গার্মেন্ট শিল্পে আবারও বিসেম্ফারণ এবং কিছু প্রাসঙ্গিক কথা by হায়দার আকবর খান রনো।
আবারও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। টঙ্গীর গার্মেন্ট শিল্প এলাকা আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। গার্মেন্ট মালিকদের নির্মম শোষণ ও সীমাহীন মুনাফার লালসার শিকার পোশাক শিল্পের নারী-পুরুষ শ্রমিক। ধনিকশ্রেণীর সরকার, শ্রমিক বিদ্বেষী সরকার উন্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ওপর। পুলিশ বেপরোয়া গুলি চালাল। তিন শ্রমিক প্রাণ হারালেন। শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামে আরও তিন শহীদের সংখ্যা যোগ হলো।
লুটেরা ধনিকদের সরকার লাশ গুমের চেষ্টা চালাল সারাদিন ধরে। তারপর কিছু মিষ্টি মিষ্টি কথা। মানুষ হত্যা করে তদন্তের আশ্বাস। লোক ঠকানোর জন্য মালিকদের মৃদু ধমক, যাকে মলিকরা মোটেও গুরুত্ব সহকারে নেবে না। কারণ তারা জানে, এই দল ও সরকার তাদেরই শ্রেণীর সরকার। সবশেষে পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন চালু করার প্রস্তাব, যা ব্রিটিশ আমল থেকেই আইন দ্বারা স্বীকৃত, সেটাই কার্যকর করার জন্য মৌখিক ঘোষণামাত্র। আর একই সঙ্গে ছুড়ে দেয়া হচ্ছে সেই অতি পুরনো বস্তাপচা ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব।
পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক শোষণ স্বাভাবিক ব্যাপার। শোষণ ছাড়া পুঁজিপতিরা ধনী হতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে গার্মেন্ট শিল্পে শোষণের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। মজুরি ও শ্রমঘণ্টা হিসাব করলেই এই মাত্রাটি খালি চোখে ধরা পড়বে। ২০০৬ সালে এক বিরাট শ্রমিক অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বাধ্য হয়েছিল শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করতে। অনেক টালবাহানা করে সেদিন সরকার গার্মেন্ট খাতের জন্য যে নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করেছিল, তা গার্মেন্টের শ্রমিকরা মেনে নেননি। সেটা ছিল মাসিক ১৬৫০ টাকা। এখানে লক্ষণীয় যে, সেদিন বিরোধী দল ছিল আওয়ামী লীগ, যারা তখন সরকারের প্রতিটা পদক্ষেপে বিরোধিতা করলেও এই প্রশ্নে চমত্কার নীরবতা পালন করেছিল। কারণ শ্রেণী স্বার্থের দিক দিয়ে দুটি বড় দল একই। গার্মেন্টের মালিকরা দুই দলেই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান করে। তারাই পার্টির ফান্ডে টাকা দেয়। আর প্রশাসন তো টাকার দিকে। ফলে মালিকের পক্ষে এরা, শ্রমিকের বিরুদ্ধে। পুঁজিবাদী সমাজে এটাই হয়ে থাকে।
২০০৬ সালে যে ১৬৫০ টাকা মাসিক ন্যূনতম মজুরি ঘোষিত হয়েছিল তাও সর্বত্র কার্যকরী হয়নি। উপরন্তু গত তিন বছরে চাল-ডালসহ সব জিনিসের দাম কতগুণ বেড়েছে, তা পাঠকদের অজানা নেই। কিন্তু মজুরি বাড়েনি। মজুরি দিয়েই মাপা যায় শোষণের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। এর সঙ্গে শ্রম দিবসের বিষয়টিও যুক্ত করতে হবে। দেশের প্রচলিত শ্রম আইনে বলা আছে শ্রম দিবস হবে আট ঘণ্টা। ব্যতিক্রমহীনভাবে কোনো গার্মেন্ট কারখানায় এটা মানা হয় না। আমি খুব জোরের সঙ্গেই এই কথা বলছি। আমি ভালো করেই জানি যে, কোনো মালিকই এই অভিযোগ অস্বীকার করতে পারবে না। গার্মেন্ট শিল্পের শ্রমিকরা ১৭/১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত খাটতে বাধ্য হয়। কয়েক বছর আগে এই শিল্পের মালিকরা অন্যায় আবদার করেছিল যে শ্রম দিবস যেন ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সরকার অবশ্য তাদের এই অন্যায্য দাবি গ্রহণ করেনি। কিন্তু বাস্তবে মালিকরা শ্রমিকদের দৈনিক ১২ ঘণ্টা কেন, তারও বেশি খাটাতে বাধ্য করে। আর ধনিকশ্রেণীর সরকার সেদিকে চোখ বুঝে থাকে।
ওভারটাইম বলে একটা কথা অবশ্য আছে। কিন্তু শ্রম আইনে (সল্ট্যান্ডিং ওভার) সে সম্পর্কে যা বলা আছে তা হলো
