ধর্ম ও সময়ের প্রত্যাশাগুলো by সৈয়দা নীলুফার
ধর্ম বলতে বুঝি উপাসনা বা ইবাদত পদ্ধতি। আচার-আচরণ, ইহকাল-পরকাল ইত্যাদি বিষয়ের নির্দেশ ও তত্ত্ব। ইংরেজিতে একইভাবে Religion বলতে বুঝানো হয়েছে The belief in the existence of God or Gods and the activities that are connected with the worship of them.. চিন্তাশীল মানুষ সৃষ্টির আদিকাল থেকে জানতে আগ্রহী হয়েছে সৃষ্টি সম্পর্কে, স্রষ্টা সম্পর্কে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন ও স্রষ্টার শক্তির প্রকাশ বিবেচনায় তারা বটবৃক্ষের পূজা করেছে। পর্বতের পূজা করেছে। চন্দ্র-সূর্য ও স্রোতস্বিনীর স্রোতধারার প্রখরতাকে পূজা করেছে। সমাজ বিবর্তনের ধারায় বুদ্ধিবৃত্তিক ও জ্ঞান বিকাশের সাথে সাথে সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে গূঢ় তত্ত্ব জানতে মানুষ আরো বেশি আগ্রহী হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে মানুষ উপলব্ধি করতে পারে ধর্মের মূল ভিত্তি হলো বিবেক। এই চিন্তা-চেতনা, ভাবনা ও বিবেকের জিজ্ঞাসার কারণেই সৃষ্টি হয়েছে হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিষ্ট ধর্ম ও ইসলাম ধর্ম। প্রত্যেক ধর্মেই কিছু মূল নীতি রয়েছে, তা তার অনুসারীরা পালন করে থাকেন। প্রসঙ্গ সংস্কৃতি বইটিতে মোহাম্মদ সোলায়মান সুন্দরভাবে ধর্মের ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তিনি লিখেছেন ধ হলো ধারণ করা; কিন্তু ধর্ম শব্দের ধ কী ধারণ করে? ইহা ধারণ করে ম্ম অর্থাৎ মর্ম। মর্ম হলো সারবস্তু। মানুষের সমগ্র চিন্তাধারা ও কার্যাবলির গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্তা হলো তার বিবেক। আর বিবেক হলো মানুষের মর্ম বা সারবস্তু। ধর্ম সম্বন্ধে টিএস ইলিয়ট মত প্রকাশ করেছেন এভাবে A religion as the whole way of life of people from birth to the grave from morning to night and even sleep, and that way of life is culture. ধর্ম হলো মানুষের একটি পূর্ণ জীবন পদ্ধতি। জন্ম থেকে সমাধি পর্যন্ত সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এমনকি ঘুমও এর অন্তর্ভুক্ত এবং এই ধরনের জীবন পদ্ধতি হলো সংস্কৃতি।
ধর্ম নিয়ে এ আলোচনার পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলাম ধর্মের বর্তমান অবস্থা কেমন? অধিকাংশ জনগণের কাছে খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয় বললে ভুল বলা হবে না। ধর্মনিরপেক্ষতা প্রদর্শন করতে গিয়ে আমরা অনেকেই ধর্মহীনতা রোগে ভুগছি। ব্রিটিশ আমলের মতো মুসলিম সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন চালাতে সাহায্য করছেন অতি প্রগতিবাদী কিছু মুসলমান। বাঙালিত্বের নামে এ ধরনের প্রচেষ্টা সত্যিকারের মুসলমানদের কষ্ট দেয়। অতীতে পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে মুসলমানদের হিন্দু সংস্কৃতি কিভাবে প্রভাবান্বিত করেছিল তার সুন্দর চিত্র মীর মশাররফ হোসেন তার ‘জীবন কথায়’ তারুণ্যচিত্র আঁকতে গিয়ে লিখেছেন ‘ধূতি পরিতে শিখিলাম চাদর বা উড়ানী গায়ে দেওয়া অভ্যাস হইল। মাথার চুল ছাঁটিয়া ফ্যাশনেবল করিলাম। পিছনের দিকে কিছুই নাই। পাজামা চাপকান বাড়ী পাঠাইয়া দিলাম। টুপিটাও ক’দিন পর সহপাঠীরা আগুনে পোড়াইয়া দিলো।’ বর্তমানে আমাদের কিছু মানুষের ধারণা এ ধরনের পোশাক পরিচ্ছদ ধর্মের ওপর তেমন আঘাত হানে না। তবে মুসলিম সংস্কৃতি বলতে আলাদা কিছু আছে এখানে সেটা উপেক্ষিত হয়েছে, সেটাই লেখক প্রকাশ করতে চেয়েছেন; কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে ধর্মের ওপর সংস্কৃতির ওপর যেভাবে নগ্ন হস্তক্ষেপ চলছে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমরা চাই যার যার ধর্ম যার যার সংস্কৃতি দুটো পরস্পর কাছাকাছি প্রবহমান সমুদ্রের মতো নির্বিঘেœ প্রবাহিত হোক। কোনো রকম চাপিয়ে দেয়া সংস্কৃতি বর্জন করা হোক। তবেই সবার সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে।
ইসলামী রীতিনীতির প্রতি অবজ্ঞা, অত্যন্ত জৌলুসপূর্ণ জীবনযাপন, ন্যায়-অন্যায়বোধের তোয়াক্কা না করা, মূল্যবোধের অবক্ষয় সমাজকে এক অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এরই ফলে দেখতে পাই ঐশীর মতো মেয়ে মা-বাবাকে খুন করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেনি। ধর্মহীন জীবন ধেয়ে চলেছে পাগলা ঘোড়ার মতো মৃত্যুর গহ্বরে। ধর্মের সাথে আধুনিকতার ও বিজ্ঞানের কোনো বৈরিতা নেই। তার দুটো উজ্জ্বল উদাহরণ এখানে তুলে ধরছি। সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী নিউটন যিনি পদার্থবিজ্ঞান, আলোবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা ও গতিবিজ্ঞানের এত উন্নতি সাধন করেছেন তিনিও ছিলেন এক বড় ধার্মিক ব্যক্তি। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন যার শৈশব কেটেছিল নবম দশম শতকে মুসলিম শাসন আমলে তার লেখা Out of my later years শেষ বছরগুলো বইটিতে বিজ্ঞান ও ধর্ম সম্বন্ধে সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনিও ছিলেন আস্তিকবাদী ধার্মিক ব্যক্তি।
ধর্মনিরপেক্ষতার আবরণে আমরা আমাদের ৮০০ বছরের মুসলমান শাসনের গৌরবময় অধ্যায়কে মুছে ফেলতে চেষ্টা করছি। আমরা আমাদের সন্তানসন্ততিদের কৌশলে তাদের ধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। অতীতের জাতীয় বীরদের গৌরবগাথা, পূর্বপুরুষদের গৌরবময় কাজ, কীর্তিকথা থেকে তারা যেন অনুপ্রেরণা না পায় শিক্ষাক্ষেত্রে সে ব্যবস্থা করে রেখেছি। তরুণ সম্প্রদায় যাতে সাংস্কৃতিক উৎসমূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র জাতীয় চেতনায় সমৃদ্ধি লাভ করতে না পারে তার জন্য চেষ্টাও অব্যাহত রেখেছি, তাই এখন সময়ের দাবি নতুন প্রজন্মকে সব কিছু জানাতে উদ্যোগ নিতে হবে। কিভাবে স্যার সৈয়দ আহমদ, কবি আল্লামা ইকবাল, কাজী নজরুল ইসলাম হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য কী নিরলস প্রচেষ্টাই চালিয়েছিলেন তা তাদের কাছে তুলে ধরা হবে। তারা জেনে অনুপ্রাণিত হবে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য মৌলানা মুহাম্মদ আলী, হাকিম আজমল, ড. এস এ আনসারী, ব্যারিস্টার আসিফ আলী, মৌলানা হযরত সোহানী যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার জন্য ধর্মের ওপর আমাদের অবশ্যই গুরুত্বারোপ করতে হবে। কারণ গাছের গোড়া কেটে (ধর্মকে গুরুত্বহীন