ওই সময় অখ্যাত কালিদাস এহেন ঘটনাটি ঘটিয়ে সবার দ্বারা মোটামুটি বুদ্ধিহীন অথবা পাগল বলে সাব্যস্ত হলেও পরবর্তীকালে তিনি ভারত তথা পৃথিবী বিখ্যাত মহাকবি কালিদাস নামে সুবিবেচিত ও সুপরিচিত হয়ে জ্ঞানী-গুণীজনের মধ্যে সমাদৃত হয়ে আজও সুবিদিত। তবে জনাব জলিল ভবিষ্যতে মহাকবি কালিদাসের মতো কিছু একটা হবেন কিনা আপাতত তা তো ভবিতব্য!
আসলে কাটাকাটির ব্যাপারে বাংলাদেশে আমরা বোধহয় আজকাল আরও একটু এগিয়ে আছি। ইদানীং গাছের ডালে বসে গাছের ডালপালা কাটাকাটিতে আমাদের তত বেশি আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। আজকাল আমাদের সবার সবিশেষ দৃষ্টিসহ একান্ত আগ্রহ গাছে বসে একই গাছের গোড়া কাটাকাটিতে। এই তো কৃচ্ছ্রতার মাস বিগত রমজানেও প্রতিদিন খবরের কাগজের মাধ্যমে জেনেছি, উপকূল থেকে সমতল, দিগন্ত বিস্তৃত সমতল ভূমি থেকে পাহাড়, দুর্ভেদ্য পাহাড় থেকে বন-জঙ্গল এবং গহীন বন-জঙ্গল থেকে এহেন জায়গা নেই যেখানকার কোটি-কোটি টাকার গাছরাজি কেটে অবলীলাক্রমে ভূমির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়নি সব সচেতন নাগরিক ও সদাশয় সরকারের দৃষ্টির সামনে। আগে জানতাম, অন্ব্দকারাচ্ছন্ন মহাদেশ আফিদ্ধকায় মানুষখেকো গাছ আছে। এখন ডিজিটাল বাংলাদেশে গাছখেকো মানুষের খোলাখুলি ও অপ্রতিরোধ্য সদর্প বিচরণ স্বচক্ষে অবলোকন করছি।
বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে আমাদের কালিদাসদের মূল লক্ষ্যই হলো দুটি। ক্ষমতা ও অর্থ-সম্পদ। এবং তা যদি হয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আর রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কারণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদের বিষয়ে বাহারি কথার ফুলঝুড়িতে মালিক হলো নামেমাত্র জনগণ। আর দেশের জনসংখ্যার ৯৫ ভাগেরও বেশি হলো এই ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’ নামের মহাক্ষমতাধর জনগণ। বাকিরা হলেন ছোট-বড় ও আতিপাতি কালিদাস।
বস্তুত বাংলাদেশে জনগণ বলতে বায়বীয় কিছু একটা বোঝায়। যারা অবলোকনের যোগ্য নয় অথবা যাদের উপস্থিতি উপলব্ধিরও প্রয়োজন নেই। অথচ কালিদাসরা সংখ্যায় নগণ্য হলেও দৃশ্যত সর্বক্ষেত্রে সদা-সর্বদা সদর্পে বিরাজিত। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদের আশপাশে। তারা অবলোকনে চোখ ধাঁধানো ও চমক লাগানো। আর তাদের সম্পর্কে জনগণের উপলব্ধি নিশ্চিতভাবে সব সময়ই স্মরণকালের স্মরণযোগ্যও বটে।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সমাজপতি ও রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্য-বিধেয় আমাদের মতো সাধারণ জনগণের সামনে ছিল মোটামুটি স্বচ্ছ তথা পরিষ্কার। আমরা তখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েও এহেন বিষয়টি বুঝতে মোটেই কষ্ট হতো না। তখনকার দিনে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে জনসেবা তথা মানবসেবাই ছিল তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। তাই তাদের আমরাও বিনা বাক্যব্যয়ে ও বিনা দ্বিধাদ্বন্দ্বে অনুসরণ করতাম। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ এবং এ দেশেরই আরও অনেক নামিদামি, স্মরণীয়-বরণীয় প্রথিতযশা সমাজপতি ও রাজনীতিবিদ। আর অন্যদিকে দেশের ব্যবসায়ীরা শুধুই লাভ-লোকসানের হিসাব কষতেন মোটামুটিভাবে পুঁজি বিনিয়োগ এবং একনিষ্ঠভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে। যেমন—আদমজী, বাওয়ানী, দাউদ, এ কে খান ও আরও অনেক ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায়ীরা তদানীন্তন পাকিস্তানে ২২ পরিবারের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হিসেবেই সুপরিচিত ছিলেন। তাদের রাজনৈতিক অভিলাষ যা-ই থাকুক, তা কিন্তু অধুনা ব্যবসায়ীদের মতো বোমা ফাটানো গতি-প্রকৃতি নিয়ে নগ্নভাবে দিনের আলোয় কখনও এসেছিল বলে আমার মনে পড়ে না।
