কথামালার নাচন, আশ্বাসের পতন by ড. সা'দত হুসাইন

তিসম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে অর্থমন্ত্রী জোরালোভাবে আশ্বাস দিয়েছেন যে চলতি অর্থবছরে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে সাত শতাংশ। অর্থমন্ত্রীর এ আশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধকারের লেখা পত্রিকায় প্রকাশ হতে দু-একদিন সময় লাগে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব লেখা প্রকাশিত হওয়ার আগেই অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়ে বসলেন, এ বছর অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশ না হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।


এর আগে অর্থমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, দু-একদিন বা বড়জোর দু-এক সপ্তাহের মধ্যেই শেয়ারবাজার ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু শেয়ারবাজার ঠিক হয়নি, অস্থিতিশীল রয়ে গেছে। অবশেষে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, শেয়ারবাজার সম্পর্কে তিনি আর কোনো কথা বলবেন না, শেয়ারবাজারের ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কিছু করণীয় নেই, এটি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) আওতাধীন বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও একসময় বলেছিলেন, শেয়ারবাজারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো সম্পর্ক নেই। পদ্মা সেতুর ব্যাপারেও জনগণকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল, চিন্তার কোনো কারণ নেই, শিগগির সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক হয়নি। এখন শুনছি, বিকল্প ব্যবস্থায় পিপিপির মাধ্যমে একটি নয়, দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে।
যেদিন জানা গেল ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর হচ্ছে না, সেই সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, চিন্তার কোনো কারণ নেই, এই সফরকালে অবশ্যই তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর হবে। একই সময়ে ভারতীয় টেলিভিশনে সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানালেন, যেহেতু একটি প্রদেশের সরকার এ চুক্তিতে সম্মতি দেয়নি, তাই আপাতত এ চুক্তি স্বাক্ষর হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত চুক্তি স্বাক্ষর না করেই মনমোহন সিং দেশে ফিরে গেলেন। আবার তাঁর এক সহকর্মী মন্ত্রীর আশ্বাস : সব ঠিক হয়ে যাবে, কয়েক মাসের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হবে। মাস পেরিয়ে গেল, চুক্তি স্বাক্ষর হলো না। কবে স্বাক্ষর হবে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না।
মন্ত্রী এবং প্রায় সমপর্যায়ের সম্মানীয় ব্যক্তিদের কাছ থেকে আমরা প্রায়ই এরূপ নিশ্চিত আশ্বাস পেয়ে থাকি, যা পূরণ হয় না। পূরণ হওয়ার কথা নয়। কিসের ভিত্তিতে, কী কারণে তাঁরা এরূপ আশ্বাস দিয়ে থাকেন তা সহজবোধ্য নয়। হয়তোবা তাঁরা ছোট বয়সে সেই হতদরিদ্র অসহায় মায়ের গল্প পড়েছিলেন, যে মা খালি হাঁড়িতে পানি চড়িয়ে ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, একটু সবুর করতে হবে, আর কিছুক্ষণের মধ্যে খাওয়া প্রস্তুত হয়ে যাবে। অবুঝ শিশুরা কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
এ ধরনের আশ্বাস দেওয়ার কারণ হতে পারে, একটি চালকের প্রাক্কলিত আকার নির্ধারণের জন্য বা ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণের জন্য যেসব প্রভাবক চালক বিবেচনায় আনা দরকার, সেসব চালক সম্পর্কে মাননীয় ব্যক্তিদের কোনো ধারণা নেই। চালক সম্পর্কে অবহিত থাকলেও চালকের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া কিংবা অন্যান্য চালকের সঙ্গে এদের মিথস্ক্রিয়া তাঁদের ধারণার বাইরে। এককথায় সামগ্রিক কর্মকাঠামো এবং রূপমঞ্চ সম্পর্কে তাঁদের প্রজ্ঞার অভাব রয়েছে। এরূপ ক্ষেত্রে ধীরেসুস্থে, সময় নিয়ে, চিন্তাভাবনা করে বক্তব্য রাখলে বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হবে না।
কোনো অনুষ্ঠানে গেলে বা লোকসমাগম হলে মন্ত্রী বা শ্রদ্ধাভাজন অনেক ব্যক্তি বক্তৃতা দেওয়ার বা কিছু কথা বলার লোভ সামাল দিতে পারেন না। কিছু একটা বলতে গিয়ে তাঁরা প্রায়ই অবাস্তব, অপ্রাসঙ্গিক বা অসত্য কথা বলে ফেলেন। আস্থার সংকট সৃষ্টি করেন। কখনো কখনো নিজেদের হাস্যস্পদ করে তোলেন। বেশি কথা বললে কিছু ভুল তথ্য, ভুল শব্দ, অগোছালো বাক্য এবং বিসংবাদিত বাক্যাংশ বক্তব্যে ঢুকে পড়া খুবই স্বাভাবিক।
