মানবাধিকার-সৌদিতে শিরশ্ছেদ :লাশগুলো অন্তত ফেরত দাও by আবু সাইয়িদ
২০ লাখ লোক সেখানে প্রবাসী, তারা ভিক্ষা করে না। রক্ত-ঘাম-শ্রমে কাজ করে। সেদেশের প্রয়োজনে সেখানে তাদের কর্মস্থল। বিষয়টি পারস্পরিক ও সমমর্যাদার। অপ্রকাশ্য বিচার ও প্রকাশ্য শিরশ্ছেদ এই সমমর্যাদা, নাগরিকত্বের সমঅধিকারে অবিশ্বাসের নীরব আর্তনাদ! মানবতা ভূলুণ্ঠিত, মানবাধিকার অবমানিত, আর কত? 'লাশগুলো অন্তত ফেরত দাও।' মর্মান্তিক, অমানবিক ঘটনা এই শিক্ষাই দিয়ে যায়, বাংলাদেশের যেমন প্রয়োজন আত্মমুক্তি, রাজা-বাদশাহদের
দরকার রাষ্ট্রশুদ্ধি দুর্বলের ওপর সবলের নির্যাতন, ধর্মের নামে মানবতার বিপর্যয়, 'প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে!' বিশ্বায়নের যুগেও এই চরম নির্দয়-নিষ্ঠুরতা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে গ্রাস করে রেখেছে। সভ্যতা, বিবেক, মানবিকতা, মানবাধিকার সবকিছুকে ছাপিয়ে আদিম বর্বরতা দৃশ্যমান! সম্প্রতি সৌদি আরবে আট বাংলাদেশির শিরশ্ছেদের ভয়ঙ্কর দৃশ্য গোটা জাতির বিবেককে ধাক্কা দিয়েছে। তাদের অপরাধের বিচার সম্পর্কে আত্মপরিজন জানেন না, পিতামাতা জানেননি, এমনকি রাষ্ট্র সময়মতো জেনেছে কি-না তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। সৌদি আরবে বিদেশি আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের বালাই আছে কী! বিচার সম্পন্ন হয় ক্যামেরা ট্রায়ালের মতো। এসব বিচার ন্যায়সঙ্গত কি-না বিশ্বে তা প্রশ্নবিদ্ধ। তবে নিদ্বর্িধায় বলা যায়, সৌদি আরবের বিচার প্রক্রিয়া কোনো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত নয়। একটি অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং এর শাসন পদ্ধতি যুগ যুগ ধরে সংস্কারহীন, বিচার প্রক্রিয়াও রয়ে গেছে মধ্যযুগীয়। কোনো বিদেশির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের ধার তারা ধারে না।
কিন্তু কোনো সৌদি নাগরিক বিদেশে দণ্ডিত হলে সৌদি সরকার তাকে রক্ষার জন্য সর্বাত্মক কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে থাকে। এমনকি তাদের বিশ্বস্ত বশংবদদের বেলায়ও তাই। সাম্প্রতিককালে যেমন, অতীতেও তেমনি। ইতিহাসের পাতা খুললেই দেখা যাবে, ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানে মুসলিম-অমুসলিম প্রশ্নে এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রায় ৫০ হাজার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী নিহত হন। এ নিয়ে একটি 'কোর্ট অব ইনকোয়ারি' গঠিত হয়। তদন্ত সূত্রে প্রকাশিত আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনকে ২১ জানুয়ারি এক মাসের সময় দিয়ে আলটিমেটাম দেওয়া হয়; কিন্তু ২৭ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদ এই দাবি অগ্রাহ্য করলে জামায়াতে ইসলামীসহ কতিপয় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দল 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন' কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং ব্যাপকভাবে জানমালের ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সেনাবাহিনী তলব করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটি ৩ হাজার ৬০০ পৃষ্ঠার লিখিত বিবৃতি এবং ২ হাজার ৭০০ পৃষ্ঠার প্রমাণ গ্রথিত করে জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা আবুল আলা মওদুদীকে হত্যা, অগি্নসংযোগ, লুটপাট এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মূল হোতা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। নির্মম পরিহাস হলো, ওহাবি আন্দোলনের আদর্শের বিশ্বস্ত অনুসারী হিসেবে সৌদি আরবের কাছে তার অপরাধের গ্রহণযোগ্যতা নির্ণীত হয়নি। 