ভাগ্যবিড়ম্বিত রোহিঙ্গা- বিশ্বসম্প্রদায়কে দায় নিতে হবে
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি এখনো
নাগরিকসুলভ আচরণ করছে না। তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ও মিয়ানমারের নাগরিক
হওয়ার দাবি বারবার অস্বীকার করা হচ্ছে। গত শতকের আশির দশক থেকে রোহিঙ্গা
ইস্যু বাংলাদেশের জন্য একটি অসহনীয়, কিন্তু মানবিক সমস্যা হয়ে আছে।
বিশ্বসম্প্রদায় এই ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেও লাভবান
হয়নি, উপরন্তু রোহিঙ্গারা আরো বেশি রোষানলে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান হতাশা ও
ভীতির কারণে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চল থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানেরা গণহারে
অন্যত্র পালিয়ে বাঁচতে চাইছে। দুই বছর আগে দেশটিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর
রোহিঙ্গাদের নৌকা করে মিয়ানমার ত্যাগের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
শীর্ষস্থানীয় একটি সংস্থা ‘রোহিঙ্গা অ্যাডভোকেসি গ্রুপ’ তথ্যটি নিশ্চিত
করেছে।
শুধু গত দুই সপ্তাহে আট হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী পশ্চিম মিয়ানমার ছেড়ে মালবাহী জাহাজে চড়ে থাইল্যান্ডের পথ ধরেছে। প্রতিদিন পলাতকদের দলে ভিড়ছে গড়ে ৯০০ করে মানুষ। মূলত ১৫ অক্টোবর থেকে এ যাত্রা শুরু হয়েছে। গত দুই সপ্তাহেরও কম সময়ে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা দেশ ছেড়েছে। এটি এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেশ ত্যাগের ঘটনা। থাইল্যান্ডে পৌঁছার পর থাই প্রশাসনের কাছ থেকেও তাদের পেতে হচ্ছে বৈরী আচরণ। শরণার্থী হিসেবে বাধ্য হয়ে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের দলগুলোকে সীমান্তে ভিড়তে দেয়া হচ্ছে না। অনেককেই পুনরায় ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। যারা কোনোভাবে থাইল্যান্ডের মাটিতে পা রাখতে সমর্থ হচ্ছেন, তারা আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর হাতে পড়ছেন এবং থাইল্যান্ডের জঙ্গলে শিবিরে নিয়ে তাদের নির্যাতন করা হচ্ছে। বড় অঙ্কের চাঁদা না দেয়া পর্যন্ত এ নির্যাতন বেড়েই চলেছে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী পলায়নপর রোহিঙ্গাদের বর্তমান আবাস রাখাইন ভূমির উত্তরাংশে। কয়েক প্রজন্ম ধরে তারা এ স্থানে বসবাস করে আসছে স্বীকৃতিবিহীনভাবে। তাদের ‘বাঙালি’ বলে অভিহিত করা হয় এবং সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের মধ্য থেকে আক্রমণাত্মক ভিুরা নিয়মিতভাবে তাদের ওপর বর্বর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমার প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ-অধ্যুষিত বিস্তীর্ণ জনপদ, যেখানে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার বাস। সামাজিকভাবে এরা অত্যন্ত অসহায় ও দারিদ্র্যের আঘাতে জর্জরিত জীবনযাপন করছে। গত দুই বছরে অসংখ্য পরিসংখ্যানবিহীন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরেছে অনেকেই। তা ছাড়া এক লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুশিবিরে মানবেতর অবস্থায় বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। রাষ্ট্রহীন নির্যাতনের শিকার মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, আরব জাহান ও অন্যান্য দেশে চলে যেতে চায়, কারণ তারা চরম সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধ দেশ মিয়ানমারে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না। রোহিঙ্গারা স্বদেশে যেমন নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার, তেমনি শরণার্থী শিবিরেও মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে তারা এক ধরনের সামাজিক সঙ্কট সৃষ্টির কারণ হয়ে আছে। আমরা মনে করি, রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের সমস্যা। জাতিগত সঙ্কট নিরসনে তাদেরই করণীয় রয়েছে। যেহেতু তারা মুসলমান তাই বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং আরব দেশগুলোরও মানবিক সাহায্য প্রত্যাশিত। একই সাথে আন্তর্জাতিক বিশ্বকেও এ ব্যাপারে অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে।
No comments