লন্ডনি কইন্যার ফাঁদ by ওয়েছ খছরু
‘লন্ডনি কইন্যা’ সেজে প্রতারণার ফাঁদ
পেতেছে গুলজান বেগম। বাড়ি মৌলভীবাজারের করিমপুর খালপাড় এলাকায়। বর ধরা এবং
বর ছাড়াই তার পেশা। গুলজানকে ঘিরে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেটও। বিয়ের
‘উকিল’ থেকে শুরু করে সিন্ডিকেটের মোহনী জালে আটকা পড়েছে অনেকেই, হারিয়েছে
সহায় সম্বল। এমন কি স্বপ্নের দেশ লন্ডনে পাড়ি দিতে নিজের শেষ অর্জনটুকুও
অনেকেই বিলিয়ে দিয়েছেন গুলজানের জালে। এমনি এক সহজ সরল যুবক সিলেটের
কামরুজ্জামান কামরুল। গুলজান ও তার সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে দুই লাখ টাকা
খুঁইয়ে হা-হুতাশ করছেন তিনি। আর এখন তার কপালে জুটছে সকাল-বিকালে গালিগালাজ
ও হুমকি। মানবজমিনের কাছে প্রতারণার অনন্য কৌশল বর্ণনা করতে গিয়ে কেঁদে
ফেললেন সিলেটের কামরুল। বললেন, ‘টাকা গেলো, মান-সম্মানও ধুলোয় মেশালো, এখন
ক্রমাগত হুমকিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি।’ কামরুজ্জামান কামরুলের বাড়ি সিলেট
নগরীর রায়নগর, দর্জিবন্ধ বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। পিতা মৃত খলিল আলী। ঘটনার
শুরু গত ঈদুল আজহার এক সপ্তাহ আগে। পার্শ্ববর্তী কলোনির এক বাসিন্দার
পরিচয়ের সূত্র ধরে বিয়ের উকিল আলতু মিয়া রায়নগরের কামরুলকে লন্ডনি কইন্যা
বিয়ের প্রস্তাব দেয়। জানায়, তার কাছে এক লন্ডনি মেয়ে রয়েছে। বিয়ে করতে
চাইলে কথাবার্তা বলা যাবে। পরবর্তীতে কামরুলের পরিবারের পক্ষ থেকে সায় দেয়া
হলেও শুরু হয় বিয়ের কথাবার্তা। কনের বাড়ি মৌলভীবাজারের করিমপুরের খালপাড়
এলাকায়। আলতু উকিলের কথার সূত্র ধরে কামরুল ও তার পরিবারের সদস্যরা ঈদের
আগে ৩রা অক্টোবর কনে দেখতে করিমপুর খালপাড়ে যান। সেখানে তারা কনে দেখে ১০
হাজার টাকা সেলামি দেন। এবং বিয়ের কথাবার্তা চূড়ান্ত করেন। বিয়েতে মোহরানা
১০ লাখ টাকা ও ৪ ভরি স্বর্ণ দেয়ার কথা হয়। পাশাপাশি গুলজানের চাচা
পরিচয়ধারী ব্যক্তি ইকবাল ওরফে তারেক ওরফে ইমরান, মা আজিজুন্নেছা বেগম
বরপক্ষের কাছে নগদ ৬ লাখ টাকা দাবি করেন। বলেন, ওই টাকা দিলে বিয়ে হবে
নতুবা হবে না। তাদের সে প্রস্তাবেও রাজি হয় কামরুলের পরিবার। ওই দিনই কনের
মা পরিচয়ধারী মহিলা আজিজুন্নেছা বরপক্ষকে জানান, তারা দেশে এসেছেন একমাস
ধরে। চলে যাবেন ঈদের পর ৯ই অক্টোবর। সুতরাং বিয়ে তারা ঈদের আগের দিন ৫ই
অক্টোবর সেরে ফেলতে চান। তাদের সে প্রস্তাবে বরপক্ষ রাজি হলে টাকা দেয়ার
জন্য চাপ দেন আজিজুন্নেছা। সে অনুযায়ী বিয়ের আগের দিন কামরুল বিয়ের উকিল
আলতু মিয়ার কাছে এক লাখ টাকা তুলে দেন। এবং বাকি ৫ লাখ টাকা বিয়ের দিনই
পরিশোধ করা হবে বলে জানিয়ে দেন। কথামতো ঈদের আগের দিন ৫ই অক্টোবর কামরুল
তার মা সেলিমা বেগম, মামা সোহেল মিয়া সহ কয়েকজনকে নিয়ে করিমপুর খাল পাড়ে
যান। সেখানে তারা গুলজানের বাড়িতে পৌঁছে বিয়ের খরচ বাবদ আরও এক লাখ টাকা
মা আজিজুন্নেছার হাতে তুলে দেন। ৬ লাখ টাকার মধ্যে মোট ২ লাখ টাকা দেয়ার পর
বিয়ের কাজী ডাকতে ইকবাল ও আজিজুন্নেছার কাছে আবদার করেন কামরুলের মা
সেলিনা বেগম। কিন্তু ইকবাল জানান, কাজী সাহেব ঈদের বাজারে গরু কিনতে চলে
গেছেন। আসার পর বিয়ে হবে। এতে অপেক্ষা করতে থাকেন কামরুল ও তার পরিবারের
সদস্যরা। বেলা ২টার দিকে ইকবাল ও আজিজুন্নেছা জানান, কাজী সাহেব আসতে
