জলবায়ু পরিবর্তন ও উপকূলের ভবিষ্যৎ by আবসার হাবীব
পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে, বরফ গলছে। বাংলাদেশেও তাপমাত্রা বাড়ছে, বৃষ্টিপাত কমছে। জলবায়ুর এমন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশে দুর্যোগও বাড়তে থাকে। ফলে দেশের অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি, পানিসম্পদ ও প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে তা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। গ্রিনহাউস গ্যাস নামে অভিহিত গ্যাসগুলো পৃথিবীতে আসা সূর্যের তাপকে পৃথিবীতে আটকে রাখার ফলে পৃথিবী গরম হয়ে ওঠে। পৃথিবীতে গরম বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেসব
প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, যেমন_ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়, ভূখণ্ড জলমগ্ন হয়, আবহাওয়ার ধরন পাল্টে যায়, ফসলের ফলনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটে, বহুমূল্য স্বাদু পানি দ্রুত বাষ্প হয়ে আকাশে মিলিয়ে যায়, জীবাণুর প্রকোপ বাড়ে, দেখা দেয় মহামারী।
বাংলাদেশ মূলত নিচু এলাকা, বদ্বীপ এবং প্লাবন ভূমি। তাই পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে এবং তাতে বাংলাদেশের ব্যাপক ক্ষতি হবে। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়, ২১০০ সালে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে সমুদ্রের জলরাশি বাংলাদেশের ভূভাগের সাড়ে ১৭ শতাংশ এলাকা নিমগ্ন করবে। ফলে প্রায় ২ কোটি মানুষ পরিবেশগত দুর্যোগহেতু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। দেশের ভেতরে এদের স্থান পাওয়ার মতো জায়গা থাকবে না। কারণ দেশের উঁচু এলাকাগুলোতে এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে স্থান দেওয়ার মতো জায়গা নেই। সমুদ্রপৃষ্ঠ ১ মিটার উঁচু হলে প্লাবিত হবে যেসব এলাকা সেসব এলাকা রক্ষার মতো বাংলাদেশ এখনও কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মৌসুমি বৃষ্টিপাত বাংলাদেশ অঞ্চলে ১১ থেকে ২০ শতাংশ বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে বন্যা সমস্যা প্রকট হবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বন্যা হবে ঘন ঘন। বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চল নিয়মিত বন্যার পানিতে ডুবে যাবে। দেশের বিভিন্ন এলাকা বন্যায় প্লাবিত হওয়ার প্রবল ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এমনকি বাঁধ থাকার ফলে যেসব এলাকা প্লাবিত হয় না সেসব এলাকাও প্লাবিত হবে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সমভূমি বন্যামুক্ত এলাকা। কিন্তু ২০০০ সালে ওই অঞ্চলেও বন্যা হয় এবং এ বন্যায় জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বন্যার স্থায়িত্ব বাড়ছে। ফলে বন্যার পানি সমুদ্রে দ্রুত নেমে যেতে পারে না। আবার এর বিপরীতে পৃথিবীতে গরম বৃদ্ধির ফলে শীতকাল হবে আরও শুষ্ক। কম বৃষ্টি, বেশি তাপ এবং জলীয় বাষ্প বেশি হারে বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে খরার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। এটা সত্য, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে অনেক বেশি ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানবে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস অনেক সহজে ভূভাগের ভেতরে আছড়ে পড়বে। বাংলাদেশে ৭শ' কিলোমিটার উপকূল রেখা আর সেই সঙ্গে বিস্তৃত উপকূলীয় সমতল ভূমি এবং অসংখ্য উপকূলীয় দ্বীপচর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, আশ্বিন-কার্তিকে, বিশেষ করে আশ্বিনের নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনে ব্যাপক বৃষ্টি হয়। আবার শীতকালটাও তেমন দীর্ঘ হচ্ছে না। আর বিশেষ করে দুটি মৌসুম শরৎ এবং বসন্ত অনুপস্থিত। ফলে মাঠপর্যায়ে নির্ভরশীল অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, বিশেষ করে কৃষিকাজ, খাবার পানির প্রাপ্যতা, মাছ ধরা_ এ ধরনের জীবিকা ব্যাহত হওয়ার প্রক্রিয়া লক্ষ্য করার মতো। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হয়ে পড়ে অত্যন্ত ঘন বসতিপূর্ণ বাংলাদেশের উপকূল। উপকূল এলাকার মানুষের মূল জীবিকা হচ্ছে কৃষিকাজ এবং মাছ ধরা। উপকূলের জেলে সম্প্রদায়ের জীবিকা মাছ ধরা বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই ব্যাহত হয়। আবার দেখা যাচ্ছে, কৃষিক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চিরায়ত কৃষির অভ্যাসগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সাধারণ মানুষও জলবায়ু পরিবর্তনের এ চিত্রটি বুঝতে এবং বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে ব্যাখ্যা করতে পারছে।
উপকূলীয় নীতিতে যত কথাই বলা হোক না কেন যদি বাস্তবতায় দেখা যায়, কোথাও এর কার্যকারিতা নেই, না থাকে বাস্তবায়নের উদ্যোগ_ তাহলে উপকূলের মানুষের সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডই কোনো এক সময় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শেষ হয়ে যাবে। তলিয়ে যাবে উপকূলের বিশাল একাংশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের আলোকে উপকূলের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ব্যাপকভাবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা খুবই জরুরি এবং প্রতিবছর বাজেটেও তার জন্য বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন বলে মনে করছি।
লেখক :উন্নয়নকর্মী
বাংলাদেশ মূলত নিচু এলাকা, বদ্বীপ এবং প্লাবন ভূমি। তাই পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে এবং তাতে বাংলাদেশের ব্যাপক ক্ষতি হবে। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়, ২১০০ সালে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে সমুদ্রের জলরাশি বাংলাদেশের ভূভাগের সাড়ে ১৭ শতাংশ এলাকা নিমগ্ন করবে। ফলে প্রায় ২ কোটি মানুষ পরিবেশগত দুর্যোগহেতু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। দেশের ভেতরে এদের স্থান পাওয়ার মতো জায়গা থাকবে না। কারণ দেশের উঁচু এলাকাগুলোতে এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে স্থান দেওয়ার মতো জায়গা নেই। সমুদ্রপৃষ্ঠ ১ মিটার উঁচু হলে প্লাবিত হবে যেসব এলাকা সেসব এলাকা রক্ষার মতো বাংলাদেশ এখনও কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মৌসুমি বৃষ্টিপাত বাংলাদেশ অঞ্চলে ১১ থেকে ২০ শতাংশ বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে বন্যা সমস্যা প্রকট হবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বন্যা হবে ঘন ঘন। বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চল নিয়মিত বন্যার পানিতে ডুবে যাবে। দেশের বিভিন্ন এলাকা বন্যায় প্লাবিত হওয়ার প্রবল ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এমনকি বাঁধ থাকার ফলে যেসব এলাকা প্লাবিত হয় না সেসব এলাকাও প্লাবিত হবে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সমভূমি বন্যামুক্ত এলাকা। কিন্তু ২০০০ সালে ওই অঞ্চলেও বন্যা হয় এবং এ বন্যায় জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বন্যার স্থায়িত্ব বাড়ছে। ফলে বন্যার পানি সমুদ্রে দ্রুত নেমে যেতে পারে না। আবার এর বিপরীতে পৃথিবীতে গরম বৃদ্ধির ফলে শীতকাল হবে আরও শুষ্ক। কম বৃষ্টি, বেশি তাপ এবং জলীয় বাষ্প বেশি হারে বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে খরার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। এটা সত্য, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে অনেক বেশি ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানবে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস অনেক সহজে ভূভাগের ভেতরে আছড়ে পড়বে। বাংলাদেশে ৭শ' কিলোমিটার উপকূল রেখা আর সেই সঙ্গে বিস্তৃত উপকূলীয় সমতল ভূমি এবং অসংখ্য উপকূলীয় দ্বীপচর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, আশ্বিন-কার্তিকে, বিশেষ করে আশ্বিনের নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনে ব্যাপক বৃষ্টি হয়। আবার শীতকালটাও তেমন দীর্ঘ হচ্ছে না। আর বিশেষ করে দুটি মৌসুম শরৎ এবং বসন্ত অনুপস্থিত। ফলে মাঠপর্যায়ে নির্ভরশীল অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, বিশেষ করে কৃষিকাজ, খাবার পানির প্রাপ্যতা, মাছ ধরা_ এ ধরনের জীবিকা ব্যাহত হওয়ার প্রক্রিয়া লক্ষ্য করার মতো। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হয়ে পড়ে অত্যন্ত ঘন বসতিপূর্ণ বাংলাদেশের উপকূল। উপকূল এলাকার মানুষের মূল জীবিকা হচ্ছে কৃষিকাজ এবং মাছ ধরা। উপকূলের জেলে সম্প্রদায়ের জীবিকা মাছ ধরা বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই ব্যাহত হয়। আবার দেখা যাচ্ছে, কৃষিক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চিরায়ত কৃষির অভ্যাসগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সাধারণ মানুষও জলবায়ু পরিবর্তনের এ চিত্রটি বুঝতে এবং বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে ব্যাখ্যা করতে পারছে।
উপকূলীয় নীতিতে যত কথাই বলা হোক না কেন যদি বাস্তবতায় দেখা যায়, কোথাও এর কার্যকারিতা নেই, না থাকে বাস্তবায়নের উদ্যোগ_ তাহলে উপকূলের মানুষের সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডই কোনো এক সময় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শেষ হয়ে যাবে। তলিয়ে যাবে উপকূলের বিশাল একাংশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের আলোকে উপকূলের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ব্যাপকভাবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা খুবই জরুরি এবং প্রতিবছর বাজেটেও তার জন্য বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন বলে মনে করছি।
লেখক :উন্নয়নকর্মী
No comments