শিল্পী নাইব উদ্দিন আহমেদ by মুস্তাফা মনোয়ার
নাইব উদ্দিন আহমেদ একটি স্মরণীয় নাম, যার সৃষ্টিতে আলোকচিত্র আরও আলোকিত হয়ে বিকশিত হয়েছে বাংলাদেশে। তিনি ছবি তোলা শুরু করেন চল্লিশ দশকের শুরুতে অবিভক্ত বাংলায়। সে সময় ছবি তোলার এত চল ছিল না, হাতে হাতে ক্যামেরা ছিল না। তখন ক্যামেরার কাজ ছিল কেবল কোনো কিছু রেকর্ড করা। যেমন—পাসপোর্ট ছবি বা বিয়ের ছবি কিংবা এ ধরনের কেজো ছবি যাকে বলি আমরা অর্থাত্ কোনো একটি কাজ সম্পন্ন হয় এ ধরনের ছবি।
কিন্তু কাজের বাইরে গিয়ে, অনেক দূরে গিয়ে, মন ও মননের সঙ্গে তার সম্পর্ক সৃষ্টি করে যারা ছবি তুলেছেন, আলোকচিত্রকে শিল্পমানে ধারণ করেছেন, তাদের মধ্যে নাইব উদ্দিন আহমেদ অন্যতম। অত্যন্ত উঁচুমাপের একজন আলোকচিত্র শিল্পী তিনি।
নাইব উদ্দিন আহমেদ পঞ্চাশ থেকে ষাট দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছবি তুলেছেন। তার ছবিতে বাংলাদেশের নানা রূপ আছে, প্রকৃতির নানা রূপক আছে; বিভিন্ন পরিবেশের, বিভিন্ন কর্মের প্রতিচ্ছবি প্রাণ পেয়েছে। কর্মরত যে কর্মজীবী, তাকে ছবিতে তিনি অন্য একটা আঙ্গিকে দেখেছেন। কাজের মধ্যে যে মানুষ কত আনন্দ পেতে পারে সেই অভিব্যক্তি অর্থাত্ নিবেদিত-প্রাণ সেই মানুষটি যে হাসছে, দৃঢ় প্রত্যয়ে কাজটি করছে সে যেন প্রকৃতিরই একটি অংশ। এই রূপকে তিনি শিল্পমহিমায় স্থান দিয়েছেন তার আলোকচিত্রে। তার ছবির মাঝি-মাল্লা-জেলে, কুমোর, কৃষক-মজুর প্রত্যেকের কাজের ভঙ্গিতে, তাদের দেহে, পরিবেশে জীবনমুখী উদ্দীপনা দেখে মনে হয় প্রকৃতির মাঝে, যে মানুষ কাজ করে যাচ্ছে, সে তার কাজটিকে কাজ হিসেবে নয়, এ পৃথিবীতে বাস করার একটা দায়িত্ব মনে করে কাজটি সম্পন্ন করছে। তার ছবিতে মানুষের এই দেহভঙ্গি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কাজ করার সময় মানুষের সেই দেহভঙ্গি আমরা লক্ষ্য করি না, কাজটাকেই দেখি। গুন টানার ওপর তার বেশ কিছু ছবি আছে। মাঝি গুন টানছে, গুন টানা মানেই হলো কাজ অর্থাত্ নৌকাটিকে বন্দরে ভেড়ানো। কিন্তু তার ছবিতে গুন টানার মধ্যে যে দেহভঙ্গি ও গতি তা কেবল মানুষের গতি নয়, নৌকার গতি নয়, প্রকৃতির গতি। প্রকৃতি, যেন সমগ্র প্রকৃতিই গুন টানার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলছে। মেঘ সহায়তা করছে, আকাশের নীল রঙ সহায়তা করছে, মাটি সহায়তা করছে এবং তারা এগিয়ে যাচ্ছে। একটি ছবির কথা এখানে উল্লেখ করছি। এ ছবিতে (দ্রষ্টব্য : চিত্র) দুটো ফিগার রয়েছে। দুটি দেহ, কিন্তু সেই দেহভঙ্গি এমন সুন্দরভাবে তিনি ঠিক সময়টাতে নিয়েছেন যেন মেঘ আর দুটো দেহের সঙ্গে একটা অদ্ভুত বন্ব্দুত্ব স্থাপিত হয়েছে এবং মনে হচ্ছে যেন একজন শিল্পী দেহভঙ্গি দেখেই মেঘটিকে রচনা করেছেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের যে বিখ্যাত ছবি— গরুর গাড়ি কাদায় পড়ে আছে, তার ওপরে ফসল। যে ফসল নিয়ে যাচ্ছে তার আকাগ্ধক্ষা, ‘আমার আঙিনায় আমার ফসল তুলবই।’ অর্থাত্ ফসল যে নিয়ে যাবে তার আঙিনায় তার নিজের জন্য, একটি পরিবারের জন্য, একটি গ্রামের জন্য এবং সর্বোপরি একটি দেশের জন্য। এই যে একাগ্র চেষ্টা ও দেহভঙ্গি জয়নুল আবেদিন এঁকেছিলেন, তেমনি নাইব উদ্দিন আহমেদের তোলা একই রকম ছবি আছে (দ্রষ্টব্য : চিত্র)। জয়নুল আবেদিন এ ছবিটি এত পছন্দ করেছিলেন যে, তার কাছ থেকে একটি প্রিন্ট-কপি চেয়ে নিয়েছিলেন। এখানে চিত্রশিল্পীর সঙ্গে আলোকচিত্র শিল্পীর সম্পর্ক কতটা নিবিড়, সেটাই প্রকাশ পেয়েছে।
বাংলাদেশে আলোকচিত্র চর্চা ও বিকাশের প্রথম দিকে মানুষের যে শৈল্পিক চেতনা ও আলোকচিত্র এ দুটোতে যেন মিল ছিল না। দৃষ্টি এবং দৃষ্টির সঙ্গে মনের আদর্শের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে আমানুল হক, নাইব উদ্দিন আহমেদ, নওয়াজেশ আহমেদ প্রমুখ আলোকচিত্রী বাংলাদেশে শৈল্পিক আলোকচিত্রের পথরেখা সৃষ্টি করেন এবং সে পথ ধরে অনেক দূর এগিয়ে যান। ছবি ওঠে ক্যামেরায় নয়, মানুষের মননে, নান্দনিক বোধে, আলোকচিত্র যে যান্ত্রিক নয় অন্তরের কথা, সেই নান্দনিক গভীরতা ও শিল্পকথা পাওয়া যায় নাইব উদ্দিন আহমেদের প্রায় প্রতিটি আলোকচিত্রে। তখন কালো-সাদা ছবির যুগ। আলোকচিত্রের এই কালো-সাদা রূপ তার প্রিয়। পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি রঙিন ছবিও তোলা শুরু করেন। তবে কালো-সাদায় তিনি যে ছবি করেছেন তা অসাধারণ। পৃথিবীতে কালো-সাদার রূপ কোনোদিনই ম্লান হবে না। অপূর্ব এক ভঙ্গিতে তা আজও এই রঙিন ও ডিজিটাল আলোকচিত্রের যুগেও উপস্থিত। কালো-সাদার একটি সংযমের অপূর্ব রূপ খুঁজে পাওয়া যায় নাইব উদ্দিন আহমেদের আলোকচিত্রে। ১২০ মিলিমিটার ফিল্ম-ফরম্যাটে তোলা তার আলোকচিত্রের কম্পোজিশনও অত্যন্ত সংহত ও শক্তিশালী। আলোকচিত্রে আলো-আঁধারের আল্পনা সৃষ্টি করেছেন তিনি। সবকিছুকে যে দেখতেই হবে, সম্পূর্ণ গা-টাকে দেখতেই হবে, মানুষের চেহারাকে বুঝতেই হবে এরকম নয়। এতটা স্পষ্টতা দিয়ে শিল্প হয় না। নান্দনিক বোধ জাগ্রত বলেই তিনি দেখা না দেখার মধ্যে যে রূপ আছে, সেই রূপে বারবার চলে গেছেন।
পঞ্চাশ ও ষাট দশক ছিল আন্দোলনের যুগ। বাংলাদেশের সব আন্দোলনের সঙ্গে নাইব উদ্দিন আহমেদ এবং তার ক্যামেরা যুক্ত ছিল। দেশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট তিনি গভীরভাবে দেখেছেন এবং তেমনিভাবেই তুলে ধরেছেন, আজকের প্রজন্মকে দেখাচ্ছেন এবং আমরা দেখতে পাচ্ছি। দেশের বিভিন্ন আন্দোলনের সময় তিনি যেসব ছবি তুলেছিলেন, সেগুলো নিয়ে বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে। আমার মনে আছে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় আমরা যেসব ছবি আঁকতাম, বিরাট বিরাট ছবি, সেসব ছবি আঁকছি, সেই পাকিস্তান আমলে, তখন আমি বেশকিছু সিরিজ ছবি এঁকেছিলাম, এর প্রত্যেকটি ছবি তিনি তুলেছিলেন। দেশের অন্য শিল্পীদের ছবিও তিনি তুলেছিলেন। দিনের পর দিন, এমনকি, আঁকা শেষ হওয়ার জন্যও তিনি অপেক্ষা করেননি। সেটা একটা স্মৃতি, সারা দিন তিনি কাজ করে যাচ্ছেন, কোনো কথা বলছেন না। এভাবে দেশের প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিক উপলব্ধি থেকেই তিনি কাজ করে গেছেন।