এদিকে স্বাধীন বাংলাদেশে আশি ও নব্বইয়ের দশকে দেখা গেল, জ্ঞানী-গুণী রাজনীতিবিশারদরা ও সমাজপতিরা ক্ষমতার পাশাপাশি অর্থ-সম্পদের দিকে কেন জানি ঝুঁকে পড়ছেন নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তাদের অতৃপ্ত আত্মা অর্থ-সম্পদ আহরণে ব্যাকুল হতে থাকে।
আর বিংশ শতাব্দীতে ঘটতে শুরু করল দ্বিমাত্রার বিষয়টি। তা হলো অর্থ-সম্পদের মালিকরা কী একটা শূন্যতার অনুভূতি থেকে ক্ষমতার পিপাসা অনুভব করতে লাগলেন। বিজ্ঞানের সূত্রমতে যখন কোনো কিছুই শূন্য থাকে না, সেই সূত্র ধরেই রাজনীতিবিদরা ও সমাজপতিরা ক্ষমতার পাশাপাশি অর্থ-সম্পদের পিপাসা আকণ্ঠ পূরণ করতে লাগলেন। ওদিকে একই সূত্রে অর্থ-সম্পদের মালিকরাও অর্থ-সম্পদের বিনিময়ে ক্ষমতার পিপাসা নিবৃত্তে মনোনিবেশ করলেন। ক্ষমতা ও অর্থ-সম্পদের এহেন হাতবদল এখন আবার অপ্রতিহত গতিতে চলছে গণতন্ত্র, সংবিধান, নারীর ক্ষমতায়ন, ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা আর মানবাধিকারের মতো দুর্বোধ্য কথামালার তুবড়ি ছোটানো ফুলঝুড়ির মধ্য দিয়েই।
আজ একবিংশ শতাব্দীতে ষোলকলা পূর্ণ হওয়ার অগ্রযাত্রায় এহেন বিষয়টি প্রায় ত্রিমাত্রায় সম্পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে কথিত ডিজিটাল বাংলাদেশে। আজকের রীতি হলো, যার ক্ষমতা আছে তিনি অনায়াসে দুই হাতে অর্থ-সম্পদ আহরণ করতে পারছেন। যার অর্থ-সম্পদ আছে তিনি বিনা দ্বিধায় ক্ষমতা ক্রয় করছেন। আর মহা ভাগ্যবান তো তারাই, ডিজিটাল জাদুর ছোঁয়ায় যাদের কাছে ক্ষমতা ও অর্থ-সম্পদ দুই-ই একই সঙ্গে হাতের নাগালে।
লেখাটি শুরু করেছিলাম জনাব জলিল সাহেবের অনেক দেরিতে হলেও অসময়ে একটি সত্য উপলব্ধিকৃত বক্তব্যের সূত্র ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্য দিয়ে। তবে জনাব জলিলের এহেন বক্তব্য নতুন কিছু নয়। ২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিলের ‘ট্রাম্পকার্ড’ তো তখন বাংলাদেশকে ওলট-পালট করার মতো অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিল। তবে আমাদের ভাগ্য ভালো যে ওসব কিছুই ছিল ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর মতো’। আসলে অধুনা বাংলাদেশে কী রাজনীতি, কী অর্থনীতি অথবা কী সমাজনীতি সবক্ষেত্রেই কিন্তু আমরা সবাই একই নৌকায় পা রেখে চলেছি। সর্বজনের আসল উদ্দেশ্যই হলো সেই গানের সুরে, ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার ক্ষমতা ও অর্থ-সম্পদ চাই’। দল-মত নির্বিশেষে, অনেকটা বিখ্যাত গায়ক ড. ভুপেন হাজারিকার সাড়া জাগানো গানের সেই কথাগুলোরও মতো। ‘ডব ধত্ব ড়হ ঃযব ংধসব নড়ধঃ নত্ড়ঃবত্ং্থ। অর্থাত্ ‘ভাইয়েরা, আমরা সবাই একই নৌকার সহযাত্রী’।
এদিকে যে নৌকায় চড়ি, সে নৌকা ফুটো করা, যে ডালে বসি, সে ডাল কাটা এবং যে পাতায় খাই, সে পাতা ফুটো করা আজকাল সাধারণভাবে আমাদের মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই একবাক্যে ছেলে-বুড়ো, ধনী-গরিব, রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ী, পেশাজীবী-সমাজসেবী এমনকি সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে ইদানীং কোনোরকম পার্থক্য আছে বলে আমার মনে হয় না। তবে স্থান-কাল ও পাত্রভেদে কথার মার-প্যাঁচে প্রায় সব বিষয়ই ঘোলাটে করার কম-বেশি প্রচেষ্টার অনেক তারতম্য অতি সহজেই পরিলক্ষিত হয়। আগেই বলেছি, আজকাল তথাকথিত ডিজিটাল বাংলাদেশে একধাপ এগিয়ে এখন যে গাছে বসি সে গাছের ডালের পরিবর্তে গোড়া কাটতেই আমরা ইচ্ছুক ও পারঙ্গম। সে লক্ষ্যে আমাদের কার্যক্রম বাছ-বিচার ছাড়াই অপ্রতিহত গতিতে ইদানীং এগিয়েও চলেছে ডিজিটাল বেগে।
