একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের আমলনামা-২-কালের আয়নায় by আবদুল গাফফ্ার চৌধুরী
'গোলাম আযমের কথা অমৃত সমান অধম লেখক ভনে শোনে পুণ্যবান।' গোলাম আযম নামটির সঙ্গে আমি প্রথম পরিচিত হই ষাটের দশকের গোড়ায়। তার আগে নয়। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলাম বা মওদুদী জামায়াতের প্রতিষ্ঠা সম্ভবত ১৯৪৮-৪৯ সালে। ১০৬ নম্বর নবাবপুর রোডে একটি ভবনের দোতলায় জামায়াতের অফিস ছিল। আমির ছিলেন একজন পাঞ্জাবি মুসলমান। তাকে লাহোর থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। একজন মাত্র বাঙালি মুসলমান তখন
জামায়াতে ছিলেন। তার নাম মওলানা আবদুর রহিম। তাকেই সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা চলে। অনেক পরে তিনি যেসব বাঙালি মুসলমানকে জামায়াতে রিত্রুক্রট করেন গোলাম আযম তাদের একজন। তিনি তখন সম্পূর্ণ অখ্যাত ব্যক্তি। তার পরিচয় দিতে হলে বলতে হতো তার চাচা খাজা নাজিমুদ্দীনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং কাউন্সিল মুসলিম লীগের একজন নেতা ছিলেন।
মওলানা আবদুর রহিমের বাড়ি বৃহত্তর বরিশালে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই ১৯৪৮ সালে বরিশাল থেকে সাপ্তাহিক 'নকীব' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বিখ্যাত সাংবাদিক নূর আহমদ ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক। আমি তখন বরিশালে স্কুলের ছাত্র। লেখালেখি করি। সুতরাং নকীব পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। নূর আহমদ সাহেব আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।
একদিন স্কুল ছুটির শেষে নকীব অফিসে গেছি। নূর আহমদ সাহেব আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় এক সৌম্যদর্শন ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, তার নাম মওলানা আবদুর রহিম। তিনি তখনও যুবা বয়স পেরোননি। লম্বা, সুঠাম, সুদর্শন পুরুষ। মুখে ফ্রেঞ্চকাট ধরনের মডার্ন দাড়ি। সবসময় হাসিমুখ। নূর আহমদ সাহেব বললেন, এখন থেকে মওলানা আবদুর রহিম নকীব কাগজে নিয়মিত লিখবেন। তিনি আধুনিক এক ইসলামী দর্শনে বিশ্বাসী এবং মোল্লাবাদের বিরুদ্ধে।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আমার একটি লেখার বিরুদ্ধে কলম ধরলেন। তখন উভয় বাংলাতেই গণসাহিত্যের জোয়ার। সুকান্ত-সুভাষের কবিতা আমাদের তরুণদের মুখে মুখে। আমি নকীবে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম, 'আর্টস ফর আর্টস সেক' থিয়োরির বিরুদ্ধে এবং 'আর্টস ফর লাইফস সেক' থিয়োরির পক্ষে। অর্থাৎ শিল্প কেবল শিল্পের জন্য নয়, শিল্প জীবনের জন্য। মওলানা আবদুর রহিম তীব্র ভাষায় আমার লেখার প্রতিবাদ করে 'নকীব' পত্রিকাতেই একটি প্রবন্ধ লেখেন। নাম_ আর্টস ফর আল্লাহ্স্ সেক' বা শিল্প আল্লাহর জন্য। তার লেখায়_ মওলানা আবুল আলা মওদুদীর লেখার প্রচুর উদ্ধৃতি ছিল। আমি তখন মওলানা মওদুদীর নামের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না।