রেখে) মৃতগাছ থেকে কখনো কোনো ফল আশা করা যায় না। এই তো কিছু দিন আগে আজান নিয়ে, রাসূল সা:কে নিয়ে, ধর্ম নিয়ে কত অশ্রাব্য কথা বলা হলো। তাদের তো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হলো না, বরঞ্চ সত্য কথা বলার জন্য নিরপরাধ ব্যক্তিকে নির্দয়ভাবে কারাগারে আটকিয়ে রাখা হলো, যা হওয়ার হয়েছে বর্তমানে তাকে ছেড়ে দিয়ে মানবতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হোক এটা জনগণের দাবি। লতিফ সিদ্দিকী হজ, রাসূল সা: ও তাবলিগ নিয়ে যেভাবে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের মনে আঘাত দিয়েছেন তা নিন্দনীয় ও কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তার শাস্তি এখন অধিকাংশ জনগণের দাবি। কারণ তিনি বিশ্বের ২১৪ কোটি মুসলমানের মনে তীব্র আঘাত হেনেছেন। তার মন্ত্রিত্ব ও সদস্যপদ বাতিল করলে সরকারের সঠিক দায়িত্ব পালন করা হবে। তবে সাধারণ জনগণের তার মন্ত্রিত্ব ও সদস্যপদ বাতিল হলে তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। জনগণের দায়িত্ব ছিল তার বিরুদ্ধে মামলা করা, তারা তা করেছে। এখন বিচার বিভাগের দায়িত্ব প্রচলিত আইনে তার শাস্তির বিধান করা।
সময়ের আরো একটি আলোচিত ঘটনা হলো পিয়াস করিমের মৃতদেহ বা লাশ শহীদ মিনারে রাখতে না দেয়ার ষড়যন্ত্র। তরুণরা রাজনীতির বাইরে নয়। তবে ছোটখাটো জিনিস নিয়ে তারা হইচই করবে সেটা তাদের শোভা পায় না। শহীদ মিনার সব তরুণের, শিশুদের, বৃদ্ধদের, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের, এমনকি টোকাইদেরও। এটা সরকারেরও নয়, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরও নয়Ñ এটা দেশের সম্পদ, সব জনগণের। পিয়াস করিম কখন কী বলেছেন তার জন্য মৃত ব্যক্তিকে এভাবে অসম্মান করা কি যুক্তিসঙ্গত হয়েছে? এ অন্যায় ও অযৌক্তিক আচরণে লজ্জায় দুঃখে অনেকের চোখে মেঘবৃষ্টি হয়ে ঝরতে দেখেছি। করুণাময় আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন। বস্তুবাদী ও ভোগবাদী জীবনের কারণে আজ অনেকেই আমরা হৃদয়হীন হয়ে পড়েছি। মৃত কি জীবিত, কারো জন্য আজ আমাদের দয়া নেই, মায়া নেই, ভালোবাসা নেই। এখানে এখন সব ধু ধু মরু প্রান্তর।
বহু প্রত্যাশিত নির্বাচন নিয়ে কিছু না বললেই নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের অনেক কিছুই আমাদের আলোড়িত করে। যদিও ভারত একটি বৃহৎ শক্তি তারপরও একটি নির্বাচিত সরকারপ্রধান হিসেবে যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানবোধ আমেরিকার জনসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রকাশ করেছেন তা ২০ হাজার আমেরিকান প্রবাসী ভারতীয়র মতো আমাদেরও মোহিত করেছে। তিনি বলেছেন তার ৮০০ সংসদ সদস্যকে তিনটি করে গ্রামের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য দায়িত্ব দিয়ে আদর্শ গ্রাম যোজনা প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন। ২০১৯-এর মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার গ্রামকে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এতটাই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তিনি নিজের সত্যিকার পরিচয় দিতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেন না বরঞ্চ সম্মান বোধ করেন, তাই তো তিনি ‘হিন্দু’ কথা লেখা ব্যান্ডটি হাতে সার্বক্ষণিক পরে ছিলেন। ওবামা নিজে ট্যুরিস্ট গাইড হয়ে মোদিকে মার্টিন লুথার কিং মেমোরিয়াল ঘুরে দেখিয়েছেন। তারা যৌথভাবে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। এগুলো ভারতীয়দের জন্য কতটুকু গৌরবের, কতটুকু আনন্দদায়ক ও প্রেরণাদায়ক তা কি কল্পনা করা যায়? আজ যদি আমাদের প্রিয় দেশনেত্রী গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে আসতেন তবে তার সম্মান স্বদেশে ও বিদেশে কি আরো বেশি গ্রহণযোগ্য হতো না। এ অপ্রাপ্তি কি আমাদের ভাবায় না, আমাদের দুঃখ দেয় না? তার সম্মান যে আমাদের সম্মান, দেশের সম্মান, তাই বলছিলাম আমরা সাধারণ মানুষ, বান কি মুন নই, আমরা আমেরিকা নই, চীন, জাপান নই (অর্থাৎ সেসব দেশের বিশিষ্ট কোনো ব্যক্তি নই) আমরা প্রধানমন্ত্রীর ‘ুদ্র প্রজাবৃন্দ’, সংবিধানে এই প্রজাদের (জনগণ) সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বলা হয়েছে যদিও বাস্তবে এর প্রতিফলন তেমন একটা দেখা যায় না, বর্তমানে রাজা ও প্রজাদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করার জন্য গণতন্ত্র নামক এক বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা সম্ভব হবে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে মনের মতন রাজা নির্বাচন করে। নির্বাচনে অধিকারবঞ্চিত জনগণ অবৈধ শব্দটির বোঝাটিও এখন আর বইতে নারাজ। তা ছাড়া বিদেশীদের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন কথাটিও জনগণের মর্মপীড়ার কারণ। তারা বলেন, দশম সংসদ নির্বাচন ও চতুর্থ উপজেলা নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণে ইউএসআইডি, ইউকে আইডি ও ইউরোপীয় কমিশন ইসির অর্থের অনুদান কমিয়ে দিয়েছে। নির্বাচনের দুর্বলতার কারণে আমাদের নানাভাবে হেয় করা হচ্ছে ও দেশকে খেসারত দিতে হচ্ছে। জনগণকে ভুল না বুঝে সব দলের প্রধানকে নিয়ে ন্যায়নিষ্ঠ আলোচনার মাধ্যমে ও পরমতসহিষ্ণুতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে রাষ্ট্রনায়কোচিত এক মহান অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন এটি বর্তমান বাংলাদেশের জনগণের এ সময়ের সর্বোচ্চ চাওয়া। আমাদের প্রত্যাশা পূরণের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দৃঢ়চিত্তে প্রার্থনা করি ‘হে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী জ্ঞানী আল্লাহ এ পৃথিবীর সব রাজত্বের তুমিই অধিপতি, তুমি আমাদের সঠিক পথ দেখাও তা না হলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্গত হবো।’
লেখক : অধ্যাপিকা
ধর্ম নিয়ে এ আলোচনার পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলাম ধর্মের বর্তমান অবস্থা কেমন? অধিকাংশ জনগণের কাছে খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয় বললে ভুল বলা হবে না। ধর্মনিরপেক্ষতা প্রদর্শন করতে গিয়ে আমরা অনেকেই ধর্মহীনতা রোগে ভুগছি। ব্রিটিশ আমলের মতো মুসলিম সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন চালাতে সাহায্য করছেন অতি প্রগতিবাদী কিছু