রোহিঙ্গাবান্ধব একান্ন ব্যক্তি চিহ্নিত
রোহিঙ্গাদের ভোটার বানাতে সহায়তা করছেন বাংলাদেশেরই ৫১ প্রভাবশালী ব্যক্তি। রাজনৈতিক স্বার্থসহ নানা কারণে এরা অসংখ্য রোহিঙ্গাকে জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিয়েছেন। এদের মধ্যে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং দালাল শ্রেণীর লোকজন আছে।
রোহিঙ্গাবান্ধব ওই ৫১ ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। চিঠির সঙ্গে ৫১ জনের নাম ও ঠিকানাসহ প্রতিবেদনও পাঠানো হয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র বাতিল এবং ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্বাচন কমিশনকেও চিঠি দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, কক্সবাজার এবং বান্দরবান জেলায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়ছে। নাফ নদী পার হয়ে তারা সরাসরি কক্সবাজার জেলায় এসে আশ্রয় নিচ্ছে। পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে বান্দরবানসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সরকারের নীতিনির্ধারণী সূত্র নিশ্চিত করেছে কক্সবাজার ও বান্দরবানে অবস্থানরত ৪৩৮ রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করেছেন। দুই জেলার ভোটার তালিকা যাচাই-বাছাই করে প্রাথমিকভাবে রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করা হয়েছে। এদের নাম বাদ দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এর বাইরেও অনেক রোহিঙ্গা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে। যারা স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। বাংলাদেশে ভোটার, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং প্রয়োজনে পাসপোর্টও সংগ্রহ করেছে। এরা বিদেশে গিয়ে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এদের কারণে বিশ্বের শ্রমবাজারে বাংলাদেশী শ্রমিকের ভাবমূর্তি কিছুটা নষ্ট হয়েছে। আগামীতে পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য জেলার ভোটার তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করে তাদের নাম বাদ দেয়া হবে বলে জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ প্রতিবেদনে ভোটার তালিকায় নাম আছে, জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছে এবং সবুজ পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গাদের দ্রুত শনাক্তের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। তাদের চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট তালিকা থেকে বাদ দেয়ার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠনের কথা বলা হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি অনুসন্ধান শেষে এ সংক্রান্ত সুপারিশ করবে। আগামীতে রোহিঙ্গাদের স্থানীয়ভাবে যাতে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া না হয় এবং ভোটার তালিকায় নাম দেয়ার সুযোগ না পায় সে জন্য ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, কক্সবাজার জেলায় যেসব রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছে তাদের মধ্যে ৩৮৯ জনের নামের একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি বান্দরবানে তথ্য গোপন করে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা চালানো ৪৯ জন রোহিঙ্গার নামের তালিকাও আলাদা দফতর দুটিতে পাঠানো হয়।
রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কৌশল উল্লেখ করে এ প্রতিবেদনে বলা হয়- প্রথমে এসব রোহিঙ্গা অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে উখিয়ার কুতুপালং, টেকনাফের নয়াপাড়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির, কুতুপালং টাল বস্তি, লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির, টেকনাফের শ্যামলাপুর সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন বস্তিসহ বাংলাদেশে অবস্থারত আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি ও বিভিন্ন ভাড়া বাসায় অবস্থান নেয়। বছরের পর বছর বসবাস করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় স্থায়ীভাবে কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থান ও বনভূমি দখল করে। অর্থের বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে নাগরিকত্ব সনদ/জন্ম নিবন্ধন সনদ নিয়ে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। এছাড়াও বাংলাদেশী ছেলে-মেয়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শ্বশুরকুলের পরিচয়েও অনেক সময় নাগরিক সনদ ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। যদিও বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশীদের বিবাহ নিষিদ্ধ রয়েছে।
সম্প্রতি কক্সবাজারসহ কয়েকটি জেলায় ভোটার তালিকা প্রণয়নের জন্য বিশেষ বাছাই কমিটি গঠনের ফলে রোহিঙ্গারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে সেখানে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে তারা চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফসহ বিভিন্ন স্থানের ঠিকানায় নির্বাচন কমিশনের ১৪নং ফরম পূরণ করে নাম স্থানান্তর করছেন।
কক্সবাজার ও বান্দরবানে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে মন্তব্য করে প্রতিবেদনে বলা হয়- নতুন করে যারা আবেদন করছে তাদের অনেকের আত্মীয়-স্বজন আগে থেকেই বাংলাদেশে বসবাস করায় সহজেই ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। এসব রোহিঙ্গা বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হওয়াসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
রোহিঙ্গাবান্ধব তালিকায় যাদের নাম : রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে সহযোগিতাকারী ৫১ ব্যক্তির নামের তালিকার শীর্ষে আছেন কক্সবাজার-৪ আসনের সরকারদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদি। কক্সবাজার সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি জিএম রহিমুল্লাহ এবং টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদের নামও তালিকায় আছে। এছাড়া টেকনাফ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রফিক উল্লাহ ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ইউনুস বাঙালির নাম রয়েছে। বাহারছড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মৌলভী আজিজের নাম রয়েছে এ তালিকায়।
একজন সাবেকসহ ৭ ইউপি চেয়ারম্যানের নাম রোহিঙ্গাবান্ধব তালিকায় আছে। এরা হলেন- টেকনাফের হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান মাস্টার মীর কাশেম, সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান হামিদুর রহমান, বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান হাবিব উল্লাহ, সেন্টমার্টিন ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আমীন, উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী, চকরিয়ার ডুলহাজারা ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী ও টেকনাফের হ্নীলা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান এইচকে আনোয়ার। তালিকায় একজন প্যানেল মেয়রসহ ৮ পৌর কাউন্সিলরের নাম রয়েছে। এরা হলেন- টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মৌলভী মুজিবুর রহমান, কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইউনুস (রোহিঙ্গা), আবু হারেছ, একরামুল হক, হাসান আহমদ, নুরুল বশর, রুবিনা আক্তার ও কক্সবাজার পৌর কাউন্সিলর আশরাফুল হুদা সিদ্দিকী জামশেদ।
তালিকায় টেকনাফ ও চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ২০ জন সদস্যের নাম রয়েছে। তাদের মধ্যে সাবরাং ইউনিয়নের মো. ইসমাইল, আবদুস সালাম ও নুর মোহাম্মদ। টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হামজালাল ও খুরশিদা বেগম। সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের আবুল বশর, আবদুর রহমান, সামসুল আলম ও কবির আহমদ। হ্নীলা ইউনিয়নের আলী আহমদ, আবুল হোসেন ও শফিক আহমদ। বাহারছড়া ইউনিয়নের জোসনা বেগম ও হোয়াইক্যাং ইউনিয়নের জাহেদ হোসাইনের নাম রয়েছে। এ ছাড়াও তালিকায় চকরিয়া উপজেলার ডুলহাজারা ইউনিয়নের মোহাম্মদ সোলায়মান, আবদুর রহিম ও জসিম উদ্দিনের নাম রয়েছে। পাশাপাশি খুটাখালী ইউনিয়নের ছৈয়দ নুর, শফিকুর রহমান ও খলিলুর রহমানের নামও রয়েছে তালিকায়। এছাড়াও তালিকায় কক্সবাজার ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্সের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম, দালাল সৈয়দ আলম প্রকাশ এবং স্থানীয় প্রভাবশালী মো. ইসমাইল, ইসলাম শিকদার ও মৌলভী বখতিয়ারের নাম রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ভোটার বানাতে সহায়তাকারী হিসেবে বান্দরবান উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মাইনুল হকের নামও রয়েছে। এছাড়া নাইক্ষ্যংছড়ির দক্ষিণ চাকঢালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সু শংকর রুদ্র, বাইশারী তুফান আলী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শহিদুল ইসলাম, আশারতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক উ ক্য চিং মাস্টার ও বিছামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. সাইফুল ইসলামের নাম রয়েছে। তারা সবাই যাচাই-বাছাই চলাকালীন সময়ে তথ্য সংগ্রহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে : প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় বসবাস করছে। তাদের অনেকেই জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। তারা ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসা, অস্ত্র চোরাচালান, মানবপাচার ও নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। স্থানীয়ভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি শ্রমবাজারও দখল করছে। স্থানীয় দালাল, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট সংগ্রহ এবং ভোটার তালিকা হালনাগাদের নামে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্তির সঙ্গে কিছু অসাধু তথ্য সংগ্রহকারী ও নির্বাচন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
রোহিঙ্গাবান্ধব ওই ৫১ ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। চিঠির সঙ্গে ৫১ জনের নাম ও ঠিকানাসহ প্রতিবেদনও পাঠানো হয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র বাতিল এবং ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্বাচন কমিশনকেও চিঠি দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, কক্সবাজার এবং বান্দরবান জেলায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়ছে। নাফ নদী পার হয়ে তারা সরাসরি কক্সবাজার জেলায় এসে আশ্রয় নিচ্ছে। পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে বান্দরবানসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সরকারের নীতিনির্ধারণী সূত্র নিশ্চিত করেছে কক্সবাজার ও বান্দরবানে অবস্থানরত ৪৩৮ রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করেছেন। দুই জেলার ভোটার তালিকা যাচাই-বাছাই করে প্রাথমিকভাবে রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করা হয়েছে। এদের নাম বাদ দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এর বাইরেও অনেক রোহিঙ্গা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে। যারা স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। বাংলাদেশে ভোটার, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং প্রয়োজনে পাসপোর্টও সংগ্রহ করেছে। এরা বিদেশে গিয়ে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এদের কারণে বিশ্বের শ্রমবাজারে বাংলাদেশী শ্রমিকের ভাবমূর্তি কিছুটা নষ্ট হয়েছে। আগামীতে পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য জেলার ভোটার তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করে তাদের নাম বাদ দেয়া হবে বলে জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ প্রতিবেদনে ভোটার তালিকায় নাম আছে, জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছে এবং সবুজ পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গাদের দ্রুত শনাক্তের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। তাদের চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট তালিকা থেকে বাদ দেয়ার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠনের কথা বলা হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি অনুসন্ধান শেষে এ সংক্রান্ত সুপারিশ করবে। আগামীতে রোহিঙ্গাদের স্থানীয়ভাবে যাতে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া না হয় এবং ভোটার তালিকায় নাম দেয়ার সুযোগ না পায় সে জন্য ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, কক্সবাজার জেলায় যেসব রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছে তাদের মধ্যে ৩৮৯ জনের নামের একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি বান্দরবানে তথ্য গোপন করে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা চালানো ৪৯ জন রোহিঙ্গার নামের তালিকাও আলাদা দফতর দুটিতে পাঠানো হয়।
রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কৌশল উল্লেখ করে এ প্রতিবেদনে বলা হয়- প্রথমে এসব রোহিঙ্গা অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে উখিয়ার কুতুপালং, টেকনাফের নয়াপাড়া নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির, কুতুপালং টাল বস্তি, লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির, টেকনাফের শ্যামলাপুর সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন বস্তিসহ বাংলাদেশে অবস্থারত আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি ও বিভিন্ন ভাড়া বাসায় অবস্থান নেয়। বছরের পর বছর বসবাস করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় স্থায়ীভাবে কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থান ও বনভূমি দখল করে। অর্থের বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে নাগরিকত্ব সনদ/জন্ম নিবন্ধন সনদ নিয়ে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। এছাড়াও বাংলাদেশী ছেলে-মেয়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শ্বশুরকুলের পরিচয়েও অনেক সময় নাগরিক সনদ ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। যদিও বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশীদের বিবাহ নিষিদ্ধ রয়েছে।
সম্প্রতি কক্সবাজারসহ কয়েকটি জেলায় ভোটার তালিকা প্রণয়নের জন্য বিশেষ বাছাই কমিটি গঠনের ফলে রোহিঙ্গারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে সেখানে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে তারা চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফসহ বিভিন্ন স্থানের ঠিকানায় নির্বাচন কমিশনের ১৪নং ফরম পূরণ করে নাম স্থানান্তর করছেন।
কক্সবাজার ও বান্দরবানে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে মন্তব্য করে প্রতিবেদনে বলা হয়- নতুন করে যারা আবেদন করছে তাদের অনেকের আত্মীয়-স্বজন আগে থেকেই বাংলাদেশে বসবাস করায় সহজেই ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। এসব রোহিঙ্গা বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হওয়াসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
রোহিঙ্গাবান্ধব তালিকায় যাদের নাম : রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে সহযোগিতাকারী ৫১ ব্যক্তির নামের তালিকার শীর্ষে আছেন কক্সবাজার-৪ আসনের সরকারদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদি। কক্সবাজার সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি জিএম রহিমুল্লাহ এবং টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদের নামও তালিকায় আছে। এছাড়া টেকনাফ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রফিক উল্লাহ ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ইউনুস বাঙালির নাম রয়েছে। বাহারছড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মৌলভী আজিজের নাম রয়েছে এ তালিকায়।
একজন সাবেকসহ ৭ ইউপি চেয়ারম্যানের নাম রোহিঙ্গাবান্ধব তালিকায় আছে। এরা হলেন- টেকনাফের হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান মাস্টার মীর কাশেম, সাবরাং ইউপি চেয়ারম্যান হামিদুর রহমান, বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান হাবিব উল্লাহ, সেন্টমার্টিন ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আমীন, উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী, চকরিয়ার ডুলহাজারা ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী ও টেকনাফের হ্নীলা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান এইচকে আনোয়ার। তালিকায় একজন প্যানেল মেয়রসহ ৮ পৌর কাউন্সিলরের নাম রয়েছে। এরা হলেন- টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মৌলভী মুজিবুর রহমান, কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইউনুস (রোহিঙ্গা), আবু হারেছ, একরামুল হক, হাসান আহমদ, নুরুল বশর, রুবিনা আক্তার ও কক্সবাজার পৌর কাউন্সিলর আশরাফুল হুদা সিদ্দিকী জামশেদ।
তালিকায় টেকনাফ ও চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ২০ জন সদস্যের নাম রয়েছে। তাদের মধ্যে সাবরাং ইউনিয়নের মো. ইসমাইল, আবদুস সালাম ও নুর মোহাম্মদ। টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হামজালাল ও খুরশিদা বেগম। সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের আবুল বশর, আবদুর রহমান, সামসুল আলম ও কবির আহমদ। হ্নীলা ইউনিয়নের আলী আহমদ, আবুল হোসেন ও শফিক আহমদ। বাহারছড়া ইউনিয়নের জোসনা বেগম ও হোয়াইক্যাং ইউনিয়নের জাহেদ হোসাইনের নাম রয়েছে। এ ছাড়াও তালিকায় চকরিয়া উপজেলার ডুলহাজারা ইউনিয়নের মোহাম্মদ সোলায়মান, আবদুর রহিম ও জসিম উদ্দিনের নাম রয়েছে। পাশাপাশি খুটাখালী ইউনিয়নের ছৈয়দ নুর, শফিকুর রহমান ও খলিলুর রহমানের নামও রয়েছে তালিকায়। এছাড়াও তালিকায় কক্সবাজার ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্সের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম, দালাল সৈয়দ আলম প্রকাশ এবং স্থানীয় প্রভাবশালী মো. ইসমাইল, ইসলাম শিকদার ও মৌলভী বখতিয়ারের নাম রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ভোটার বানাতে সহায়তাকারী হিসেবে বান্দরবান উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মাইনুল হকের নামও রয়েছে। এছাড়া নাইক্ষ্যংছড়ির দক্ষিণ চাকঢালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সু শংকর রুদ্র, বাইশারী তুফান আলী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শহিদুল ইসলাম, আশারতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক উ ক্য চিং মাস্টার ও বিছামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. সাইফুল ইসলামের নাম রয়েছে। তারা সবাই যাচাই-বাছাই চলাকালীন সময়ে তথ্য সংগ্রহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে : প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় বসবাস করছে। তাদের অনেকেই জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। তারা ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসা, অস্ত্র চোরাচালান, মানবপাচার ও নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। স্থানীয়ভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি শ্রমবাজারও দখল করছে। স্থানীয় দালাল, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট সংগ্রহ এবং ভোটার তালিকা হালনাগাদের নামে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্তির সঙ্গে কিছু অসাধু তথ্য সংগ্রহকারী ও নির্বাচন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
No comments