মধ্যবর্তী নির্বাচন চাইলেই হবে না কীভাবে সেটাও বলতে হবে by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক সংকট চলমান রয়েছে। সংকটটি জন্ম নিয়েছে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনটি ছিল গণতান্ত্রিক বিশ্বের সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসে নজিরবিহীন। নির্বাচনটি এমনই ব্যতিক্রমী ছিল যে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী একটি দল সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে। প্রধান বিরোধী দলের বর্জনের কারণে এবং অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দল নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় একটি বড় দলকে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ওই দলের কিছুসংখ্যক নেতাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়ে তাদের দিয়ে সংসদে একটি অভূতপূর্ব ও বিচিত্র বিরোধী দল সৃষ্টি করা হয়। এ নির্বাচনের অনিয়ম এবং নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃংখলা বাহিনীর ভূমিকা দেখার পর সাধারণ মানুষ নির্বাচনটির প্রতি একেবারেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এসব কারণে নামকাওয়াস্তের এ নির্বাচনটি যুগপৎ দেশে-বিদেশে একটি সাধারণ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মতো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সে কারণে এ নির্বাচনের ওপর ভর করে গঠিত সরকারও দেশে সমালোচনা ও আন্দোলন এবং বিদেশে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। বিরোধী দল থেকে এবং বন্ধুপ্রতিম গণতান্ত্রিক দেশগুলো থেকেও বারংবার একটি অংশগ্রহণমূলক স্বচ্ছ নির্বাচনের আয়োজন করতে বলা হচ্ছে। নাগরিকদের অনেকেই ভাবছেন, সরকার একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দিলে হয়তো চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হবে এবং দেশ আবার শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে।
সাধারণ মানুষের এ ধারণা একেবারেই ভুল। কারণ, একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের আয়োজন করলেই কেবল চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হবে না। পঞ্চদশ সংশোধনী-উত্তর সংবিধানের বিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে ও বর্তমান চরিত্রের নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে একটি কেন, পাঁচ-দশটি মধ্যবর্তী নির্বাচন করেও চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করা যাবে না। আর ওই রকম নির্বাচনে সংসদের বাইরের প্রধান ও প্রকৃত বিরোধী দল বিএনপি হয়তো অংশগ্রহণও করবে না। কারণ, এমন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে বিরোধী দলের পক্ষে মুখ রক্ষা করা সহজ হবে না। তখন বিএনপিকে স্বীকার করতে হবে যে, তারা তাহলে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে ভুল করেছিল। আরও স্বীকার করে নিতে হবে যে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে দশম সংসদ নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন করে দলটি ভুল করেছিল এবং ওই আন্দোলন করতে গিয়ে যারা আহত ও নিহত হয়েছিলেন এবং যে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সেজন্য তারাই দায়ী। এ রকম স্বীকারোক্তি করা আর নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা একই কথা। এ কাজ করলে দলটির জনসমর্থন কমে যাবে এবং দলটি নির্বাচনেও ভালো করতে পারবে না। এমন নির্বাচনে যদি তারা ভুল করে অংশগ্রহণ করেও, তাহলে দলটির জণসমর্থনও কমে যাবে। অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও বিএনপির পক্ষে ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবে না। আর প্রকৃত প্রধান বিরোধী দল ছাড়া কেবল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং শওকত হোসেন নিলুরা অংশগ্রহণ করলে ওই রকম মধ্যবর্তী নির্বাচন আবারও গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