মুসলমান। বাঙালিত্বের নামে এ ধরনের প্রচেষ্টা সত্যিকারের মুসলমানদের কষ্ট দেয়। অতীতে পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে মুসলমানদের হিন্দু সংস্কৃতি কিভাবে প্রভাবান্বিত করেছিল তার সুন্দর চিত্র মীর মশাররফ হোসেন তার ‘জীবন কথায়’ তারুণ্যচিত্র আঁকতে গিয়ে লিখেছেন ‘ধূতি পরিতে শিখিলাম চাদর বা উড়ানী গায়ে দেওয়া অভ্যাস হইল। মাথার চুল ছাঁটিয়া ফ্যাশনেবল করিলাম। পিছনের দিকে কিছুই নাই। পাজামা চাপকান বাড়ী পাঠাইয়া দিলাম। টুপিটাও ক’দিন পর সহপাঠীরা আগুনে পোড়াইয়া দিলো।’ বর্তমানে আমাদের কিছু মানুষের ধারণা এ ধরনের পোশাক পরিচ্ছদ ধর্মের ওপর তেমন আঘাত হানে না। তবে মুসলিম সংস্কৃতি বলতে আলাদা কিছু আছে এখানে সেটা উপেক্ষিত হয়েছে, সেটাই লেখক প্রকাশ করতে চেয়েছেন; কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে ধর্মের ওপর সংস্কৃতির ওপর যেভাবে নগ্ন হস্তক্ষেপ চলছে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমরা চাই যার যার ধর্ম যার যার সংস্কৃতি দুটো পরস্পর কাছাকাছি প্রবহমান সমুদ্রের মতো নির্বিঘেœ প্রবাহিত হোক। কোনো রকম চাপিয়ে দেয়া সংস্কৃতি বর্জন করা হোক। তবেই সবার সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে।
ইসলামী রীতিনীতির প্রতি অবজ্ঞা, অত্যন্ত জৌলুসপূর্ণ জীবনযাপন, ন্যায়-অন্যায়বোধের তোয়াক্কা না করা, মূল্যবোধের অবক্ষয় সমাজকে এক অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এরই ফলে দেখতে পাই ঐশীর মতো মেয়ে মা-বাবাকে খুন করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেনি। ধর্মহীন জীবন ধেয়ে চলেছে পাগলা ঘোড়ার মতো মৃত্যুর গহ্বরে। ধর্মের সাথে আধুনিকতার ও বিজ্ঞানের কোনো বৈরিতা নেই। তার দুটো উজ্জ্বল উদাহরণ এখানে তুলে ধরছি। সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী নিউটন যিনি পদার্থবিজ্ঞান, আলোবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা ও গতিবিজ্ঞানের এত উন্নতি সাধন করেছেন তিনিও ছিলেন এক বড় ধার্মিক ব্যক্তি। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন যার শৈশব কেটেছিল নবম দশম শতকে মুসলিম শাসন আমলে তার লেখা Out of my later years শেষ বছরগুলো বইটিতে বিজ্ঞান ও ধর্ম সম্বন্ধে সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনিও ছিলেন আস্তিকবাদী ধার্মিক ব্যক্তি।
ধর্মনিরপেক্ষতার আবরণে আমরা আমাদের ৮০০ বছরের মুসলমান শাসনের গৌরবময় অধ্যায়কে মুছে ফেলতে চেষ্টা করছি। আমরা আমাদের সন্তানসন্ততিদের কৌশলে তাদের ধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। অতীতের জাতীয় বীরদের গৌরবগাথা, পূর্বপুরুষদের গৌরবময় কাজ, কীর্তিকথা থেকে তারা যেন অনুপ্রেরণা না পায় শিক্ষাক্ষেত্রে সে ব্যবস্থা করে রেখেছি। তরুণ সম্প্রদায় যাতে সাংস্কৃতিক উৎসমূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র জাতীয় চেতনায় সমৃদ্ধি লাভ করতে না পারে তার জন্য চেষ্টাও অব্যাহত রেখেছি, তাই এখন সময়ের দাবি নতুন প্রজন্মকে সব কিছু জানাতে উদ্যোগ নিতে হবে। কিভাবে স্যার সৈয়দ আহমদ, কবি আল্লামা ইকবাল, কাজী নজরুল ইসলাম হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য কী নিরলস প্রচেষ্টাই চালিয়েছিলেন তা তাদের কাছে তুলে ধরা হবে। তারা জেনে অনুপ্রাণিত হবে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য মৌলানা মুহাম্মদ আলী, হাকিম আজমল, ড. এস এ আনসারী, ব্যারিস্টার আসিফ আলী, মৌলানা হযরত সোহানী যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার জন্য ধর্মের ওপর আমাদের অবশ্যই গুরুত্বারোপ করতে হবে। কারণ গাছের গোড়া কেটে (ধর্মকে গুরুত্বহীন রেখে) মৃতগাছ থেকে কখনো কোনো ফল আশা করা যায় না। এই তো কিছু দিন আগে আজান নিয়ে, রাসূল সা:কে নিয়ে, ধর্ম নিয়ে কত অশ্রাব্য কথা বলা হলো। তাদের তো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হলো না, বরঞ্চ সত্য কথা বলার জন্য নিরপরাধ ব্যক্তিকে নির্দয়ভাবে কারাগারে আটকিয়ে রাখা হলো, যা হওয়ার হয়েছে বর্তমানে তাকে ছেড়ে দিয়ে মানবতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হোক এটা জনগণের দাবি। লতিফ সিদ্দিকী হজ, রাসূল সা: ও তাবলিগ নিয়ে যেভাবে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের মনে আঘাত দিয়েছেন তা নিন্দনীয় ও কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তার শাস্তি এখন অধিকাংশ জনগণের দাবি। কারণ তিনি বিশ্বের ২১৪ কোটি মুসলমানের মনে তীব্র আঘাত হেনেছেন। তার মন্ত্রিত্ব ও সদস্যপদ বাতিল করলে সরকারের সঠিক দায়িত্ব পালন করা হবে। তবে সাধারণ জনগণের তার মন্ত্রিত্ব ও সদস্যপদ বাতিল হলে তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। জনগণের দায়িত্ব ছিল তার বিরুদ্ধে মামলা করা, তারা তা করেছে। এখন বিচার বিভাগের দায়িত্ব প্রচলিত আইনে তার শাস্তির বিধান করা।
সময়ের আরো একটি আলোচিত ঘটনা হলো পিয়াস করিমের মৃতদেহ বা লাশ শহীদ মিনারে রাখতে না দেয়ার ষড়যন্ত্র। তরুণরা রাজনীতির বাইরে নয়। তবে ছোটখাটো জিনিস নিয়ে তারা হইচই করবে সেটা তাদের শোভা পায় না। শহীদ মিনার সব তরুণের, শিশুদের, বৃদ্ধদের, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের, এমনকি টোকাইদেরও। এটা সরকারেরও নয়, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরও নয়Ñ এটা দেশের সম্পদ, সব জনগণের। পিয়াস করিম কখন কী বলেছেন তার জন্য মৃত ব্যক্তিকে এভাবে অসম্মান করা কি যুক্তিসঙ্গত হয়েছে? এ অন্যায় ও অযৌক্তিক আচরণে লজ্জায় দুঃখে অনেকের চোখে মেঘবৃষ্টি হয়ে ঝরতে দেখেছি। করুণাময় আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন। বস্তুবাদী ও ভোগবাদী জীবনের কারণে আজ অনেকেই আমরা হৃদয়হীন হয়ে পড়েছি। মৃত কি জীবিত, কারো জন্য আজ আমাদের দয়া নেই, মায়া নেই, ভালোবাসা নেই। এখানে এখন সব ধু ধু মরু প্রান্তর।
বহু প্রত্যাশিত নির্বাচন নিয়ে কিছু না বললেই নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের অনেক কিছুই আমাদের আলোড়িত করে। যদিও ভারত একটি বৃহৎ শক্তি তারপরও একটি নির্বাচিত সরকারপ্রধান হিসেবে যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানবোধ আমেরিকার জনসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রকাশ করেছেন তা ২০ হাজার আমেরিকান প্রবাসী ভারতীয়র মতো আমাদেরও মোহিত করেছে। তিনি বলেছেন তার ৮০০ সংসদ সদস্যকে তিনটি করে গ্রামের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য দায়িত্ব দিয়ে আদর্শ গ্রাম যোজনা প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন। ২০১৯-এর মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার গ্রামকে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এতটাই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তিনি নিজের সত্যিকার পরিচয় দিতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেন না বরঞ্চ সম্মান বোধ করেন, তাই তো তিনি ‘হিন্দু’ কথা লেখা ব্যান্ডটি হাতে সার্বক্ষণিক পরে ছিলেন। ওবামা নিজে ট্যুরিস্ট গাইড হয়ে মোদিকে মার্টিন লুথার কিং মেমোরিয়াল ঘুরে দেখিয়েছেন। তারা যৌথভাবে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। এগুলো ভারতীয়দের জন্য কতটুকু গৌরবের, কতটুকু আনন্দদায়ক ও প্রেরণাদায়ক তা কি কল্পনা করা যায়? আজ যদি আমাদের প্রিয় দেশনেত্রী গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে আসতেন তবে তার সম্মান স্বদেশে ও বিদেশে কি আরো বেশি গ্রহণযোগ্য হতো না। এ অপ্রাপ্তি কি আমাদের ভাবায় না, আমাদের দুঃখ দেয় না? তার সম্মান যে আমাদের সম্মান, দেশের সম্মান, তাই বলছিলাম আমরা সাধারণ মানুষ, বান কি মুন নই, আমরা আমেরিকা নই, চীন, জাপান নই (অর্থাৎ সেসব দেশের বিশিষ্ট কোনো ব্যক্তি নই) আমরা প্রধানমন্ত্রীর ‘ুদ্র প্রজাবৃন্দ’, সংবিধানে এই প্রজাদের (জনগণ) সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বলা হয়েছে যদিও বাস্তবে এর প্রতিফলন তেমন একটা দেখা যায় না, বর্তমানে রাজা ও প্রজাদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করার জন্য গণতন্ত্র নামক এক বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা সম্ভব হবে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে মনের মতন রাজা নির্বাচন করে। নির্বাচনে অধিকারবঞ্চিত জনগণ অবৈধ শব্দটির বোঝাটিও এখন আর বইতে নারাজ। তা ছাড়া বিদেশীদের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন কথাটিও জনগণের মর্মপীড়ার কারণ। তারা বলেন, দশম সংসদ নির্বাচন ও চতুর্থ উপজেলা নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণে ইউএসআইডি, ইউকে আইডি ও ইউরোপীয় কমিশন ইসির অর্থের অনুদান কমিয়ে দিয়েছে। নির্বাচনের দুর্বলতার কারণে আমাদের নানাভাবে হেয় করা হচ্ছে ও দেশকে খেসারত দিতে হচ্ছে। জনগণকে ভুল না বুঝে সব দলের প্রধানকে নিয়ে ন্যায়নিষ্ঠ আলোচনার মাধ্যমে ও পরমতসহিষ্ণুতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে রাষ্ট্রনায়কোচিত এক মহান অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন এটি বর্তমান বাংলাদেশের জনগণের এ সময়ের সর্বোচ্চ চাওয়া। আমাদের প্রত্যাশা পূরণের জন্য মহান আল্লাহর কাছে দৃঢ়চিত্তে প্রার্থনা করি ‘হে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী জ্ঞানী আল্লাহ এ পৃথিবীর সব রাজত্বের তুমিই অধিপতি, তুমি আমাদের সঠিক পথ দেখাও তা না হলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্গত হবো।’
লেখক : অধ্যাপিকা
No comments