গিলগামেশ ২- by মুহম্মদ নূরুল হুদা
তৃতীয় ট্যাবলেটে বর্ণিত হয়েছে গিলগামেশের এক রোমাঞ্চকর অভিযান কাহিনী। শত্রুতা পেরিয়ে বন্ব্দুত্ব ও ভ্রাতৃত্বে উত্তীর্ণ হয়েছে এনকিদু। সেই এনকিদু এ অভিযানে তার প্রধান সঙ্গী। তখন উরুকদেশে কোনো গোলযোগ নেই, অশান্তি নেই। দিনের পর দিন শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে করতে এক সময় জীবনটাকে বড় একঘেয়ে আর ক্লান্তিকর মনে হলো রাজার। বাসনা জাগল এমন কিছু করার, যার ফলে তার নাম চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই জগৎ-সংসারে।
অনেক ভেবেও তেমন কিছু পাওয়া গেল না। দিন যায় রাত যায়, রাজার মন আরও অস্থির হয়ে ওঠে। কর্তব্য স্থির করাটাই কেমন যেন কঠিন হয়ে দাঁড়াল। রাজ্যের এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত চষে বেড়াল তারা দু’জন। শেষ পর্যন্ত ঠিক করল, তারা সমতল ছেড়ে গভীর জঙ্গলেই যাবে। সেখানে আছে রহস্যের পর রহস্য, বিস্ময়ের পর বিস্ময়। আছে চিরহরিত্ পাইনের সারি। সেখানে গিয়ে বনের বিশালকায় বৃক্ষাবলি সংহার করবে। তবে কাজটি অত সহজ নয়। কেননা সেখানে আছে বনের অতন্দ্রপ্রহরী ও একচ্ছত্র অধিপতি দৈত্য স্লমবাবা। আগে সেই স্লমবাবাকে পরাস্ত ও হত্যা করতে হবে। তা না হলে বনে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। অভিযানটি সফল হলে লাভ অনেক। একদিকে তার শৌর্য, বীর্য আর সাহসের সুখ্যাতি বাড়বে, অন্যদিকে উন্নতমানের কাঠ সংগ্রহ করা যাবে, আর সেই কাঠ দিয়ে মূল্যবান সব আসবাবপত্র বানানো সম্ভব হবে। কিন্তু এনকিদুর মন এতে সায় দিল না। সে জানে চিরহরিত্ পাইনের বন দেবী অনুন্নাকির প্রিয়ভূমি। তাই এ বন যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি পবিত্র। এ অভিযানে দেবী অসন্তুষ্ট হতে পারেন। দেবীর অসন্তুষ্টি মানে অভিযান ব্যর্থ হয়ে যাওয়া। এনকিদু গিলগামেশকে বোঝাতে চাইল, কিন্তু পারল না। অনন্যোপায় এনকিদু রাজাকে নিবৃত্ত করার জন্য আরেক পথে এগোতে চাইল। সে পুরো অভিযানটা সম্পর্কে রাজার পরামর্শ সভার মতামত গ্রহণ করার জন্য চাপ দিল। রাজা এই ফাঁদেও পা দেয়ার মানুষ নয়। অর্থাত্ একরোখা গিলগামেশ তার সিদ্ধান্তে অনড়। কারও কথা শুনতে নারাজ সে। একসময় এনকিদু হাল ছেড়ে দেয়, তারপর দু’জনে মিলে পাইনের সবুজবনে অভিযানের প্রস্তুতি নিতে থাকে। গিলগামেশ যাত্রার আগে মায়ের অনুমতি গিলগামেশ যাত্রার আগে মায়ের অনুমতি প্রার্থনা করে। মা প্রথমে নিমরাজি হলেও পরে ছেলের সিদ্ধান্তে সায় দিতে বাধ্য হন। তিনি এনকিদুকেও তার দ্বিতীয় ছেলে রূপে গ্রহণ করেন। যাত্রার আগে এনকিদুর কানে কিছু উপদেশও বর্ষণ করেন। তারপর তিনি সূর্যদেবতা সামাসের কাছে প্রার্থনা করেন যেন এ অভিযানে দেবতাও গিলগামেশকে সাহায্য করেন।