এসব লেখালেখি সত্ত্বেও তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক অটুট ছিল। তিনি তখন নিয়মিত মওলানা মওদুদীর লেখা বাংলায় অনুবাদ করতেন এবং নকীবে ছাপাতেন। আমাকে বাংলায় তার অনুবাদ করা মওদুদীর বইও পড়তে দিতেন। ইসলাম সম্পর্কে মওদুদীর আধুনিক ব্যাখ্যা আমার কিছুটা ভালোই লাগত। আমার পরবর্তীকালের ধারণা, তিনি আমাকে জামায়াতি দর্শনের দিকে টানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন আমি বাম ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত। ওই বয়সেই মার্কস-এঙ্গেলসের অনেক বই (বাংলায় অনূদিত) পড়ে ইঁচড়ে পাকা হয়ে উঠেছি। সুতরাং মওদুদীবাদ আমাকে কোনোভাবেই আকর্ষণ করতে পারেনি।
তখন জামায়াতের একটি নামকাওয়াস্তে হেড অফিস ঢাকাতে ছিল এবং তার একজন পাঞ্জাবি আমির ছিলেন। তথাপি জামায়াতের প্রকৃত যাত্রা শুরু বরিশাল থেকে এবং মওলানা আবদুর রহিম ছিলেন তার অঘোষিত প্রকৃত নেতা বা আমির। 'নকীব' পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে কেবল একটি প্রবন্ধ লিখে জামায়াতের আদর্শ প্রচার করা যাবে না জেনে মওলানা আবদুর রহিম বরিশাল থেকেই জামায়াতের প্রথম সাপ্তাহিক মুখপত্রটি প্রকাশ করেন। নাম সাপ্তাহিক 'তানজীম'।
এর কিছুকাল পর মওলানা আবদুর রহিম ঢাকায় চলে আসেন এবং ওই পাঞ্জাবি আমিরের বদলে প্রথম পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের বাঙালি আমির নিযুক্ত হন। তিনি ওই ১০৬ নম্বর নবাবপুরের বাসাতেই তখন বাস করতেন। ১৯৪৯ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে (তখন ভাষা আন্দোলন দিবস ছিল ১১ মার্চ) সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকা এবং ডেপুটি কমিশনারের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ মিছিলে শামিল হওয়ার জন্য অন্যদের সঙ্গে আমাকেও গ্রেফতার করা হয়। আমি আটকাবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েই কিছুদিনের জন্য ঢাকায় চলে আসি। কোথায় থাকব স্থির করতে না পেরে পূর্ব পরিচয়ের জোরে মওলানা আবদুর রহিমের কাছে যাই। তিনি তার জামায়াত অফিসে আমাকে সাদরে আশ্রয় দিয়েছিলেন। অবশ্য দু'দিনের বেশি আমাকে জামায়াত অফিসে থাকতে হয়নি। তখনও দেখেছি, ওই অফিসে মওলানা রহিম ছাড়া কোনো বাঙালি নেই। ওই পাঞ্জাবি সাবেক আমির আছেন। আরও দু'চারজন জামায়াতি আছেন। তারা সকলেই পাঞ্জাবি। অফিসকক্ষটি মওলানা মওদুদীর উর্দু, বাংলা বইতে ভর্তি। বাংলা বইগুলো অনুবাদ করেছেন মওলানা রহিম একাই।
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনার সঙ্গে কোনো বাঙালি নেই। আপনি পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি ছাড়া কীভাবে একটি দল চালাবেন? তিনি বলেছেন, 'আমাদের দল মতবাদভিত্তিক। এই মতবাদে আকৃষ্ট করে ধীরে ধীরে দলে মতাদর্শী সদস্য টানতে হবে। সেই চেষ্টা আমি শুরু করেছি।' তার এই চেষ্টা সফল হবে, তখন তা আমি বিশ্বাস করিনি।
কিন্তু ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে কিংবা পরে জামায়াত দলে মুষ্টিমেয় বাঙালি এসে জুটে গেছেন। গোলাম আযমকে তখনই সম্ভবত মওলানা আবদুর রহিম রিত্রুক্রট করেন। ঢাকায় জামায়াতের তখন একটি নতুন অফিস হয়েছে এবং একটি সাপ্তাহিক মুখপত্র বেরিয়েছে। নাম ছিল সম্ভবত 'জাহানে নও'। জামায়াত সম্পর্কে সাংবাদিক হিসেবে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে তখনই জানতে পারি, জামায়াত