পারবেন না। সুতরাং ঈদের পর ৮ই অক্টোবর বিয়ে হবে। এ সময় পূর্বের কথামতো
বিয়ের আয়োজন না করায় কামরুলের পরিবারের সঙ্গে গুলজানের পরিবারের কথা
কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে বেলা আড়াইটার দিকে কামরুলের পরিবার সেখান থেকে চলে
আসেন। এদিকে, ঈদের পর কামরুল ও তার পরিবারের সদস্যরা বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক
করতে চাচা ইকবাল ও মা আজিজুন্নেছার কাছে বার বার ফোন করলেও তারা কালক্ষেপণ
করেন। এভাবে এক সপ্তাহ চলার পর উল্টো গুলজানের পরিবারের পক্ষ থেকে
গালিগালাজ করা হয়। বলা হয়, কিসের বিয়ে, কার বিয়ে- তারা কিছুই জানেন না। এবং
২ লাখ টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করেন। এরপর থেকে ফোন দিলেই কামরুলের
পরিবারের সদস্যদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়। এদিকে, এ ঘটনার পর পুরো
রহস্য উদঘাটনে কামরুল ও তার মামা সোহেল মিয়া ছুটে যান করিমপুরের খালপাড়ে।
সিলেটের শেরপুর থেকে মৌলভীবাজার রোডে সরকার বাজার এলাকা পাড়ি দিলেই করিমপুর
গ্রাম। এই গ্রামেই গুলজানের বাড়ি। সিলেট থেকে কামরুল ও তার মামা গিয়ে
গ্রামের লোকজনের কাছে বিচারপ্রার্থী হন। কিন্তু গ্রামের লোকজন জানান, ওদের
প্রতারণায় পড়েছেন। কিছুই করার নেই। ওদের ব্যবসাই এটা। কিন্তু গ্রামের লোকজন
তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না। আর পুলিশে গেলে পুলিশও ওদের পক্ষ নিয়ে
অযথা হয়রানি শুরু করে। কামরুজ্জামান কামরুল জানান, করিমপুরে গিয়ে খবর নেয়ার
পর ওদের প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ে। তারা প্রতি সপ্তাহেই ২ থেকে ৩টি পক্ষের
সঙ্গে এভাবে গুলজানকে ‘লন্ডনি কইন্যা’ পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে। আর সহজ
সরল মানুষ তাদের প্রতারণায় পড়ে মান সম্মানের ভয়ে থানা পর্যন্ত যান না।
স্থানীয় লোকজন জানান, কনে গুলজান, মা আজিজুন্নেছা, চাচা ইকবাল ওরফে তারেক
ওরফে ইমরান এবং উকিল আলতু মিলে ওই এলাকায় সিন্ডিকেট গড়েছে। তারা গুলজানকে
লন্ডনি কইন্যা পরিচয় দিয়ে মৌলভীবাজার, সিলেট ও হবিগঞ্জের একাধিক স্থানে
প্রতারণা করেছে। সুনামগঞ্জে আরও দু’টি ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ইকবাল ও আলতুর
বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। নিজেকে লন্ডনি বর পরিচয় দিয়ে বিয়ে করেছিলো ইকবাল।
বিয়ের তিন দিন পর সে স্ত্রীকে তাড়িয়ে দিয়ে গাঢাকা দেয়। ওই সিন্ডিকেটের উকিল
আলতু লোক ধরে ধরে নিয়ে তাদের প্রতারণার জালে আটক করে। আলতুর বাড়ি
সুনামগঞ্জে। সেও একাধিক বিয়ে করেছে। এলাকায় আলতু চোরা হিসেবে এক নামেই
আলতুকে চেনেন সবাই। এদিকে এ ঘটনার সত্যতা জানতে ইকবাল ওরফে তারেক ওরফে
ইমরানকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, তিনি ইকবাল। তবে তার বাড়ি মৌলভীবাজারের
নাদামপুরে। আর গুলজান বলে তার কোন ভাইঝি নেই। তিনি বলেন, এসব ঘটনার সঙ্গে
তার কোন সম্পর্ক নেই। প্রায় ১৫ মিনিট পর ফিরতি ফোন দিয়ে ইকবাল জানতে চান এই
নম্বরটি সাংবাদিকদের কে দিয়েছে। আর আলতু মিয়ার ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করা
হলে এক বাক্যেই আলতু অস্বীকার করেন তিনি আলতু নন। ভুল নম্বরে ফোন এসেছে।
No comments