১৯৭১-এ তোলা মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্রগুলো নাইব উদ্দিন আহমেদের জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। নানা পরিবেশে, নানা দুঃখ-কষ্টের মধ্যে পালিয়ে-পালিয়ে অনেক বিপদের মধ্যে থেকেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি ছবি তুলেছেন। সে সময় পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন-নিপীড়ন, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের অনেক ছবি তোলেন তিনি। বিভিন্ন কৌশলে কিছু ছবি আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। সেগুলো বিশ্ব বিবেককে ভীষণ নাড়া দেয়। তার তোলা নির্যাতিত-লাঞ্ছিত নারীর ছবি, বধ্যভূমিতে পড়ে থাকা মৃতদেহ ও কঙ্কালের ছবিগুলো কেবল সংবাদ-সুলভ ঘটনা নয়। একজন শিল্পীর মনের বেদনা দিয়ে ছবিগুলো নির্মিত। তাই এগুলো শুধু সংবাদ-চিত্র নয়, মানুষের মনুষ্যত্বে যে আঘাত লেগেছিল সেই আঘাত থেকে এ ছবিগুলো তৈরি হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনে একটি ভয়ঙ্কর ও মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা। মানুষ যে কত নৃশংস হতে পারে, কত পশুত্ব তার মধ্যে বিরাজমান, এসবকিছু দেখেছেন তিনি এ সময়। পশুর চেয়ে অধম সেই মানুষগুলো বাংলাদেশের মানুষকে মেরেছে, নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত করেছে। সেসব দেখে, তাদের সেই দুঃখ-কষ্ট বেদনা, সব হারানোর বেদনা এবং নিঃস্ব হওয়ার বেদনা তার অন্তরে এমনভাবে পৌঁছেছে যে, তারপর থেকে তার ছবি তোলা থমকে গেছে। কেন ছবি তুলছি, ছবি তুলে কী করব, যারা চলে গেল তাদের জন্য কী করতে পারি— সেই বেদনায় একেবারে বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন তিনি এবং তার পর থেকে ছবি তোলা ভীষণভাবে কমে গেছে, হয়তবা তোলেন কিন্তু আর তুলতে যেন ইচ্ছা করে না তার। তিনি একথা বারবার বলেছেন। এরকম প্রাণোদ্দীপ্ত মানবিক শিল্পী ক’জন হয়। এভাবে সবদিক দিয়েই নাইব উদ্দিন আহমেদ অত্যন্ত উজ্জ্বল একটি নাম, আমাদের স্মরণীয় বরণীয় এবং চিরকালের অত্যন্ত উচ্চমানের একজন শিল্পী। শুধু আলোকচিত্র শিল্পীই বলব না, তাকে আমি শিল্পীই বলছি। অত্যন্ত সৃষ্টিশীল এবং গভীরভাবে শিল্পী। এ দেশের যে চিত্র, দেশের কাল-ক্ষণ-মুহূর্ত তিনি আলোকচিত্রে ধরে রেখেছেন সেটা এ দেশের বিরাট একটা সম্পদ। এ দেশের মানুষ তাকে চিরকাল স্মরণ করবে।
সুদীর্ঘকাল পরে হলেও নাইব উদ্দিন আহমেদের আলোকচিত্র অ্যালবাম প্রকাশিত হচ্ছে বলে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। তার মতো দেশপ্রেমে উজ্জীবিত উঁচু মাপের শিল্পীর অ্যালবাম জাতীয়ভাবে জাতীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত হওয়া উচিত ছিল। ‘প্রজ্ঞা’ এই প্রচারবিমুখ শিল্পীর অ্যালবাম প্রকাশ করে একটি বড় দায়িত্ব পালন করছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন জানাই।
No comments