১. কোনো শ্রমিকের সম্মতি ছাড়া তাকে আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে বলা যাবে না, ২. কোনো অবস্থাতেই কোনো শ্রমিককে দুই ঘণ্টার বেশি ওভারটাইম কাজ করানো যাবে না। ৩. ওভারটাইমের জন্য দ্বিগুণ মজুরি দিতে হবে।
বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের মালিকরা এর কোনোটিই মেনে চলেন না। শ্রম আইন ভঙ্গ করলে তা হবে দণ্ডনীয় অপরাধ। এ পর্যন্ত একজন মালিকও শাস্তি ভোগ করেনি। ধনিকশ্রেণীর সরকারের রাজত্বে শাস্তিভোগ করবে, এমনকি গুলিতে মারা যাবে কেবল শ্রমিকরাই।
এ পর্যন্ত যতবার শ্রমিক বিক্ষোভ হয়েছে তার কারণ কিন্তু অন্য। বর্ধিত মজুরির দাবি বা আট ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবি থাকলেও অতীতের সব ক’টি শ্রমিক বিক্ষোভের তাত্ক্ষণিক কারণ ছিল বকেয়া-মজুরির দাবি। খুবই কম মজুরি, দীর্ঘ শ্রম দিবস ছাড়াও কারখানার পরিবেশও খুব খারাপ। বিগত কয়েক বছরে এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক মারা গেছে আগুনে পুড়ে এবং গেট বেআইনিভাবে বন্ব্দ থাকার কারণে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে। বস্তুত মালিক এবং সেই মালিকদের সরকার শ্রমিকদের মানুষ বলেই গণ্য করে না। এমনই বর্বর ব্যবস্থা। গার্মেন্ট কারখানায় যা চলে তাকে এক কথায় বলা যায় শ্রম দাসত্ব। মধ্যযুগীয় বর্বরতা।
এই সেদিন টঙ্গীর নিপ্পন কারখানায় যা ঘটে গেল, তার মূলেও ছিল বকেয়া বেতন। ২ নভেম্বর আমার দেশ-এর সম্পাদকীয়তে সঠিকভাবেই বলা হয়েছে, ‘নিপ্পন গার্মেন্ট শ্রমিকরা শনিবার সকালে কাজে যোগ দিতে এসে কারখানার গেট তালাবদ্ধ এবং নোটিশ টাঙানো দেখে।... যেখানে চালু অবস্থাতেই নিয়মিত বেতন দেয়া হতো না, সেখানে বন্ব্দ ঘোষণার পর বকেয়া বেতন দেয়া হবে সেটা কারও কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।... এমন পরিস্থিতিতে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা সামনে কাউকে না পেয়ে যা করার তা-ই করেছে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় আশপাশের মানুষ। এ দেশে এ ধরনের অঘটন মোটেই অস্বাভাবিক নয়। তাই বলে পুলিশ যেভাবে উন্মত্তের মতো গুলি চালিয়েছে তার পেছনে যুক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন।’
পুলিশের গুলি চালানো চরমভাবে নিন্দনীয় তো বটেই। বরং পুলিশের নির্বিচারে গুলি সরকারের গণবিরোধী ও শ্রমিক বিদ্বেষী মনোভাবেরই পরিচায়ক। আরও নিন্দনীয় লাশ গুম করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা। ১ নভেম্বর আমার দেশ-এর প্রথম পাতায় যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে সেখান থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করা যাক।
‘মৃত্যুর খবর প্রাথমিকভাবে স্থানীয় পুলিশ স্বীকার করলেও পরে বলেছে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তারা এ নিয়ে কিছু বলবে না।... সন্ব্দ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও লাশ পাওয়া যায়নি বলে সাংবাদিকদের জানান। একই দাবি করেন বিজিএমইএর সভাপতি। বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও প্রিন্ট মিডিয়াকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলে রাত অবধি।’
কিন্তু ‘এর আগে সংঘর্ষের তীব্রতার সময় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশের ভ্যানে করে ঘটনাস্থল থেকে তিনটি লাশ নিয়ে যাওয়ার খবর প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে অতি সংবেদনশীল আচরণের পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রায় ১২ ঘণ্টা লাশ গুমের ব্যর্থ চেষ্টা চালান।’
