জ্বালানির দাম বৃদ্ধি-মূল্যস্ফীতির আগুনে ঘি পড়বে

মাত্র ৫০ দিনের ব্যবধানে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পেছনে সরকারের দিক থেকে যুক্তি যতই থাকুক; এতে করে জনজীবনে দুর্ভোগ যে বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। নানা কারণে ইতিমধ্যেই দেখা দেওয়া মূল্যস্ফীতির আগুনে এই সিদ্ধান্তে ঘি ঢালবে বলেই আশঙ্কা। অস্বীকার করা যাবে না যে, জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও সেবার মূল্য সর্বত্রই বাড়ে। এ দেশের প্রেক্ষিতে বাড়তি বিপদ হচ্ছে, জ্বালানির দাম বৃদ্ধির অনুপাতের সঙ্গে পণ্য ও সেবার দাম বৃদ্ধির


সঙ্গতি থাকে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, বিশেষ করে পরিবহন ভাড়ায়, কয়েকগুণ বৃদ্ধির দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতাও আমাদের রয়েছে। এমনকি গত সেপ্টেম্বরে যখন কেবল তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল, তখন সিএনজিচালিত কোনো কোনো পরিবহনের ভাড়াও অত্যন্ত অন্যায়ভাবে বাড়ানো হয়েছিল। অন্যান্য দেশে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির অভিঘাতের বড় অংশ উদ্যোক্তাদের বহন করতে হয়। আমাদের দেশে ভোক্তাশ্রেণীই এর প্রধান শিকার। এবার যাতে পণ্য ও সেবার মূল্য জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ন্যায্য অনুপাতই বজায় থাকে, সেদিকে কড়া নজরদারি চাই। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকার সাধারণত আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে থাকে। এবারের তথ্য বিবরণীতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সেখানে অস্থিতিশীলতার প্রমাণ নেই। তারপরও কেন এমন অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হলো_ এর কারণ হিসেবে সমালোচকরা আইএমএফের শর্তের কথা বলছেন। সরকারের ঋণ আবেদনের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অর্থকরী প্রতিষ্ঠানটি জ্বালানির দাম বাড়াতে বলেছিল। এতে করে তাদের দোষও দেওয়া যায় না। কোনো ঋণদাতাই চাইবে না, তাদের অর্থ ভর্তুকিতে ব্যয় হোক। এটাও অনস্বীকার্য যে, উন্নয়ন ব্যয় অক্ষুণ্ন রাখতে হলে ভর্তুকি কমানো ছাড়া সরকারের সামনে খুব বেশি পথও খোলা নেই। সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টাও সংবাদমাধ্যমের কাছে একই কথা বলেছেন। আমাদের প্রশ্ন অন্যখানে। প্রথমত, এভাবে স্বল্প সময়ে দফায় দফায় দাম বৃদ্ধির যুক্তি কী? গত এক বছরে চার দফা দাম না বাড়িয়ে একবারেই বাড়ালে বরং বাড়তি অনুপাতে পণ্য ও সেবার খরচ বেড়ে যাওয়া থেকে রেহাই মিলত। দ্বিতীয়ত, জ্বালানির দাম বাড়ানোর মতো জনদুর্ভোগমূলক পদক্ষেপ কেন অনিবার্য হয়ে উঠল? সরকার যদি ইতিমধ্যেই ব্যাংক থেকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ না নিত, তাহলে এমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হতো না। বহুল সমালোচিত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জন্য বাড়তি জ্বালানি জোগাতে গিয়েও সরকার তেলের দাম বাড়ানোর দুষ্টচক্রে পড়ে গেছে। এতে স্পষ্ট হয় যে সরকার জ্বালানি খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারছে না। সতর্ক হওয়ার সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি বলে আমরা মনে করি। তৃতীয় যে প্রশ্নটি আমরা তুলতে চাই, তা যতখানি না অর্থনৈতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক বিবেচনার বিষয়। সরকার ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুৎপাদনশীল খাতে বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এগুলোর কোনো কোনোটিতে যথেষ্ট নয়ছয়ের খবর সংবাদমাধ্যমেও এসেছে। জ্বালানির দাম না বাড়িয়ে এগুলোই কি কাটছাঁট করা যেত না? সরকারের তিন বছর পার হওয়ার পর জ্বালানির দাম তথা জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি সরকারের নিজের জন্যও যে আখেরে সুফল বয়ে আনবে না, তা আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই। আর নীতিনির্ধারকদের ভুলের দায়ে জনসাধারণ দুর্ভোগ পোহাবে কেন?

No comments

Powered by Blogger.