প্রকাশ্যে কোরবানির গরু-ছাগলের চামড়া এবং অন্যান্য দান-খয়রাত গ্রহণ করে দলের খরচ চালাচ্ছে বলে প্রচার চালাচ্ছে। আসলে তাদের মূল ফান্ড আসছে সৌদি আরব থেকে। এই সাহায্য এসেছে এতিমখানা প্রতিষ্ঠা ও এতিমদের সাহায্যের নামে। এসব টাকা খরচ করা হয়েছে জামায়াতের সংগঠনের কাজে বলে প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। ঢাকার সৌদি দূতাবাসের এক কর্মকর্তাও এই অভিযোগ তার সরকারকে জানিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
এসব কার্যকলাপের সঙ্গে মওলানা আবদুর রহিম সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে জানা যায় না। ততদিনে তার রিত্রুক্রট বাঙালিরা এসে সংগঠনে ভিড় জমিয়েছেন। তাদের মধ্যে অল্পদিনেই প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন গোলাম আযম। জামায়াতের একটি সূত্র থেকে জেনেছি, তিনি প্রথম দিকে মওলানা আবদুর রহিমের প্রতি কিছুটা আনুগত্য দেখালেও তলে তলে তাকে ডিঙিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে মওলানা আবদুর রহিমের সঙ্গে তার মতানৈক্য স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।
মওলানা আবদুর রহিম ছিলেন সহজ সরল উদার প্রকৃতির মানুষ। গোলাম আযম ধূর্ত ও কপটাচারী। তিনি জামায়াতের আমির হওয়ার বহু আগে থেকেই মওলানা আবদুর রহিমকে আমির পদ থেকে সরানোর চক্রান্ত করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাতে সফল হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সূচনায় গোলাম আযমের সঙ্গে মওলানা আবদুর রহিমের মতানৈক্য চরমে পেঁৗছায়। মওলানা রহিম পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় বিশ্বাসী ছিলেন; কিন্তু পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী নিধনে যুক্ত হতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু গোলাম আযমের সঙ্গে এই দ্বন্দ্বে পেরে ওঠেননি। তাকে নিশ্চুপ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে হয়।
গোলাম আযম একাত্তর সালে হানাদারদের গণহত্যায় সাহায্যার্থে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন, বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকা প্রণয়ন ইত্যাদি কাজে ঢাকার তৎকালীন গভর্নর হাউসে (বর্তমানে বঙ্গভবন) জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে বাঙালি কোলাবরেটর নেতাদের বৈঠকের প্রত্যেকটিতে জামায়াত নেতা হিসেবে অবজার্ভার কাগজের মালিক হামিদুল হক চৌধুরীর সঙ্গে হাজির ছিলেন। মওলানা আবদুর রহিমকে দেখা যায়নি। এসব বৈঠকের ছবি হানাদারকবলিত ঢাকার কাগজেই প্রকাশিত হয়েছিল।
হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের পর জামায়াত নেতা হিসেবে গোলাম আযমের মতো মওলানা আবদুর রহিমও পাকিস্তানে পলায়ন করেছিলেন। কিন্তু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে ধ্বংস করার জন্য গোলাম আযমের মতো প্রচার-প্রোপাগান্ডা ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হননি এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ঘুরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রচার অভিযান চালাননি।
