ঘড়ি নড়ে না, নড়ে না-দুই by ফখরুজ্জামান চৌধুরী
বাংলাদেশের মানুষ যারা বাইরের খবরাখবর রাখেন, ঘড়ির কাঁটা একঘণ্টা দেড়ঘণ্টা এগিয়ে আনার বিষয়টি তাদের অজানা নয়। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের কাছে ১৯ জুন শুক্রবার ঘড়ির কাঁটা রাত এগারোটায় সময় বারোটায় স্থাপন করার কারণ তাদের কাছে খুবই চমকপ্রদ মনে হয়েছে। সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না—এই আপ্তবাক্য অমোঘ সত্য। কিন্তু সময়কে জোর করে এগিয়ে কিংবা পিছিয়ে দেয়া যায়, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের তা এতকাল অজানা ছিল।
বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, যাদের বাস গ্রামবাংলায় তাদের কাছে এ ধরনের খবরের বিশেষ অর্থ আছে বলে মনে হয় না। এখন পর্যন্ত, এত যে আধুনিক সুবিধা চারপাশে লভ্য, গ্রামের মানুষ সহজ-সরল জীবনাচরণেই অভ্যস্ত। তারা ঘড়ি দেখে কাজে যান না, ঘড়ি দেখে কাজ থেকে ফেরেনও না। তাদের জীবনের নিয়ামক হলো সূর্য। সূর্যোদয়ে তারা মাঠে যান, সূর্যাস্তে তারা ক্লান্ত দেহে বাড়ির পথ ধরেন।এসব সহজ-সরল মানুষের প্রতিকৃতি বোধ করি বিশ্বব্যাপী একই। যারা এই উক্তির মধ্যে অবাস্তবতা দেখছেন তাদের স্মরণ করতে বলি আর্নেসল্ট হেমিংওয়ের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী উপন্যাস ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সি’-এর সেই বিখ্যাত সংলাপ যাতে অংশ নিয়েছিলেন বৃদ্ধ জেলে সান্তিয়াগো এবং তার সাহায্যকারী বালকটি।
বালক বৃদ্ধ জেলেকে জিজ্ঞেস করল; সান্তিয়াগো, প্রতিদিন এত সকালে ঘুম থেকে ওঠো তুমি কি করে? তোমার কি কোনো এলার্ম ক্লক আছে?
সান্তিয়াগোর উত্তর—না, বয়সই আমার এলার্ম ক্লক।
হয়তো আমাদের দেশের সহজ-সরল মানুষগুলোর জবাবটা ওরকম না হয়ে এ রকম হতে পারে : প্রয়োজন আমার এলার্ম ক্লক।
ডে লাইট সেভিং টাইম (ডিটিএস) বাংলাদেশে যারা চালু করলেন, বোধ করি তারা আধুনিক একটি পদ্ধতি এ দেশে প্রবর্তন করে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কাতারভুক্ত হওয়ার কথা মনে মনে ভেবে পুলক বোধ করেছেন। তা তারা করতেই পারেন! কারণ ডিটিএস পদ্ধতির কথা প্রথমে ভাবা হয় উন্নত দেশ নিউজিল্যান্ডে। এর পরে যুক্তরাজ্যে।
এই পদ্ধতি অনুসৃত হয় জার্মানি, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার মতো উন্নত এবং প্রাচুর্যের দেশে। হেতু? বিদ্যুত্ তথা জ্বালানির সাশ্রয় করা। যেন বিদ্যুত্ আর জ্বালানির অভাব না হয়। ‘আছে’ থেকে যেন ‘নাই’ না হয়।
আর আমাদের দেশে চালু করা হয় ‘নাই’ থেকে যেন ‘আরও নাই’ না হয়! এটুকু পার্থক্য কিন্তু কম নয়।
বিদ্যুতের অভাবে গোটা দেশ বিপর্যস্ত। গ্যাসের অভাবে বিদ্যুত্ উত্পাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। আটত্রিশ বছরের স্বাধীনতা-উত্তর দেশে এই অভাবের জন্য দোষ চাপানউতোর কম হয়নি।
আগে পশ্চিমাদের ওপর দায় চাপিয়েছি সঙ্গত কারণেই। বিদেশি তারা। দেশ শাসনের নামে শোষণ করেছে। তার যোগ্য জবাবও পেয়েছে।
এখন ‘ব্লেম গেম’-এর টার্গেট হচ্ছেন দেশি প্রতিপক্ষরা। বিদ্যুতের জন্য বিগত জোট সরকারের শাপান্ত করে ছেড়েছেন বর্তমান ক্ষমতাসীনরা। কিন্তু বিদ্যুত্ উত্পাদন বাড়েনি। উল্টো জনগণকে বিদ্যুত্ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য উপদেশ দেয়া হয় প্রতিনিয়ত।
যারা নিজেরা ব্যবহার করা বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করেন, তারা বিদ্যুত্ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হন নিজের গরজে। মাসের শেষে বিদ্যুতের মোটা বিল এলে বিলটা তো শোধ করতে হয় তাদেরই।
অফিস-আদালতে বিদ্যুতের যে অপচয় হয়, তা রোধ করার জন্য মাঝে মাঝে গৃহীত সরকারি পদক্ষেপ হাস্যকর মনে হয়। এখন শুনি কম বিদ্যুত্ খরচ হয় এমন বাল্ব বিনামূল্যে বিতরণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। বাল্ব কেনার জন্য টেন্ডারও ডাকা হয়েছে। টেন্ডারের শর্তাবলী নিয়ে অনেক ওজর-আপত্তির কথাও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।
অভাবের সংসারে কোনো কর্মসূচিই ঠিকমত পালন যে করা যায় না, নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে তা বস্লবার দেখা গেছে।
বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে দিবালোক সময় সাশ্রয় প্রকল্প গ্রহণের সময় বলা হয়েছিল, এর ফলে ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ সাশ্রয় হবে। লোডশেডিংয়ের পুন:পৌনিকতা থেকে মানুষ বাঁচবে। কাগ্ধিক্ষত ফলাফল কতটা অর্জিত হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে ডে লাইট সেভিং পদ্ধতি যদি শীতকালেও বহাল থাকে তা হলে মানুষের যে দুর্ভোগ বাড়বে, তাকে বলা যেতে পারে গোদের ওপর বিষফোঁড়া।
শীতকালে দিনের দৈর্ঘ্য ছোট হয়ে যায়। সূর্য ওঠে দেরিতে। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা বসে থাকে না।
এখনকার এগিয়ে রাখা সময় যদি বলবত্ থাকে তা হলে মানুষের ভোগান্তির সীমা থাকবে না।
পশ্চিমা বিশ্বে শীতকালে ঘড়ির কাঁটা ঠিক ততটাই পিছিয়ে দেয়া হয় যতটা এগিয়ে দেয়া হয় গরমকালে। এই সময় আগানো-পেছানোকে বলা হয়, ‘স্প্রি ফরোয়ার্ড, ফল ব্যাকওয়ার্ড।’
কী জানি কী ভেবে নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, মানুষ নতুন সময়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছে বা যাবে।
ভদ্র লোকের এক কথা, এই নীতিকে আদর্শ বলে মনে করলে সব সময়ে কাগ্ধিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করা না-ও যেতে পারে!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক
No comments