স্বাধীনতার ৪০ বছর-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।শহীদ এরশাদ আলী, বীর উত্তম মাটি কামড়ে যুদ্ধ করলেন তিনি যুদ্ধের সাফল্যে এরশাদ আলী ও তাঁর সহযোদ্ধারা বেশ উদ্দীপ্ত। তবে আনন্দের আতিশয্যে ভাসছেন না। আনন্দের মধ্যেও সবাই সতর্ক। কারণ, যেকোনো সময় আবার পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করতে পারে। সবাই নিজ নিজ বাংকারে সতর্ক অবস্থায়। রাতে তাঁরা পালা করে ঘুমালেন। সকাল হতেই
তাঁদের অবস্থানের ওপর শুরু হলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি গোলাবর্ষণ। একটু এর বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা ব্যাপক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আক্রমণ চালায় তাঁদের ওপর। আক্রমণের প্রচণ্ডতায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেন। কিন্তু এরশাদ আলী মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন। বিপুল বিক্রমে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে লড়াই করতে থাকলেন। তাঁর সাহস ও বীরত্বে উদ্দীপ্ত হলেন আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা নিজ নিজ বাংকারে থেকে যুদ্ধ করছেন। এমন সময় গুলি এসে লাগল এরশাদ আলীর বুকে। বাংকারে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ। বাকি মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণে বাধ্য হলেন। রক্তে রঞ্জিত বাংকারে পড়ে থাকল এরশাদ আলীর নিথর দেহ। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিলের। তিস্তা রেলসেতুতে।
২৫ মার্চের পর রংপুর ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পরে বিডিআর, এখন বিজিবি) উইংয়ের বাঙালি সেনারা অবস্থান নেন কাউনিয়ায়। ৩১ মার্চ রংপুর সেনানিবাস থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স কাউনিয়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তখন ইপিআর সেনারা কৌশলগত কারণে পিছু হটে তিস্তা রেলসেতুর কুড়িগ্রাম প্রান্তে অবস্থান নেন। সেখানে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন লালমনিরহাট, কালিগঞ্জ, হাতিবান্দা, পাটগ্রাম ও কুড়িগ্রাম থেকে আসা ইপিআর সেনা, পুলিশ, আনসার ও ছাত্র-জনতা। তাঁরা রেলসেতুর মাঝের স্লিপার খুলে কুড়িগ্রাম প্রান্তে লাইনের ওপর গাছের গুঁড়ি ফেলে রাখেন। ১ এপ্রিল কাউনিয়া রেলস্টেশন থেকে একদল পাকিস্তানি সেনা ট্রেনে তিস্তা সেতু অভিমুখে যাত্রা করে। মুক্তিযোদ্ধারা (ইপিআর সেনা) সেতুর কুড়িগ্রাম প্রান্তে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের অপেক্ষায় ছিলেন। ট্রেন মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের আওতায় আসামাত্র তাঁরা একযোগে আক্রমণ চালান। পাকিস্তানি বাহিনীও পাল্টা আক্রমণ চালায়। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর এজাজ মোস্তফা, ১৫ জন সেনা ও কাউনিয়া থানার ওসি নিহত হন। বাকি পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এই সাফল্যে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বেড়ে যায়। অপরদিকে ওই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীা নতুন দল ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রংপুর সেনানিবাস থেকে পরদিন এসে আবার আক্রমণ চালায়। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর প্রথমে গোলাবর্ষণ করে। এতে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। ব্যাপক গোলাবর্ষণের মুখে বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা পাঁচ-সাত শ গজ পিছু হটে অবস্থান নেন। কিন্তু এরশাদ আলীসহ কয়েকজন নিজ নিজ বাংকারেই থাকেন। তাঁরা সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। তাঁদের অব্যর্থ গুলির নিশানায় পাকিস্তানি সেনারা কোনোভাবে এগোতে পারছিল না। যুদ্ধের একপর্যায়ে তাঁর এক সহযোদ্ধা (আতাহার আলী মল্লিক, বীর বিক্রম) শহীদ হন। এর কিছুক্ষণ পর এক ঝাঁক গুলি এসে লাগে তাঁর বুকে। এরশাদ আলী শহীদ হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দখল করে নেয়। সহযোদ্ধারা শহীদ দুজনের মরদেহ উদ্ধার করতে পারেননি। পরে তাঁদের মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