পাকিস্তানে বসেই মওলানা আবদুর রহিম ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে এক ১৭ পৃষ্ঠা চিঠি লেখেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালে তার ভূমিকা ব্যাখ্যা করে তাকে ক্ষমা করে দেশে ফিরে আসার অনুমতিদানের আবেদন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সময় সামরিক বাহিনীর লোকেরা তার বহু ফাইল ধ্বংস করে। সম্ভবত তার কোনো ফাইলে মওলানা রহিমের লেখা চিঠিটাও ছিল। এই চিঠি ধ্বংস না হলে এটাতেও গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের বহু প্রমাণ পাওয়া যেত। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর টেলিভিশনের খবরে যারা গোলাম আযমের দানবসুলভ অট্টহাসি দেখেছেন, তাদের কাছে নরপশুর নতুন পরিচয় তুলে ধরার প্রয়োজন নেই।
বঙ্গবন্ধু মওলানা আবদুর রহিমকে ক্ষমা করেছিলেন কি-না আমার জানা নেই। কিন্তু মওলানা আবদুর রহিমকে দেশে ফিরে আসতে দিয়েছিলেন। মওলানা রহিম দেশে ফিরে জামায়াতের সঙ্গে আর সংশ্রব রাখেননি। নিজে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ বা এ ধরনের একটি নতুন দল গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। আজ যদি সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আমির এবং গোলাম আযমকে জামায়াতে রিত্রুক্রটকারী মওলানা আবদুর রহিম বেঁচে থাকতেন, তাহলে তিনিই সম্ভবত হতেন গোলাম আযমসহ অন্যান্য জামায়াতি নেতার যুদ্ধাপরাধের বিচারে সবচেয়ে বড় সাক্ষী। কতটা সঠিক জানি না, মৃত্যুর আগে মওলানা রহিম নাকি তার কোনো কোনো বন্ধুর কাছে গোলাম আযমকে জামায়াতে রিত্রুক্রট করা সম্পর্কে বলেছেন, 'আমি জামায়াতে খাল কেটে কুমির এনেছিলাম, এই কুমির দলে আরও কুমির জন্ম দিয়েছে।'
গোলাম আযমের আমলনামা আজ এখানেই আপাতত শেষ করছি। কিন্তু তার শঠতা, চতুরতা ও নৃশংসতার আরও ইতিহাস আছে। সময় ও সুযোগ পেলে আরেক লেখায় তা লিখব। এখন ভালোয় ভালোয় নুরেমবার্গ বিচারের মতো ঢাকায় এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলেই বাঁচোয়া। বাংলাদেশের ইতিহাসকে কলঙ্কমুক্ত করার জন্য হাসিনা সরকারকে অবশ্যই দ্বিধাহীন পদক্ষেপ নিতে হবে। (সমাপ্ত)।
লন্ডন, ৩০ ডিসেম্বর ২০১১, শুক্রবার
মওলানা আবদুর রহিমের বাড়ি বৃহত্তর বরিশালে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই ১৯৪৮ সালে বরিশাল থেকে সাপ্তাহিক 'নকীব' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বিখ্যাত সাংবাদিক নূর আহমদ ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক। আমি তখন বরিশালে স্কুলের ছাত্র। লেখালেখি করি। সুতরাং নকীব পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। নূর আহমদ সাহেব আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।
একদিন স্কুল ছুটির শেষে নকীব অফিসে গেছি। নূর আহমদ সাহেব আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় এক সৌম্যদর্শন ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, তার নাম মওলানা আবদুর রহিম। তিনি তখনও যুবা বয়স পেরোননি। লম্বা, সুঠাম, সুদর্শন পুরুষ। মুখে ফ্রেঞ্চকাট ধরনের মডার্ন দাড়ি। সবসময় হাসিমুখ। নূর আহমদ সাহেব বললেন, এখন থেকে মওলানা আবদুর রহিম নকীব কাগজে নিয়মিত লিখবেন। তিনি আধুনিক এক ইসলামী দর্শনে বিশ্বাসী এবং মোল্লাবাদের বিরুদ্ধে।