গাঁয়ের যোগী ভিখ পায় না! by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
কবি নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন, এই দুর্ভাগা জাতি দেশের ঠাকুর রেখে বিদেশী কুকুর বরণ করতে কুণ্ঠা করবে না। তাই নিজের স্বপ্নের কথা বলেছেন- ‘কতরূপে স্নেহ করি দেশের কুকুর ধরি বিদেশের ঠাকুর ত্যাজিয়া’। আমরা মধ্য আয়ের দেশ হতে চাই। আমরা অচিরেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চাই। আমরা স্বাবলম্বী হতে চাই। তবে সব ক্ষেত্রেই বিদেশী পরামর্শক প্রয়োজন। যদিও বিদেশী পরামর্শক আর বিশেষজ্ঞ যে শুধু কাড়ি কাড়ি টাকা নিতে পারে এবং যুগ যুগ ধরে সমস্যা জিইয়ে রাখে, তার ভূরিভূরি উদাহরণ রয়েছে। এই তো সেদিন বাংলাদেশ বিমানকে লাভের মুখ দেখানোর জন্য এক বিদেশী ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনা হয়েছিল। পত্রিকান্তরে জানা গেল, বিমানকে বেহাল রেখেই তিনি সরে পড়েছেন। যমুনা সেতু তৈরির কিছুদিনের মধ্যেই ফাটল ধরেছে। বিদেশী বিশেষজ্ঞরা নির্বাচন কমিশনে একই কাজ করার জন্য একাধিক প্রকল্পের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকেও মিলিয়ন ডলারের প্রকল্পে সম্ভবত বিএ পাস বিশেষজ্ঞ আকাশ স্পর্শ করা বেতনে চাকরি করেছেন, সঙ্গে তার স্ত্রীও চড়া বেতনে।
আমরা শুধু ভারত থেকে নয়, এখন শ্রীলংকা থেকেও কম্পিউটারের পরামর্শক আনা শুরু করেছি। মিয়ানমার আর নেপাল শুধু সময়ের ব্যাপার। অন্তত সেই প্রকল্পগুলো যে সফলতার মুখ দেখেনি, তা না জেনেও বলা যায়। কারণ, সফল হলে শুধু তারা নয়, তাদের উত্তরাধিকারীরাও আমাদের দেশের সস্তা রোজগার থেকে নিজেদের বঞ্চিত করত না। রাজনৈতিক হানাহানির দেশে যখন বিদেশের ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ অনিশ্চিত পরিবেশে পরামর্শক হিসেবে আসে, তখন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কোনো কারণ নেই যে, নিজের দেশে তাদের কাজের অভাব, উপরন্তু আমাদের দেশে আকাশচুম্বী বেতন।
একবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে একজন প্রবাসী বাংলাদেশীর চাকরির সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। অনেক টাকা বেতন। কিন্তু যখন তার সার্টিফিকেট দেখতে চাচ্ছিলাম, তা আর পাওয়া যাচ্ছিল না। যাও একটা পাওয়া গেল তার চল্লিশ ভাগ লেখা মুছে গেছে। আমি ভালো একটি কপি দাবি করে চলে এলাম। পরদিন সকালে একজন এসে আমার বিভাগে মাস্টার্স করার সম্ভাবনা যাচাই করছিল। তার সার্টিফিকেট আর ওই দামি প্রবাসী বিশেষজ্ঞের শিক্ষা জীবনের শেষ সার্টিফিকেট এক হওয়ায় আমি ধারণা পেলাম, নিজের দেশে নিজেদের কী পরিমাণ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেই না আমরা চলেছি। অথচ আমাদের স্নাতকেরা বিদেশে সুনামের সঙ্গে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নয়, ইন্ডাস্ট্রিতেও কাজ করছে এবং অনেকেই শুধু আমাদের ডিগ্রি নিয়েই। স্বদেশী পণ্য এবং উৎপাদনমুখী নীতি অনুসরণ করে মানসম্পন্ন ব্লেড তৈরিতে অপারগ ভারত প্রথম এশীয় দেশ হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে মঙ্গল গ্রহে রকেট পাঠিয়েছে। এর আগে তাদের রকেট চাঁদে পানির অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণা করেছে। আমরা আগেও বিদেশী পণ্য, বিশেষজ্ঞ ও সেবায় ধন্য হয়েছি, এখনও তাই। ব্যবধান এটুকু যে, আগে বিদেশ বলতে জাপান, জার্মানি, আমেরিকা বোঝাত; আর এখন বিদেশ আমাদের অনেক কাছে- মালয়েশিয়া, ভারত, শ্রীলংকা কিংবা থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ।
কয়েকদিন আগে যে সারা দেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটল, তার সমাধান নাকি বিদেশী পরামর্শক নিয়োগ! টিভিতে তাই দেখতে পেলাম। ২০০৭ সালেও এমন বিপর্যয় ঘটেছিল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা সমস্যা চিহ্নিত করে সুপারিশও করেছিলেন, যার কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। বাঙালরা কি আর এ সবকিছু বোঝে? বিদেশী হলে অবশ্য যে কোনো রঙের হলেও পারে! অথচ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ গর্ব করার মতো মেধাবী শিক্ষকে সমৃদ্ধ। এই বিভাগের স্নাতকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আইইই-এর ফেলো, বার্কলেসহ নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আবার আমেরিকার বিখ্যাত ইলেকট্রিক পাওয়ার রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. আরশাদ মনসুর হলেন বিদ্যুৎ ব্যবস্থার নামকরা গবেষক। এবারের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পরপরই জনপ্রিয় সাহিত্যিক-কলামিস্ট আনিসুল হক এ সমস্যায় তার ভূমিকার কথা উল্লেখ করে আমাদের দেশেও প্রয়োজনে তার সহযোগিতার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।
আমরা দেশটি ঠিকঠাকই চালাতে পারছি, তবে শুধু গর্বের প্রতীক আদমজী জুট মিল চালাতে না পেরে বন্ধ করে দেই, কখনওবা বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের মতো একেবারেই গৃহস্থালির কাজও বিদেশীদের দিয়ে করানোর উদ্যোগ নেই, অথবা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা থাইদের হাতে ছেড়ে দিতে চাই। এ কাজগুলো বিদেশীদের দিলে কখনও নিজেরা শিখতে পারব না। কোনো দেশই আমাদের সেই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তাদের কাজ ছেড়ে দেবে না। নিজেদের কাজ নিজেদেরই করতে হবে, তা যত আনাড়িভাবেই আমরা পারি না কেন। এক প্রজন্মের ত্যাগ ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ বাংলাদেশের গোড়াপত্তন করবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আর ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা না থাকলে জন্মজন্মান্তর আমাদের উত্তরসূরিরা উন্নয়নশীল দেশের ছাপ কপালে নিয়ে নিগৃহীত হবে।
স্বাধীনতার পর ৪০ বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। এভাবে পরমুখাপেক্ষী থাকায় কোনো গৌরব নেই, বরং বিস্তর গ্লানি আছে। জাতি হিসেবে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চাই। আমাদের মেরুদণ্ড যতই দুর্বল হোক না কেন, এর ওপর ভর করেই শির উন্নত করে আমরা দাঁড়াতে চাই। বিদেশ-বিভূঁইয়ে অনাত্মীয় পরিবেশে, এমনকি উন্নত চিকিৎসার জন্য শুধু নিজেরা নয়, আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতাদেরও মরতে দিতে চাই না। নিজের দেশে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে মরতে মরতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বাঁচাতে ও বাঁচতে শিখে যাবে।
ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ : অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
আমরা শুধু ভারত থেকে নয়, এখন শ্রীলংকা থেকেও কম্পিউটারের পরামর্শক আনা শুরু করেছি। মিয়ানমার আর নেপাল শুধু সময়ের ব্যাপার। অন্তত সেই প্রকল্পগুলো যে সফলতার মুখ দেখেনি, তা না জেনেও বলা যায়। কারণ, সফল হলে শুধু তারা নয়, তাদের উত্তরাধিকারীরাও আমাদের দেশের সস্তা রোজগার থেকে নিজেদের বঞ্চিত করত না। রাজনৈতিক হানাহানির দেশে যখন বিদেশের ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ অনিশ্চিত পরিবেশে পরামর্শক হিসেবে আসে, তখন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কোনো কারণ নেই যে, নিজের দেশে তাদের কাজের অভাব, উপরন্তু আমাদের দেশে আকাশচুম্বী বেতন।
একবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে একজন প্রবাসী বাংলাদেশীর চাকরির সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। অনেক টাকা বেতন। কিন্তু যখন তার সার্টিফিকেট দেখতে চাচ্ছিলাম, তা আর পাওয়া যাচ্ছিল না। যাও একটা পাওয়া গেল তার চল্লিশ ভাগ লেখা মুছে গেছে। আমি ভালো একটি কপি দাবি করে চলে এলাম। পরদিন সকালে একজন এসে আমার বিভাগে মাস্টার্স করার সম্ভাবনা যাচাই করছিল। তার সার্টিফিকেট আর ওই দামি প্রবাসী বিশেষজ্ঞের শিক্ষা জীবনের শেষ সার্টিফিকেট এক হওয়ায় আমি ধারণা পেলাম, নিজের দেশে নিজেদের কী পরিমাণ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেই না আমরা চলেছি। অথচ আমাদের স্নাতকেরা বিদেশে সুনামের সঙ্গে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নয়, ইন্ডাস্ট্রিতেও কাজ করছে এবং অনেকেই শুধু আমাদের ডিগ্রি নিয়েই। স্বদেশী পণ্য এবং উৎপাদনমুখী নীতি অনুসরণ করে মানসম্পন্ন ব্লেড তৈরিতে অপারগ ভারত প্রথম এশীয় দেশ হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে মঙ্গল গ্রহে রকেট পাঠিয়েছে। এর আগে তাদের রকেট চাঁদে পানির অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণা করেছে। আমরা আগেও বিদেশী পণ্য, বিশেষজ্ঞ ও সেবায় ধন্য হয়েছি, এখনও তাই। ব্যবধান এটুকু যে, আগে বিদেশ বলতে জাপান, জার্মানি, আমেরিকা বোঝাত; আর এখন বিদেশ আমাদের অনেক কাছে- মালয়েশিয়া, ভারত, শ্রীলংকা কিংবা থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ।
কয়েকদিন আগে যে সারা দেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটল, তার সমাধান নাকি বিদেশী পরামর্শক নিয়োগ! টিভিতে তাই দেখতে পেলাম। ২০০৭ সালেও এমন বিপর্যয় ঘটেছিল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা সমস্যা চিহ্নিত করে সুপারিশও করেছিলেন, যার কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। বাঙালরা কি আর এ সবকিছু বোঝে? বিদেশী হলে অবশ্য যে কোনো রঙের হলেও পারে! অথচ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ গর্ব করার মতো মেধাবী শিক্ষকে সমৃদ্ধ। এই বিভাগের স্নাতকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আইইই-এর ফেলো, বার্কলেসহ নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আবার আমেরিকার বিখ্যাত ইলেকট্রিক পাওয়ার রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. আরশাদ মনসুর হলেন বিদ্যুৎ ব্যবস্থার নামকরা গবেষক। এবারের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পরপরই জনপ্রিয় সাহিত্যিক-কলামিস্ট আনিসুল হক এ সমস্যায় তার ভূমিকার কথা উল্লেখ করে আমাদের দেশেও প্রয়োজনে তার সহযোগিতার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।
আমরা দেশটি ঠিকঠাকই চালাতে পারছি, তবে শুধু গর্বের প্রতীক আদমজী জুট মিল চালাতে না পেরে বন্ধ করে দেই, কখনওবা বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের মতো একেবারেই গৃহস্থালির কাজও বিদেশীদের দিয়ে করানোর উদ্যোগ নেই, অথবা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা থাইদের হাতে ছেড়ে দিতে চাই। এ কাজগুলো বিদেশীদের দিলে কখনও নিজেরা শিখতে পারব না। কোনো দেশই আমাদের সেই অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তাদের কাজ ছেড়ে দেবে না। নিজেদের কাজ নিজেদেরই করতে হবে, তা যত আনাড়িভাবেই আমরা পারি না কেন। এক প্রজন্মের ত্যাগ ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ বাংলাদেশের গোড়াপত্তন করবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আর ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা না থাকলে জন্মজন্মান্তর আমাদের উত্তরসূরিরা উন্নয়নশীল দেশের ছাপ কপালে নিয়ে নিগৃহীত হবে।
স্বাধীনতার পর ৪০ বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। এভাবে পরমুখাপেক্ষী থাকায় কোনো গৌরব নেই, বরং বিস্তর গ্লানি আছে। জাতি হিসেবে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চাই। আমাদের মেরুদণ্ড যতই দুর্বল হোক না কেন, এর ওপর ভর করেই শির উন্নত করে আমরা দাঁড়াতে চাই। বিদেশ-বিভূঁইয়ে অনাত্মীয় পরিবেশে, এমনকি উন্নত চিকিৎসার জন্য শুধু নিজেরা নয়, আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতাদেরও মরতে দিতে চাই না। নিজের দেশে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে মরতে মরতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বাঁচাতে ও বাঁচতে শিখে যাবে।
ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ : অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
No comments