ট্যাবলেট ৪-এর আছে যাত্রার বর্ণনা। সব বাধা পেরিয়ে একসময় ওরা দু’জন চিরহরিত্ পাইনবনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। যতই এগোতে থাকে, ততই নানারকম চিন্তা গিলগামেশের মাথায় কিলবিল করে। দিনের পর দিন হাঁটতে হাঁটতে পরিশ্রান্ত হয়ে ওঠে। তারপর রাতেও ভালো ঘুম হয় না। কেবল স্বপ্নের পর স্বপ্ন দেখে। কোনোটাই ভালো স্বপ্ন নয়, সবই কেমন যেন গোলমেলে। একে একে পাঁচ-পাঁচটি দুঃস্বপ্ন দেখল গিলগামেশ। কিন্তু কী দেখল তার বিষয়-আশায় খুব একটা পরিষ্কার হলো না। প্রস্তরলিপিতেও এই অংশের বর্ণনা অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য। ফলে এখান থেকেও তেমন কিছু উদ্ধার করা সম্ভব নয়। ওদিকে গিলগামেশ কিন্তু প্রতিটি দুঃস্বপ্নকে সুস্বপ্ন মনে করল, তারপর নিজের মতো করে স্বপ্নের তাবির করতে লাগল। তার মতে, সে যে স্বপ্ন দেখেছে তার কোনোটারই কোনো খারাপ তাত্পর্য নেই। অবশেষে সমতল পেরিয়ে বনের প্রান্তে এসে পড়ল তারা দু’জন। এবার বনে প্রবেশের পালা। কেমন যেন অগোছালো মনে হলো নিজেকে। পা যেন ঠিকমত পড়ছে না। বনের সীমানায় ঢুকতেই গা ছম ছম করতে লাগল। বলতে গেলে কিছুটা ভীত হয়ে পড়ল গিলগামেশ। এনকিদু দেখল, এতদূর এসে আর ফেরা যাবে না। ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ, লড়ে যায় বীর। ওরা দু’জন বীর-বন্ব্দু, বীর-ভাই। তারা পিছিয়ে যাবে কোন যুক্তিতে? তাই এনকিদু নিজেই গিলগামেশকে উত্সাহ যোগাতে শুরু করল। অভিযানে এখন এনকিদুই গিলগামেশের বড় অনুপ্রেরণা, একমাত্র সহায়।
ট্যাবলেট ৫-এ আছে কাহিনীর পরবর্তী পর্যায়। বনে ঢুকেই তারা তাদের কর্তব্য স্থির করল। প্রথম কাজ হবে গাছপালার রক্ষক দৈত্য স্লমবাবাকে উত্ত্যক্ত ও পর্যুদস্ত করা। তবে কাজটা যে খুব সহজ নয় তা তারা হাড়ে হাড়ে টের পেল। আবার ভয় পেয়ে গেল গিলগামেশ। কিন্তু এনকিদুর মনে কোনো ভয়-ডর নেই। রাজাকে অভয়বাণী শুনিয়ে প্রেরণা জোগাল সে। বলল, আমরা হারার জন্য আসিনি, এসেছি জয়কে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য। অসম্ভবকে সম্ভব করাই হবে আমাদের কাজ। উজ্জীবিত হলো রাজা। শুরু হলো দৈত্যের সঙ্গে যুদ্ধ। সে এক ভয়ঙ্কর অসম যুদ্ধ। তাই তাদের নানারকম ছলাকলার আশ্রয় নিতে হলো এ যুদ্ধে। দুই যোদ্ধার রাগ চড়লো সপ্তমে। তাদের স্লঙ্কারে সিরিয়ার পর্বতমালা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল লেবানন থেকে। যুদ্ধ চলছে তো চলছেই। কেউ হারে না, কেউ জেতে না। স্লমবাবার দেহ সাত স্তরের বর্মে আচ্ছাদিত। এগুলো ছিন্ন করা না গেলে তাকে পরাজিত করাও সম্ভব নয়। তাই অন্য কোনো ফন্দি আঁটতে লাগল সে।
লেখক : কবি, প্রফেসর; সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব ও বাংলাদেশ রাইটার্স কপিরাইট সোসাইটি
No comments