সরল গরল- নাইকো-হোসেন! পদ্মা-হোসেন! by মিজানুর রহমান খান

মাদের পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য মন্ট্রিলের এসএনসি-লাভলিনের দপ্তরে হানা দেওয়া কানাডীয় কর্তৃপক্ষের নাম আরসিএমপি (রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ) ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি করাপশন ইউনিট। তাদের কপাল বটে। ছয় বছর কাজ করে এক হোসেনকে কাবু করতে না করতে হয়তো তাদের শ্রবণযন্ত্রে আঘাত হানছে আরেক হোসেন। নাইকোর পরে পদ্মা। মোটা দাগে দুই হোসেনের গল্প। একটি প্রমাণিত। আরেকটি অনুমাননির্ভর। নাইকো জোটের হোসেনকে (এ কে এম মোশাররফ হোসেন) ১,৯০,৯৮৪ কানাডীয় ডলার খরচ করে গাড়ি কিনে দিয়েছিল।

রাজসিক ভ্রমণ ও খানাপিনা ঘুষ দিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, মওকা পেতে প্রতিমন্ত্রীকে কাজে লাগানো। তারা তাদের ওয়েবসাইটে এটা প্রকাশ করে গত বছরের জুনে। গত সেপ্টেম্বরে ওই একই আরসিএমপি হানা দিল লাভলিনের দপ্তরে। বিশ্বব্যাংক কেন পদ্মা সেতু প্রকল্প আপাতত স্থগিত করেছে, তার কারণ ‘দুর্নীতি’ বলা হলেও বিষয়টি অস্পষ্ট। প্রথম আলোতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে মনে হতে পারে পদ্মাপচন জোট আমলেই ধরেছিল। আওয়ামী প্রচারযন্ত্র নানা রঙেঢঙে সেদিকে ইঙ্গিত করছে। কিন্তু আমরা এখন জানছি যে, তিনটি অভিযোগ তুলেছে বিশ্বব্যাংক। দুটি বিএনপি আমলের, আরেকটি হালের। অর্থাৎ পদ্মায় বিএনপি নেই।
১৩ অক্টোবর বিশ্বব্যাংকের আবাসিক পরিচালক ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘আমরা গোড়া থেকেই বলে আসছি “জুয়াচুরি এবং দুর্নীতির” (ফ্রড অ্যান্ড করাপশন) বিষয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আমরা অগ্রসর হব না। এবং সেটা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে।’
প্রধানমন্ত্রী এ পর্যন্ত দায়সারা তদন্তের নির্দেশ নিয়েছেন। এই তদন্তের সঙ্গে কোন পর্যায়ের, কতজন কর্মকর্তা জড়িত, তাঁদের কার্যপরিধি কী, তাঁরা কবে কখন কার কাছে রিপোর্ট দেবেন, সে বিষয়ে আমরা জানি না। হঠাৎ খবর পাই সেগুনবাগিচার নখদন্তহীন দুদক বিশ্বব্যাংকের কাছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়েছে। অর্থমন্ত্রী মুহিতও দুদককে অবহিত করতে বিশ্বব্যাংককে চিঠি দেবেন বলে ডেইলি স্টার রিপোর্ট বলছে।
নাইকো-হোসেনের টিকি ছুঁতে আমরা গলদঘর্ম। ক্ষমতায় নেই তাতেও। এখন পদ্মা-হোসেনের কী হবে। দেশের সীমান্তের বাইরে যদি নাইকোর দুর্নীতি হাতেনাতে এবং সন্দেহাতীতভাবে না ধরা পড়ত, তাহলে বাংলাদেশে এটা বিশ্বাস করানোও সম্ভব ছিল না। নিরুপায় হয়েও পাবলিককে মানতে হয় যে, নেত্রী হোসেনকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন।
দুই হোসেনের মধ্যে অনেক মিল। দুটোতেই কানাডীয় কোম্পানি। নাইকোর চেয়ে লাভলিন আরও বেশি শক্তিশালী। এ কোম্পানিটি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম। বিশ্ব রাজনীতির দাবা কোর্টেও তার পদচারণ আছে। কানাডীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গোপন লিবিয়া সফরের প্রতিনিধি থেকেছে লাভলিন। লাভলিন ধোয়া তুলসী পাতা নয়।
