সুশাসন-রাণীশংকৈলের রাজকথা! by আবু এন. এম. ওয়াহিদ
সরকারি দল বা সরকারকে যদি আমরা এমপি সাবের অভিভাবক বা পিতা হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে সহজেই বলতে পারি সন্তানের অপরাধে পিতা তার দায়িত্ব পালন না করে আশকারা দিচ্ছেন। আর আগেকার দিনের সঙ্গে তুলনা করলে বলতে পারি, যুগ পাল্টেছে। মূল্যবোধও পাল্টেছে। তাই আমাদের মনমানসিকতাকেও বোধ করি পাল্টাতে হবে ন্যাশভীলে ক'দিন ধরে খুব গরম ছিল। হঠাৎ সেদিন রাত থেকে বৃষ্টি শুরু হয়ে চলল ক'দিন। যেদিনের
কথা বলছি সেদিন সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখ_ সোমবার ২০১১ সাল। প্রকৃতি ঠাণ্ডা, ছুটির দিন তাই বাইরে বের হইনি। বিকেলবেলা প্রথম আলোতে একটি খবর পড়ে মনে বড় দুঃখ পেলাম। ছোটবেলার কথা মনে পড়ল। উনিশশ' ষাট সালের একেবারে গোড়ার দিক। আমি তখন বড়লেখা উপজেলার গলগজা প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র।
আমার পরিষ্কার মনে আছে, আমাদের পাশের গ্রামের এক ভদ্রলোক (মুহিব আলী) একদিন তার ছয়-সাত বছরের ছেলেকে (মখলাস আলী) টেনে-হেঁচড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে স্কুল ঘরে হেডমাস্টার সাবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, 'এই নেন। এর গোশ্ত আপনার আর হাড্ডি আমার।' অর্থাৎ 'ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার জন্য প্রয়োজনে ইচ্ছামতো মারধর করতে পারেন। মার খেতে খেতে যদি তার শরীরের সব মাংস ঝরেও যায়, তাতে আপত্তি নেই। আমি আমার ছেলের হাড্ডি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকব।' বাবার কাছে সন্তান আপন প্রাণের চেয়েও প্রিয়। কোনো পিতা কোনো সময়ই সন্তানের অপমান সহ্য করেন না। কিন্তু তার একমাত্র ব্যতিক্রম শিক্ষক। শিক্ষকের ওপর কতখানি আস্থা থাকলে একজন স্নেহশীল পিতা এভাবে তার সন্তানকে ওস্তাদের হাতে সঁপে দিয়ে আসতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়! সে সময়কার শিক্ষকরাও ছিলেন আদর্শবান। প্রাণ থাকতে অভিভাবকদের এই আস্থার বরখেলাফ করতেন না। তবে হ্যাঁ, ব্যতিক্রমও যে ছিল না তা আমি হলফ করে বলব না।
যদিও মুহিব আলীর কথা ছিল নিতান্তই একটি 'কথার কথা', তবু এটাও ঠিক, সে সময় প্রাথমিক স্কুল এমনকি হাইস্কুলেও বেত মারামারির চল ছিল। কোনো কোনো মাস্টার এ ব্যাপারে একটু বাড়াবাড়িও করতেন। পাঠশালার কথা মনে নেই, তবে হাইস্কুলে অল্পবিস্তর মার আমিও খেয়েছি। কিছু পড়ার জন্য আবার কিছু দুষ্টমির জন্য। যেহেতু আমার বাবা একই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, তাই দুষ্টমির বিচার তার কাছেই যেত এবং অন্যদের চেয়ে সাজা আমি একটু বেশিই পেতাম। তখন বুঝতাম না, কিন্তু এখন যতটুকু বুঝি, বেত মেরে ছাত্রছাত্রীদের আদব-কায়দা কিংবা জ্ঞান শেখানোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এই চল কীভাবে কোত্থেকে আমাদের দেশে এসেছিল আল্লাহই মালুম। সুখের কথা আজকাল নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সব স্কুলে বেত মারা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। হওয়াই উচিত কারণ পৃথিবীর