সিডর by এম এ সাইদ খোকন
তখন রাত ৭টা ৪০ মিনিট
এম এ সাইদ খোকন, আমতলী (বরগুনা) থেকে: আজ সেই ভয়াল দিন। এই দিনে সিডরে লণ্ডভণ্ড হয়েছিল উপকূলীয় অঞ্চল। তখন রাত ৭টা ৪০ মিনিট। মহাবিপদ সংকেতের কথা শুনে আতঙ্কিত বরগুনা উপকূলের মানুষ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়া বইছে। সচেতন মানুষগুলো যেতে শুরু করলেন আশ্রয় কেন্দ্রে। বেশির ভাগ মানুষ থেকে যান বাড়িতে। তাদের ধারণা ছিল, কত ঝড়ই তো এলো-গেল, এবারও তাদের কিছু হবে না। সিডর আঘাত হানতে শুরু করলো উপকূলীয় এলাকায়। মানুষের ঘরবাড়ি যেন এখনই উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তার সঙ্গে যুক্ত হলো জলোচ্ছ্বাস। রাত সাড়ে ১০টার দিকে বঙ্গোপসাগরের সব পানি যমদূতের মতো এসে মানুষগুলোকে তছনছ করে দিলো। মাত্র ১০ মিনিটের জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের কয়েক হাজার মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। পুরো এলাকা হয়ে গেল লণ্ডভণ্ড। সকালে মনে হলো কিয়ামত হয়ে গেছে। চারদিকে ধ্বংসলীলা। লাশের পর লাশ পাওয়া যাচ্ছে। কবর দেয়ার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। এক একটি কবরে ২-৩ জনের লাশ ফেলে মাটিচাপা দেয়া হলো। সিডরের চার বছর পরেও নিহতের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সিডরে বরগুনা জেলায় ১ হাজার ৩৪৫ জন মানুষ মারা গেছে। নিখোঁজ রয়েছে আরও ১৫৬ জন। ৩০ হাজার ৪৯৯টি গবাদিপশু ও ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৫৯টি হাঁস-মুরগি মারা যায়। জেলার ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬১টি পরিবারের সবাই কমবেশি ক্ষতির শিকার হন। সম্পূর্ণভাবে গৃহহীন হয়ে পড়ে জেলার ৭৭ হাজার ৭৫৪টি পরিবার। বেসরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ৬শ’ জনের ওপরে।
মৃত্যুর কারণ: সিডরের সময় আবহাওয়া বিভাগের সতর্কবাণী যথাযথ ছিল না। আবহাওয়া অফিস ৪ নম্বর সতর্ক সংকেত থেকে হঠাৎ করে ১০ নম্বর বিপদ সংকেতের কথা ঘোষণা করে। মংলা সমুদ্র বন্দরকে কেন্দ্র করে যে সতর্ক সংকেত প্রচার করা হয়েছিল, তা বোঝার উপায় বরগুনার মানুষের ছিল না। রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকরা ছিল প্রায় নিষ্ক্রিয়। দু’-এক জায়গায় তারা মাইকিং করলেও বেশির ভাগ জায়গায়ই কোন রকম সংকেত প্রচার করা হয়নি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তথ্য অফিস মাইকিং করলেও তা ছিল শহর এলাকায় সীমাবদ্ধ। আবার যারা ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত শুনেছেন, তারাও পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্রের অভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারেননি। জাগো নারীর প্রধান নির্বাহী হোসনেয়ারা হাসি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সতর্ক সংকেত স্থানীয় ভাষায় বোধগম্য করে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য ঘূর্ণিঝড় সতর্ক কর্মসূচির আওতায় স্বেচ্ছাসেবকসহ বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে।
১৯ কবরে ৩৩ লাশ: বরগুনা সদর উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার নাম নলটোনা। যেখানে সিডরের এক বছর আগে থেকেই বেড়িবাঁধ ছিল না। সিডরের সময় সেখানে ২০ ফুটের মতো পানি বৃদ্ধি পেয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিনই সেখানে অর্ধশতাধিক মানুষের লাশ পাওয়া যায়। তখনও এলাকাটি পানির নিচে হাবুডুব খাচ্ছিল। লাশ দাফনের জন্য কোন স্থান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। লাশগুলো নিয়ে আসা হয় বরগুনা-নিশানবাড়িয়া সড়কের পাশে পশ্চিম গর্জনবুনিয়া গ্রামে। কাপনের কাপড় ছাড়াই ৩৩ জনকে ১৯টি কবরে মাটিচাপা দেয়া হয়। জায়গার অভাবে ৫টি কবরে ৩ জন করে ১৫ জন, ৪টি কবরে ২ জন করে ৮ জন ও ১০টি কবরে ১ জন করে ১০ জনের লাশ দাফন করা হয়। কবরগুলোকে একটু উঁচু করে রাখা হয়েছে। বরগুনা প্রেস ক্লাবের সহযোগিতায় স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা সংগ্রাম সমপ্রতি ইট দিয়ে কবরস্থানটি ঘিরে দিয়েছে। সারিবদ্ধ এসব কবর দেখে মানুষ এসে থমকে দাঁড়ায়। কেউ কেউ কান্না চেপে রাখতে পারেন না। সিডরের স্মৃতি হয়ে আছে কবরগুলো।
