সময়ের প্রতিধ্বনি-রাষ্ট্রপতির সংলাপ-উদ্যোগ সফল হবে তো! by মোস্তফা কামাল
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ার কারণে এমনিতেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। রাজনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি বাড়ছে অস্থিরতা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পারস্পরিক সম্পর্ক খুবই নাজুক। উভয় দলের নেতারা পরস্পরকে শত্রু মনে করছেন। সর্বোচ্চ পর্যায়ের এই নেতিবাচক মনোভাবের প্রভাব পড়ছে তৃণমূলে। কিছুদিন আগেও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্পর্ক
জাতীয় পর্যায়ের চেয়ে ভালো ছিল। এখন তেমনটি দেখা যায় না। দুঃখজনক হলেও সত্য, রাজনৈতিক এই বিরোধ সমাজে, এমনকি পরিবারেও ভাঙন ধরাচ্ছে।
বিএনপি সরকারকে টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামাতে চায়। আর ক্ষমতাসীন দল চায় বিরোধীদের নিপীড়ন-নির্যাতন করে ঘরে বসিয়ে দিতে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও একটি পক্ষ দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সংলাপ-উদ্যোগের খবরটি স্বস্তিদায়ক বলেই মনে হচ্ছে। তিনি আগামীকাল বৃহস্পতিবার মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি এবং জাসদের (ইনু) সঙ্গে বৈঠক করবেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ এবং জাসদের হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে যাবে এবং রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেবে। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্য দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক হবে।
কেউ কেউ এখনই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, রাষ্ট্রপতি উদ্যোগ নিলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সংলাপে যোগ দেবে না। অবশ্য এর কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় বিএনপি নেতাদের সাম্প্রতিক কথাবার্তায়। তাঁরা বলেছেন, আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল করা হোক, তারপর আলোচনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতেই পারে। তবে তার আগে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের কাজটি দ্রুত শেষ করা দরকার। সব রাজনৈতিক দল সমঝোতার ভিত্তিতে যদি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতে পারে, তাহলে অন্তত কমিশনারদের নিরপেক্ষতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। কোনো বিতর্কও হবে না। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার বিষয়টি আলোচনায় উত্থাপন করতে পারে। নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) প্রকৃত অর্থেই স্বাধীন করতে হবে। ইসিকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিতে হবে। এ জন্য অবশ্যই বিএনপির আলোচনায় অংশ নেওয়া দরকার। এখন বিএনপি যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে গোঁ ধরে বসে থাকে, তাহলে আবারও সরকার একতরফাভাবে কমিশনারদের নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ পাবে। সরকারকে সেই সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না।
এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপিকে সংসদে গিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাব দেওয়ার জন্য সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাগিদ দিয়েছিলেন। সুধী সমাজ এবং গণমাধ্যম থেকেও বলা হয়েছিল, বিএনপির উচিত সংসদে সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাব উপস্থাপন করা। কিন্তু সে পথে যায়নি বিএনপি। বিএনপির ধারণা ছিল, আন্দোলন করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল করতে সক্ষম হবে। আন্দোলন করার মতো সাংগঠনিক শক্তি যে বিএনপির নেই, তা হয়তো উপলব্ধি করতে তাদের কিছুটা দেরি হয়েছে। আর তাই আন্দোলন করতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেয়েছে বিএনপি। আন্দোলন জমাতে না পেরে বেগম জিয়া নেতাদের দুষছেন। কারো কারো প্রতি নাখোশ হয়েছেন। বারবার তিনি নেতা-কর্মীদের রাজপথে সক্রিয় থাকার নির্দেশ দিলেও কোনো কাজ হয়নি। পুলিশের লাঠিপেটার ভয়ে নেতা-কর্মীরা মাঠে নামছেন না। সংগত কারণেই বিএনপির উচিত ছিল, সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব উপস্থাপন করা। সংসদে জোরালো অবস্থান নিলে মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করা হতো। তাহলে সরকারের ওপরও চাপ সৃষ্টি হতো। সেই চাপ প্রয়োগে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। অপরদিকে তারা সংসদকেও অকার্যকর করে রেখেছে। এতে শেষ পর্যন্ত লাভ হয়েছে ক্ষমতাসীন দলেরই। তারা একতরফাভাবে সংসদে সংবিধান সংশোধনসহ অসংখ্য বিল পাস করিয়ে নিয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে ক্ষমতাসীন দলও একগুঁয়ে মনোভাব দেখিয়েছে। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করলেও জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে আরো দুই মেয়াদে রাখার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশনা মেনে চললে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমূর্তি বাড়ত। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে।