লাশ গুমের ঘটনা আমাদের মনে পুরানো লোমহর্ষক ঘটনাগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। এক সময় রক্ষীবাহিনী ঠিক এই কাজ করত। ক্রসফায়ার হলো একই কৌশলের পরবর্তী সংস্করণ। যেখানে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত সঠিক তথ্য না দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। যেখানে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে লাশ সরিয়ে নিয়ে সরাসরি অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায়, সেখানে আমরা শঙ্কিত না হয়ে পারি না। এ যে ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মধ্যে যদি কোনো সরকার ফ্যাসিবাদী চেহারায় আত্মপ্রকাশ করে তাহলে গণতন্ত্রমনা মানুষকে এখনই সাবধান হতে হবে। ফ্যাসিবাদ যাতে গেড়ে বসতে না পারে সেজন্য আমাদের যা যা করণীয় তা-ই করতে হবে।
ফ্যাসিবাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বাগাড়ম্বর। এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারি দলের উপরে আর কেউ যেতে পারবে না। মুখে চমত্কার বুলি, কাজে ঠিক তার বিপরীত। এই সরকারের একটি প্রিয় বুলি হলো ষড়যন্ত্র। কিছুদিন আগে প্রভাবশালী মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এক বক্তৃতায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের বকেয়া বেতন চাওয়ার পেছনেও ষড়যন্ত্রের গন্ব্দ খুঁজে পেয়েছিলেন। গার্মেন্টের মালিকরাও বলেন ষড়যন্ত্রের কথা। শ্রমিকের মজুরি মাসের পর মাস বকেয়া রাখাই কি সেই ষড়যন্ত্র, যার জন্য দায়ী মালিকরাই? অন্যদিকে প্রধান বিরোধীদল বিএনপির সাধারণ সম্পাদকও ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব শুনিয়েছেন। প্রতিবেশী দেশকে সুবিধা দিতে দেশের গার্মেন্ট শিল্প ধ্বংস করার জন্য ষড়যন্ত্র করছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। সরকারি দল, বিরোধীদল এবং মালিক সমিতি সবাই কোনো না কোনোভাবে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব আনছেন। কিন্তু শ্রমিকের প্রতি চরম অন্যায়ের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া এবং তারই ফলশ্রুতি স্বাভাবিক বিসেম্ফারণ হিসেবে এই ঘটনাকে কেউ দেখতে রাজি নন। শ্রেণীস্বার্থে কি সবাই এক?
আমার দেশ-এর সম্পাদকীয়তে (২ নভেম্বর ২০০৯) সঠিকভাবেই বলা হয়েছে: ‘ষড়যন্ত্র, নাশকতা, দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট, গার্মেন্ট শিল্প ধ্বংসের মতো কথা এখন খুবই পুরনো হয়ে গেছে। এর আগে অনেক ঘটনার পর এসব বলেই দায় সেরেছেন গার্মেন্ট মালিক নেতা ও সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু তাদের কথার প্রমাণ বা দোষী ব্যক্তি বা শক্তিকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার পদক্ষেপ দেখা যায়নি।’
তবে ন্যায়সঙ্গত শ্রমিক বিক্ষোভের সুযোগ যে অন্য কেউ নেয় না এমন কথা বলা যাবে না। এমন দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিক সময়েই পাওয়া যাবে। গত জুলাই মাসে আশুলিয়ায় গার্মেন্ট শিল্পে ঠিক একইভাবে শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। এখানে লক্ষণীয় যে, কোনো এক কারখানায় কোনো ঘটনা ঘটলে আশপাশের কারখানার শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসেন সংহতি জানানোর জন্য। এটি শুভ দিক। শ্রমিকশ্রেণীর উন্নততর চেতনার প্রকাশ। গত জুলাই মাসে আশুলিয়ায় গোটা এলাকা জুড়ে ন্যায়সঙ্গত শ্রমিক বিক্ষোভের সময় হা-মীম গ্রুপের এক কারখানায় কিছু বহিরাগত ব্যক্তি আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই কারখানার বা অন্য কোনো কারখানার শ্রমিকরা এই কাজ করেননি। কারা করেছিলেন সেই নামও পাওয়া গেছে। শ্রমিক নেতারা সংবাদ সম্মেলনে সেসব নাম প্রকাশ করেছিলেন। যারা আগুন লাগিয়েছিলেন, তারা সরকার দলীয় লোক, স্থানীয় নেতাও বটে। তাদের সঙ্গে কারখানার কর্তৃপক্ষের ঝুট ব্যবসা নিয়ে আগের বিরোধ ছিল। তারা শোধ নিয়েছিলেন শ্রমিক বিক্ষোভের সময় এবং এটা সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপটের কারণে। ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব এখানে কাজে লাগিয়ে প্রকৃত দোষীকে ধরা হয়নি। এরও আগে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জরুরি আইনের যুগে গার্মেন্ট খাতে শ্রমিক বিক্ষোভের সময় বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা উচ্চকিত কণ্ঠে বলা হয়েছিল এবং একজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। পরে মার্কিন দূতাবাসের হস্তক্ষেপের ফলে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল মার্কিন প্রশাসনের একান্ত বাধ্য ও অনুগত সেদিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
