মোনাফেকি যখন অস্ত্র কিংবা অলঙ্কার by গোলাম মাওলা রনি
মোনাফেকির বাংলা কি? আগে জানতাম বিশ্বাসঘাতকতা। কথা দিয়ে কথা না রাখা বা একজনের কথা অন্যজনের কাছে অসদুদ্দেশ্যে বলে দেয়া অথবা চোগলখুরিকেও মোনাফেকি বলা যেতে পারে; কিন্তু আজ উপরিউক্ত শিরোনাম লিখতে বসে যখন ডিকশনারিতে মোনাফেক শব্দের অর্থ খুঁজতে গেলাম, তখন ভারি বিপদে পড়ে গেলাম। বাংলা-ইংরেজির অনেক ডিকশনারি খুঁজে মোনাফেক শব্দের কোনো সন্ধানই পেলাম নাÑ অর্থ তো দূরের কথা। ফলে শব্দটির ভাবার্থ নিয়ে আমাকে কুরআন-হাদিসের দ্বারস্থ হতে হলো। কথায় কথায় আমরা অহরহ শব্দটির ব্যবহার করিÑ অথচ এর প্রকৃত অর্থ জানি না কিংবা বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় শব্দটির কোনো প্রতিশব্দ নেই, এ কথা এত দিন পরে জানার পর জ্ঞানের রাজ্যে নিজেকে এক নিঃস্ব দরিদ্র ফকির বলে প্রতীয়মান হলো।
আজকের লেখার প্রতিপাদ্যÑ রাজনীতিতে মোনাফেকি। রাজনীতির অঙ্গনে কিভাবে মোনাফেকি চলছে এবং কিভাবে সংশ্লিষ্টরা মোনাফেকিকে তাদের গলার মালা, নাকের ফুল কিংবা কানের দুল বানিয়ে নিজেদের অলঙ্কৃত করছে, সেসব বৃত্তান্ত লিখব; কিন্তু তার আগে মোনাফেকি ও মোনাফেক সম্পর্কে একটু ধারণা নেয়া দরকার। এটি একটি আরবি শব্দ। কুরআনে একাধিকবার শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। একাধিক হাদিসও রয়েছে মোনাফেকি সম্পর্কে। মোনাফেক এবং মোনাফেকি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেয়ার সুবিধার্থে কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যাকারকেরা সব সময় উদাহরণ হিসেবে একটি লোককে সামনে নিয়ে আসেন। এই লোকটির নাম হলোÑ আবদ-আল্লাহ ইবনে উবাই। সচরাচর তাকে ডাকা হয়Ñ আবদুল্লাহ বিন উবাই নামে। রাসূল সা:-এর মদিনার জমানার লোক ছিলেন তিনি। তার চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের মধ্যেই রয়েছে মোনাফেকির সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো।
আল্লাহর রাসূল সা: যখন মদিনায় হিজরত করলেন, তখন আবদুল্লাহ বিন উবাই ছিলেন সেখানকার সবচেয়ে বড় এবং প্রভাবশালী নেতা। তার ডাক নাম ছিল ইবনে সালুল। তৎকালীন আরবে ছেলেমেয়েদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাবার নামের পরিচয় বহন করতে হতো। অনেকের আবার পিতৃ পরিচয়ে সঙ্কট দেখা দিলে মায়ের পরিচয় বহন করতে হতো। নিজেদের নাম তারপর ইবনে বা বিনতে শব্দটি বসিয়ে বাবা অথবা মায়ের নাম জুড়ে দেয়া হতো। আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মায়ের নাম ছিল সালুল। লোকজন তাকে কখনো ডাকত ইবনে উবাই, আবার কখনো বা ডাকত ইবনে সালুল বলে। মদিনা কিংবা মক্কার কোনো গোত্রপতিকে তার মা-বাবার দ্বৈত নাম বহন করতে হতো না। নিজের জন্মসংক্রান্ত এহেন সন্দেহ ও অবিশ্বাস ধারণ করা সত্ত্বেও তিনি মদিনাতুল মনওয়ারা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে বসবাসরত সবচেয়ে বড় গোত্র বনু খারাজের গোত্রপতির পদটি ধরে রেখেছিলেন প্রচণ্ড শক্তিমত্তা এবং প্রভাবসহকারে। তার ছিল অনেক সঙ্গী-সাথী এবং অনুসারী। এসব লোক নামে মুসলমান হলেও আল্লাহ-রাসূল সা:কে বাদ দিয়ে ইবনে উবাই বা ইবনে সালুলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করত।