এ কারণে সাধারণ মানুষ বলতেই পারে, প্রধান দুটি দল দেশের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থ বড় করে দেখে। দলীয় সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব উঠতে না পারার কারণেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাকে গুরুত্ব দেয়নি সরকার। ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে আবার ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে। আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভাবছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে পারলে আবার ক্ষমতায় আসা সহজ হবে। অর্থাৎ আবার ক্ষমতায় যাওয়া নিয়েই উভয় দলের মধ্যে সংঘাত। আর তাতে যদি দেশের বারোটাও বাজে ক্ষতি কী! তাদের তো কোনো ক্ষতি হবে না, খেসারত দিতে হবে জনগণকে। বলতে দ্বিধা নেই, প্রধান দুই দলের সংঘাতের কারণে প্রতিনিয়তই জনগণকে খেসারত দিতে হচ্ছে। দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজমান থাকায় বিদেশিরা বিনিয়োগ আগ্রহ হারাচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এর ফলে মানুষের হতাশাও বেড়ে যাচ্ছে। আমার জানামতে, মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত অনেক পরিবার এখন উন্নত বিশ্বে পাড়ি জমাচ্ছে। প্রতিদিনই আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় দেশগুলোতে স্থায়ী অভিবাসী হওয়ার জন্য বাংলাদেশিরা আবেদন করছেন। অনেকে বলছেন, উন্নত দেশে স্থায়ী অভিবাসী হওয়ার এই প্রবণতা উদ্বেগজনক।
গত মঙ্গলবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যে তাণ্ডব আমরা দেখলাম, তাতে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিতই হতে হয়। আমরা স্পষ্ট টের পাচ্ছি, পরিকল্পিতভাবে একটি পক্ষ দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে। মঙ্গলবারের ঘটনাটি ছিল তাদের প্রথম পদক্ষেপ। এরপর তারা আরো বেশ কয়েকটি বড় অঘটন ঘটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। গোয়েন্দারাও এ ধরনের আশঙ্কার খবর পেয়েছেন। কোনো কোনো সংস্থার কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণও রয়েছে।
দেশকে অস্থিতিশীল করার অশুভ পরিকল্পনার তথ্য নিশ্চয়ই রাষ্ট্রপতিও পেয়েছেন। সম্ভবত রাজনৈতিক সংঘাত এড়ানোর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রাষ্ট্রপতি সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছেন। এই সংলাপে সব রাজনৈতিক দল অংশ নিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই ইতিবাচক ফল আসবে। আমাদের নেতাদের মূল সমস্যা হচ্ছে, আন্তরিকতার অভাব। 'আলোচনায় বসতে রাজি, কিন্তু তালগাছটা আমার'_এই নীতিতে অগ্রসর হলে সংলাপে না বসাই ভালো। ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলের নেতাদের আগে অঙ্গীকার করতে হবে। তারপর সমস্যা সমাধানে আন্তরিক উদ্যোগ নিতে হবে।
আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করা হলেও নির্বাচন কমিশন স্বাধীন না হলে এবং নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হলে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও দিতে হবে।
আমরা জানি, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা এবং অপর দুই কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন ও ছহুল হোসাইনের মেয়াদ শেষ হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্দলীয় ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করতে হবে। অন্যথায় আগামী নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
ক্ষমতাসীন দলও নিশ্চয়ই প্রধান রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে চাইবে না। কারণ প্রধান রাজনৈতিক দল ছাড়া নির্বাচন হলে সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তা ছাড়া রাষ্ট্রপতির উদ্যোগকে সফল করতে হলে ক্ষমতাসীন দলকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। অনেক বেশি নমনীয় এবং ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রপতি আমাদের সর্বশেষ ভরসার জায়গা। তাঁর চেষ্টা ও উদ্যোগ যেন ব্যর্থ না হয়।
এর আগের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিশ্চয়ই আমাদের স্মরণ আছে। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। মাগুরা উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলন করছে। তখন বেগম খালেদা জিয়া বললেন, কেবল শিশু এবং পাগল ছাড়া দেশে নিরপেক্ষ কোনো ব্যক্তি নেই। তাই তারা আওয়ামী লীগের দাবি মানতে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিএনপি ১৫ ফেব্রুয়ারি একদলীয় নির্বাচন করে জাতীয় নির্বাচনকে কলঙ্কিত করেছিল। সেই সঙ্গে বিএনপিকেও সেই কলঙ্কের বোঝা বহন করতে হয়েছিল।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল নিশ্চয়ই সেই ইতিহাস ভুলে যায়নি। অতীত থেকে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ শিক্ষা নেবে এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে যা যা করণীয় তার সবই করবে। অন্যথায় গণতন্ত্র আবার হুমকির মুখে পড়বে। আর তার দায় কিন্তু আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