এখানে কিছু স্বপ্ন-মায়ামণ্ডিত সংখ্যার কথা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে। অনেক সময় একটি সংখ্যার প্রতি আমরা অযৌক্তিকভাবে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ি। যেমন_সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি অথবা দুই বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি। প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশ না হলে বা সহায়তার প্রতিশ্রুতি দুই বিলিয়ন না হলে জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে না বা সরকারের পতন ঘটবে_এ রকম কোনো কথা নেই। প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ এবং সাত শতাংশের মধ্যে বাস্তব পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। হিসাবকর্মীর মারপ্যাঁচে আগে-পরে এমন সংখ্যার যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে দেখেছি, প্রতিশ্রুতির সঙ্গে প্রকৃত সাহায্য সংগ্রহের বস্তুত কোনো সম্পর্ক নেই। তবুও জনগণকে আশ্বস্ত করার সে কী প্রাণান্ত চেষ্টা। প্যারিসে তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর কাকুতি-মিনতি ছিল_প্রতিশ্রুতির পরিমাণ যেন অন্তত দুই বিলিয়ন ডলার হয়। শেষ পর্যন্ত দুই বিলিয়নের আশ্বাস পাওয়া গেল, কিন্তু অর্থ পাওয়া গেল না। তাতে কিছু যায় আসে না। ঢাকায় এসে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, দুই বিলিয়ন ডলারের আশ্বাস পাওয়া গেছে। মনে হলো, সরকার যেন এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে।
আসলে মন্ত্রী, সম্মানীয়রা এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যখন যাচিত বা অযাচিত, প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় আশ্বাস-বাক্য উচ্চারণ করেন, তখন বোধ হয় তাঁরা অত ভেবেচিন্তে কথা বলেন না। এসব আশ্বাস-বাক্যকে তাঁরা নিতান্তই কথার কথা মনে করে থাকেন। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু একটা বলতে হবে, উপস্থিত লোকজনকে খুশি করতে হবে, হাততালি পেতে হবে_এ ভেবেই তাঁরা সেই মহূর্তে যা মনে আসে তা-ই বলে ফেলেন। শব্দ চয়ন, বক্তব্যের গাঁথুনি_এসবের প্রতি খুব একটা লক্ষ রাখেন না। ফলে 'আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে', 'আপনারা কিছুদিন না খেয়ে থাকেন', 'উই আর লুকিং ফর শত্রুজ' বা 'টিপাইমুখ বাঁধ ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার'_এসব বাক্য আমরা উপহার পেয়েছি। জনগণের হাসির খোরাক কিছুটা হলেও বেড়েছে।
তা ছাড়া ক্ষমতাধর ব্যক্তির আশ্বাস কোনো কোনো সময় জনমনে আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করে, বিশ্বাসের সৃষ্টি করে। সেই বিশ্বাস আহত হলে জনগণের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়, ফলে বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এ আশঙ্কায় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা কোনো কোনো সময় নিজেরাই তাঁদের অবিবেচনাপ্রসূত আশ্বাসের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন।
আসল কথা বলা একটা আর্ট, একটা শিল্পকলা। এর কিছু অংশ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আয়ত্ত করা যায়। বিদেশে 'আর্টিকুলেশন'-এর ওপর আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। তবে আমাদের দেশে যাঁরা উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হন তাঁরা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কোনো কিছু আয়ত্ত করতে চান না। তাঁরা মনে করেন, আসনই মানুষকে গড়ে নেয়, ক্ষমতাই হচ্ছে জ্ঞান। প্রকৃতপক্ষে এ মানসিকতা বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। নিবিষ্ট প্রশিক্ষণ এবং সদা সপ্রতিভ প্রয়োগ এরূপ পরিস্থিতিতে বিশেষ সহায়ক হতে পারে। উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা নিম্নোক্ত শ্লোক মনে রাখতে পারেন_
কথা বুদ্ধি কথা শুদ্ধি কথা মারে কুল,
কথা ধ্যানী, কথা জ্ঞানী, কথা সর্ব মূল।

লেখক : সাবেক পিএসসি চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

No comments

Powered by Blogger.