'শরিয়া আইন' অনুসারে অবধারিত মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগে সৌদি আরবের প্রবল বাধা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ আছে। সৌদি বাদশাহর অনুজ্ঞায় জামায়াতের শীর্ষ নেতা মওদুদীর দণ্ড মওকুফ করতে পাকিস্তান বাধ্য হয়। এ ঘটনা থেকে দুটি প্রতিপাদ্য বেরিয়ে আসে_ এক. 'শরিয়া আইন'কে বাইপাস করা; দুই. অন্য রাষ্ট্রের আইন ও বিচারিক রায়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ। অথচ ভ্রাতৃপ্রতিম অন্য রাষ্ট্রের মানবিক অনুরোধ তাদের কাছে মূল্যহীন, যেমন প্রত্যাখ্যাত বাংলাদেশ।
৬০০ বছর আগের কথা। সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ ১৩৮৯ থেকে ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার সিংহাসনে। দরিদ্র আরববাসীর জন্য বাংলা থেকে কয়েকবার খয়রাতি সাহায্য প্রেরিত হয়। পাঠানো অর্থ তৎকালীন মক্কা শরিফের শাসক হাসান বিন ওজলান নিজে কিছু রেখে বাকিটা 'মিসকিন' মক্কা ও মদিনাবাসীকে ভাগ করে দিয়েছিলেন। মক্কার বার-ই-উম্মেহানি নামক স্থানে বাংলা থেকে প্রেরিত অর্থে একটি মাদ্রাসা ও সরাইখানা নির্মিত হয়। এতে খরচ হয় ১২ হাজার স্বর্ণ মিসকাল। ইসান-উল-আতিম নামক স্থানে বাংলা থেকে প্রেরিত অর্থে মদিনার লোকদের জন্য আরেকটি মাদ্রাসা নির্মাণ করা হয়। এছাড়া দরিদ্র আরববাসীকে পানির কষ্ট থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে আরফা নামক স্থানে খাল খনন করার জন্য বাংলা থেকে ৩০ হাজার স্বর্ণ মিসকাল পাঠানো হয়। মক্কা শরিফে বাংলাদেশের টাকায় প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার শিক্ষক তকি-আর-ফসিহ ইবনে হাজার কুতুবুদ্দীন হানাফি, আল সখাভি প্রমুখ ইতিহাসবিদের লেখা গ্রন্থ থেকে তৎকালীন দরিদ্র আরব দেশের জন্য পৃথিবীর মধ্যে সেকালের সবচেয়ে ধনী দেশ বাংলা থেকে প্রেরিত এসব সাহায্যের কথা স্পষ্ট। সেদিন সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছিল এ দেশের মুখাপেক্ষী। এ দেশে এসেছে তারা কাজের জন্য, ব্যবসার জন্য এবং জীবিকার জন্য। কেউবা এসেছে সুগন্ধি নিয়ে। কম্বল, গরম কাপড়, খেজুর বা শুকনো ফল বেচতে। এসেছে অনুগ্রহ পেতে, করুণা পেতে। বেশি দিন আগের কথা নয়।
একথা অনস্বীকার্য যে, ২০ লাখ লোক সেখানে প্রবাসী, তারা ভিক্ষা করে না। রক্ত-ঘাম-শ্রমে কাজ করে। সেদেশের প্রয়োজনে সেখানে তাদের কর্মস্থল। বিষয়টি পারস্পরিক ও সমমর্যাদার। অপ্রকাশ্য বিচার ও প্রকাশ্য শিরশ্ছেদ এই সমমর্যাদা, নাগরিকত্বের সমঅধিকারে অবিশ্বাসের নীরব আর্তনাদ! মানবতা ভূলুণ্ঠিত, মানবাধিকার অবমানিত, আর কত? 'লাশগুলো অন্তত ফেরত দাও।' মর্মান্তিক, অমানবিক ঘটনা এই শিক্ষাই দিয়ে যায়, বাংলাদেশের যেমন প্রয়োজন আত্মমুক্তি, রাজা-বাদশাহদের দরকার রাষ্ট্রশুদ্ধি।
অধ্যাপক আবু সাইয়িদ : সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী
কিন্তু কোনো সৌদি নাগরিক বিদেশে দণ্ডিত হলে সৌদি সরকার তাকে রক্ষার জন্য সর্বাত্মক কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে থাকে। এমনকি তাদের বিশ্বস্ত বশংবদদের বেলায়ও তাই। সাম্প্রতিককালে যেমন, অতীতেও তেমনি। ইতিহাসের পাতা খুললেই দেখা যাবে, ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানে মুসলিম-অমুসলিম প্রশ্নে এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রায় ৫০ হাজার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী নিহত হন। এ নিয়ে একটি 'কোর্ট অব ইনকোয়ারি' গঠিত হয়। তদন্ত সূত্রে প্রকাশিত আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনকে ২১ জানুয়ারি এক মাসের সময় দিয়ে আলটিমেটাম দেওয়া হয়; কিন্তু ২৭ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদ এই দাবি অগ্রাহ্য করলে জামায়াতে