এবার আমরা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কর্ম এবং বৈশিষ্ট্য বর্ণনার মাধ্যমে মোনাফেকির ধরন-ধারণ বুঝতে চেষ্টা করব। তিনি ছিলেন গোত্রপতি এবং একজন ধনবান প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সার পথে প্রধান বাধা ছিলেন আল্লাহর রাসূল সা:। তিনি প্রকাশ্য যুদ্ধ কিংবা দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের মাধ্যমে রাসূল সা:-এর সাথে পেরে ওঠার কোনো সম্ভাবনা দেখতে না পেয়ে নামমাত্র মুসলিম হলেন; কিন্তু অন্তরে কুফরি ধারণ করে রইলেন। মদিনার সবচেয়ে প্রভাবশালী সরদার হিসেবে তিনি রাসূল সা:-এর দরবারে নিয়মিত হাজির থাকতেন এবং নিজের উপস্থিতির সুবাদে সাধারণ মুসলিম ও তার অনুসারীদের বিভ্রান্ত করতেন। তিনি মুসলমানদের গোপন সংবাদগুলো মক্কা এবং হেজাজ অঞ্চলের অপরাপর কাফেরদের কাছে পাচার করতেন। বিচার-সালিস, মদিনা রাষ্ট্র পরিচালনা, যুদ্ধ, সন্ধি প্রভৃতি ক্ষেত্রে তিনি ছলে-বলে-কৌশলে নিজের দুরভিসন্ধি, চক্রান্ত এবং বিভ্রান্ত মতবাদ মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দিতেন। মুসলমানদের দুর্দিনে শয়তানি চাল এবং প্রতারণামূলক অভিপ্রায় নিয়ে এগিয়ে আসতেন এবং বিপদগ্রস্ত অবস্থায় সাহায্য দেয়ার আশ্বাস দিতেন। মুসলমানেরা তার প্রতি আস্থা রেখে বিকল্প সাহায্যের বাকি সব পন্থা অবলম্বন না করে যখন বিপদ-আপদের প্রান্তসীমায় পৌঁছাত, তখন ইবনে উবাই কোনো সাহায্য না করেই বিপদগ্রস্তদের দুর্দশা বহু গুণে বাড়িয়ে দিতেন। তার চক্রান্ত ছিল অতিশয় সূক্ষ্ম এবং বুদ্ধিদীপ্ত। তার বাহ্যিক আচরণ ছিল বন্ধুর মতো। ফলে মুসলমানেরা বারবার প্রতারিত হতেন। তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ রাসূল সা:কে সতর্ক করে দিতেন।
এবার আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলেই মোনাফেকি সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হয়ে যাবে। তিনি রাজনীতি করতেন। ছিলেন একটি গোত্র বা দলের প্রধান। সমগ্র মদিনা বা ইয়াসরিব অঞ্চলের বাদশাহ হওয়ার জন্য দল, সাংগঠনিক শক্তি, দলীয় লোকজনের অর্থবিত্ত ও সামরিক শক্তি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেছিলেন। সোজা পথে তার প্রতিপক্ষের সাথে পেরে উঠছিলেন না। নানামুখী চক্রান্ত ও প্রতারণার মাধ্যমে সে প্রথম প্রথম বিরোধী দলের সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতায় নেমে ব্যর্থ হন। এর পর নিজের ধর্ম ও চরিত্র গোপন রেখে প্রতিপক্ষের ধর্ম ও চরিত্রের মধ্যে একাকার হয়ে যান। ছিলেন চমৎকার একজন অভিনেতা। তার ব্যক্তিত্ব, কথা বলার ধরন এবং মজলিসকে নিয়ন্ত্রণ করার জাদুকরী ও সম্মোহনী ক্ষমতার কারণে অনায়াসে যেকোনো বৈঠকে উপস্থিত লোকজনকে বিভ্রান্ত করে তাদের ওপর নিজের মতামত চাপিয়ে দিতে পারতেন।
তিনি ছিলেন যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং যার পুরোটাই ব্যবহার করত কূটকৌশলে। শুধু মদিনা নয়, সমগ্র আরব উপদ্বীপের পরস্পরবিরোধী প্রায় সব প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের সাথে তার ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এসব যোগাযোগকে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন। তার অন্তর ছিল ঈর্ষায় পরিপূর্ণ। তিনি ক্ষমা করতে জানতেন না। সময় ও সুযোগ পেলেই প্রতিপক্ষের ওপর অত্যাচার, অনাচার এবং অবিচার করতেন। আবার অবস্থা পাল্টে গেলে অত্যাচারিত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সাথে কী করে যেন সম্পর্ক স্বাভাবিক করে ফেলতেন। তার ছিল অসাধারণ বাগ্মিতা। অনবরত কথার দ্বারা প্রতিপক্ষের মনোবল দুর্বল করে দিতেন এবং প্রতিপক্ষের মনে সন্দেহ ও অবিশ্বাস ঢুকিয়ে দিতেন। কোনো কাজ না করেও হতেন সব কাজের কাজী।
ছিলেন ভণ্ড ধার্মিক। মসজিদে যেতেন অনেকের পরে; কিন্তু অন্য সবাইকে অতিক্রম করে সে চলে যেতেন জামাতের প্রথম সারিতে। দাঁড়াতেন প্রতিপক্ষের প্রধান ব্যক্তিদের কাতারে। সবাই যখন রুকু বা সিজদায় ব্যস্ত থাকতেন তখন তিনি ঘাড় বাঁকিয়ে বা মাথা উঁচু করে তার প্রতিপক্ষের একাগ্রতা যাচাই করার চেষ্টা করতেন। নামাজে দাঁড়ানো অবস্থায় চার পাশে, ওপরে এবং নিচে অবলীলায় তাকিয়ে দেখতেনÑ কে কী করে! মূলত ধর্মকে মানতেন না; তবে ধার্মিক হওয়ার ভান করে মানুষজনকে বিভ্রান্ত করতেন।
