জোরজবরদস্তির গণতন্ত্র by সাদ সাকলান
তৃতীয় বিশ্বের শাসনব্যবস্থা, বিশেষ করে গণতন্ত্রের নামে যা হচ্ছে বা চালানো হচ্ছে, তা দেখে মহামতি সক্রেটিস-অ্যারিস্টটল-প্লেটো হয়তো ভিরমি খেতেন, নয়তো গণতন্ত্রের ধারণা ভিন্নভাবে লিখে যেতেন। আমাদের দেশের মতো ক’খানা গণতান্ত্রিক দেশের গণতন্ত্র দেখলে লাস্কি-সিডনি-টয়েনবি কিংবা বার্কার-স্টুয়ার্ট মিলরা কী লিখতেন বোঝা দায়। আর গণতন্ত্র মানেই সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনÑ সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন মানেই অবাধ নির্বাচনÑ সবই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কথা। কিন্তু এসব দেশের নির্বাচন-শাসনব্যবস্থা এবং সর্বোপরি গণতন্ত্রের হালহকিকত দেখে জাঁদরেল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাদের ছাত্রদের কিভাবে গণতন্ত্রের ধারণা দিতেন, তা কল্পনা করা কঠিন। কিংবা যেসব পণ্ডিত নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন রাখার প্রবক্তা, তারা এসব দেশের নির্বাচন কমিশনের কায়কারবার দেখে হুঁশও হারিয়ে ফেলতে পারতেন। কিন্তু এসব দেশের মানুষের এ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। আমজনতা এসব থেকে অনেক দূরে। বুদ্ধিজীবীদের ঠিক কী ভূমিকা সেটাও আমাদের দেশে অনুধাবন করা কঠিন।
খবর বেরিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের হলের জনাপঞ্চাশেক মেয়েকে রাতভর রুমে আটকে রাখা হয়েছিল পরের দিন বিকেল ৩টার সভায় হাজির হতে বাধ্য করার জন্য। কোনো একজন বেরসিক খবরটা ফাঁস করেছেন। একই ঘটনা, একই দিনে বুয়েটেও ঘটেছে। একটি হল চারতলায় সম্প্রসারিত হয়েছে। সেখানে চল্লিশজন ছাত্রকে থাকতে দেয়া হয়েছে। থাকতে যেহেতু দেয়াই হয়েছে, সুতরাং শোকদিবসের অনুষ্ঠানে যেতেই হবে। তাদেরও পুরো রাত কোথাও যেতে দেয়া হয়নিÑ যদিও এই খবর কাগজে আসেনি। বদরুন্নেছা কলেজের মেয়েদেরও ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিছিলে আসতে বাধ্য করা হয় এবং এটি অনেক দিন ধরেই ঘটছে। হলে অবস্থানকারীদের ক্ষেত্রেই চিত্রটা প্রকট। একই দশা ইডেনেÑ এটি কাগজে আসার দরকার নেই। একটু খোঁজ নিলেই হয়। এর আগে ছাত্রলীগের নেতাদের সাথে ইডেনের মেয়েদের লং-ড্রাইভে যেতে বাধ্য করার সংবাদ ছাপা হয়েছে। আমরা পারিও বটেÑ না হলে সেঞ্চুরিয়ান মানিককে ভুলে যাই কী করে! এই মানিকও কিন্তু একটি ছাত্রসংগঠনের সাথেই সম্পৃক্ত ছিল। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তো দূর অস্ত, বরং বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়েছে। এখন হলগুলো একটি মাত্র ছাত্রসংগঠনের দখলে, তাদেরই নিরঙ্কুশ আধিপত্য। ভিন্ন মতের হলে হল, এমনকি ভার্সিটিছাড়া করা মুহূর্তের ব্যাপার। সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন ও তাদের নেতারা কোনো রকমের প্রতিযোগিতায় যেতে আগ্রহী নন। তাই তাদের মুরব্বি-দল যখন ক্ষমতায়, তখন কেবল তারাই থাকবেন। হলে যারা থাকবেন, তাদের যেহেতু দয়া করে থাকতে দেয়া হচ্ছে, সুতরাং তাদের কথার অন্যথা হওয়ার সুযোগ নেইÑ এই হচ্ছে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক চর্চা। যারা ছাত্ররাজনীতিকে আগামী দিনের গণতান্ত্রিক চর্চার সূতিকাগার মনে করেন, কী বলবেন তারা? হলে হলেই নয়, টেন্ডার কিংবা চাকরি পেতেও তারা প্রতিযোগিতায় যেতে নারাজ। সঠিক অর্থে নির্বাচন করে ছাত্রসংসদে বসা এবং ঠিক ঠিক একটি জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলেও আগ্রহী মানুষের অভাব দেখা দিয়েছে। গণতন্ত্রই এখন উল্টো পথে হাঁটছে।
অদ্ভুত হলেও সত্য যে, বুয়েটেও শোনা যায়, দল ক্ষমতায়; এখন আমরাই হলে থাকব, তোমরা বেরিয়ে যাওÑ আমরাই শেষ কথা। বিপদে পড়েছেন নতুন ভিসিÑ এমনিতে ক’জনকে ডিঙিয়ে তাকে দেয়া হয়েছে। সেটা কোনো ব্যাপার হয়তো নয়। কারণ পছন্দটা সর্বোচ্চপর্যায়ের। তেয়াত্তরের অধ্যাদেশে ভিসি নিয়োগের জন্য কী সব নির্বাচন-টির্বাচনের কথা আছে, তা নিয়ে আর কোনো পক্ষকে কথা বলতে শোনা যায় না। নতুন ভিসি নাকি বলেছেন, বুয়েট সব ছাত্রের জন্যই উন্মুক্ত, এটি হবে সহাবস্থানের জায়গা। বিপদটা এ জায়গায়। সোনার ছেলেরা চাইছে, আমরাই শেষ কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেও একটি দলের ছাত্র-ছাত্রী ব্যতিরেকে অন্য কারো স্থান নেইÑ গণতন্ত্রের উর্বর চারণভূমি তো! ডাকসু নির্বাচন এলেই কথাটি জোরেশোরে উচ্চারিত হতো। এখন ডাকসুই নেই। ছেলেমেয়েরা নিয়মিত টাকা দিচ্ছে (তার নাকি হিসাবও ঠিকমতো নেই, হায়!)। স্বৈরাচার এরশাদের সময়েও ডাকসুর নির্বাচন হতে দেখা গেছে। এখন কেবল ডাকসু নয়, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নির্বাচিত সংসদ নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বা কেন, জেলা পরিষদ কিংবা ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়েই বা কী ব্যাখ্যা? ব্যাখ্যা হয়তো আছেÑ যিনি কিছু করেন, সেটার ব্যাখ্যাও তার থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। যেমন এই দেশের সর্বশেষ নির্বাচনÑ যুক্তির তো শেষ দেখি না; এই মিছিলে আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও যোগ দিয়েছেন। ঢাবি কিংবা বুয়েটে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কারো মিছিল শেষ কবে দেখা গেছে তা গবেষণা করেও বের করা কঠিন হবে। অথচ বুয়েটে ক’বছর আগেও চরম ডান-চরম বাম নিয়ে নির্বাচিত ইউকসু ছিল। এখন গণতন্ত্রের চরম উৎকর্ষের সময়Ñ একটি ছাত্রসংগঠন থাকাই যে বাঞ্ছনীয়; কী বলেন! জাতীয় রাজনীতি থেকে ছাত্ররাজনীতি ভিন্ন হয় কী করে!