অতএব ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব তুলে ধরার আগে সরকার বা অন্য কেউ যেন তা ভালোভাবে বুঝেসুঝে করেন।
টঙ্গীর ঘটনার পর সরকারের মুখপাত্ররা এবার পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন করার কথা বলেছেন।
‘পোশাক শিল্পে অসন্তোষ নিরসনে ট্রেড ইউনিয়ন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এজন্য শ্রম মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে।’ কী আশ্চর্য! তাহলে কি এতদিন পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন অবৈধ ছিল? আইনগতভাবে সিদ্ধ হলেও বস্তুত এই খাতে ট্রেড ইউনিয়নকে জোর করে বেআইনিভাবে নিষিদ্ধ রাখা হয়েছিল। মালিকরা ট্রেড ইউনিয়ন সহ্য করতে রাজি ছিল না। ট্রেড ইউনিয়ন করার উদ্যোগ নিলে মালিকরা উদ্যোক্তাদের ছাঁটাই করত, গুণ্ডা দিয়ে রাস্তায় মারধোর করত, নারী শ্রমিকদের ওপর যৌন হয়রানির ঘটনাও ঘটত। এর সঙ্গে যুক্ত থাকত স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন। তাই ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীরা চাকরি হারানো, গুণ্ডার আক্রমণ, যৌন হয়রানির শিকার হওয়া থেকে মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হতো। বর্তমান সরকারসহ অতীতের শ্রমিক-বিদ্বেষী সরকারগুলো এসব না দেখার ভান করত।
ট্রেড ইউনিয়ন আইনগতভাবে নিষিদ্ধ নয় যে নতুন করে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেটা সরকারকে করতে হবে, তা হলো মালিকদের অবৈধ কাজের ব্যাপারে কড়া নজর রাখতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও ট্রেড ইউনিয়নের কাজের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলে অথবা ট্রেড ইউনিয়ন করার জন্য কাউকে ভিকটিমাইজ করলে, সেসব মালিকের বিরুদ্ধে জেল-জরিমানাসহ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তাছাড়া শ্রম আইন সংশোধন করতে হবে। বর্তমান শ্রম আইনে বলা হয়েছে যে, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার ১৫ দিনের মধ্যে নিবন্ব্দনের আগেই কারখানা কর্তৃপক্ষকে তা জানাতে হবে। আগে এমন ধারা ছিল না। বর্তমানের এই ধারার ফলে মালিকরা খুব সহজেই গোড়াতেই ছাঁটাই, মিথ্যা মামলা ইত্যাদি দ্বারা ট্রেড ইউনিয়নকে ধ্বংস করার সুযোগ পায়। তাই ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের চাকরির ও অন্যান্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া শ্রমিক সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ সদস্য না হলে ট্রেড ইউনিয়ন করা যাবে না, এমন যে ধারা আছে সেটাও পরিবর্তন করা দরকার। ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা নির্দিষ্ট করা সঠিক নয়। তা গণতান্ত্রিকও নয়। সবচেয়ে বড় কথা, মালিকদের পশ্চাত্পদ ধ্যান-ধারণা পরিত্যাগ করে সামন্ত মানসিকতা দূর করে আধুনিক বুর্জোয়া হতে হবে। যতদিন তা তারা হবেন না, ততদিন শ্রমিক বিক্ষোভ কোনো আইনানুগ পথ না নিয়ে বিসেম্ফারণ ও অভ্যুত্থানের পথেই এগুবে। কারণ, আইনের পথ মালিক ও সরকার উভয়ই মিলে বন্ব্দ করে দিয়েছে।
ট্রেড ইউনিয়নের কথা বললে মালিকরা আঁেক ওঠেন। পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়নের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘আমাদের উপর এক ধরনের অযৌক্তিক দাবি চাপিয়ে দেয়ার চক্রান্ত চলছে।’ অর্থাত্ ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার তাদের বিবেচনায় অযৌক্তিক। এই মানসিকতা থাকলে গার্মেন্ট খাতে সুস্থ পরিবেশ কখনই আসতে পারে না।