বিএনপি সরকারকে টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামাতে চায়। আর ক্ষমতাসীন দল চায় বিরোধীদের নিপীড়ন-নির্যাতন করে ঘরে বসিয়ে দিতে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও একটি পক্ষ দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সংলাপ-উদ্যোগের খবরটি স্বস্তিদায়ক বলেই মনে হচ্ছে। তিনি আগামীকাল বৃহস্পতিবার মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি এবং জাসদের (ইনু) সঙ্গে বৈঠক করবেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ এবং জাসদের হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে যাবে এবং রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেবে। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্য দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক হবে।
কেউ কেউ এখনই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, রাষ্ট্রপতি উদ্যোগ নিলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সংলাপে যোগ দেবে না। অবশ্য এর কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় বিএনপি নেতাদের সাম্প্রতিক কথাবার্তায়। তাঁরা বলেছেন, আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল করা হোক, তারপর আলোচনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতেই পারে। তবে তার আগে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের কাজটি দ্রুত শেষ করা দরকার। সব রাজনৈতিক দল সমঝোতার ভিত্তিতে যদি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতে পারে, তাহলে অন্তত কমিশনারদের নিরপেক্ষতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। কোনো বিতর্কও হবে না। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার বিষয়টি আলোচনায় উত্থাপন করতে পারে। নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) প্রকৃত অর্থেই স্বাধীন করতে হবে। ইসিকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিতে হবে। এ জন্য অবশ্যই বিএনপির আলোচনায় অংশ নেওয়া দরকার। এখন বিএনপি যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে গোঁ ধরে বসে থাকে, তাহলে আবারও সরকার একতরফাভাবে কমিশনারদের নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ পাবে। সরকারকে সেই সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না।
এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপিকে সংসদে গিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাব দেওয়ার জন্য সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাগিদ দিয়েছিলেন। সুধী সমাজ এবং গণমাধ্যম থেকেও বলা হয়েছিল, বিএনপির উচিত সংসদে সুনির্দিষ্টভাবে প্রস্তাব উপস্থাপন করা। কিন্তু সে পথে যায়নি বিএনপি। বিএনপির ধারণা ছিল, আন্দোলন করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল করতে সক্ষম হবে। আন্দোলন করার মতো সাংগঠনিক শক্তি যে বিএনপির নেই, তা হয়তো উপলব্ধি করতে তাদের কিছুটা দেরি হয়েছে। আর তাই আন্দোলন করতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেয়েছে বিএনপি। আন্দোলন জমাতে না পেরে বেগম জিয়া নেতাদের দুষছেন। কারো কারো প্রতি নাখোশ হয়েছেন। বারবার তিনি নেতা-কর্মীদের রাজপথে সক্রিয় থাকার নির্দেশ দিলেও কোনো কাজ হয়নি। পুলিশের লাঠিপেটার ভয়ে নেতা-কর্মীরা মাঠে নামছেন না। সংগত কারণেই বিএনপির উচিত ছিল, সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব উপস্থাপন করা। সংসদে জোরালো অবস্থান নিলে মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করা হতো। তাহলে সরকারের ওপরও চাপ সৃষ্টি হতো। সেই চাপ প্রয়োগে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। অপরদিকে তারা সংসদকেও অকার্যকর করে রেখেছে। এতে শেষ পর্যন্ত লাভ হয়েছে ক্ষমতাসীন দলেরই। তারা একতরফাভাবে সংসদে সংবিধান সংশোধনসহ অসংখ্য বিল পাস করিয়ে নিয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে ক্ষমতাসীন দলও একগুঁয়ে মনোভাব দেখিয়েছে। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করলেও জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে আরো দুই মেয়াদে রাখার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশনা মেনে চললে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমূর্তি বাড়ত। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে।