কাজেই সরকার যদি চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আন্তরিক হতে চায়, তাহলে দলীয় সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের চিন্তা বাদ দিতে হবে। কারণ, এমন নির্বাচন করলে ওই নির্বাচনের স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা দিলেও কেউ বিশ্বাস করবে না। আর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসন ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকায় নির্বাচন যে কতটা দুর্নীতি-কারচুপিমুক্ত এবং অবাধ হতে পারবে সে বিষয়টি যুগপৎ দশম সংসদ নির্বাচন এবং তৎপরবর্তী চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই সরকার যদি মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে চলমান সংকটের সমাধান করতে চায়, তাহলে তাকে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে কেমন সরকারের অধীনে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হবে সে বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে। সরকারকে জনগণের মধ্যে এ বিশ্বাস আনতে হবে, যে মধ্যবর্তী নির্বাচন তারা করবে তা দশম সংসদ বা চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের মতো হবে না। এ কাজটি করতে হলে সরকারকে আগামী সংসদ নির্বাচন কেমন সরকারের অধীনে হবে, তার রূপরেখা তৈরি করতে হবে। এ কাজ করতে বেশ সময় লাগবে। সেজন্য সরকার যদি মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে চায়, তাহলে তাকে খুব বেশি দেরি না করেই ওই নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এবং সে লক্ষ্যে এখনই নির্বাচনকালীন সরকারের একটি গ্রহণযোগ্য রূপরেখা তৈরির লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অর্থবহ সংলাপ শুরু করতে হবে।
চলমান রাজনৈতিক সংকটটি যেহেতু বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা তৈরি করেছেন, কাজেই এর সমাধানও তাদেরই বের করতে হবে। এ লক্ষ্যে বিদেশীদের ওপর নির্ভর করে তাদের বেশি গুরুত্ব না দেয়াই ভালো। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এ দেশে এ ধরনের সংকট বিদেশীরা দূর করতে পারেনি। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে স্যার নিনিয়ান স্টিফেন এবং ২০১৩ সালে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা দেশবাসী বিস্মৃত হননি। কাজেই বিদেশীদের মাধ্যমে আলোচ্য সমস্যার সমাধান করার প্রচেষ্টা নিলে তাতে কেবল সময় নষ্ট করা হবে। তবে সরকার যদি বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতাকে পুঁজি করে ও জামায়াত-হেফাজতকে নিষ্ক্রিয় করার প্রয়াস নিয়ে চলমান সংকটের সমাধানে গড়িমসি করে, তাহলে সরকারি ফর্মুলায়ই যে রাজনৈতিক অংক চলবে এমনটি নাও হতে পারে। ভোটবঞ্চিত সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে মোনাফেকি করে নিয়ম রক্ষার নির্বাচনের পর আরেকটি নির্বাচন না দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে চাইলে যে কোনো সময় যে কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ হওয়ার সম্ভাবনাটি নাকচ করার মতো নয়। সরকার যদি এ বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের প্রলোভন দেখিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করার বিষয়টি অবহেলা করে, তাহলে তা এক রকমের বোকামি হবে।
বিশ্বায়নের যুগে বিদেশীদের দেশীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব দিতে না চাইলেও তাদের একেবারেই উপেক্ষা করে একাকী যা খুশি তা করার দিন আজ নেই। যেহেতু অন্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে মিলিমিশেই বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হবে, সে কারণে বহির্বিশ্বকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজের দেশে যা খুশি তাই করার সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। নিজে যা খুশি তাই করতে গেলে যে অনেক সময় তা সম্ভব হয় না সে বিষয়টি পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা প্রদান প্রত্যাহার করার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই বিরোধী দলকে আন্দোলন করতে না দিয়ে এবং তাদের হামলা-মামলায় পর্যুদস্ত করে এককভাবে দেশ পরিচালনা করতে চাইলে বিদেশী গণতান্ত্রিক বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো যে এ ব্যাপারে চুপ থাকবে না তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে বিদেশী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো সরকারকে বারবার সে ইঙ্গিত দিয়েছে। তারা অর্থবহ সংলাপ করে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের পরামর্শ দিলেও সরকার সে পরামর্শ গায়ে মাখছে না।