মালিকদের বোঝানো দরকার যে, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার গণতন্ত্রেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ ধরনের মানসিকতা সম্বন্ব্দে মালিকদের গণতান্ত্রিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং কিছুটা আধুনিক করাই এখন একটা বড় কাজ বলে গণ্য হওয়া উচিত। আর তা যদি তারা না হতে পারেন, তাহলে শ্রমিকশ্রেণীই তাদের গণতন্ত্রের শিক্ষা দেবে। সব সভ্য দেশে শ্রমিকশ্রেণী যেভাবে এই কাজটি করে এসেছে, বাংলাদেশেও তারা একই ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস ও আস্থা আছে।
পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক শোষণ স্বাভাবিক ব্যাপার। শোষণ ছাড়া পুঁজিপতিরা ধনী হতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে গার্মেন্ট শিল্পে শোষণের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। মজুরি ও শ্রমঘণ্টা হিসাব করলেই এই মাত্রাটি খালি চোখে ধরা পড়বে। ২০০৬ সালে এক বিরাট শ্রমিক অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বাধ্য হয়েছিল শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করতে। অনেক টালবাহানা করে সেদিন সরকার গার্মেন্ট খাতের জন্য যে নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করেছিল, তা গার্মেন্টের শ্রমিকরা মেনে নেননি। সেটা ছিল মাসিক ১৬৫০ টাকা। এখানে লক্ষণীয় যে, সেদিন বিরোধী দল ছিল আওয়ামী লীগ, যারা তখন সরকারের প্রতিটা পদক্ষেপে বিরোধিতা করলেও এই প্রশ্নে চমত্কার নীরবতা পালন করেছিল। কারণ শ্রেণী স্বার্থের দিক দিয়ে দুটি বড় দল একই। গার্মেন্টের মালিকরা দুই দলেই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান করে। তারাই পার্টির ফান্ডে টাকা দেয়। আর প্রশাসন তো টাকার দিকে। ফলে মালিকের পক্ষে এরা, শ্রমিকের বিরুদ্ধে। পুঁজিবাদী সমাজে এটাই হয়ে থাকে।
২০০৬ সালে যে ১৬৫০ টাকা মাসিক ন্যূনতম মজুরি ঘোষিত হয়েছিল তাও সর্বত্র কার্যকরী হয়নি। উপরন্তু গত তিন বছরে চাল-ডালসহ সব জিনিসের দাম কতগুণ বেড়েছে, তা পাঠকদের অজানা নেই। কিন্তু মজুরি বাড়েনি। মজুরি দিয়েই মাপা যায় শোষণের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। এর সঙ্গে শ্রম দিবসের বিষয়টিও যুক্ত করতে হবে। দেশের প্রচলিত শ্রম আইনে বলা আছে শ্রম দিবস হবে আট ঘণ্টা। ব্যতিক্রমহীনভাবে কোনো গার্মেন্ট কারখানায় এটা মানা হয় না। আমি খুব জোরের সঙ্গেই এই কথা বলছি। আমি ভালো করেই জানি যে, কোনো মালিকই এই অভিযোগ অস্বীকার করতে পারবে না। গার্মেন্ট শিল্পের শ্রমিকরা ১৭/১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত খাটতে বাধ্য হয়। কয়েক বছর আগে এই শিল্পের মালিকরা অন্যায় আবদার করেছিল যে শ্রম দিবস যেন ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সরকার অবশ্য তাদের এই অন্যায্য দাবি গ্রহণ করেনি। কিন্তু বাস্তবে মালিকরা শ্রমিকদের দৈনিক ১২ ঘণ্টা কেন, তারও বেশি খাটাতে বাধ্য করে। আর ধনিকশ্রেণীর সরকার সেদিকে চোখ বুঝে থাকে।
ওভারটাইম বলে একটা কথা অবশ্য আছে। কিন্তু শ্রম আইনে (সল্ট্যান্ডিং ওভার) সে সম্পর্কে যা বলা আছে তা হলো
১. কোনো শ্রমিকের সম্মতি ছাড়া তাকে আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে বলা যাবে না, ২. কোনো অবস্থাতেই কোনো শ্রমিককে দুই ঘণ্টার বেশি ওভারটাইম কাজ করানো যাবে না। ৩. ওভারটাইমের জন্য দ্বিগুণ মজুরি দিতে হবে।
বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের মালিকরা এর কোনোটিই মেনে চলেন না। শ্রম আইন ভঙ্গ করলে তা হবে দণ্ডনীয় অপরাধ। এ পর্যন্ত একজন মালিকও শাস্তি ভোগ করেনি। ধনিকশ্রেণীর সরকারের রাজত্বে শাস্তিভোগ করবে, এমনকি গুলিতে মারা যাবে কেবল শ্রমিকরাই।