কানাডীয় টিভি গত ১৯ সেপ্টেম্বর জানিয়েছে, লাভলিনের প্রধান নির্বাহী পিয়েরে বলেছেন, লাভলিন বর্তমানে বাংলাদেশের একটি প্রকল্পের বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখছে। এর সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে আরসিএমপি সম্প্রতি অন্টারিয়তে লাভলিন অফিসে অভিযান চালিয়েছে। লাভলিনের বদনাম নতুন নয়। এমনকি ফ্রড বা প্রতারণার দায়ে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পে অংশগ্রহণে ইতিপূর্বে নিষিদ্ধ হয়েছিল তারা। সেপ্টেম্বরে ফাঁস হওয়া সে দেশের একটি টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন বলেছে, কুইবেকে সরকারি ঠিকা কাজের মূল্যবৃদ্ধিতে লাভলিনও জড়িত। টিভি প্রতিবেদনমতে, কুইবেকের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে গণতদন্ত অনুষ্ঠানে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। যদিও ওই প্রতিবেদনে লাভলিন ছাড়াও মন্ট্রিলের রাজনৈতিক দল ও সংঘটিত অপরাধ সংঘটনকারী শক্তির যোগসাজশ রয়েছে। এই প্রতিবেদন যে টাস্কফোর্স তৈরি করেছে, তারা প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগপ্রাপ্ত। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় যে কেউ একমত হবেন যে, ‘সম্ভবত সবচেয়ে বিস্ফোরক অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে লাভলিনের মতো নির্মাণ কোম্পানির সঙ্গে মাফিয়াদের যোগসাজশ রয়েছে। তারা নির্মাণ কোম্পানিগুলোর পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে হুমকি দিয়ে কিংবা ঠিকাদারি-প্রক্রিয়ায় লাল ফিতার দৌরাত্ম্য সৃষ্টি করে লাভলিনকে সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে।’
বিএনপির হোসেনকে দিয়ে নাইকো যা করিয়েছে আওয়ামী হোসেনকে দিয়ে লাভলিন তা-ই করিয়েছে বলেই অভিযোগ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের একজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ যিনি বিশ্বব্যাংক ও দাতা সংস্থার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সুপরিচিত, তিনি গতকাল লেখককে বলেছেন, একজন মন্ত্রীর কোম্পানি পদ্মা সেতু প্রকল্পের সার্বিক তদারকির জন্য ঠিকাদার বাছাই প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটিয়েছে। ওই কোম্পানি সম্ভাব্য বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে এ মর্মে চিঠি চালাচালি করেছে যে, ওই কাজ পেতে হলে তারা দরকারি সুবিধা দিতে পারে। এমন অস্বচ্ছতায় লাভলিন কাজ পায়। এতে বিদেশি প্রতিযোগীরা ক্ষুব্ধ হয়। তারা প্রমাণপত্র বিশ্বব্যাংকের কাছে হস্তান্তরও করেছে। ওই অর্থনীতিবিদ লেখককে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিষয়ে দুটি শব্দ ব্যবহার করছে। প্রথমটি ফ্রড দ্বিতীয়টি করাপশন। অর্থমন্ত্রীর গতকালের বক্তব্য কিন্তু অর্থনীতিবিদের কথাকেই আরও জোরালো করে। কারণ, তিনি বলেন, পদ্মা প্রকল্পে দুর্নীতি হয়নি অন্তত ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনে। বিশ্বব্যাংক এখানে অভিযোগও করেনি।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের মুখে আমরা বারংবার শুনেছি, প্রকল্পের কাজই শুরু হলো না, টাকা-পয়সা খরচ হলো না তাহলে দুর্নীতি হলো কী করে। এটা ঠিক যে, আমাদের দেশে দুর্নীতির গতর গন্ডারের চামড়ার মতোই এখনো এতটাই মোটা রয়ে গেছে যে, টাকা মারা ছাড়া অন্য সব দুর্নীতি পাত্তা পায় না। কিন্তু ওই অভিযোগ যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে পরিকল্পিতভাবে কোনো একটা কোম্পানিকে লোয়েস্ট বিডার বানানোও জুয়াচুরি। এটি দণ্ডনীয় প্রতারণা। একে অবশ্যই গুরুতর দুর্নীতি হিসেবেও আখ্যা দেওয়া চলে।