ছাত্রদলের সুসময়েও একই চিত্র দেখা গেছে। হলের সিট দখল, ক্যান্টিনে বিনে পয়সায় ভোজ আর পাশের মার্কেট-বস্তি থেকে নগদ আদায়। তখন তাদের লোকবলের অভাব ছিল না। নিমেষেই মিছিল-মিটিং লোকাকীর্ণ হয়ে উঠত। এখন! ছাত্রদল একটা জুতসই মিছিলও বের করতে পারে না। যারা তখন দুধ-মাখন-ননি কিংবা গুড়-বাতাসা খেয়েছে, কারো খোঁজ নেই। আবার কেউ কেউ আখের গুছিয়ে আরাম-আয়েশে সময় পার করছেন। জোরজবরদস্তি করে সাময়িক উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়Ñ এই যেমন মিটিংয়ে ছাত্রছাত্রী জড়ো করা, হলে আধিপত্য কায়েম ইত্যাদি। টেন্ডার চাঁদাবাজি কিংবা তদবির-দালালি করে পকেটে হয়তো নগদ আসে, কিন্তু জোরপূর্বক সভাসমিতিতে মানুষ জড়ো করে আখেরে লাভ হয় নাÑ রুমে ফিরতে ফিরতেই মনে মনে খেস্তিখেউড় আওড়ায়। ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের নেতারা এসব বুঝলে ভালো। জাতির জনকের শোকসভায় ছেলেমেয়েদের জোর করে নিতে হবে আর সে জন্য তাদের রাতভর আটকে রাখতে হবে, যাতে অন্যত্র যেতে না পারে, অর্থাৎ তাদের শোকসভায় যেতেই হবে এটি এই সময়ের জন্য মানানসই নয়Ñ কেমন তেতো লাগে শুনতে। কারো চেতনায় আঘাত করতে না পারলে এভাবে জোরজবরদস্তি করে সভায় নিয়ে কোনো দল বা কোনো ব্যক্তির ওপর আস্থা-শ্রদ্ধা-ভক্তি সৃষ্টি করা কঠিন। মত ও পথ নিয়ে দ্বিমত থাকলেও এ ব্যাপারে বরং ছাত্র ইউনিয়ন-শিবির একটু এগিয়ে; জোরজবরদস্তিটা এখনো সেভাবে পেয়ে বসেনি তাদের।
কেবল ছাত্রদের কিংবা ছাত্রসংগঠনের কথাই বা কেনÑ এখন তো সারা দেশেই জোরজবরদস্তির গণতন্ত্র চলছে। সামরিক জান্তা কিংবা একনায়কতন্ত্রের অনুকরণে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই জোরজবরদস্তির শাসন চলছে। কোথাও কোথাও আবার তাতে গণতন্ত্রের লেবাস লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। শুধু ঢাবি আর বুয়েট নয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও কেবল একটি দল মিছিল-মিটিং করতে পারবে। অনেক উপজেলায়ও তাই। এখন পার্টিতন্ত্রই বড় কথা নয়Ñ আমরাই সব। একদল-একনেতা; কেবল সংবিধানে অন্তর্ভুক্তি বাদ আছে। পশ্চিমবঙ্গে বাম-শাসনামলে আমরা আর ওরার খুব প্রচলন ছিল। এখানে সেটিও নেই, আছে আমরাতন্ত্র। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, পদ-পদোন্নতি, টেন্ডার, ভর্তিÑ সর্বত্রই পার্টিতন্ত্র। সরকার বদলের বৈধ পন্থার নাম নির্বাচনÑ জোরদবরদস্তি থেকে মুক্ত ছিল পনেরো বছর। সেটাতেও জিনের আসর লেগেছে। গত কিংবা আগামী নির্বাচন এরশাদীয় মডেলের যে হবে না, তা কে বলবে! সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের নাম গণতন্ত্র। গণতন্ত্র মানেই ভোটের অধিকার। গণতন্ত্র মানেই সব দলের সহাবস্থান। সব দল যেমন ভাবছে না তাদের সহাবস্থান আছে; তেমনি আমজনতা ভোটের অধিকার হারিয়ে দিশেহারা। সংসদ মানেই সরকারি দল আর বিরোধী পক্ষ। কিন্তু আমাদের সংসদের এই হাল দেখে এই সময়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কী