সিডর বিধ্বস্তদের কান্না এখনও থামেনি: শুধু গৃহহীনরাই নয়, স্বজন হারাদের কান্নাও থামেনি। ফালিশাতলী গ্রামের খালিদা বেগম এখনও দুই মেয়ের কবরের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করেন। ঝরনা ও শিরিনা নামের তার দুই মেয়ে ছিল। খালিদা আক্তার জানান, সিডরের রাতে তাদের ঘরটি ভেঙে গেলে আবদুস সোবহানের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেই ঘরটিও ভেঙে যায়। সাঁতরে তারা বাঁচার চেষ্টা করলেও ঝরনা ও শিরিনা মারা যায়। পানিতে এলাকা ডুবে থাকায় পরের দিন সকালে বেড়িবাঁধের পাশে মেয়ে দুটোকে দাফন করা হয়। নদীভাঙনের শিকার হয়ে মেয়ে দুটোর কবরও হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। মাঝেরচরের বিলকিস বেগম জানান, সিডরে তার মা জয়গুন বেগম, ভাবী খাদিজা আক্তার ও ভাইয়ের ছেলে আসিফ মারা গেছে। সিডরের সপ্তাহ খানেক পরে বিলকিসের পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে। নাম রাখা হয়েছে ‘সিডর’। সিডরের স্মৃতি নিয়েই সেই সিডর বড় হচ্ছে।
তবে বিলকিস জানালেন অন্য কষ্টের কথা। সিডরে তাদের পরিবারের কয়েকজন বেঁচে গেলেও লড়াই থেমে নেই। লড়াই করেই তাদের বেঁচে থাকতে হচ্ছে। অপরদিকে আলমগীর হোসেনের ছেলে রুবেল ও আবেদ আলীর ছেলে ইমরান হোসেন মামুনের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের এখন শ্রম বিক্রি করে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। সিডর বিধ্বস্তদের চাপা কান্না শোনা যাচ্ছে। নিম্নচাপের কথা শুনলেই উপকূলের মানুষ আঁতকে ওঠে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহির উদ্দিন জানান, সিডরের পরে আইলায় ১১.৪২ কি.মি. সম্পূর্ণ ও ৭৯.৪৪ কি.মি. বেড়িবাঁধ আংশিক ভেঙে যায়। বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আ. মালেক জানান, সিডর ও আইলায় বরগুনার ৪৮৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। তখন বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। যা দিয়ে ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া ১ হাজার ৪৪৮ মে. টন গমের মাধ্যমে ১০.৬৫৮ কি.মি. বাঁধ (অস্থায়ী প্রতিরক্ষা) মেরামত করা হয়েছে। পুরনো আদলে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হলে দেড়শ’ কোটি টাকা দরকার। তিনি আরও জানান, বরগুনা সদর উপজেলার পুরাকাটা, ডালভাঙ্গা, আমতলীর জয়ালভাঙ্গা, ঘটখালী, পাথরঘাটার পদ্মা ও রুহিতায় কোন বেড়িবাঁধ নেই। এসব এলাকার মানুষ দুর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে। তাছাড়া স্লুইসগেট নেই ১৬টি। এসব জায়গা দিয়ে এখনও পানি ঢুকে ফসলহানি হচ্ছে।
আজও ভুলিনি
শরিফুল হক শাহীন, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) থেকে: ১৫ই নভেম্বরের সেই ভয়াল দিনটির কথা উপকূলীয় এলাকার মানুষ আজও ভোলেনি। এই দিনে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যায় ইতিহাসের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। এতে উপকূলবর্তী কলাপাড়া উপজেলার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিধ্বস্ত হয় অসংখ্য ঘরবাড়ি। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সড়ক, বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা। কৃষি ও মৎস্য সম্পদেরও ক্ষতি হয় ব্যাপক। মারা যায় অনেক গবাদিপশু। সেই দিনটির কথা মনে করে এখনও আঁতকে ওঠে কলাপাড়ার মানুষ। কোনদিন ওই দুর্বিষহ স্মৃতির কথা ভুলতেও পারবে না। এ উপজেলার প্রত্যন্ত জনপদ ঘুরলে এখনও স্বজনহারা ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বিলাপ শোনা যায়। সিডরের ৭ বছর পূর্ণ হলেও বহু মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। সচল হয়নি অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য। কেউ কেউ অর্থাভাবে ফিরতে পারেনি নিজ পেশায়। কলাপাড়া উপজেলার মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের চর নজিব গ্রামের ইউসুফ মেকার (৫২)। বালিয়াতলী খেয়াঘাটে মেকারি করেন। তার ইতি (এক মাস) ও ইশিতা (৭) নামে দুই মেয়ে সিডরে মারা গেছে। কথা প্রসঙ্গে সে জানায়, ‘বছর ঘুইর্যা হেই দিন আইছে! মোনে পরে মাইয়্যা দুইডার কতা। এ্যাহনো আমরা ঠিক অইতে পারি নাই।’
লালুয়া ইউনিয়নের জেলে ইউনুস হাওলাদার (৫২) সিডরের দুই দিন আগে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। তার স্ত্রী সূর্য বানু (৫০) বলেন, ‘পোলাপানগুলা অর বাপেরে খোঁজে। হ্যার কতা মোনে অইলে কান্দি। জানি না হে বাইচ্যা আছে কিনা’। ওই ইউনিয়নের এমন আরও ছয়টি পরিবার স্বজন হারানোর বেদনায় পাগলপ্রায়। ওইসব পরিবারগুলোর পুরুষ সদস্যরা সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে নিখোঁজ হয়। খাপড়াভাঙ্গা ইউনিয়নের নুরপুুর গ্রামের আ. আউয়াল বয়াতি (৬০) বলেন, ‘বইন্যার রাইতের কতা মোনে অইলে এ্যাহনো গাও কাঁপে। হেই দিন কেয়ামত অইয়া গ্যাছে।’
সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, সিডরে কলাপাড়া উপজেলায় ৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে এক হাজার ৭৮ জন। এর মধ্যে প্রতিবন্ধী হয়েছে ৯৬ জন। বিধবা ১২। এতিম হয়েছে ২০টি শিশু। নিখোঁজ রয়েছে সাত জেলে। এই উপজেলার মৃত গবাদিপশুর সংখ্যা চার হাজার নয়শত ৪৪টি। ক্ষতি হয়েছে পাঁচশ’ ৫৩টি নৌযানের। ১২ হাজার নয়শত ৭০টি পরিবার হয়েছে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১৪ হাজার নয়শ’ ২৫টি।
মুহূর্তেই লণ্ডভণ্ড
নির্ঝর কান্তি বিশ্বাস ননী, বামনা (বরগুনা) থেকে: ২০০৭ সালের এই দিনে রাত ১২টায় ঘণ্টায় ১৮০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানা দমকা হাওয়া ও জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে বরগুনার বামনা উপজেলার সমগ্র উপকূল। যেদিকে চোখ পড়েছে সে দিকেই ধ্বংসস্তূপ দেখা গেছে। ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে বরগুনার বামনা উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিষখালী নদীরতীরবর্তী এ জনপদের ১৬ হাজার ৩২টি পরিবার সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ৫০ হাজার ২০৯ জন মানুষ দুর্যোগে পড়েন। ২১ হাজার ৭১৯ জন সম্পূর্র্র্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হন। সিডরে ৪৮ জন মানুষের প্রাণহানিসহ ২ হাজার ৬৫ জন মানুষ আহত হন। ১১ হাজার ৭৪৯টি বসতবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। ৪ হাজার ২৮৩টি বসতবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বরগুনার বামনা উপজেলা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরে বিধ্বস্ত হওয়ার ৭ বছর পরেও এ উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত অধিকাংশ পরিবারকে অদ্যাবধি পুনর্বাসনের আওতায় আনা হয়নি। ঘূর্ণিঝড় সিডরের বিধ্বস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায় পুনর্বাসনের যে কাজ হয়েছে তা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম। এখনও অনেক পরিবার গৃহহীন বসবাস করছে। সরজমিন দেখা গেছে, বামনা উপজেলা সদর ইউনিয়নের পুরনো বামনা গ্রামের সিডর দুর্গত আইউব আলী (৬৫) এখনও খুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। তিনি জানান, তার আসল বসতি বিষখালী নদীর পেটে বিলীন হয়ে যায়। সিডরের কয়েক বছর আগে আইউব আলী নদীতীরে খুপড়ি ঘর তুলে কোন মতে বসবাস করে আসছিলেন। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরে তার পুরো ঘরটি ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। আবার গৃহহীন হয়ে পড়েন। সিডরের পর একটি এক কক্ষের পুনর্বাসনের ঘরও তিনি পান। সেই ঘরে বসবাসের কোন উপায় নেই। অপরিসর আর বেড়াবিহীন এক কক্ষের ঘরে আর তার ঠাঁই মেলেনি। এখন ওই ঘর ছেড়ে নদীতীরে একটি খুপড়ি ঘরেই তিনি বাস করছেন। শুধু আইউব আলী নন, বামনা সদর ইউনিয়নের কালিকাবাড়ী গ্রামের বিধবা মনোয়ারা বেগম (৫৫) ঘূর্ণিঝড় সিডরে বিধ্বস্ত হওয়ার ৭ বছর পরেও এখনও পলিথিন টানিয়ে ঘরে বসবাস করছেন প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে। অর্থের অভাবে প্রতিবন্ধী ছেলে মো. সেলিমকে (২০) দুই মুঠো খাবার দিতে পারছেন না। এ ব্যাপারে কথা হয় দিনমজুর মো. ছগির সরদারের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর রাতের বন্যায় মোগো সব ভাসাইয়া নেছে বিষখালীর পানিতে, আমরা অনেক দিন না খেয়ে থাকছি। এহোনো তিনবেলা খাইতে পারি না। মোগো দুঃখ দেহার কেউ নাই।’ বামনা উপজেলার ৪৯টি গ্রামে ১৬ হাজার ৩২টি পরিবার সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে মাত্র ৩,২৩৫টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। ৫,৬৪৩টি পরিবার নিজস্ব অর্থায়নে গৃহ পুনঃনির্মাণ কোন রকম করেছে। তবে এখনও ৭ হাজার ১৫৪টি পরিবার রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে-পুড়ে গৃহহীন বসবাস করছে। তাদের অধিকাংশ পরিবারেই স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নেই। বিশুদ্ধ পানি ক্ষেত্রে ৩০টি পরিবারের জন্য রয়েছে একটি টিউবওয়েল। উপজেলার বুকাবুনিয়া এবং ডৌয়াতলা ইউনিয়নের যেসব স্থানে টিউবওয়েলের পানি পেতে সমস্যা সে এলাকায় ৪টি পিএসএফ থাকলেও সেগুলো বর্তমানে অকেজো। ফলে বিশুদ্ধ পানির অভাবে ওইসব এলাকার অধিকাংশ মানুষ ডায়রিয়াসহ জটিল রোগে ভুগছে। জাপান সরকারের অর্থ-সহায়তায় সিডর-পরবর্তী গৃহহীন মানুষের পুনর্বাসন সহায়তা হিসেবে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় উপকূলীয় বামনা উপজেলায় ৩০টি ব্যারাকে ৩০০ গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে এসব আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলে। সিডরের ৭ বছর পার হলেও এসব ঘরে দুর্গত মানুষের কষ্টের জীবনযাপনের কেউ খবর নেননি। এসব ব্যারাকে বসবাসকারীদের পানীয়জলের জন্য যেসব টিউবওয়েল বসানো হয়েছিল সেগুলো ছয় মাস পরেই অকেজো হয়ে পড়ে এবং স্বাস্থ্যসম্মত পায়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও ভেঙে পরে। ফলে ব্যারাকগুলোতে আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলো বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে ভুগছেন। আবাসনের ঘরের টিনের ছাউনি মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে বামনা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) এইচ এম মাহবুব হোসেন জানান, আমি বামনা উপজেলার আতিরিক্ত দায়িত্বে আছি। পরিপত্র না দেখে এ মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না। বামনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন সরকার জানান, ঘূর্ণিঝড় সিডরে গৃহহাড়া ছিন্নমূল মানুষরাই আবাসনগুলোতে বসবাস করে তাই কর্তৃপক্ষের উচিত আবাসনগুলো প্রতি দুই বছর পরপর সরজমিন গিয়ে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করা। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে সরজমিন পাঠিয়ে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে।
