সীমান্তে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন by এস এম আব্রাহাম লিংকন
বেশ কিছুদিন সীমান্তে গোলাগুলি ছিল না। বিশেষত ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের বাংলাদেশ সফরের পর কয়েক মাস পরিস্থিতি শান্ত ছিল। হঠাৎ সে নীরবতা ভেঙে আবারও সীমান্তে গোলাগুলি আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) গুলি করে বাংলাদেশের তিন অঞ্চলের চারজনকে হত্যা করেছে। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলায় প্রাণ দিয়েছেন কৃষ্ণানন্দ বকশি গ্রামের আলমগীর হোসেন,
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার শাওড়াতলা গ্রামের নাহারুল হোসেন, দিনাজপুর জেলার বিরামপুর উপজেলার দাউদপুর গ্রামের মতিয়ার রহমান ও রণগ্রামের তাইজুল ইসলাম। সীমান্তে আমাদের নাগরিকদের প্রাণ দেওয়া নতুন কোনো বিষয় নয়। ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে ঢাকায় প্রস্তুতিমূলক কাজে ভারতীয় সচিব এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সীমান্তে আর কোনো গুলি হবে না। ভারতীয় স্বরাষ্ট্র সচিবের এ কথা বলার পরদিনই সীমান্তে গুলি হয়েছে এবং বাংলাদেশি নাগরিক যথারীতি প্রাণ দিয়েছে বিএসএফের হাতে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের মাস কয়েক আগে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে বিএসএফ অত্যন্ত ঠাণ্ডামাথায় কিশোরী ফেলানীকে হত্যা করে। কাঁটাতারে ঝোলানো ফেলানীর লাশের ছবি সারা বিশ্বে প্রচারিত হলে ভারত সাময়িকভাবে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। ঘটনা-পরবর্তী সময়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান ফেলানীর মা-বাবার সঙ্গে দেখা করেন। আমাদের প্রতিবেশীরা প্রতিশ্রুতি দেয় আর ভাঙে। তাদের প্রতিশ্রুতিও নতুন নয়, প্রতিশ্রুতি ভাঙাও নতুন নয়।
সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামে আমার বাস, ফলে সীমান্তের শব্দ সহজেই কানে আসে। এই জেলা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং মেঘালয়ের সীমান্ত বেষ্টিত। কুড়িগ্রাম ব্রহ্মপুত্রের পূর্বপারের রৌমারী-রাজিবপুর বাদেই ২৭৪ কিলোমিটার ভারতীয় সীমান্ত। বাংলাদেশ মোট ৪৪২৭ কিলোমিটার সীমান্ত বেষ্টিত। তন্মধ্যে ভারত ৪১৫৬ কিলোমিটার, যার স্থলসীমান্ত ৩৯৭৬ এবং নদীসীমান্ত ১৮০ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত, যার স্থল ১০৮ এবং নদী ৬৩ কিলোমিটার। এই বিশাল সীমান্ত রক্ষায় শুধু বিজিবিই যথেষ্ট নয়। নাগরিকদের চেতনার অভাব, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নৈতিক স্খলন ছাড়াও বর্ডার ম্যানেজমেন্টের অবকাঠামোগত দুর্বলতা অন্যতম কারণ আমাদের পিছিয়ে থাকার। সীমান্তে যে নিত্য হাঙ্গামা হচ্ছে, এর পেছনে হয়তো আমাদের কোনো কোনো নাগরিকের অনৈতিক স্বার্থযুক্ত আছে, নিশ্চয়ই তারা অপরাধী। তারা আইনের আওতায় আসতে পারে, বিচারে তাদের সাজাও হতে পারে। বেআইনি কাজের অজুহাতে কাউকে হত্যা করার অধিকার কোনো রাষ্ট্রেরই নেই। এ রকম হত্যাকাণ্ড Extra Judicial Killing- যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারেরও লংঘন। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের দেশজ আইনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জীবনাবসান আইনানুগ করেছে, যা ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচিত। ব্যতিক্রম নিত্যপ্রয়োগের জন্য নয়। কিন্তু আমাদের সীমান্তে যা দেখছি তা নিত্য। ব্যতিক্রমের নিত্য ব্যবহার শক্তিধরের দুর্বলের ওপর পরিহাসের চরিত্রকে পরিস্ফুট করে। ভারত ও মিয়ানমার অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে হয়তো ক্ষমতাধর, পরিস্থিতির কারণেই আমরা তাদের বড়ভাইসুলভ আচরণ অশোভনীয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক অবদানের জন্য আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অবদান স্বীকার করি, কারণ সেটি আমাদের ঋণ। সে কারণে রয়েছে অশেষ কৃতজ্ঞতা। তার মানে এই নয়, কোনো প্রতিবেশীর কাছে শুধু অবদান থাকার কারণেই সব অন্যায় মেনে নিতে হবে।