আমরা মনে রাখব যে, শিল্পোন্নত দেশের মোর্চা জি-সেভেনের মধ্যে কানাডা কিন্তু দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সুতরাং চ্যাম্পিয়নশিপের একটা মিল আছে। নাইকোতে আমরা দেখেছি, কানাডার লিবারেল পার্টির সিনেটর ম্যাক হার্ভ কি করে বাংলাদেশে ছুটে এসে নাইকোর পক্ষে নির্লজ্জ দালালি করেছেন। মন্ত্রিপাড়ায় দৌড়াদৌড়ি করেছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত তখনকার কানাডীয় হাইকমিশনার তাঁর বিবৃতিতে সিনেটর হার্ভের অনৈতিক কাণ্ড অকপটে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি ঢাকার হোটেলে ছুটে গেছেন। তাঁকে বলেছেন, আপনি কিছুতেই একটি কোম্পানির পক্ষে বাংলাদেশের মন্ত্রীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় যেতে পারেন না। কিন্তু তাঁকে আটকাতে পারিনি। তিনি এক রাতে বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে যান তাঁকে না জানিয়ে।
বাংলাদেশ ও কানাডাকে আমরা দুর্নীতির দুই মেরুর দুই চ্যাম্পিয়ন ধরে নিলে বলতে পারি, সিনেটর হার্ভকে কিন্তু জনগণের সামনে বিবৃতি দিতে হয়েছে। আমাদের এথিক্স কমিটি হোসেন বা মোরশেদ খানদের ডাকবে না। সিনেটের এথিক্স কমিটিতে নাইকো নিয়ে হার্ভ বক্তব্য দিয়েছেন। আরসিএমপি ছয় বছর তদন্ত চালিয়ে নাইকোকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। আদালতে ৯৪ লাখ ৯৯ হাজার ডলার দণ্ড দিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, কুইন্স বেঞ্চ নাইকোকে আগামী তিন বছর চোখে চোখে রাখবে। শর্ত হলো, তারা তাদের অডিট রিপোর্ট আদালতের কাছে জমা দেবে। আর গত জুনে কানাডার গ্লোব অ্যান্ড মেইল পত্রিকা জানিয়েছে, সিনেটর হার্ভের বিরুদ্ধে আরসিএমপি নতুন করে জনগণের অর্পিত বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধে তদন্ত শুরু করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ফেডারেল সরকারের জারি করা বিশেষ পাসপোর্ট ব্যবহার করে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন নাইকোর পক্ষে লবিং করতে। নাইকো এক বিবৃতিতে বলেছে, হার্ভকে তারা ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৬ সালের জুলাইয়ের মধ্যে ৬৫ হাজার ডলার দিয়েছিল ব্যক্তিগতভাবে, সিনেটর হিসেবে নয়।
পাঠক, আপনাদের কি এই সুরটা একটু চেনা চেনা লাগছে না। আমরা স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে আওয়ামী লীগের বিগত সরকারে ব্যক্তিগত বাণিজ্য সফর করতে দেখেছিলাম। সেবার তাঁকে শুধু সে কারণেই পদত্যাগ করতে হয়েছিল। এবার তিনি সততার সনদসহ নানা ধরনের কসরত করে টিকে থাকতে চাইছেন। তাঁর আসলে বিতর্ক এড়াতেই উচিত ছিল পদত্যাগ করা। তদন্তে যদি তাঁর সম্পৃক্ততা কোনোভাবেই প্রমাণিত না হয় তখন তিনি না হয় আবার পুনর্বহাল হবেন। মরিয়ার্টিকে তিনিই বলেছিলেন পদ্মা সেতু এই মেয়াদে শেষ করতে না পারলে প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বরখাস্ত করবেন বলে জানিয়েছেন। সার্বিক বিবেচনায় তিনি সরে দাঁড়ালে পদ্মা সেতু নিয়ে সৃষ্ট মেঘ কেটে যেতে পারে।
এক হোসেনের কারণে নাইকো কেলেঙ্কারি হয়েছিল। আরেক হোসেনের কারণে পদ্মা সেতুর কাজ আটকে থাকবে—তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। হোসেনের পর হোসেন নিয়ে জাতিকে যেন আর বিলাপ করতে না হয়।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.