গণতান্ত্রিক বিশ্বের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনকে প্রথম থেকেই প্রশংসা করেনি। আজও ওই দেশগুলো তাদের সে অবস্থানে অনড় রয়েছে। গত ১১ মাসে যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই তারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে তাদের মনোভাব জানিয়ে দিয়েছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও নেতারা বিদেশ সফর করলে তাদের বারবার নতুন করে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দেয়া হচ্ছে। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী লিন ফেদারস্টোন ঢাকা সফরে এলে অবাধ নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে ওই রকম নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসার পরামর্শ দিয়েছেন। সরকারের তরফ থেকে এ রকম কোনো সংলাপের উদ্যোগ না থাকায় এ ব্রিটিশমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করে গেছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তার আগের অবস্থানে অনড় থেকে গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে অবিলম্বে সব পক্ষের অংশগ্রহণে একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ প্রদান অব্যাহত রেখেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার কোনো পরিবর্তন পরবর্তীকালে যে হয়নি, সে বিষয়টি অক্টোবরে ওয়াশিংটন ডিসিতে আমেরিকান সিকিউরিটি প্রজেক্ট আয়োজিত বাংলাদেশ : প্রসপেক্টস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস শীর্ষক সেমিনারে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের উপ-সহকারী মন্ত্রী ট্যাড ব্রাউন আবারও নিশ্চিত করেছেন। এ মাসের শেষ সপ্তাহে কাঠমুন্ডুর সার্ক সম্মেলন শেষ করে দুদিনের জন্য আবারও ঢাকায় আসছেন সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। তিনি ঢাকা এসে একই সুরে আবারও যে চলমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও সে লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থবহ সংলাপের তাগিদ দিয়ে যাবেন, তা আগেই বলে দেয়া যায়।
ভোটাধিকারবঞ্চিত সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়ায় এবং বন্ধুপ্রতিম গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মনোভাবে কোনো পরিবর্তন না দেখে সরকার বুঝতে পেরেছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ওপর ভর করে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার প্রচেষ্টা যুগপৎ দেশে ও বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তির ক্ষতি করছে। সেজন্য সরকারের অনেক নেতা-মন্ত্রী ২০১৯ সালের আগে সংসদ নির্বাচন হবে না বলে বক্তব্য দিলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে এসে নির্বাচন সময়মতো হবে বলে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের মধ্যে অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক অংশগ্রহণমূলক মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইঙ্গিত খুঁজে পাচ্ছেন। আবারও বলতে হচ্ছে, সরকার কেবল মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে কোনো সাফল্য দাবি করতে পারবে না এবং এমন নির্বাচনে চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধানও হবে না। সরকার চলমান সংকট নিরসনের কৃতিত্ব কেবল তখনই দাবি করতে পারবে, যখন সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে একটি নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার উদ্ভাবন করতে পারবে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সাধারণ মানুষের এ ধারণা একেবারেই ভুল। কারণ, একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের আয়োজন করলেই কেবল চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হবে না। পঞ্চদশ সংশোধনী-উত্তর সংবিধানের বিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে ও বর্তমান চরিত্রের নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে একটি কেন, পাঁচ-দশটি মধ্যবর্তী নির্বাচন করেও চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করা যাবে না। আর ওই রকম নির্বাচনে সংসদের বাইরের প্রধান ও প্রকৃত বিরোধী দল বিএনপি হয়তো অংশগ্রহণও করবে না। কারণ, এমন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে বিরোধী দলের পক্ষে মুখ রক্ষা করা সহজ হবে না। তখন বিএনপিকে স্বীকার করতে হবে যে, তারা তাহলে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে ভুল করেছিল। আরও স্বীকার করে নিতে হবে যে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে দশম সংসদ নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন করে দলটি ভুল করেছিল এবং ওই আন্দোলন করতে গিয়ে যারা আহত ও নিহত হয়েছিলেন এবং যে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সেজন্য তারাই