এ পর্যন্ত যতবার শ্রমিক বিক্ষোভ হয়েছে তার কারণ কিন্তু অন্য। বর্ধিত মজুরির দাবি বা আট ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবি থাকলেও অতীতের সব ক’টি শ্রমিক বিক্ষোভের তাত্ক্ষণিক কারণ ছিল বকেয়া-মজুরির দাবি। খুবই কম মজুরি, দীর্ঘ শ্রম দিবস ছাড়াও কারখানার পরিবেশও খুব খারাপ। বিগত কয়েক বছরে এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক মারা গেছে আগুনে পুড়ে এবং গেট বেআইনিভাবে বন্ব্দ থাকার কারণে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে। বস্তুত মালিক এবং সেই মালিকদের সরকার শ্রমিকদের মানুষ বলেই গণ্য করে না। এমনই বর্বর ব্যবস্থা। গার্মেন্ট কারখানায় যা চলে তাকে এক কথায় বলা যায় শ্রম দাসত্ব। মধ্যযুগীয় বর্বরতা।
এই সেদিন টঙ্গীর নিপ্পন কারখানায় যা ঘটে গেল, তার মূলেও ছিল বকেয়া বেতন। ২ নভেম্বর আমার দেশ-এর সম্পাদকীয়তে সঠিকভাবেই বলা হয়েছে, ‘নিপ্পন গার্মেন্ট শ্রমিকরা শনিবার সকালে কাজে যোগ দিতে এসে কারখানার গেট তালাবদ্ধ এবং নোটিশ টাঙানো দেখে।... যেখানে চালু অবস্থাতেই নিয়মিত বেতন দেয়া হতো না, সেখানে বন্ব্দ ঘোষণার পর বকেয়া বেতন দেয়া হবে সেটা কারও কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।... এমন পরিস্থিতিতে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা সামনে কাউকে না পেয়ে যা করার তা-ই করেছে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় আশপাশের মানুষ। এ দেশে এ ধরনের অঘটন মোটেই অস্বাভাবিক নয়। তাই বলে পুলিশ যেভাবে উন্মত্তের মতো গুলি চালিয়েছে তার পেছনে যুক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন।’
পুলিশের গুলি চালানো চরমভাবে নিন্দনীয় তো বটেই। বরং পুলিশের নির্বিচারে গুলি সরকারের গণবিরোধী ও শ্রমিক বিদ্বেষী মনোভাবেরই পরিচায়ক। আরও নিন্দনীয় লাশ গুম করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা। ১ নভেম্বর আমার দেশ-এর প্রথম পাতায় যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে সেখান থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করা যাক।
‘মৃত্যুর খবর প্রাথমিকভাবে স্থানীয় পুলিশ স্বীকার করলেও পরে বলেছে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তারা এ নিয়ে কিছু বলবে না।... সন্ব্দ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও লাশ পাওয়া যায়নি বলে সাংবাদিকদের জানান। একই দাবি করেন বিজিএমইএর সভাপতি। বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও প্রিন্ট মিডিয়াকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলে রাত অবধি।’
কিন্তু ‘এর আগে সংঘর্ষের তীব্রতার সময় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশের ভ্যানে করে ঘটনাস্থল থেকে তিনটি লাশ নিয়ে যাওয়ার খবর প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে অতি সংবেদনশীল আচরণের পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রায় ১২ ঘণ্টা লাশ গুমের ব্যর্থ চেষ্টা চালান।’
লাশ গুমের ঘটনা আমাদের মনে পুরানো লোমহর্ষক ঘটনাগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। এক সময় রক্ষীবাহিনী ঠিক এই কাজ করত। ক্রসফায়ার হলো একই কৌশলের পরবর্তী সংস্করণ। যেখানে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত সঠিক তথ্য না দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। যেখানে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে লাশ সরিয়ে নিয়ে সরাসরি অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায়, সেখানে আমরা শঙ্কিত না হয়ে পারি না। এ যে ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মধ্যে যদি কোনো সরকার ফ্যাসিবাদী চেহারায় আত্মপ্রকাশ করে তাহলে গণতন্ত্রমনা মানুষকে এখনই সাবধান হতে হবে। ফ্যাসিবাদ যাতে গেড়ে বসতে না পারে সেজন্য আমাদের যা যা করণীয় তা-ই করতে হবে।