এম এ সাইদ খোকন, আমতলী (বরগুনা) থেকে: আজ সেই ভয়াল দিন। এই দিনে সিডরে লণ্ডভণ্ড হয়েছিল উপকূলীয় অঞ্চল। তখন রাত ৭টা ৪০ মিনিট। মহাবিপদ সংকেতের কথা শুনে আতঙ্কিত বরগুনা উপকূলের মানুষ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়া বইছে। সচেতন মানুষগুলো যেতে শুরু করলেন আশ্রয় কেন্দ্রে। বেশির ভাগ মানুষ থেকে যান বাড়িতে। তাদের ধারণা ছিল, কত ঝড়ই তো এলো-গেল, এবারও তাদের কিছু হবে না। সিডর আঘাত হানতে শুরু করলো উপকূলীয় এলাকায়। মানুষের ঘরবাড়ি যেন এখনই উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তার সঙ্গে যুক্ত হলো জলোচ্ছ্বাস। রাত সাড়ে ১০টার দিকে বঙ্গোপসাগরের সব পানি যমদূতের মতো এসে মানুষগুলোকে তছনছ করে দিলো। মাত্র ১০ মিনিটের জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের কয়েক হাজার মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। পুরো এলাকা হয়ে গেল লণ্ডভণ্ড। সকালে মনে হলো কিয়ামত হয়ে গেছে। চারদিকে ধ্বংসলীলা। লাশের পর লাশ পাওয়া যাচ্ছে। কবর দেয়ার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। এক একটি কবরে ২-৩ জনের লাশ ফেলে মাটিচাপা দেয়া হলো। সিডরের চার বছর পরেও নিহতের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সিডরে বরগুনা জেলায় ১ হাজার ৩৪৫ জন মানুষ মারা গেছে। নিখোঁজ রয়েছে আরও ১৫৬ জন। ৩০ হাজার ৪৯৯টি গবাদিপশু ও ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৫৯টি হাঁস-মুরগি মারা যায়। জেলার ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬১টি পরিবারের সবাই কমবেশি ক্ষতির শিকার হন। সম্পূর্ণভাবে গৃহহীন হয়ে পড়ে জেলার ৭৭ হাজার ৭৫৪টি পরিবার। বেসরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ৬শ’ জনের ওপরে।
মৃত্যুর কারণ: সিডরের সময় আবহাওয়া বিভাগের সতর্কবাণী যথাযথ ছিল না। আবহাওয়া অফিস ৪ নম্বর সতর্ক সংকেত থেকে হঠাৎ করে ১০ নম্বর বিপদ সংকেতের কথা ঘোষণা করে। মংলা সমুদ্র বন্দরকে কেন্দ্র করে যে সতর্ক সংকেত প্রচার করা হয়েছিল, তা বোঝার উপায় বরগুনার মানুষের ছিল না। রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকরা ছিল প্রায় নিষ্ক্রিয়। দু’-এক জায়গায় তারা মাইকিং করলেও বেশির ভাগ জায়গায়ই কোন রকম সংকেত প্রচার করা হয়নি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তথ্য অফিস মাইকিং করলেও তা ছিল শহর এলাকায় সীমাবদ্ধ। আবার যারা ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত শুনেছেন, তারাও পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্রের অভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারেননি। জাগো নারীর প্রধান নির্বাহী হোসনেয়ারা হাসি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সতর্ক সংকেত স্থানীয় ভাষায় বোধগম্য করে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য ঘূর্ণিঝড় সতর্ক কর্মসূচির আওতায় স্বেচ্ছাসেবকসহ বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে।
১৯ কবরে ৩৩ লাশ: বরগুনা সদর উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার নাম নলটোনা। যেখানে সিডরের এক বছর আগে থেকেই বেড়িবাঁধ ছিল না। সিডরের সময় সেখানে ২০ ফুটের মতো পানি বৃদ্ধি পেয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিনই সেখানে অর্ধশতাধিক মানুষের লাশ পাওয়া যায়। তখনও এলাকাটি পানির নিচে হাবুডুব খাচ্ছিল। লাশ দাফনের জন্য কোন স্থান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। লাশগুলো নিয়ে আসা হয় বরগুনা-নিশানবাড়িয়া সড়কের পাশে পশ্চিম গর্জনবুনিয়া গ্রামে। কাপনের কাপড় ছাড়াই ৩৩ জনকে ১৯টি কবরে মাটিচাপা দেয়া হয়। জায়গার অভাবে ৫টি কবরে ৩ জন করে ১৫ জন, ৪টি কবরে ২ জন করে ৮ জন ও ১০টি কবরে ১ জন করে ১০ জনের লাশ দাফন করা হয়। কবরগুলোকে একটু উঁচু করে রাখা হয়েছে। বরগুনা প্রেস ক্লাবের সহযোগিতায় স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা সংগ্রাম সমপ্রতি ইট দিয়ে কবরস্থানটি ঘিরে দিয়েছে। সারিবদ্ধ এসব কবর দেখে মানুষ এসে থমকে দাঁড়ায়। কেউ কেউ কান্না চেপে রাখতে পারেন না। সিডরের স্মৃতি হয়ে আছে কবরগুলো।