অন্য কোথাও এ রেওয়াজ আছে কিনা আমার জানা নেই। যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, ফিরে আসি প্রথম আলোর সংবাদে। সংবাদ বিবরণীতে প্রকাশ, ঠাকুরগাঁওয়ের সংসদ সদস্য (নাম না হয় নাইবা বললাম, সম্ভবত সরকারদলীয়ই হবেন, কারণ আজকালকার দিনে বিরোধীদলীয় কোনো এমপির এত বড় সাহস হওয়ার কথা নয়) দিন-দুপুরে জনসমক্ষে মোটরসাইকেল চালিয়ে রাণীশংকৈল মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে অধ্যক্ষের শার্টের কলার চেপে ধরে চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি মেরেছেন। উপস্থিত লোকজন দৌড়ে এসে এমপি সাবের আক্রমণ থেকে অধ্যক্ষকে রক্ষা করেছেন। সাংসদের অভিযোগ, 'কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাম্পাসের গাছ কাটতে গিয়ে এমপি সাবের কতগুলো ব্যক্তিগত গাছ কেটে ফেলেছেন।' এদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছেন, 'ক্যাম্পাস সীমানার বাইরে তারা কোনো গাছ কাটেননি।'
এবার পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে যারা মূল সংবাদটি পড়েননি তাদের কৌতূহল মেটাবার জন্য সংক্ষেপে গাছ কাটার কারণটি বলছি। সংবাদ ভাষ্য অনুযায়ী, কলেজ ব্যবস্থাপনা পরিষদ চলতি সেশনের ছাত্রীদের থাকার জন্য দেড় লাখ টাকা ব্যয়ে একটি হোস্টেল বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। একই সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয়, টাকার জন্য ক্যাম্পাসের ৮০টি ঘোড়া নিমগাছ কেটে বিক্রি করা হবে এবং গাছ কাটার পর ওই জায়গায় একই জাতের ১৫০টি নতুন চারা পোঁতা হবে। চারা লাগাতে গিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ ঝোপঝাড় কেটে সাফ করেছে। এতে কিছু বনজ ও ভেষজ গাছ কাটা পড়েছে। এমপি সাব বলছেন, কাটা পড়া গাছগুলোর মালিক তিনি নিজে। কলেজ কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগ অস্বীকার করছে।
কলেজের জমিদাতার ছেলে বর্তমানে যিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী। তিনি বলছেন, 'ক্যাম্পাসের পাশের যে গাছ এবং জমি তা আসলে আর এমপি সাবের নিজের নয়। কারণ এমপি সাবের বাবা গাছগাছালিসহ এই জমি কলেজকে দান করে গেছেন। এমপি সাব না জেনে এই মাস্তানি করেছেন।' জমির মালিকানা এবং গাছ কাটার সত্যাসত্য যাই হোক, এমপি সাবের এই গর্হিত কাজ কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। জনগণের ভাগ্যের পরিহাস এমপি সাবরা এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটাচ্ছেন এবং আইন-আদালতের ঊধর্ে্ব উঠে সহজেই পার
পেয়ে যাচ্ছেন।
সরকারি দল বা সরকারকে যদি আমরা এমপি সাবের অভিভাবক বা পিতা হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে সহজেই বলতে পারি সন্তানের অপরাধে পিতা তার দায়িত্ব পালন না করে আশকারা দিচ্ছেন। আর আগেকার দিনের সঙ্গে তুলনা করলে বলতে পারি, যুগ পাল্টেছে। মূল্যবোধও পাল্টেছে। তাই আমাদের মনমানসিকতাকেও বোধকরি পাল্টাতে হবে। ভেবে দেখুন, যেখানে সে যুগের পিতা সন্তানকে শিক্ষকের হাতে তুলে দিয়ে বলতেন, 'এই নেন। এর গোশত আপনার আর হাড্ডি আমার।' সেখানে এ যুগের পিতা শিক্ষককে সন্তানের হাতে তুলে দিয়ে বলছেন, 'এই নাও। এর গোশত তোমার আর হাড্ডিও তোমার।' সবশেষে পাঠক-পাঠিকাদের উদ্দেশে বলছি, 'পেশায় আমিও একজন শিক্ষক। আমার লেখায় যদি রাণীশংকৈল কলেজের অধ্যক্ষের প্রতি কোনো অযাচিত আবেগ কিংবা পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ পেয়ে থাকে তবে আপনাদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।