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আমার একটি লেখার বিরুদ্ধে কলম ধরলেন। তখন উভয় বাংলাতেই গণসাহিত্যের জোয়ার। সুকান্ত-সুভাষের কবিতা আমাদের তরুণদের মুখে মুখে। আমি নকীবে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম, 'আর্টস ফর আর্টস সেক' থিয়োরির বিরুদ্ধে এবং 'আর্টস ফর লাইফস সেক' থিয়োরির পক্ষে। অর্থাৎ শিল্প কেবল শিল্পের জন্য নয়, শিল্প জীবনের জন্য। মওলানা আবদুর রহিম তীব্র ভাষায় আমার লেখার প্রতিবাদ করে 'নকীব' পত্রিকাতেই একটি প্রবন্ধ লেখেন। নাম_ আর্টস ফর আল্লাহ্স্ সেক' বা শিল্প আল্লাহর জন্য। তার লেখায়_ মওলানা আবুল আলা মওদুদীর লেখার প্রচুর উদ্ধৃতি ছিল। আমি তখন মওলানা মওদুদীর নামের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না।
এসব লেখালেখি সত্ত্বেও তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক অটুট ছিল। তিনি তখন নিয়মিত মওলানা মওদুদীর লেখা বাংলায় অনুবাদ করতেন এবং নকীবে ছাপাতেন। আমাকে বাংলায় তার অনুবাদ করা মওদুদীর বইও পড়তে দিতেন। ইসলাম সম্পর্কে মওদুদীর আধুনিক ব্যাখ্যা আমার কিছুটা ভালোই লাগত। আমার পরবর্তীকালের ধারণা, তিনি আমাকে জামায়াতি দর্শনের দিকে টানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন আমি বাম ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত। ওই বয়সেই মার্কস-এঙ্গেলসের অনেক বই (বাংলায় অনূদিত) পড়ে ইঁচড়ে পাকা হয়ে উঠেছি। সুতরাং মওদুদীবাদ আমাকে কোনোভাবেই আকর্ষণ করতে পারেনি।
তখন জামায়াতের একটি নামকাওয়াস্তে হেড অফিস ঢাকাতে ছিল এবং তার একজন পাঞ্জাবি আমির ছিলেন। তথাপি জামায়াতের প্রকৃত যাত্রা শুরু বরিশাল থেকে এবং মওলানা আবদুর রহিম ছিলেন তার অঘোষিত প্রকৃত নেতা বা আমির। 'নকীব' পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে কেবল একটি প্রবন্ধ লিখে জামায়াতের আদর্শ প্রচার করা যাবে না জেনে মওলানা আবদুর রহিম বরিশাল থেকেই জামায়াতের প্রথম সাপ্তাহিক মুখপত্রটি প্রকাশ করেন। নাম সাপ্তাহিক 'তানজীম'।
এর কিছুকাল পর মওলানা আবদুর রহিম ঢাকায় চলে আসেন এবং ওই পাঞ্জাবি আমিরের বদলে প্রথম পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের বাঙালি আমির নিযুক্ত হন। তিনি ওই ১০৬ নম্বর নবাবপুরের বাসাতেই তখন বাস করতেন। ১৯৪৯ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে (তখন ভাষা আন্দোলন দিবস ছিল ১১ মার্চ) সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকা এবং ডেপুটি কমিশনারের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ মিছিলে শামিল হওয়ার জন্য অন্যদের সঙ্গে আমাকেও গ্রেফতার করা হয়। আমি আটকাবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েই কিছুদিনের জন্য ঢাকায় চলে আসি। কোথায় থাকব স্থির করতে না পেরে পূর্ব পরিচয়ের জোরে মওলানা আবদুর রহিমের কাছে যাই। তিনি তার জামায়াত অফিসে আমাকে সাদরে আশ্রয় দিয়েছিলেন। অবশ্য দু'দিনের বেশি আমাকে জামায়াত অফিসে থাকতে হয়নি। তখনও দেখেছি, ওই অফিসে মওলানা রহিম ছাড়া কোনো বাঙালি নেই। ওই পাঞ্জাবি সাবেক আমির আছেন। আরও দু'চারজন জামায়াতি আছেন। তারা সকলেই পাঞ্জাবি। অফিসকক্ষটি মওলানা মওদুদীর উর্দু, বাংলা বইতে ভর্তি। বাংলা বইগুলো অনুবাদ করেছেন মওলানা রহিম একাই।