ফ্যাসিবাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বাগাড়ম্বর। এ ব্যাপারে বর্তমান সরকারি দলের উপরে আর কেউ যেতে পারবে না। মুখে চমত্কার বুলি, কাজে ঠিক তার বিপরীত। এই সরকারের একটি প্রিয় বুলি হলো ষড়যন্ত্র। কিছুদিন আগে প্রভাবশালী মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এক বক্তৃতায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের বকেয়া বেতন চাওয়ার পেছনেও ষড়যন্ত্রের গন্ব্দ খুঁজে পেয়েছিলেন। গার্মেন্টের মালিকরাও বলেন ষড়যন্ত্রের কথা। শ্রমিকের মজুরি মাসের পর মাস বকেয়া রাখাই কি সেই ষড়যন্ত্র, যার জন্য দায়ী মালিকরাই? অন্যদিকে প্রধান বিরোধীদল বিএনপির সাধারণ সম্পাদকও ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব শুনিয়েছেন। প্রতিবেশী দেশকে সুবিধা দিতে দেশের গার্মেন্ট শিল্প ধ্বংস করার জন্য ষড়যন্ত্র করছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। সরকারি দল, বিরোধীদল এবং মালিক সমিতি সবাই কোনো না কোনোভাবে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব আনছেন। কিন্তু শ্রমিকের প্রতি চরম অন্যায়ের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া এবং তারই ফলশ্রুতি স্বাভাবিক বিসেম্ফারণ হিসেবে এই ঘটনাকে কেউ দেখতে রাজি নন। শ্রেণীস্বার্থে কি সবাই এক?
আমার দেশ-এর সম্পাদকীয়তে (২ নভেম্বর ২০০৯) সঠিকভাবেই বলা হয়েছে: ‘ষড়যন্ত্র, নাশকতা, দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট, গার্মেন্ট শিল্প ধ্বংসের মতো কথা এখন খুবই পুরনো হয়ে গেছে। এর আগে অনেক ঘটনার পর এসব বলেই দায় সেরেছেন গার্মেন্ট মালিক নেতা ও সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু তাদের কথার প্রমাণ বা দোষী ব্যক্তি বা শক্তিকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার পদক্ষেপ দেখা যায়নি।’
তবে ন্যায়সঙ্গত শ্রমিক বিক্ষোভের সুযোগ যে অন্য কেউ নেয় না এমন কথা বলা যাবে না। এমন দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিক সময়েই পাওয়া যাবে। গত জুলাই মাসে আশুলিয়ায় গার্মেন্ট শিল্পে ঠিক একইভাবে শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। এখানে লক্ষণীয় যে, কোনো এক কারখানায় কোনো ঘটনা ঘটলে আশপাশের কারখানার শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসেন সংহতি জানানোর জন্য। এটি শুভ দিক। শ্রমিকশ্রেণীর উন্নততর চেতনার প্রকাশ। গত জুলাই মাসে আশুলিয়ায় গোটা এলাকা জুড়ে ন্যায়সঙ্গত শ্রমিক বিক্ষোভের সময় হা-মীম গ্রুপের এক কারখানায় কিছু বহিরাগত ব্যক্তি আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই কারখানার বা অন্য কোনো কারখানার শ্রমিকরা এই কাজ করেননি। কারা করেছিলেন সেই নামও পাওয়া গেছে। শ্রমিক নেতারা সংবাদ সম্মেলনে সেসব নাম প্রকাশ করেছিলেন। যারা আগুন লাগিয়েছিলেন, তারা সরকার দলীয় লোক, স্থানীয় নেতাও বটে। তাদের সঙ্গে কারখানার কর্তৃপক্ষের ঝুট ব্যবসা নিয়ে আগের বিরোধ ছিল। তারা শোধ নিয়েছিলেন শ্রমিক বিক্ষোভের সময় এবং এটা সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপটের কারণে। ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব এখানে কাজে লাগিয়ে প্রকৃত দোষীকে ধরা হয়নি। এরও আগে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জরুরি আইনের যুগে গার্মেন্ট খাতে শ্রমিক বিক্ষোভের সময় বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা উচ্চকিত কণ্ঠে বলা হয়েছিল এবং একজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। পরে মার্কিন দূতাবাসের হস্তক্ষেপের ফলে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল মার্কিন প্রশাসনের একান্ত বাধ্য ও অনুগত সেদিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
অতএব ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব তুলে ধরার আগে সরকার বা অন্য কেউ যেন তা ভালোভাবে বুঝেসুঝে করেন।
টঙ্গীর ঘটনার পর সরকারের মুখপাত্ররা এবার পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন করার কথা বলেছেন।
‘পোশাক শিল্পে অসন্তোষ নিরসনে ট্রেড ইউনিয়ন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এজন্য শ্রম মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে।’ কী আশ্চর্য! তাহলে কি এতদিন পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন অবৈধ ছিল? আইনগতভাবে সিদ্ধ হলেও বস্তুত এই খাতে ট্রেড ইউনিয়নকে জোর করে বেআইনিভাবে নিষিদ্ধ রাখা হয়েছিল। মালিকরা ট্রেড ইউনিয়ন সহ্য করতে রাজি ছিল না। ট্রেড ইউনিয়ন করার উদ্যোগ নিলে মালিকরা উদ্যোক্তাদের ছাঁটাই করত, গুণ্ডা দিয়ে রাস্তায় মারধোর করত, নারী শ্রমিকদের ওপর যৌন হয়রানির ঘটনাও ঘটত। এর সঙ্গে যুক্ত থাকত স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন। তাই ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীরা চাকরি হারানো, গুণ্ডার আক্রমণ, যৌন হয়রানির শিকার হওয়া থেকে মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হতো। বর্তমান সরকারসহ অতীতের শ্রমিক-বিদ্বেষী সরকারগুলো এসব না দেখার ভান করত।
ট্রেড ইউনিয়ন আইনগতভাবে নিষিদ্ধ নয় যে নতুন করে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেটা সরকারকে করতে হবে, তা হলো মালিকদের অবৈধ কাজের ব্যাপারে কড়া নজর রাখতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও ট্রেড ইউনিয়নের কাজের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলে অথবা ট্রেড ইউনিয়ন করার জন্য কাউকে ভিকটিমাইজ করলে, সেসব মালিকের বিরুদ্ধে জেল-জরিমানাসহ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তাছাড়া শ্রম আইন সংশোধন করতে হবে। বর্তমান শ্রম আইনে বলা হয়েছে যে, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার ১৫ দিনের মধ্যে নিবন্ব্দনের আগেই কারখানা কর্তৃপক্ষকে তা জানাতে হবে। আগে এমন ধারা ছিল না। বর্তমানের এই ধারার ফলে মালিকরা খুব সহজেই গোড়াতেই ছাঁটাই, মিথ্যা মামলা ইত্যাদি দ্বারা ট্রেড ইউনিয়নকে ধ্বংস করার সুযোগ পায়। তাই ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের চাকরির ও অন্যান্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া শ্রমিক সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ সদস্য না হলে ট্রেড ইউনিয়ন করা যাবে না, এমন যে ধারা আছে সেটাও পরিবর্তন করা দরকার। ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা নির্দিষ্ট করা সঠিক নয়। তা গণতান্ত্রিকও নয়। সবচেয়ে বড় কথা, মালিকদের পশ্চাত্পদ ধ্যান-ধারণা পরিত্যাগ করে সামন্ত মানসিকতা দূর করে আধুনিক বুর্জোয়া হতে হবে। যতদিন তা তারা হবেন না, ততদিন শ্রমিক বিক্ষোভ কোনো আইনানুগ পথ না নিয়ে বিসেম্ফারণ ও অভ্যুত্থানের পথেই এগুবে। কারণ, আইনের পথ মালিক ও সরকার উভয়ই মিলে বন্ব্দ করে দিয়েছে।
ট্রেড ইউনিয়নের কথা বললে মালিকরা আঁেক ওঠেন। পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়নের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘আমাদের উপর এক ধরনের অযৌক্তিক দাবি চাপিয়ে দেয়ার চক্রান্ত চলছে।’ অর্থাত্ ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার তাদের বিবেচনায় অযৌক্তিক। এই মানসিকতা থাকলে গার্মেন্ট খাতে সুস্থ পরিবেশ কখনই আসতে পারে না।
মালিকদের বোঝানো দরকার যে, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার গণতন্ত্রেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ ধরনের মানসিকতা সম্বন্ব্দে মালিকদের গণতান্ত্রিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং কিছুটা আধুনিক করাই এখন একটা বড় কাজ বলে গণ্য হওয়া উচিত। আর তা যদি তারা না হতে পারেন, তাহলে শ্রমিকশ্রেণীই তাদের গণতন্ত্রের শিক্ষা দেবে। সব সভ্য দেশে শ্রমিকশ্রেণী যেভাবে এই কাজটি করে এসেছে, বাংলাদেশেও তারা একই ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস ও আস্থা আছে।
No comments