টিপাইমুখ বাঁধ পরিকল্পনা নিয়ে বিতর্ক by ক্যাপ্টেন (অব.) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন

টিপাইমুখ বাঁধের পরিকল্পনা শুরু হয় ১৯৫৪ সালে। টিপাইমুখ বাঁধটি বরাক ও তুইভাই নদীর প্রবাহের ৫০০ মিটার ডাউনস্ট্রিমে অবস্থিত। মণিপুর জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে এর অবস্থান। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০ মিটার উঁচু। এই বাঁধের ধারণক্ষমতা হবে ১৫,৯০০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ১,৭২৫.৫ মিটার। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও বলেছেন, 'টিপাইমুখ বাঁধ দিলে বাংলাদেশের সুরমা-কুশিয়ারা নদী শুকিয়ে যাবে', পাঁচ কোটি মানুষ


বঞ্চিত হবে। সুরমা ও কুশিয়ারার ৬০টি বহমান শাখা নদীর পানি প্রায় পাঁচ ফুট কমে যাবে। এই পানিশূন্যতা মেঘনা নদীর প্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বাংলাদেশের ২০টি জেলা কোনো না কোনোভাবে এই বাঁধের কুফল ভোগ করবে। বরাক-সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা নদীর গতিপথ ৯৪৬ কিলোমিটার, যদি এই প্রবাহে টিপাইমুখের মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণ করা হয়, তবে এই নদীগুলো যে মারাত্মক সমস্যার মধ্যে পড়বে, তা কিন্তু বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকেই বলা যায়। তা ছাড়া ভারত চেনাব নদীর ওপরও বাঁধ নির্মাণ করছে, যা পাকিস্তান ও ভারতের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া চেনাব নদীর প্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, এ দুই দেশের মানুষই ক্ষতির সম্মুখীন হবে, এই বাঁধের নাম বাঘলিয়ার। প্রস্তাবিত ১৬২.৮ মিটার টিপাইমুখ বাঁধ ভারতের মণিপুর জেলার যেসব সমস্যা সৃষ্টি করবে, তার কিছু বর্ণনা নিচে দেওয়া হলো। ১. ২৮৬.২০ স্কয়ার কিলোমিটার জমি চিরতরে পানির নিচে চলে যাবে। ২. ৪০,১০০ মানুষ ভূমিহীন হবে। ৩. বরাক নদের তীরবর্তী আটটি গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যাবে। ৪. প্রায় ২৭,২৪২ হেক্টর কৃষিজমি নষ্ট হবে। ৫. তামেনগ্লন জেলার প্রায় ৯০টি গ্রাম এই বাঁধের ফলে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ৬. বরাক জলপ্রপাত ও জিলাদ লেক তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে। ৭. এই বাঁধ নির্মাণের ফলে মানুষের জীবন-জীবিকা ও আর্থসামাজিক দিক থেকে বিশেষভাবে মণিপুর ও তামেনগ্লনবাসী প্রভূত ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এই বাঁধ নির্মাণের একটি বড় কারণ হচ্ছে, আসামে ঘন ঘন বন্যা প্রতিহত করা। ভারতের উত্তর-পূর্ব পাওয়ার করপোরেশন লিমিটেড প্রথমে বাঁধ তৈরি করতে চেয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য। কিন্তু পরে এই বাঁধ থেকে প্রায় ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নিয়ে কাজ শুরু হয়, ১৫০০ মেগাওয়াটের ১২ শতাংশ বিদ্যুৎ দেওয়া হবে মণিপুরবাসীকে। এই সামান্য বিদ্যুতের পরিবর্তে তারা হারাবে তাদের বসবাসের জমি, কৃষিজমি, ঐতিহ্য ও আরো অনেক কিছু। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার তাদের জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ নগদ টাকা, অন্যত্র বাসস্থানের ব্যবস্থা ও চাকরির প্রস্তাব করেছে; কিন্তু এখানকার জনগোষ্ঠী এ আশ্বাসে আশ্বস্ত নয়। নানা প্রতিকূলতার পরও তারা এ বাঁধ তৈরির বিপক্ষেই রয়েছে। এই বাঁধের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো, এর মধ্য দিয়ে সুপার হাইওয়ে তৈরি করা, যা ভারতের সিলচর, বাংলাদেশের ঢাকা ও থাইল্যান্ডের ব্যাংকককে একত্র করবে। ৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারতের ব্যাখ্যায় বাংলাদেশ সন্তুষ্ট। ১৯৭০ সালে ভারত ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করে, তখন ভারতের উদ্দেশ্য মহৎ ছিল এবং কলকাতা পোর্টকে রক্ষা করার উদ্দেশ্য ছিল মুখ্য, বাংলাদেশের ক্ষতি করার কোনো উদ্দেশ্যই তাদের ছিল না; কিন্তু আজ কী আমাদের বাস্তবতা! এই বাঁধের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ পানিশূন্যতায় ভুগছে, জমি হয়ে আছে মরুময়, চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে, নদীর নাব্য চলে গেছে, মৎস্য চাষ হচ্ছে না, জীববৈচিত্র্যও হারিয়ে গেছে। ২০১২ সালের মধ্যে সব কিছু ঠিক থাকলে টিপাইমুখ বাঁধের কাজ ভারত শেষ করবে। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, 'এই বাঁধ হলে বাংলাদেশের চেয়ে ইন্ডিয়াই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ভারতের সাধারণ জনগণ এই বাঁধের বিপক্ষে রয়েছে।' আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো নদীর প্রবাহ যদি একাধিক দেশজুড়ে হয়ে থাকে, তাহলে সেই নদী কর্তৃক যেকোনো প্রকল্পের কাজে সংশ্লিষ্ট দেশের মতামত বিবেচনা করা আবশ্যকীয়। টিপাইমুখ বাঁধের কথা এলে আরো দুটি শব্দ আমাদের চলে আসে। একটি হলো ব্যারাজ এবং অন্যটি হলো ড্যাম। ব্যারাজ হলো কোনো নদীর কিছু অংশ পানি আটকে আরেক দিকে প্রবাহিত করা। পক্ষান্তরে ড্যাম হলো, নদীর প্রবাহ যখন এত বেশি হয় যে বন্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তখন অতিরিক্ত পানি আটকে রাখা। শুকনো মৌসুমে যখন পানির প্রবাহ কম থাকে, তখন জলাধার থেকে পানি ছেড়ে নদীর প্রবাহ ঠিক রাখা। টিপাইমুখ আসলে একটি ড্যাম, ব্যারাজ নয়। টিপাইমুখ নিয়ে রাজনৈতিক যত তর্ক-বিতর্কই আসুক না কেন, আজ দেশাত্মবোধের একাত্মতায় একটি কথাই চলে আসে_দেশের মানুষ, দেশের স্বার্থ তথা বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ ও চুক্তি যেন বাস্তবায়িত না হয়, সেদিকে অবশ্যই দৃষ্টি দিতে হবে।
লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত

No comments

Powered by Blogger.