দায়ী। এ রকম স্বীকারোক্তি করা আর নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা একই কথা। এ কাজ করলে দলটির জনসমর্থন কমে যাবে এবং দলটি নির্বাচনেও ভালো করতে পারবে না। এমন নির্বাচনে যদি তারা ভুল করে অংশগ্রহণ করেও, তাহলে দলটির জণসমর্থনও কমে যাবে। অর্থাৎ দলীয় সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও বিএনপির পক্ষে ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবে না। আর প্রকৃত প্রধান বিরোধী দল ছাড়া কেবল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং শওকত হোসেন নিলুরা অংশগ্রহণ করলে ওই রকম মধ্যবর্তী নির্বাচন আবারও গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
কাজেই সরকার যদি চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আন্তরিক হতে চায়, তাহলে দলীয় সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনের চিন্তা বাদ দিতে হবে। কারণ, এমন নির্বাচন করলে ওই নির্বাচনের স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা দিলেও কেউ বিশ্বাস করবে না। আর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসন ও আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকায় নির্বাচন যে কতটা দুর্নীতি-কারচুপিমুক্ত এবং অবাধ হতে পারবে সে বিষয়টি যুগপৎ দশম সংসদ নির্বাচন এবং তৎপরবর্তী চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই সরকার যদি মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে চলমান সংকটের সমাধান করতে চায়, তাহলে তাকে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে কেমন সরকারের অধীনে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হবে সে বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে। সরকারকে জনগণের মধ্যে এ বিশ্বাস আনতে হবে, যে মধ্যবর্তী নির্বাচন তারা করবে তা দশম সংসদ বা চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের মতো হবে না। এ কাজটি করতে হলে সরকারকে আগামী সংসদ নির্বাচন কেমন সরকারের অধীনে হবে, তার রূপরেখা তৈরি করতে হবে। এ কাজ করতে বেশ সময় লাগবে। সেজন্য সরকার যদি মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে চায়, তাহলে তাকে খুব বেশি দেরি না করেই ওই নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এবং সে লক্ষ্যে এখনই নির্বাচনকালীন সরকারের একটি গ্রহণযোগ্য রূপরেখা তৈরির লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অর্থবহ সংলাপ শুরু করতে হবে।
চলমান রাজনৈতিক সংকটটি যেহেতু বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা তৈরি করেছেন, কাজেই এর সমাধানও তাদেরই বের করতে হবে। এ লক্ষ্যে বিদেশীদের ওপর নির্ভর করে তাদের বেশি গুরুত্ব না দেয়াই ভালো। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এ দেশে এ ধরনের সংকট বিদেশীরা দূর করতে পারেনি। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে স্যার নিনিয়ান স্টিফেন এবং ২০১৩ সালে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা দেশবাসী বিস্মৃত হননি। কাজেই বিদেশীদের মাধ্যমে আলোচ্য সমস্যার সমাধান করার প্রচেষ্টা নিলে তাতে কেবল সময় নষ্ট করা হবে। তবে সরকার যদি বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতাকে পুঁজি করে ও জামায়াত-হেফাজতকে নিষ্ক্রিয় করার প্রয়াস নিয়ে চলমান সংকটের সমাধানে গড়িমসি করে, তাহলে সরকারি ফর্মুলায়ই যে রাজনৈতিক অংক চলবে এমনটি নাও হতে পারে। ভোটবঞ্চিত সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে মোনাফেকি করে নিয়ম রক্ষার নির্বাচনের পর আরেকটি নির্বাচন না দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে চাইলে যে কোনো সময় যে কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে মানুষের ক্ষোভের বিস্ফোরণ হওয়ার সম্ভাবনাটি নাকচ করার মতো নয়। সরকার যদি এ বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের প্রলোভন দেখিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করার বিষয়টি অবহেলা করে, তাহলে তা এক রকমের বোকামি হবে।