লিখবেন বোঝা দায়। এর আগে তো ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ কিংবা ‘লয়াল অপজিশন’ নামে শব্দগুলো এই দেশে চালু ছিল, এখন? এখানেও জোরজবরদস্তিÑ এই জোরজবরদস্তির মধ্যে অন্যরা কিছু পেলেই বা মন্দ কিসে! তেমনটিই যে আমাদের গণতন্ত্রের সার কথা, শেষ কথা। আর এ জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের নতুন করে কিছু একটা লিখতেই হবে। বদলে দিতে হবে গণতন্ত্র-নির্বাচন কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের সংজ্ঞা। নির্বাচনে ভোটাধিকারের বদলে লিখতে হবে পেশিশক্তি-নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব আর উর্দিধারীদের দাপট নিয়ে কয়েকটি অধ্যায়। ক্ষমতার জোরজবরদস্তিই হবে গণতন্ত্রের সারকথা-শেষ কথা। সে ক্ষেত্রে ‘আমরা আর ওরা’ নয়Ñআমরাই শেষ কথা।
খবর বেরিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের হলের জনাপঞ্চাশেক মেয়েকে রাতভর রুমে আটকে রাখা হয়েছিল পরের দিন বিকেল ৩টার সভায় হাজির হতে বাধ্য করার জন্য। কোনো একজন বেরসিক খবরটা ফাঁস করেছেন। একই ঘটনা, একই দিনে বুয়েটেও ঘটেছে। একটি হল চারতলায় সম্প্রসারিত হয়েছে। সেখানে চল্লিশজন ছাত্রকে থাকতে দেয়া হয়েছে। থাকতে যেহেতু দেয়াই হয়েছে, সুতরাং শোকদিবসের অনুষ্ঠানে যেতেই হবে। তাদেরও পুরো রাত কোথাও যেতে দেয়া হয়নিÑ যদিও এই খবর কাগজে আসেনি। বদরুন্নেছা কলেজের মেয়েদেরও ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিছিলে আসতে বাধ্য করা হয় এবং এটি অনেক দিন ধরেই ঘটছে। হলে অবস্থানকারীদের ক্ষেত্রেই চিত্রটা প্রকট। একই দশা ইডেনেÑ এটি কাগজে আসার দরকার নেই। একটু খোঁজ নিলেই হয়। এর আগে ছাত্রলীগের নেতাদের সাথে ইডেনের মেয়েদের লং-ড্রাইভে যেতে বাধ্য করার সংবাদ ছাপা হয়েছে। আমরা পারিও বটেÑ না হলে সেঞ্চুরিয়ান মানিককে ভুলে যাই কী করে! এই মানিকও কিন্তু একটি ছাত্রসংগঠনের সাথেই সম্পৃক্ত ছিল। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তো দূর অস্ত, বরং বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়েছে। এখন হলগুলো একটি মাত্র ছাত্রসংগঠনের দখলে, তাদেরই নিরঙ্কুশ আধিপত্য। ভিন্ন মতের হলে হল, এমনকি ভার্সিটিছাড়া করা মুহূর্তের ব্যাপার। সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন ও তাদের নেতারা কোনো রকমের প্রতিযোগিতায় যেতে আগ্রহী নন। তাই তাদের মুরব্বি-দল যখন ক্ষমতায়, তখন কেবল তারাই থাকবেন। হলে যারা থাকবেন, তাদের যেহেতু দয়া করে থাকতে দেয়া হচ্ছে, সুতরাং তাদের কথার অন্যথা হওয়ার সুযোগ নেইÑ এই হচ্ছে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক চর্চা। যারা ছাত্ররাজনীতিকে আগামী দিনের গণতান্ত্রিক চর্চার সূতিকাগার মনে করেন, কী বলবেন তারা? হলে হলেই নয়, টেন্ডার কিংবা চাকরি পেতেও তারা প্রতিযোগিতায় যেতে নারাজ। সঠিক অর্থে নির্বাচন করে ছাত্রসংসদে বসা এবং ঠিক ঠিক একটি জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলেও আগ্রহী মানুষের অভাব দেখা দিয়েছে। গণতন্ত্রই এখন উল্টো পথে হাঁটছে।
অদ্ভুত হলেও সত্য যে, বুয়েটেও শোনা যায়, দল ক্ষমতায়; এখন আমরাই হলে থাকব, তোমরা বেরিয়ে যাওÑ আমরাই শেষ কথা। বিপদে পড়েছেন নতুন ভিসিÑ এমনিতে ক’জনকে ডিঙিয়ে তাকে দেয়া হয়েছে। সেটা কোনো ব্যাপার হয়তো নয়। কারণ পছন্দটা সর্বোচ্চপর্যায়ের। তেয়াত্তরের অধ্যাদেশে ভিসি নিয়োগের জন্য কী সব নির্বাচন-টির্বাচনের কথা আছে, তা নিয়ে আর কোনো পক্ষকে কথা বলতে শোনা যায় না। নতুন ভিসি নাকি বলেছেন, বুয়েট সব ছাত্রের জন্যই উন্মুক্ত, এটি হবে সহাবস্থানের জায়গা। বিপদটা এ জায়গায়। সোনার ছেলেরা চাইছে, আমরাই শেষ কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেও একটি দলের ছাত্র-ছাত্রী ব্যতিরেকে অন্য কারো স্থান নেইÑ গণতন্ত্রের উর্বর চারণভূমি তো! ডাকসু নির্বাচন এলেই কথাটি জোরেশোরে উচ্চারিত হতো। এখন ডাকসুই নেই। ছেলেমেয়েরা নিয়মিত টাকা দিচ্ছে (তার নাকি হিসাবও ঠিকমতো নেই, হায়!)। স্বৈরাচার এরশাদের সময়েও ডাকসুর নির্বাচন হতে দেখা গেছে। এখন কেবল ডাকসু নয়, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নির্বাচিত সংসদ নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বা কেন, জেলা পরিষদ কিংবা ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়েই বা কী ব্যাখ্যা? ব্যাখ্যা হয়তো আছেÑ যিনি কিছু করেন, সেটার ব্যাখ্যাও তার থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। যেমন এই দেশের সর্বশেষ নির্বাচনÑ যুক্তির তো শেষ দেখি না; এই মিছিলে আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও যোগ দিয়েছেন। ঢাবি কিংবা বুয়েটে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কারো মিছিল শেষ কবে দেখা গেছে তা গবেষণা করেও বের করা কঠিন হবে। অথচ বুয়েটে ক’বছর আগেও চরম ডান-চরম বাম নিয়ে নির্বাচিত ইউকসু ছিল। এখন গণতন্ত্রের চরম উৎকর্ষের সময়Ñ একটি ছাত্রসংগঠন থাকাই যে বাঞ্ছনীয়; কী বলেন! জাতীয় রাজনীতি থেকে ছাত্ররাজনীতি ভিন্ন হয় কী করে!
ছাত্রদলের সুসময়েও একই চিত্র দেখা গেছে। হলের সিট দখল, ক্যান্টিনে বিনে পয়সায় ভোজ আর পাশের মার্কেট-বস্তি থেকে নগদ আদায়। তখন তাদের লোকবলের অভাব ছিল না। নিমেষেই মিছিল-মিটিং লোকাকীর্ণ হয়ে উঠত। এখন! ছাত্রদল একটা জুতসই মিছিলও বের করতে পারে না। যারা তখন দুধ-মাখন-ননি কিংবা গুড়-বাতাসা খেয়েছে, কারো খোঁজ নেই। আবার কেউ কেউ আখের গুছিয়ে আরাম-আয়েশে সময় পার করছেন। জোরজবরদস্তি করে সাময়িক উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়Ñ এই যেমন মিটিংয়ে ছাত্রছাত্রী জড়ো করা, হলে আধিপত্য কায়েম ইত্যাদি। টেন্ডার চাঁদাবাজি কিংবা তদবির-দালালি করে পকেটে হয়তো নগদ আসে, কিন্তু জোরপূর্বক সভাসমিতিতে মানুষ জড়ো করে আখেরে লাভ হয় নাÑ রুমে ফিরতে ফিরতেই মনে মনে খেস্তিখেউড় আওড়ায়। ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের নেতারা এসব বুঝলে ভালো। জাতির জনকের শোকসভায় ছেলেমেয়েদের জোর করে নিতে হবে আর সে জন্য তাদের রাতভর আটকে রাখতে হবে, যাতে অন্যত্র যেতে না পারে, অর্থাৎ তাদের শোকসভায় যেতেই হবে এটি এই সময়ের জন্য মানানসই নয়Ñ কেমন তেতো লাগে শুনতে। কারো চেতনায় আঘাত করতে না পারলে এভাবে জোরজবরদস্তি করে সভায় নিয়ে কোনো দল বা কোনো ব্যক্তির ওপর আস্থা-শ্রদ্ধা-ভক্তি সৃষ্টি করা কঠিন। মত ও পথ নিয়ে দ্বিমত থাকলেও এ ব্যাপারে বরং ছাত্র ইউনিয়ন-শিবির একটু এগিয়ে; জোরজবরদস্তিটা এখনো সেভাবে পেয়ে বসেনি তাদের।
কেবল ছাত্রদের কিংবা ছাত্রসংগঠনের কথাই বা কেনÑ এখন তো সারা দেশেই জোরজবরদস্তির গণতন্ত্র চলছে। সামরিক জান্তা কিংবা একনায়কতন্ত্রের অনুকরণে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই জোরজবরদস্তির শাসন চলছে। কোথাও কোথাও আবার তাতে গণতন্ত্রের লেবাস লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। শুধু ঢাবি আর বুয়েট নয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও কেবল একটি দল মিছিল-মিটিং করতে পারবে। অনেক উপজেলায়ও তাই। এখন পার্টিতন্ত্রই বড় কথা নয়Ñ আমরাই সব। একদল-একনেতা; কেবল সংবিধানে অন্তর্ভুক্তি বাদ আছে। পশ্চিমবঙ্গে বাম-শাসনামলে আমরা আর ওরার খুব প্রচলন ছিল। এখানে সেটিও নেই, আছে আমরাতন্ত্র। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, পদ-পদোন্নতি, টেন্ডার, ভর্তিÑ সর্বত্রই পার্টিতন্ত্র। সরকার বদলের বৈধ পন্থার নাম নির্বাচনÑ জোরদবরদস্তি থেকে মুক্ত ছিল পনেরো বছর। সেটাতেও জিনের আসর লেগেছে। গত কিংবা আগামী নির্বাচন এরশাদীয় মডেলের যে হবে না, তা কে বলবে! সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের নাম গণতন্ত্র। গণতন্ত্র মানেই ভোটের অধিকার। গণতন্ত্র মানেই সব দলের সহাবস্থান। সব দল যেমন ভাবছে না তাদের সহাবস্থান আছে; তেমনি আমজনতা ভোটের অধিকার হারিয়ে দিশেহারা। সংসদ মানেই সরকারি দল আর বিরোধী পক্ষ। কিন্তু আমাদের সংসদের এই হাল দেখে এই সময়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কী লিখবেন বোঝা দায়। এর আগে তো ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ কিংবা ‘লয়াল অপজিশন’ নামে শব্দগুলো এই দেশে চালু ছিল, এখন? এখানেও জোরজবরদস্তিÑ এই জোরজবরদস্তির মধ্যে অন্যরা কিছু পেলেই বা মন্দ কিসে! তেমনটিই যে আমাদের গণতন্ত্রের সার কথা, শেষ কথা। আর এ জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের নতুন করে কিছু একটা লিখতেই হবে। বদলে দিতে হবে গণতন্ত্র-নির্বাচন কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের সংজ্ঞা। নির্বাচনে ভোটাধিকারের বদলে লিখতে হবে পেশিশক্তি-নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব আর উর্দিধারীদের দাপট নিয়ে কয়েকটি অধ্যায়। ক্ষমতার জোরজবরদস্তিই হবে গণতন্ত্রের সারকথা-শেষ কথা। সে ক্ষেত্রে ‘আমরা আর ওরা’ নয়Ñআমরাই শেষ কথা।
No comments