সিডর বিধ্বস্তদের কান্না এখনও থামেনি: শুধু গৃহহীনরাই নয়, স্বজন হারাদের কান্নাও থামেনি। ফালিশাতলী গ্রামের খালিদা বেগম এখনও দুই মেয়ের কবরের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করেন। ঝরনা ও শিরিনা নামের তার দুই মেয়ে ছিল। খালিদা আক্তার জানান, সিডরের রাতে তাদের ঘরটি ভেঙে গেলে আবদুস সোবহানের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেই ঘরটিও ভেঙে যায়। সাঁতরে তারা বাঁচার চেষ্টা করলেও ঝরনা ও শিরিনা মারা যায়। পানিতে এলাকা ডুবে থাকায় পরের দিন সকালে বেড়িবাঁধের পাশে মেয়ে দুটোকে দাফন করা হয়। নদীভাঙনের শিকার হয়ে মেয়ে দুটোর কবরও হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। মাঝেরচরের বিলকিস বেগম জানান, সিডরে তার মা জয়গুন বেগম, ভাবী খাদিজা আক্তার ও ভাইয়ের ছেলে আসিফ মারা গেছে। সিডরের সপ্তাহ খানেক পরে বিলকিসের পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে। নাম রাখা হয়েছে ‘সিডর’। সিডরের স্মৃতি নিয়েই সেই সিডর বড় হচ্ছে।
তবে বিলকিস জানালেন অন্য কষ্টের কথা। সিডরে তাদের পরিবারের কয়েকজন বেঁচে গেলেও লড়াই থেমে নেই। লড়াই করেই তাদের বেঁচে থাকতে হচ্ছে। অপরদিকে আলমগীর হোসেনের ছেলে রুবেল ও আবেদ আলীর ছেলে ইমরান হোসেন মামুনের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের এখন শ্রম বিক্রি করে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। সিডর বিধ্বস্তদের চাপা কান্না শোনা যাচ্ছে। নিম্নচাপের কথা শুনলেই উপকূলের মানুষ আঁতকে ওঠে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহির উদ্দিন জানান, সিডরের পরে আইলায় ১১.৪২ কি.মি. সম্পূর্ণ ও ৭৯.৪৪ কি.মি. বেড়িবাঁধ আংশিক ভেঙে যায়। বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আ. মালেক জানান, সিডর ও আইলায় বরগুনার ৪৮৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। তখন বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। যা দিয়ে ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া ১ হাজার ৪৪৮ মে. টন গমের মাধ্যমে ১০.৬৫৮ কি.মি. বাঁধ (অস্থায়ী প্রতিরক্ষা) মেরামত করা হয়েছে। পুরনো আদলে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হলে দেড়শ’ কোটি টাকা দরকার। তিনি আরও জানান, বরগুনা সদর উপজেলার পুরাকাটা, ডালভাঙ্গা, আমতলীর জয়ালভাঙ্গা, ঘটখালী, পাথরঘাটার পদ্মা ও রুহিতায় কোন বেড়িবাঁধ নেই। এসব এলাকার মানুষ দুর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে। তাছাড়া স্লুইসগেট নেই ১৬টি। এসব জায়গা দিয়ে এখনও পানি ঢুকে ফসলহানি হচ্ছে।
আজও ভুলিনি
শরিফুল হক শাহীন, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) থেকে: ১৫ই নভেম্বরের সেই ভয়াল দিনটির কথা উপকূলীয় এলাকার মানুষ আজও ভোলেনি। এই দিনে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যায় ইতিহাসের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। এতে উপকূলবর্তী কলাপাড়া উপজেলার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিধ্বস্ত হয় অসংখ্য ঘরবাড়ি। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সড়ক, বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা। কৃষি ও মৎস্য সম্পদেরও ক্ষতি হয় ব্যাপক। মারা যায় অনেক গবাদিপশু। সেই দিনটির কথা মনে করে এখনও আঁতকে ওঠে কলাপাড়ার মানুষ। কোনদিন ওই দুর্বিষহ স্মৃতির কথা ভুলতেও পারবে না। এ উপজেলার প্রত্যন্ত জনপদ ঘুরলে এখনও স্বজনহারা ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বিলাপ শোনা যায়। সিডরের ৭ বছর পূর্ণ হলেও বহু মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। সচল হয়নি অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য। কেউ কেউ অর্থাভাবে ফিরতে পারেনি নিজ পেশায়। কলাপাড়া উপজেলার মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের চর নজিব গ্রামের ইউসুফ মেকার (৫২)। বালিয়াতলী খেয়াঘাটে মেকারি করেন। তার ইতি (এক মাস) ও ইশিতা (৭) নামে দুই মেয়ে সিডরে মারা গেছে। কথা প্রসঙ্গে সে জানায়, ‘বছর ঘুইর্যা হেই দিন আইছে! মোনে পরে মাইয়্যা দুইডার কতা। এ্যাহনো আমরা ঠিক অইতে পারি নাই।’
লালুয়া ইউনিয়নের জেলে ইউনুস হাওলাদার (৫২) সিডরের দুই দিন আগে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। তার স্ত্রী সূর্য বানু (৫০) বলেন, ‘পোলাপানগুলা অর বাপেরে খোঁজে। হ্যার কতা মোনে অইলে কান্দি। জানি না হে বাইচ্যা আছে কিনা’। ওই ইউনিয়নের এমন আরও ছয়টি পরিবার স্বজন হারানোর বেদনায় পাগলপ্রায়। ওইসব পরিবারগুলোর পুরুষ সদস্যরা সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে নিখোঁজ হয়। খাপড়াভাঙ্গা ইউনিয়নের নুরপুুর গ্রামের আ. আউয়াল বয়াতি (৬০) বলেন, ‘বইন্যার রাইতের কতা মোনে অইলে এ্যাহনো গাও কাঁপে। হেই দিন কেয়ামত অইয়া গ্যাছে।’
সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, সিডরে কলাপাড়া উপজেলায় ৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে এক হাজার ৭৮ জন। এর মধ্যে প্রতিবন্ধী হয়েছে ৯৬ জন। বিধবা ১২। এতিম হয়েছে ২০টি শিশু। নিখোঁজ রয়েছে সাত জেলে। এই উপজেলার মৃত গবাদিপশুর সংখ্যা চার হাজার নয়শত ৪৪টি। ক্ষতি হয়েছে পাঁচশ’ ৫৩টি নৌযানের। ১২ হাজার নয়শত ৭০টি পরিবার হয়েছে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১৪ হাজার নয়শ’ ২৫টি।
মুহূর্তেই লণ্ডভণ্ড
নির্ঝর কান্তি বিশ্বাস ননী, বামনা (বরগুনা) থেকে: ২০০৭ সালের এই দিনে রাত ১২টায় ঘণ্টায় ১৮০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানা দমকা হাওয়া ও জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে বরগুনার বামনা উপজেলার সমগ্র উপকূল। যেদিকে চোখ পড়েছে সে দিকেই ধ্বংসস্তূপ দেখা গেছে। ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে বরগুনার বামনা উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিষখালী নদীরতীরবর্তী এ জনপদের ১৬ হাজার ৩২টি পরিবার সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ৫০ হাজার ২০৯ জন মানুষ দুর্যোগে পড়েন। ২১ হাজার ৭১৯ জন সম্পূর্র্র্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হন। সিডরে ৪৮ জন মানুষের প্রাণহানিসহ ২ হাজার ৬৫ জন মানুষ আহত হন। ১১ হাজার ৭৪৯টি বসতবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। ৪ হাজার ২৮৩টি বসতবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বরগুনার বামনা উপজেলা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরে বিধ্বস্ত হওয়ার ৭ বছর পরেও এ উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত অধিকাংশ পরিবারকে অদ্যাবধি পুনর্বাসনের আওতায় আনা হয়নি। ঘূর্ণিঝড় সিডরের বিধ্বস্ত পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায় পুনর্বাসনের যে কাজ হয়েছে তা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম। এখনও অনেক পরিবার গৃহহীন বসবাস করছে। সরজমিন দেখা গেছে, বামনা উপজেলা সদর ইউনিয়নের পুরনো বামনা গ্রামের সিডর দুর্গত আইউব আলী (৬৫) এখনও খুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। তিনি জানান, তার আসল বসতি বিষখালী নদীর পেটে বিলীন হয়ে যায়। সিডরের কয়েক বছর আগে আইউব আলী নদীতীরে খুপড়ি ঘর তুলে কোন মতে বসবাস করে আসছিলেন। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরে তার পুরো ঘরটি ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। আবার গৃহহীন হয়ে পড়েন। সিডরের পর একটি এক কক্ষের পুনর্বাসনের ঘরও তিনি পান। সেই ঘরে বসবাসের কোন উপায় নেই। অপরিসর আর বেড়াবিহীন এক কক্ষের ঘরে আর তার ঠাঁই মেলেনি। এখন ওই ঘর ছেড়ে নদীতীরে একটি খুপড়ি ঘরেই তিনি বাস করছেন। শুধু আইউব আলী নন, বামনা সদর ইউনিয়নের কালিকাবাড়ী গ্রামের বিধবা মনোয়ারা বেগম (৫৫) ঘূর্ণিঝড় সিডরে বিধ্বস্ত হওয়ার ৭ বছর পরেও এখনও পলিথিন টানিয়ে ঘরে বসবাস করছেন প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে। অর্থের অভাবে প্রতিবন্ধী ছেলে মো. সেলিমকে (২০) দুই মুঠো খাবার দিতে পারছেন না। এ ব্যাপারে কথা হয় দিনমজুর মো. ছগির সরদারের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর রাতের বন্যায় মোগো সব ভাসাইয়া নেছে বিষখালীর পানিতে, আমরা অনেক দিন না খেয়ে থাকছি। এহোনো তিনবেলা খাইতে পারি না। মোগো দুঃখ দেহার কেউ নাই।’ বামনা উপজেলার ৪৯টি গ্রামে ১৬ হাজার ৩২টি পরিবার সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে মাত্র ৩,২৩৫টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। ৫,৬৪৩টি পরিবার নিজস্ব অর্থায়নে গৃহ পুনঃনির্মাণ কোন রকম করেছে। তবে এখনও ৭ হাজার ১৫৪টি পরিবার রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে-পুড়ে গৃহহীন বসবাস করছে। তাদের অধিকাংশ পরিবারেই স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নেই। বিশুদ্ধ পানি ক্ষেত্রে ৩০টি পরিবারের জন্য রয়েছে একটি টিউবওয়েল। উপজেলার বুকাবুনিয়া এবং ডৌয়াতলা ইউনিয়নের যেসব স্থানে টিউবওয়েলের পানি পেতে সমস্যা সে এলাকায় ৪টি পিএসএফ থাকলেও সেগুলো বর্তমানে অকেজো। ফলে বিশুদ্ধ পানির অভাবে ওইসব এলাকার অধিকাংশ মানুষ ডায়রিয়াসহ জটিল রোগে ভুগছে। জাপান সরকারের অর্থ-সহায়তায় সিডর-পরবর্তী গৃহহীন মানুষের পুনর্বাসন সহায়তা হিসেবে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় উপকূলীয় বামনা উপজেলায় ৩০টি ব্যারাকে ৩০০ গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে এসব আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলে। সিডরের ৭ বছর পার হলেও এসব ঘরে দুর্গত মানুষের কষ্টের জীবনযাপনের কেউ খবর নেননি। এসব ব্যারাকে বসবাসকারীদের পানীয়জলের জন্য যেসব টিউবওয়েল বসানো হয়েছিল সেগুলো ছয় মাস পরেই অকেজো হয়ে পড়ে এবং স্বাস্থ্যসম্মত পায়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও ভেঙে পরে। ফলে ব্যারাকগুলোতে আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলো বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে ভুগছেন। আবাসনের ঘরের টিনের ছাউনি মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে বামনা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) এইচ এম মাহবুব হোসেন জানান, আমি বামনা উপজেলার আতিরিক্ত দায়িত্বে আছি। পরিপত্র না দেখে এ মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না। বামনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন সরকার জানান, ঘূর্ণিঝড় সিডরে গৃহহাড়া ছিন্নমূল মানুষরাই আবাসনগুলোতে বসবাস করে তাই কর্তৃপক্ষের উচিত আবাসনগুলো প্রতি দুই বছর পরপর সরজমিন গিয়ে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করা। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে সরজমিন পাঠিয়ে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে।
No comments