বিশ্বায়নের যুগে বিদেশীদের দেশীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব দিতে না চাইলেও তাদের একেবারেই উপেক্ষা করে একাকী যা খুশি তা করার দিন আজ নেই। যেহেতু অন্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে মিলিমিশেই বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হবে, সে কারণে বহির্বিশ্বকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজের দেশে যা খুশি তাই করার সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। নিজে যা খুশি তাই করতে গেলে যে অনেক সময় তা সম্ভব হয় না সে বিষয়টি পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা প্রদান প্রত্যাহার করার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই বিরোধী দলকে আন্দোলন করতে না দিয়ে এবং তাদের হামলা-মামলায় পর্যুদস্ত করে এককভাবে দেশ পরিচালনা করতে চাইলে বিদেশী গণতান্ত্রিক বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো যে এ ব্যাপারে চুপ থাকবে না তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে বিদেশী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো সরকারকে বারবার সে ইঙ্গিত দিয়েছে। তারা অর্থবহ সংলাপ করে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের পরামর্শ দিলেও সরকার সে পরামর্শ গায়ে মাখছে না।
গণতান্ত্রিক বিশ্বের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনকে প্রথম থেকেই প্রশংসা করেনি। আজও ওই দেশগুলো তাদের সে অবস্থানে অনড় রয়েছে। গত ১১ মাসে যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই তারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে তাদের মনোভাব জানিয়ে দিয়েছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও নেতারা বিদেশ সফর করলে তাদের বারবার নতুন করে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দেয়া হচ্ছে। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী লিন ফেদারস্টোন ঢাকা সফরে এলে অবাধ নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে ওই রকম নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসার পরামর্শ দিয়েছেন। সরকারের তরফ থেকে এ রকম কোনো সংলাপের উদ্যোগ না থাকায় এ ব্রিটিশমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করে গেছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তার আগের অবস্থানে অনড় থেকে গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে অবিলম্বে সব পক্ষের অংশগ্রহণে একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ প্রদান অব্যাহত রেখেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার কোনো পরিবর্তন পরবর্তীকালে যে হয়নি, সে বিষয়টি অক্টোবরে ওয়াশিংটন ডিসিতে আমেরিকান সিকিউরিটি প্রজেক্ট আয়োজিত বাংলাদেশ : প্রসপেক্টস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস শীর্ষক সেমিনারে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের উপ-সহকারী মন্ত্রী ট্যাড ব্রাউন আবারও নিশ্চিত করেছেন। এ মাসের শেষ সপ্তাহে কাঠমুন্ডুর সার্ক সম্মেলন শেষ করে দুদিনের জন্য আবারও ঢাকায় আসছেন সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। তিনি ঢাকা এসে একই সুরে আবারও যে চলমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও সে লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থবহ সংলাপের তাগিদ দিয়ে যাবেন, তা আগেই বলে দেয়া যায়।
ভোটাধিকারবঞ্চিত সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়ায় এবং বন্ধুপ্রতিম গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মনোভাবে কোনো পরিবর্তন না দেখে সরকার বুঝতে পেরেছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ওপর ভর করে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার প্রচেষ্টা যুগপৎ দেশে ও বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তির ক্ষতি করছে। সেজন্য সরকারের অনেক নেতা-মন্ত্রী ২০১৯ সালের আগে সংসদ নির্বাচন হবে না বলে বক্তব্য দিলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মধ্যপ্রাচ্য ঘুরে এসে নির্বাচন সময়মতো হবে বলে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের মধ্যে অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক অংশগ্রহণমূলক মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইঙ্গিত খুঁজে পাচ্ছেন। আবারও বলতে হচ্ছে, সরকার কেবল মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে কোনো সাফল্য দাবি করতে পারবে না এবং এমন নির্বাচনে চলমান রাজনৈতিক সংকটের সমাধানও হবে না। সরকার চলমান সংকট নিরসনের কৃতিত্ব কেবল তখনই দাবি করতে পারবে, যখন সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে একটি নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার উদ্ভাবন করতে পারবে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments