রাজধানীতে পুলিশের টহল ব্যবস্থাপনা নাজুক-হঠাৎ ছিনতাই বেড়েছে by সাহাদাত হোসেন পরশ

ব্যাংক বা বাসা থেকে নগদ টাকা তুলে বের হয়েছেন। যে কোনো সময় অস্ত্রধারী ছিনতাইকারীরা সামনে এসে হাজির হতে পারে। মুহূর্তের মধ্যে লুট করতে পারে টাকা। অবাধ্য হলে গুলি করতেও দ্বিধা করে না তারা। অনেক ক্ষেত্রে ওত পেতে থাকে ছিনতাইকারীরা। আবার কিছু ক্ষেত্রে টাকা তোলার খবর পেয়েই হাজির হয় দুর্বৃত্তরা। রাজধানীতে আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছিনতাইকারীরা। দিনদুপুরে প্রকাশ্যে কমান্ডো স্টাইলে গুলি করে ও কুপিয়ে কোটি


কোটি টাকা লুট করে নিচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। ছিনতাইয়ের ঘটনায় এরই মধ্যে একাধিক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছিনতাই হওয়া টাকা ও লুণ্ঠিত মালপত্র উদ্ধারে ব্যর্থ হচ্ছে পুলিশ। রাজধানীতে মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাসে বাহিনীসহ ছোট-বড় শতাধিক ছিনতাইকারী চক্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ছিনতাইকারী চক্রের সব সদস্যই দামি মোটরসাইকেল ব্যবহার করে থাকে। ১২ আগস্ট রাতে উত্তরায় র‌্যাবের গুলিতে পাঁচ ছিনতাইকারী নিহত হওয়ার পর নগরীতে ছিনতাইয়ের ঘটনা কিছুটা কমে যায়।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, পুলিশ-র‌্যাবের টহল ও চেকপোস্ট কমে যাওয়ায় সম্প্রতি ছিনতাই কিছুটা বেড়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কম হওয়ায় রাজধানীর বিশাল এলাকা নজরদারিতে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ কর্মকাণ্ড মোকাবেলা করতে পুলিশ অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকে। অন্যদিকে পুলিশের অধিকাংশ টহল গাড়ির অবস্থাও চলাচল অনুপযোগী। ভুক্তভোগীরা জানান, রাজধানীর অধিকাংশ ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয় না।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ছিনতাইকারীদের হাতে রয়েছে রিভলবার কিংবা পিস্তলের মতো ক্ষুদ্রাস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র। জোনভিত্তিক ছিনতাইকারী চক্রের অবস্থান থাকলেও অনেক সময় তারা পুরো শহর ঘুরে বেড়ায়। যে কারণে তাদের গ্রেফতার করতে সমস্যা হয়। রাজধানীতে বিভিন্ন সময় পেশাদার ছিনতাইকারী দলের হোতা ও ওইসব দলের সদস্য একাধিকবার গ্রেফতার হলেও কিছুদিনের মধ্যেই জামিনে বেরিয়ে একই কাজে লিপ্ত হচ্ছে। আইনি দুর্বলতার কারণে তাদের আটকে রাখা যাচ্ছে না। রাজধানীতে যারা বড় ধরনের ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত তাদের একটি ভাগ চলে যায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পকেটে।
১৬ অক্টোবর সকাল ১১টার দিকে শ্যামপুরের ধোলাইপাড় এলাকায় বাংলালিংকের পরিবেশক প্রতিষ্ঠান এনটিসি ডিস্ট্রিবিউশনে দুই কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে ও কুপিয়ে ২৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকা ছিনতাই করে অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তরা। এ সময় দুর্বৃত্তদের চাপাতির আঘাতে ওই কোম্পানির হিসাবরক্ষক দিদারুল আলম ও গুলিতে গাড়িচালক ওয়াহিদুর রহমান ওহিদ গুরুতর আহত হন। ১০ অক্টোবর দুপুর দেড়টার দিকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের পাশের রাস্তা দিয়ে সিএনজি অটোরিকশাযোগে অঞ্জন ট্রাভেল এজেন্সির এক কর্মচারী ও এক পিয়ন যাচ্ছিলেন। এ সময় একটি মাইক্রোবাস আরোহী কয়েকজন ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে ওই দু'জনকে উঠিয়ে নেয়। ৯ অক্টোবর গুলশানের মহাখালীতে সশস্ত্র ছিনতাইকারীরা প্যারাগন গ্রুপের কোষাধ্যক্ষ আবু হানিফকে গুলি করে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ১০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। একই দিন শ্যামপুরের জুরাইনে অস্ত্র ঠেকিয়ে ও গুলি করে ব্যাংক এশিয়ার ১১ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় সন্ত্রাসীরা। ৫ অক্টোবর ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন সার্জেন্ট আনোয়ার হোসেন। একইদিন মহাখালী ফ্লাইওভারে এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে মোটরসাইকেলসহ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা।
২ অক্টোবর কামরাঙ্গীরচরে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান হযরত আলী নামে এক ব্যক্তি। ১১ মে দিনদুপুরে গুলি চালিয়ে রাজধানীর বনানীতে মোহাম্মদীয়া গ্রুপের ৪৭ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। চলতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি ছিনতাইকারীর গুলিতে উত্তর বাড্ডার সাঁতারকুল রাইস এজেন্সির ম্যানেজার শামসুল হক নিহত হন। এ সময় ছিনতাইকারীরা তার কাছ থেকে ১৬ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। একই দিন গে ারিয়ায় গুলি করে ব্যবসায়ী আবদুর রউফের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা।
গোয়েন্দা সূত্রমতে, রাজধানীর যেসব স্পটে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে সেগুলো হলো_ কমলাপুর রেলওয়ে হাসপাতাল রোড, নটর ডেম কলেজ গেট থেকে আলহেলাল পুলিশ বক্স, ফকিরাপুল গরম পানি গলি, খিলগাঁও ওভারব্রিজ, পল্টন বিএনপি অফিসের সামনে ভাসানী গলি, রাজারবাগ টেলিকম ভবনের সামনের রাস্তা, শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রের সামনের সড়ক, মানিক মিয়া এভিনিউ, আগারগাঁও ক্রসিং, গাবতলী বাস টার্মিনাল, শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ড, মিরপুর বেড়িবাঁধ, মিরপুর ১ নম্বর সনি সিনেমা হলের সামনে, পীরেরবাগ মুক্তি হাউজিং, মোহাম্মদপুরের আওরঙ্গজেব রোড, কাঁটাসুর, ধানমণ্ডির ৮ নম্বর ব্রিজ মোড়, ফার্মগেট সংলগ্ন ইন্দিরা রোড ও টিঅ্যান্ডটি কার্যালয়ের পেছনের গলি, বানানী কাঁচাবাজার রোড, বনানীর সাবেক ঢাকা গেট, গুলশান লেকপাড়, গুলশান নিকেতন, গুলশান শুটিং ক্লাবের সামনে, কাকলী মোড়, রামপুরা ব্রিজের নিচে, মেরুল বাড্ডা বাজার, উত্তর বাড্ডা থানা রোডের মুখে, মহাখালী কাঁচাবাজারের সামনে, তিব্বত মোড়, খিলগাঁও চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ রেলগেট, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন রেলগেট, পূর্ব দনিয়া, আলমবাগ, সূত্রাপুরের লালমোহন সাহা স্ট্রিট ও ঢালকানগর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা চত্বর, তিন নেতার মাজারের সামনের রাস্তা, মগবাজারের নয়াটোলা, মৌচাক মার্কেটের সামনে ও মালিবাগ রেলগেট সংলগ্ন স্থান।
যেভাবে টার্গেট করা হয় : গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাজধানীতে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী সদস্যরা বেনামে ব্যাংক, বীমা ও সিএনজি স্টেশন এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেয়। টাকা বহনের আগে তারা আগেই চক্রের সদস্যদের জানিয়ে দেয়। এরপর দ্রুত মোটরসাইকেল বা মাইক্রোবাসযোগে টার্গেট করে ঘটনাস্থলে চলে আসে। ব্যাংকের নিচে ছিনতাইকারী গ্রুপের কয়েক সদস্য দু'তিনটি মোটরসাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। ওই গ্রুপকে সহায়তা করতে আরও একটি গ্রুপ তাদের অনুসরণ করে। প্রথম গ্রুপ ব্যর্থ হলে দ্বিতীয় গ্রুপ তাদের অনুসরণ করে।

No comments

Powered by Blogger.