আমি যখন এ লেখাটি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি তখন একজন পাঠক আমার একটি লেখা (যা ‘দৈনিক আমার দেশ’-এ গত ১৪ অক্টোবর ছাপা হয়েছে) পড়ে অনেকটা অবাক করা তার মূল্যবান কিছু মন্তব্য পাঠিয়েছেন। আমার জানামতে, এই পাঠক নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠদের একজন সজ্জন ব্যক্তি—একজন ছাপোষা মানুষ। তার উপলব্ধিকৃত মন্তব্যগুলো পাঠকদের জন্য এখানে উদ্ধৃত না করেই পারছি না।
তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃগ্ধখলার অবনতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও দখলবাজি ইত্যাদি বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনের ট্রেডমার্ক হিসেবে গণ্য করলে খুব একটা ভুল হবে বলে মনে হয় না।’ ইতিহাস তার নিজস্ব ধারা ও গতিতে এদের সত্যের মুখোমুখি করলেও ততদিনে আরও প্রায় চার বছর অতীত হবে। অতীতের অভিজ্ঞতায় এরপর যারা আসবেন তারাও এর ব্যতিক্রম হবেন এমনটি আশা করা আশার পিঠে আশা হলেও নিরর্থক বলেই প্রমাণিত হবে। আমরা সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতি ও পেশস্ফীিতির চাপে উপর্যুপরি আরও নিষ্পেষিত হতে থাকব। এদিকে দুঃখজনক হলেও সত্য, ২০০৭-০৮ সাল আমাদের সামরিক বাহিনীর জন্য প্রশ্নবোধক অধ্যায় হিসেবেও ইতিহাসের পাতায় সংযোজিত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ন্যায়-অন্যায়ের বিষয়টি আলাদাভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। এ পরিস্থিতিতে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর কোনো ভরসা রইল না। এহেন অবস্থায় এর থেকে পরিত্রাণের অন্য কোনো উপায় ও পথ দেখানোর আর কেউ কোথাও আছে কি?
শেষে মন্তব্যকারী পাঠকের ব্যক্তিগত অবস্থান জানাতে তিনি লিখছেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে এহেন গণতন্ত্র ও দলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী নই। অন্তত অধুনা একটি দরিদ্র, অশিক্ষিত, ফন্দিবাজ ও ব্যক্তিস্বার্থের জনগোষ্ঠীর এই দেশে। এদেশে অধুনা রাজনীতি ও গণতন্ত্রের উদ্দেশ্যই হলো, ‘ব্যক্তি ও দলের’ ফায়দা। এখানে বাংলাদেশসহ আমার মতো মানুষের কল্যাণ ও সাধারণ নাগরিকের সুযোগ-সুবিধা আশা করাও ধৃষ্টতা।”
মন্তব্যকারী পাঠকের সবশেষ বক্তব্যগুলো আরও চমত্কার। তিনি বলছেন, ‘আমার অনেক অনেক কষ্ট-আত্মার অনেক আকুল আকুতি। কারণ এত কিছুর পরও অনেক আশা ছিল, সত্যিই এবার আমাদের ‘দিনবদল’ হবেই হবে। এবং বিগত নির্বাচনের আগে বিষয়টি উচ্চকিতও হয়েছিল বারবার বেশ জোরেশোরেই। তবে সবই ক্রমান্বয়ে ফিকে হয়ে আসছে। ক্রমান্বয়েই জীবনের যত্সামান্য ভালো সবকিছু হাতের নাগালসহ ধরাছোঁয়ার বাইরে যেতে যেতে এখন দৃষ্টিরও আড়ালে চলে যাচ্ছে। তবে আশার পিঠে আশা হলো, বিষয়টি এখনও বোধহয় অত্যন্ত কঠিন হলেও মোটেই অসম্ভব নয়। কারণ নীতিগতভাবে কিন্তু হর-হামেশা নিজের অজান্তেই আমরা সমস্বরে একই বাক্য যা বলে থাকি তা হলো ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ।’ কাজেই এ মুহূর্তে একমাত্র সরকারপ্রধান যদি মনস্থির করে শক্ত হাতে কার্যকরভাবে নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে অবস্থান নেন, তাহলে তিনি এখনও পারেন আপাতত অসম্ভবকে সম্ভব করতে। মূল কথা হলো, আপাতদৃষ্টিতে বায়বীয় জনগণ কিন্তু তা-ই চায়!”
No comments