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনার সঙ্গে কোনো বাঙালি নেই। আপনি পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি ছাড়া কীভাবে একটি দল চালাবেন? তিনি বলেছেন, 'আমাদের দল মতবাদভিত্তিক। এই মতবাদে আকৃষ্ট করে ধীরে ধীরে দলে মতাদর্শী সদস্য টানতে হবে। সেই চেষ্টা আমি শুরু করেছি।' তার এই চেষ্টা সফল হবে, তখন তা আমি বিশ্বাস করিনি।
কিন্তু ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে কিংবা পরে জামায়াত দলে মুষ্টিমেয় বাঙালি এসে জুটে গেছেন। গোলাম আযমকে তখনই সম্ভবত মওলানা আবদুর রহিম রিত্রুক্রট করেন। ঢাকায় জামায়াতের তখন একটি নতুন অফিস হয়েছে এবং একটি সাপ্তাহিক মুখপত্র বেরিয়েছে। নাম ছিল সম্ভবত 'জাহানে নও'। জামায়াত সম্পর্কে সাংবাদিক হিসেবে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে তখনই জানতে পারি, জামায়াত প্রকাশ্যে কোরবানির গরু-ছাগলের চামড়া এবং অন্যান্য দান-খয়রাত গ্রহণ করে দলের খরচ চালাচ্ছে বলে প্রচার চালাচ্ছে। আসলে তাদের মূল ফান্ড আসছে সৌদি আরব থেকে। এই সাহায্য এসেছে এতিমখানা প্রতিষ্ঠা ও এতিমদের সাহায্যের নামে। এসব টাকা খরচ করা হয়েছে জামায়াতের সংগঠনের কাজে বলে প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। ঢাকার সৌদি দূতাবাসের এক কর্মকর্তাও এই অভিযোগ তার সরকারকে জানিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
এসব কার্যকলাপের সঙ্গে মওলানা আবদুর রহিম সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে জানা যায় না। ততদিনে তার রিত্রুক্রট বাঙালিরা এসে সংগঠনে ভিড় জমিয়েছেন। তাদের মধ্যে অল্পদিনেই প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন গোলাম আযম। জামায়াতের একটি সূত্র থেকে জেনেছি, তিনি প্রথম দিকে মওলানা আবদুর রহিমের প্রতি কিছুটা আনুগত্য দেখালেও তলে তলে তাকে ডিঙিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে মওলানা আবদুর রহিমের সঙ্গে তার মতানৈক্য স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।
মওলানা আবদুর রহিম ছিলেন সহজ সরল উদার প্রকৃতির মানুষ। গোলাম আযম ধূর্ত ও কপটাচারী। তিনি জামায়াতের আমির হওয়ার বহু আগে থেকেই মওলানা আবদুর রহিমকে আমির পদ থেকে সরানোর চক্রান্ত করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাতে সফল হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সূচনায় গোলাম আযমের সঙ্গে মওলানা আবদুর রহিমের মতানৈক্য চরমে পেঁৗছায়। মওলানা রহিম পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় বিশ্বাসী ছিলেন; কিন্তু পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী নিধনে যুক্ত হতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু গোলাম আযমের সঙ্গে এই দ্বন্দ্বে পেরে ওঠেননি। তাকে নিশ্চুপ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে হয়।