আবু এন. এম. ওয়াহিদ : অধ্যাপক
টেনেসি স্টেইট ইউনিভার্সিটি
আমার পরিষ্কার মনে আছে, আমাদের পাশের গ্রামের এক ভদ্রলোক (মুহিব আলী) একদিন তার ছয়-সাত বছরের ছেলেকে (মখলাস আলী) টেনে-হেঁচড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে স্কুল ঘরে হেডমাস্টার সাবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, 'এই নেন। এর গোশ্ত আপনার আর হাড্ডি আমার।' অর্থাৎ 'ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার জন্য প্রয়োজনে ইচ্ছামতো মারধর করতে পারেন। মার খেতে খেতে যদি তার শরীরের সব মাংস ঝরেও যায়, তাতে আপত্তি নেই। আমি আমার ছেলের হাড্ডি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকব।' বাবার কাছে সন্তান আপন প্রাণের চেয়েও প্রিয়। কোনো পিতা কোনো সময়ই সন্তানের অপমান সহ্য করেন না। কিন্তু তার একমাত্র ব্যতিক্রম শিক্ষক। শিক্ষকের ওপর কতখানি আস্থা থাকলে একজন স্নেহশীল পিতা এভাবে তার সন্তানকে ওস্তাদের হাতে সঁপে দিয়ে আসতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়! সে সময়কার শিক্ষকরাও ছিলেন আদর্শবান। প্রাণ থাকতে অভিভাবকদের এই আস্থার বরখেলাফ করতেন না। তবে হ্যাঁ, ব্যতিক্রমও যে ছিল না তা আমি হলফ করে বলব না।
যদিও মুহিব আলীর কথা ছিল নিতান্তই একটি 'কথার কথা', তবু এটাও ঠিক, সে সময় প্রাথমিক স্কুল এমনকি হাইস্কুলেও বেত মারামারির চল ছিল। কোনো কোনো মাস্টার এ ব্যাপারে একটু বাড়াবাড়িও করতেন। পাঠশালার কথা মনে নেই, তবে হাইস্কুলে অল্পবিস্তর মার আমিও খেয়েছি। কিছু পড়ার জন্য আবার কিছু দুষ্টমির জন্য। যেহেতু আমার বাবা একই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, তাই দুষ্টমির বিচার তার কাছেই যেত এবং অন্যদের চেয়ে সাজা আমি একটু বেশিই পেতাম। তখন বুঝতাম না, কিন্তু এখন যতটুকু বুঝি, বেত মেরে ছাত্রছাত্রীদের আদব-কায়দা কিংবা জ্ঞান শেখানোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এই চল কীভাবে কোত্থেকে আমাদের দেশে এসেছিল আল্লাহই মালুম। সুখের কথা আজকাল নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সব স্কুলে বেত মারা নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। হওয়াই উচিত কারণ পৃথিবীর অন্য কোথাও এ রেওয়াজ আছে কিনা আমার জানা নেই। যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, ফিরে আসি প্রথম আলোর সংবাদে। সংবাদ বিবরণীতে প্রকাশ, ঠাকুরগাঁওয়ের সংসদ সদস্য (নাম না হয় নাইবা বললাম, সম্ভবত সরকারদলীয়ই হবেন, কারণ আজকালকার দিনে বিরোধীদলীয় কোনো এমপির এত বড় সাহস হওয়ার কথা নয়) দিন-দুপুরে জনসমক্ষে মোটরসাইকেল চালিয়ে রাণীশংকৈল মহিলা কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে অধ্যক্ষের শার্টের কলার চেপে ধরে চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি মেরেছেন। উপস্থিত লোকজন দৌড়ে এসে এমপি সাবের আক্রমণ থেকে অধ্যক্ষকে রক্ষা করেছেন। সাংসদের অভিযোগ, 'কলেজের অধ্যক্ষ ক্যাম্পাসের গাছ কাটতে গিয়ে এমপি সাবের কতগুলো ব্যক্তিগত গাছ কেটে ফেলেছেন।' এদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছেন, 'ক্যাম্পাস সীমানার বাইরে তারা কোনো গাছ কাটেননি।'
এবার পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে যারা মূল সংবাদটি পড়েননি তাদের কৌতূহল মেটাবার জন্য সংক্ষেপে গাছ কাটার কারণটি বলছি। সংবাদ ভাষ্য অনুযায়ী, কলেজ ব্যবস্থাপনা পরিষদ চলতি সেশনের ছাত্রীদের থাকার জন্য দেড় লাখ টাকা ব্যয়ে একটি হোস্টেল বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। একই সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয়, টাকার জন্য ক্যাম্পাসের ৮০টি ঘোড়া নিমগাছ কেটে বিক্রি করা হবে এবং গাছ কাটার পর ওই জায়গায় একই জাতের ১৫০টি নতুন চারা পোঁতা হবে। চারা লাগাতে গিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ ঝোপঝাড় কেটে সাফ করেছে। এতে কিছু বনজ ও ভেষজ গাছ কাটা পড়েছে। এমপি সাব বলছেন, কাটা পড়া গাছগুলোর মালিক তিনি নিজে। কলেজ কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগ অস্বীকার করছে।
কলেজের জমিদাতার ছেলে বর্তমানে যিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী। তিনি বলছেন, 'ক্যাম্পাসের পাশের যে গাছ এবং জমি তা আসলে আর এমপি সাবের নিজের নয়। কারণ এমপি সাবের বাবা গাছগাছালিসহ এই জমি কলেজকে দান করে গেছেন। এমপি সাব না জেনে এই মাস্তানি করেছেন।' জমির মালিকানা এবং গাছ কাটার সত্যাসত্য যাই হোক, এমপি সাবের এই গর্হিত কাজ কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। জনগণের ভাগ্যের পরিহাস এমপি সাবরা এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটাচ্ছেন এবং আইন-আদালতের ঊধর্ে্ব উঠে সহজেই পার
পেয়ে যাচ্ছেন।
সরকারি দল বা সরকারকে যদি আমরা এমপি সাবের অভিভাবক বা পিতা হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে সহজেই বলতে পারি সন্তানের অপরাধে পিতা তার দায়িত্ব পালন না করে আশকারা দিচ্ছেন। আর আগেকার দিনের সঙ্গে তুলনা করলে বলতে পারি, যুগ পাল্টেছে। মূল্যবোধও পাল্টেছে। তাই আমাদের মনমানসিকতাকেও বোধকরি পাল্টাতে হবে। ভেবে দেখুন, যেখানে সে যুগের পিতা সন্তানকে শিক্ষকের হাতে তুলে দিয়ে বলতেন, 'এই নেন। এর গোশত আপনার আর হাড্ডি আমার।' সেখানে এ যুগের পিতা শিক্ষককে সন্তানের হাতে তুলে দিয়ে বলছেন, 'এই নাও। এর গোশত তোমার আর হাড্ডিও তোমার।' সবশেষে পাঠক-পাঠিকাদের উদ্দেশে বলছি, 'পেশায় আমিও একজন শিক্ষক। আমার লেখায় যদি রাণীশংকৈল কলেজের অধ্যক্ষের প্রতি কোনো অযাচিত আবেগ কিংবা পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ পেয়ে থাকে তবে আপনাদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।
আবু এন. এম. ওয়াহিদ : অধ্যাপক
টেনেসি স্টেইট ইউনিভার্সিটি
No comments