এ কারণে সাধারণ মানুষ বলতেই পারে, প্রধান দুটি দল দেশের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থ বড় করে দেখে। দলীয় সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব উঠতে না পারার কারণেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাকে গুরুত্ব দেয়নি সরকার। ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে আবার ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে। আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভাবছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে পারলে আবার ক্ষমতায় আসা সহজ হবে। অর্থাৎ আবার ক্ষমতায় যাওয়া নিয়েই উভয় দলের মধ্যে সংঘাত। আর তাতে যদি দেশের বারোটাও বাজে ক্ষতি কী! তাদের তো কোনো ক্ষতি হবে না, খেসারত দিতে হবে জনগণকে। বলতে দ্বিধা নেই, প্রধান দুই দলের সংঘাতের কারণে প্রতিনিয়তই জনগণকে খেসারত দিতে হচ্ছে। দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজমান থাকায় বিদেশিরা বিনিয়োগ আগ্রহ হারাচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এর ফলে মানুষের হতাশাও বেড়ে যাচ্ছে। আমার জানামতে, মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত অনেক পরিবার এখন উন্নত বিশ্বে পাড়ি জমাচ্ছে। প্রতিদিনই আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় দেশগুলোতে স্থায়ী অভিবাসী হওয়ার জন্য বাংলাদেশিরা আবেদন করছেন। অনেকে বলছেন, উন্নত দেশে স্থায়ী অভিবাসী হওয়ার এই প্রবণতা উদ্বেগজনক।
গত মঙ্গলবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যে তাণ্ডব আমরা দেখলাম, তাতে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিতই হতে হয়। আমরা স্পষ্ট টের পাচ্ছি, পরিকল্পিতভাবে একটি পক্ষ দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে। মঙ্গলবারের ঘটনাটি ছিল তাদের প্রথম পদক্ষেপ। এরপর তারা আরো বেশ কয়েকটি বড় অঘটন ঘটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। গোয়েন্দারাও এ ধরনের আশঙ্কার খবর পেয়েছেন। কোনো কোনো সংস্থার কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণও রয়েছে।
দেশকে অস্থিতিশীল করার অশুভ পরিকল্পনার তথ্য নিশ্চয়ই রাষ্ট্রপতিও পেয়েছেন। সম্ভবত রাজনৈতিক সংঘাত এড়ানোর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রাষ্ট্রপতি সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছেন। এই সংলাপে সব রাজনৈতিক দল অংশ নিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই ইতিবাচক ফল আসবে। আমাদের নেতাদের মূল সমস্যা হচ্ছে, আন্তরিকতার অভাব। 'আলোচনায় বসতে রাজি, কিন্তু তালগাছটা আমার'_এই নীতিতে অগ্রসর হলে সংলাপে না বসাই ভালো। ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলের নেতাদের আগে অঙ্গীকার করতে হবে। তারপর সমস্যা সমাধানে আন্তরিক উদ্যোগ নিতে হবে।
আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করা হলেও নির্বাচন কমিশন স্বাধীন না হলে এবং নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হলে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও দিতে হবে।
আমরা জানি, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা এবং অপর দুই কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন ও ছহুল হোসাইনের মেয়াদ শেষ হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্দলীয় ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করতে হবে। অন্যথায় আগামী নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
ক্ষমতাসীন দলও নিশ্চয়ই প্রধান রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে চাইবে না। কারণ প্রধান রাজনৈতিক দল ছাড়া নির্বাচন হলে সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তা ছাড়া রাষ্ট্রপতির উদ্যোগকে সফল করতে হলে ক্ষমতাসীন দলকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। অনেক বেশি নমনীয় এবং ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রপতি আমাদের সর্বশেষ ভরসার জায়গা। তাঁর চেষ্টা ও উদ্যোগ যেন ব্যর্থ না হয়।
এর আগের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিশ্চয়ই আমাদের স্মরণ আছে। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। মাগুরা উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলন করছে। তখন বেগম খালেদা জিয়া বললেন, কেবল শিশু এবং পাগল ছাড়া দেশে নিরপেক্ষ কোনো ব্যক্তি নেই। তাই তারা আওয়ামী লীগের দাবি মানতে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিএনপি ১৫ ফেব্রুয়ারি একদলীয় নির্বাচন করে জাতীয় নির্বাচনকে কলঙ্কিত করেছিল। সেই সঙ্গে বিএনপিকেও সেই কলঙ্কের বোঝা বহন করতে হয়েছিল।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দল নিশ্চয়ই সেই ইতিহাস ভুলে যায়নি। অতীত থেকে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ শিক্ষা নেবে এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে যা যা করণীয় তার সবই করবে। অন্যথায় গণতন্ত্র আবার হুমকির মুখে পড়বে। আর তার দায় কিন্তু আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
No comments