গোলাম আযম একাত্তর সালে হানাদারদের গণহত্যায় সাহায্যার্থে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন, বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকা প্রণয়ন ইত্যাদি কাজে ঢাকার তৎকালীন গভর্নর হাউসে (বর্তমানে বঙ্গভবন) জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে বাঙালি কোলাবরেটর নেতাদের বৈঠকের প্রত্যেকটিতে জামায়াত নেতা হিসেবে অবজার্ভার কাগজের মালিক হামিদুল হক চৌধুরীর সঙ্গে হাজির ছিলেন। মওলানা আবদুর রহিমকে দেখা যায়নি। এসব বৈঠকের ছবি হানাদারকবলিত ঢাকার কাগজেই প্রকাশিত হয়েছিল।
হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের পর জামায়াত নেতা হিসেবে গোলাম আযমের মতো মওলানা আবদুর রহিমও পাকিস্তানে পলায়ন করেছিলেন। কিন্তু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে ধ্বংস করার জন্য গোলাম আযমের মতো প্রচার-প্রোপাগান্ডা ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হননি এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ঘুরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রচার অভিযান চালাননি।
পাকিস্তানে বসেই মওলানা আবদুর রহিম ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে এক ১৭ পৃষ্ঠা চিঠি লেখেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালে তার ভূমিকা ব্যাখ্যা করে তাকে ক্ষমা করে দেশে ফিরে আসার অনুমতিদানের আবেদন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সময় সামরিক বাহিনীর লোকেরা তার বহু ফাইল ধ্বংস করে। সম্ভবত তার কোনো ফাইলে মওলানা রহিমের লেখা চিঠিটাও ছিল। এই চিঠি ধ্বংস না হলে এটাতেও গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের বহু প্রমাণ পাওয়া যেত। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর টেলিভিশনের খবরে যারা গোলাম আযমের দানবসুলভ অট্টহাসি দেখেছেন, তাদের কাছে নরপশুর নতুন পরিচয় তুলে ধরার প্রয়োজন নেই।
বঙ্গবন্ধু মওলানা আবদুর রহিমকে ক্ষমা করেছিলেন কি-না আমার জানা নেই। কিন্তু মওলানা আবদুর রহিমকে দেশে ফিরে আসতে দিয়েছিলেন। মওলানা রহিম দেশে ফিরে জামায়াতের সঙ্গে আর সংশ্রব রাখেননি। নিজে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ বা এ ধরনের একটি নতুন দল গঠনের চেষ্টা করেছিলেন। আজ যদি সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আমির এবং গোলাম আযমকে জামায়াতে রিত্রুক্রটকারী মওলানা আবদুর রহিম বেঁচে থাকতেন, তাহলে তিনিই সম্ভবত হতেন গোলাম আযমসহ অন্যান্য জামায়াতি নেতার যুদ্ধাপরাধের বিচারে সবচেয়ে বড় সাক্ষী। কতটা সঠিক জানি না, মৃত্যুর আগে মওলানা রহিম নাকি তার কোনো কোনো বন্ধুর কাছে গোলাম আযমকে জামায়াতে রিত্রুক্রট করা সম্পর্কে বলেছেন, 'আমি জামায়াতে খাল কেটে কুমির এনেছিলাম, এই কুমির দলে আরও কুমির জন্ম দিয়েছে।'
গোলাম আযমের আমলনামা আজ এখানেই আপাতত শেষ করছি। কিন্তু তার শঠতা, চতুরতা ও নৃশংসতার আরও ইতিহাস আছে। সময় ও সুযোগ পেলে আরেক লেখায় তা লিখব। এখন ভালোয় ভালোয় নুরেমবার্গ বিচারের মতো ঢাকায় এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলেই বাঁচোয়া। বাংলাদেশের ইতিহাসকে কলঙ্কমুক্ত করার জন্য হাসিনা সরকারকে অবশ্যই দ্বিধাহীন পদক্ষেপ নিতে হবে। (সমাপ্ত)।
লন্ডন, ৩০ ডিসেম্বর ২০১১, শুক্রবার
No comments