আমাদের বর্তমান সীমান্তরক্ষী বাহিনীর যে শক্তি, তা দিয়ে কার্যকর বর্ডার ম্যানেজমেন্ট সহজ নয়। কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম পারের দায়িত্বাধীন ৪৫ বিজিবির শক্তির একটি তুলনামূলক পরিসংখ্যান দিলে বুঝতে সহজ হবে পরিস্থিতি। জেলার ২৭৪ কিলোমিটার বিশাল সীমান্তপথের মধ্যে ৪২.৯৮ কিলোমিটার নদ-নদীর পথ, যার মধ্যে আছে ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমোর, ধরলার মতো খরস্রোতা নদ-নদী। এই বন্ধুর সীমান্ত পাহারা দেওয়ার জন্য আমাদের আছে মাত্র ২৫টি বর্ডার আউট পোস্ট (বিওপি)। একটি বিওপি থেকে আরেকটি বিওপির দূরত্ব ১০.৯৬ কিলোমিটার (প্রায় ১১ কিলোমিটার), পক্ষান্তরে ভারতের বিওপি ৬৪টি। আমাদের একটি বিওপিতে আছেন ১৫-২০ জন সীমান্তরক্ষী, পক্ষান্তরে ভারতের প্রতিটিতে ৩৫-৪০ জন_অর্থাৎ জনবলের দিক থেকে তারা আমাদের দ্বিগুণ। তাদের প্রতিটি ক্যাম্পের বিপরীতে আছে যেমন জনবল, তেমনি যোগাযোগের জন্য আধুনিক ব্যবস্থা। তাদের যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত। আমাদের পথও দুর্গম এবং যোগাযোগের মাধ্যম অনেকটাই আদিম। জওয়ানরা মূলত হেঁটেই সীমান্ত পাহারা দেন। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্বিচক্রযান ব্যবহৃত হয়। নদীপথে আবার ভাড়া করা নৌকার সাহায্য নিতে হয়। আমাদের জওয়ানরা যখন যোগাযোগের পুরনো পদ্ধতি মেনে দায়িত্ব পালন করছেন, আর অপরাধী চক্র ও প্রতিপক্ষ আধুনিক যানবাহন ব্যবহার করে। ফলে প্রতিরোধকারী শক্তি হিসেবে বিজিবি প্রতিপক্ষ বা অসাধুদের থেকে অনেক পিছিয়ে। এই পিছিয়ে থাকা দুষ্টচক্রের জন্য লাভের। ওরা বিজিবি জওয়ানদের ফাঁকি দিলেও ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিতে পারে না।
বাংলাদেশ ভৌগোলিক কারণেই পাচারের বা চোরাকারবারের সহজ রুট। নারী ও শিশু পাচার এবং চোরাচালান প্রতিরোধ করতে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আধুনিকায়নের বিকল্প নেই। সেখানে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগব্যবস্থায় আধুনিক পরিবহনের সনি্নবেশ ঘটাতে হবে। নতুবা প্রতিপক্ষ থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে ও থাকবে। সীমান্তবিরোধ নিরসনে যা করা দরকার তা হচ্ছে_১. সচেতনতা সৃষ্টি। ২. দেশপ্রেম জাগ্রতকরণ (জনগণ ও সীমান্তরক্ষী সবার জন্য)। ৩. ধর্মীয় মূল্যবোধের এ ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় দিকগুলোর প্রয়োগ। এ ব্যাপারে মসজিদের ইমামরা জুমার নামাজে খুতবার সময় বয়ান দিতে পারেন। ৪. রেডিও-টিভিতে পাচারের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা। ৫. গান, নাটক, পথনাটক প্রভৃতির মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করা। ৬. চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রদের পাঠ্যসূচিতে পাচারবিষয়ক পাঠ সংযুক্ত করা। ৭. স্কুল-কলেজের ক্লাসে পাচার ও চোরাচালানবিরোধী সভা-সমাবেশ করা। ৮. রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় যেকোনো সভা-সমাবেশে পাচার এবং চোরাচালানের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা। ওইসব কার্যক্রমের জন্য বাংলাদেশ সরকারের ২০০৫ সালের আগস্ট মাসের নারী ও শিশু পাচার রোধকল্পে প্রচার, উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কর্মসূচির নীতিমালার বাস্তবায়ন। এ পদ্ধতিগুলোকে আমরা বলতে পারি সফটওয়ার কার্যক্রম। সীমান্ত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য অবকাঠামোগত খাতে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে_১. সীমান্তের পাশে পাকা সড়ক নির্মাণ, ২. সীমান্তরক্ষীদের জন্য পাশাপাশি দু-তিনটি বিওপির জন্য জিপ এবং প্রতিটি বিওপির জন্য মোবাইল টিম পরিচালনায় মোটরসাইকেল প্রদান, ৩. বিজিবি জওয়ানদের মোবাইল ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া। সংশ্লিষ্টদের কল রেকর্ড নিয়মিত পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা। প্রতিটি ক্যাম্পে ই-মেইলসহ কম্পিউটার-সংযোগ প্রদান। ৪. নৌপথে যোগাযোগের জন্য দ্রুতগামী জলযান যোগ করা। নিজস্ব স্পিডবোটসহ নৌ-ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। ৫. যেহেতু সীমান্ত রক্ষা একটি জরুরি ও ঝুঁকিপূর্ণ সেবা খাত, সে কারণে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সৈনিক থেকে অফিসার_সবার বেতন কাঠামো উন্নত করা। পাহাড়ে থাকলে যেমন রাষ্ট্রীয় চাকরিতে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়, অনুরূপ যেসব জওয়ান দুর্গম চরাঞ্চলে দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁদের সুবিধা আনুপাতিক হারে বেশি দেওয়া। ৬. বিওপি বৃদ্ধিসহ প্রতিটি বিওপিতে তিনগুণ জনবল বৃদ্ধি করা। ৭. বিডিআর বিদ্রোহের নামে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর অফিসার পদে যে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা জরুরি ভিত্তিতে পূরণ করা। ৮. শূন্যপদে দ্রুত নিয়োগ দেওয়া। ৯. মহিলা বিজিবি নিয়োগ দেওয়া। প্রচলিত আইনের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে বিশেষত মহিলা অপরাধীর শরীর তল্লাশিকালে মহিলাদের উপস্থিতি জরুরি। ১০. ভারতের সঙ্গে যেসব রাজনৈতিক বিষয় এখনো ঝুলে আছে, তার সমাধান করা। যেমন_মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বাস্তবায়ন করে ছিটমহল সমস্যার সমাধান করা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি এবং ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ছিটমহল ৫৭টি। ছিটমহলের Stateless অবস্থানকে অপরাধীরা ব্যবহার করে। ১১. উভয় দেশের নাগরিকদের আন্তরাষ্ট্রীয় যাতায়াত সহজ করা। ১২. নবসৃষ্ট বর্ডারহাট জোরদার এবং নতুন নতুন হাট স্থাপন করা। একই সঙ্গে বর্ডারহাটে উভয় দেশের মধ্যে চুক্তিবদ্ধ যত পণ্য আছে, তা বিক্রির সুযোগ সৃষ্টি করা। প্রকৃত অর্থে কার্যকর বর্ডারহাট সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। রপ্তানির আওতাভুক্ত পণ্য সহজভাবে পাওয়া গেলে যেমন চোরাচালান কমবে, তেমনি সীমান্ত সমস্যারও অবসান হবে। উপরোক্ত বিষয়াদি ছাড়াও সীমান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য আইনসংক্রান্ত কিছু বিষয় আছে, যার সমাধানও জরুরি যথা_১. চোরাচালান ও পাচারের মামলাগুলোর দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করা। ২. চোরাচালান ও পাচারের ক্ষেত্রে মামলা প্রমাণের ভার আসামির ওপর অর্পণ করা। ৩. মানব পাচার কথাটি যুক্ত করা। ৪. চোরাচালান ও নারী-শিশু আইন এবং এর প্রয়োগ সম্পর্কে বিজিবি সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান বিশেষত জব্দ তালিকা প্রস্তুতকরণসহ আনুষঙ্গিক আইনগত ব্যবহারিক বিষয় জ্ঞাতকরণ। এতদ্ব্যতীত যে প্রধান কারণে পাচার ও চোরাচালান হয়ে থাকে, যার কারণে সীমান্তবিরোধ দেখা যায় তা নিরসন করা যথা_১. দারিদ্র্য নিরসন করা, ২. নাগরিককে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং ৩. সীমান্তে চোরাচালান রোধে জনগণকে সঙ্গে যুক্ত করা। উদ্ধৃত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিলে আমরা একটি শান্তিপূর্ণ সীমান্ত গড়ে তুলতে পারব।
লেখক : অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম আইন কলেজ, পাবলিক প্রসিকিউটর, কুড়িগ্রাম ও সাধারণ সম্পাদক জেলা আইনজীবী সমিতি, কুড়িগ্রাম
No comments