ইসলামীসহ কতিপয় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দল 'ডাইরেক্ট অ্যাকশন' কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং ব্যাপকভাবে জানমালের ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সেনাবাহিনী তলব করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটি ৩ হাজার ৬০০ পৃষ্ঠার লিখিত বিবৃতি এবং ২ হাজার ৭০০ পৃষ্ঠার প্রমাণ গ্রথিত করে জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা আবুল আলা মওদুদীকে হত্যা, অগি্নসংযোগ, লুটপাট এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মূল হোতা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। নির্মম পরিহাস হলো, ওহাবি আন্দোলনের আদর্শের বিশ্বস্ত অনুসারী হিসেবে সৌদি আরবের কাছে তার অপরাধের গ্রহণযোগ্যতা নির্ণীত হয়নি। 'শরিয়া আইন' অনুসারে অবধারিত মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগে সৌদি আরবের প্রবল বাধা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ আছে। সৌদি বাদশাহর অনুজ্ঞায় জামায়াতের শীর্ষ নেতা মওদুদীর দণ্ড মওকুফ করতে পাকিস্তান বাধ্য হয়। এ ঘটনা থেকে দুটি প্রতিপাদ্য বেরিয়ে আসে_ এক. 'শরিয়া আইন'কে বাইপাস করা; দুই. অন্য রাষ্ট্রের আইন ও বিচারিক রায়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ। অথচ ভ্রাতৃপ্রতিম অন্য রাষ্ট্রের মানবিক অনুরোধ তাদের কাছে মূল্যহীন, যেমন প্রত্যাখ্যাত বাংলাদেশ।
৬০০ বছর আগের কথা। সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ ১৩৮৯ থেকে ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার সিংহাসনে। দরিদ্র আরববাসীর জন্য বাংলা থেকে কয়েকবার খয়রাতি সাহায্য প্রেরিত হয়। পাঠানো অর্থ তৎকালীন মক্কা শরিফের শাসক হাসান বিন ওজলান নিজে কিছু রেখে বাকিটা 'মিসকিন' মক্কা ও মদিনাবাসীকে ভাগ করে দিয়েছিলেন। মক্কার বার-ই-উম্মেহানি নামক স্থানে বাংলা থেকে প্রেরিত অর্থে একটি মাদ্রাসা ও সরাইখানা নির্মিত হয়। এতে খরচ হয় ১২ হাজার স্বর্ণ মিসকাল। ইসান-উল-আতিম নামক স্থানে বাংলা থেকে প্রেরিত অর্থে মদিনার লোকদের জন্য আরেকটি মাদ্রাসা নির্মাণ করা হয়। এছাড়া দরিদ্র আরববাসীকে পানির কষ্ট থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে আরফা নামক স্থানে খাল খনন করার জন্য বাংলা থেকে ৩০ হাজার স্বর্ণ মিসকাল পাঠানো হয়। মক্কা শরিফে বাংলাদেশের টাকায় প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার শিক্ষক তকি-আর-ফসিহ ইবনে হাজার কুতুবুদ্দীন হানাফি, আল সখাভি প্রমুখ ইতিহাসবিদের লেখা গ্রন্থ থেকে তৎকালীন দরিদ্র আরব দেশের জন্য পৃথিবীর মধ্যে সেকালের সবচেয়ে ধনী দেশ বাংলা থেকে প্রেরিত এসব সাহায্যের কথা স্পষ্ট। সেদিন সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছিল এ দেশের মুখাপেক্ষী। এ দেশে এসেছে তারা কাজের জন্য, ব্যবসার জন্য এবং জীবিকার জন্য। কেউবা এসেছে সুগন্ধি নিয়ে। কম্বল, গরম কাপড়, খেজুর বা শুকনো ফল বেচতে। এসেছে অনুগ্রহ পেতে, করুণা পেতে। বেশি দিন আগের কথা নয়।
একথা অনস্বীকার্য যে, ২০ লাখ লোক সেখানে প্রবাসী, তারা ভিক্ষা করে না। রক্ত-ঘাম-শ্রমে কাজ করে। সেদেশের প্রয়োজনে সেখানে তাদের কর্মস্থল। বিষয়টি পারস্পরিক ও সমমর্যাদার। অপ্রকাশ্য বিচার ও প্রকাশ্য শিরশ্ছেদ এই সমমর্যাদা, নাগরিকত্বের সমঅধিকারে অবিশ্বাসের নীরব আর্তনাদ! মানবতা ভূলুণ্ঠিত, মানবাধিকার অবমানিত, আর কত? 'লাশগুলো অন্তত ফেরত দাও।' মর্মান্তিক, অমানবিক ঘটনা এই শিক্ষাই দিয়ে যায়, বাংলাদেশের যেমন প্রয়োজন আত্মমুক্তি, রাজা-বাদশাহদের দরকার রাষ্ট্রশুদ্ধি।
অধ্যাপক আবু সাইয়িদ : সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী
No comments