শহীদ এরশাদ আলী চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরের রংপুর উইংয়ে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ এরশাদ আলীকে মরণোত্তর বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৪৯।
শহীদ এরশাদ আলীর পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার (ডাক: কুতুবের হাট) বিষ্ণবপুর গ্রামে। বিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম আলী মিয়া। মা আসমতের নেছা। স্ত্রী মোসাম্মৎ নুরুন নেছা। তাঁর এক মেয়ে।
সূত্র: ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৬। ছবি: মুক্তিযুদ্ধে রাইফেলস ও অন্যান্য বাহিনী থেকে।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com
২৫ মার্চের পর রংপুর ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পরে বিডিআর, এখন বিজিবি) উইংয়ের বাঙালি সেনারা অবস্থান নেন কাউনিয়ায়। ৩১ মার্চ রংপুর সেনানিবাস থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স কাউনিয়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তখন ইপিআর সেনারা কৌশলগত কারণে পিছু হটে তিস্তা রেলসেতুর কুড়িগ্রাম প্রান্তে অবস্থান নেন। সেখানে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন লালমনিরহাট, কালিগঞ্জ, হাতিবান্দা, পাটগ্রাম ও কুড়িগ্রাম থেকে আসা ইপিআর সেনা, পুলিশ, আনসার ও ছাত্র-জনতা। তাঁরা রেলসেতুর মাঝের স্লিপার খুলে কুড়িগ্রাম প্রান্তে লাইনের ওপর গাছের গুঁড়ি ফেলে রাখেন। ১ এপ্রিল কাউনিয়া রেলস্টেশন থেকে একদল পাকিস্তানি সেনা ট্রেনে তিস্তা সেতু অভিমুখে যাত্রা করে। মুক্তিযোদ্ধারা (ইপিআর সেনা) সেতুর কুড়িগ্রাম প্রান্তে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের অপেক্ষায় ছিলেন। ট্রেন মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের আওতায় আসামাত্র তাঁরা একযোগে আক্রমণ চালান। পাকিস্তানি বাহিনীও পাল্টা আক্রমণ চালায়। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর এজাজ মোস্তফা, ১৫ জন সেনা ও কাউনিয়া থানার ওসি নিহত হন। বাকি পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এই সাফল্যে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বেড়ে যায়। অপরদিকে ওই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীা নতুন দল ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রংপুর সেনানিবাস থেকে পরদিন এসে আবার আক্রমণ চালায়। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর প্রথমে গোলাবর্ষণ করে। এতে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। ব্যাপক গোলাবর্ষণের মুখে বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা পাঁচ-সাত শ গজ পিছু হটে অবস্থান নেন। কিন্তু এরশাদ আলীসহ কয়েকজন নিজ নিজ বাংকারেই থাকেন। তাঁরা সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। তাঁদের অব্যর্থ গুলির নিশানায় পাকিস্তানি সেনারা কোনোভাবে এগোতে পারছিল না। যুদ্ধের একপর্যায়ে তাঁর এক সহযোদ্ধা (আতাহার আলী মল্লিক, বীর বিক্রম) শহীদ হন। এর কিছুক্ষণ পর এক ঝাঁক গুলি এসে লাগে তাঁর বুকে। এরশাদ আলী শহীদ হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দখল করে নেয়। সহযোদ্ধারা শহীদ দুজনের মরদেহ উদ্ধার করতে পারেননি। পরে তাঁদের মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
শহীদ এরশাদ আলী চাকরি করতেন ইপিআরে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরের রংপুর উইংয়ে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য শহীদ এরশাদ আলীকে মরণোত্তর বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৪৯।
শহীদ এরশাদ আলীর পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার (ডাক: কুতুবের হাট) বিষ্ণবপুর গ্রামে। বিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম আলী মিয়া। মা আসমতের নেছা। স্ত্রী মোসাম্মৎ নুরুন নেছা। তাঁর এক মেয়ে।
সূত্র: ফখরুল ইসলাম (নোয়াখালী) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৬। ছবি: মুক্তিযুদ্ধে রাইফেলস ও অন্যান্য বাহিনী থেকে।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com
No comments