দলের সরদার হিসেবে কেবল নিজের ও তার পরিবারের স্বার্থই দেখতেন। দলের দরিদ্র লোকদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থটুকু ষোলআনাই আদায় করে নিতেন। তিনি যাদের ব্যবহার করে বিরোধী দলের কাছ থেকে ফায়দা হাসিল করতেন, সেই লোকদের কল্যাণের জন্য কিছুই করতেন না। কেবল নিজের ভণ্ডামি, প্রতারণা ও কথামালার জাদুতে দলীয় লোকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন দিনের পর দিন। মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি যুদ্ধে তার মোনাফেকির কারণে ভয়ানক বিপর্যয় নেমে আসে। ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে বনু কায়নুকার যুদ্ধ, ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে ওহুদের যুদ্ধ, বনু নাজির গোত্রের সঙ্ঘাত ও ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত বনু মোস্তালিফের ঘটনায় আবদুল্লাহ বিন উবাই মুসলমানদের নানামুখী বিপর্যয়ে ফেলেছিলেন। বিশেষ করে বনু মোস্তালিফের ঘটনায় তার কূটকৌশলে মুসলমানদের মধ্যে শুরু হয় অবিশ্বাস, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও আত্মকলহ। এমনকি হজরত ওমর রা: পর্যন্ত আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের দ্বারা বিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়লে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আল কুরআনের ৬৩ নম্বর সূরা নাজিল করেন, যার নাম সূরা মুনাফিক্কুন। এই সূরার আট নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তারা এরূপই বলে যে, মদিনায় ফিরে আমরা দুর্বলদের অবশ্যই সেখান থেকে বের করে দেবো; কিন্তু প্রকৃত মর্যাদা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এবং মুমিনদের জন্য; কিন্তু মোনাফিকরা তা অবগত নয়।’
ওই আয়াতের ব্যাখ্যা বা তফসিরে গেলে বহু সময় লেগে যাবে। তাই আমরা আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের অন্যসব কুকীর্তির মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখি। তিনি দশমুখে প্রতিপক্ষের নামে কুৎসা রটনা করতেন। মা আয়েশা সিদ্দিকা রা: সম্পর্কে কুৎসা ভয়াবহরূপে মদিনায় ছড়িয়ে পড়েছিল কেবল তারই কারণে। ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্পাদিত হুদাইবিয়ার সন্ধির সময়ও তিনি উপস্থিত ছিলেন। অত্যন্ত সফলভাবে মুসলমান ও কাফের উভয় সম্প্রদায়কেই চুক্তিটির নেতিবাচক দিক বর্ণনা করার মাধ্যমে বিভ্রান্ত করেন। মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার অন্যতম চক্রান্ত ছিল ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে, যখন আল্লাহর রাসূল সা: সিরিয়ার বাইজান্টাইন সম্রাটের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন।
মারা যাওয়ার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত এই মোনাফিক সরদার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন মুসলমানদের ঐক্য, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং সব শক্তি বিনষ্ট করার। দলের মধ্যে উপদল সৃষ্টি, বিরোধী দলে ভাঙন, লোভী ব্যক্তিদের একত্র করা, দুর্নীতিবাজদের সংগঠিত করা এবং অন্যায়কারী, জুলুমবাজ ও অপরাধীদের ভালো মানুষদের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়ার দক্ষতার কারণে সমাজের সবাই তাকে যমের মতো ভয় পেত। ৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আবদুল্লাহ বিন উবাই তার কুকর্ম চালিয়ে যেতে থাকেন বিপুল বিক্রমে।
এখন বাংলাদেশের রাজনীতি প্রসঙ্গে আসা যাক। আমাদের সমাজে কে বা কারা আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের চরিত্রের অধিকারী, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলাপের দরকার নেই। সম্মানিত পাঠক-পাঠিকারা তাদের আপন মেধা ও মননশীলতা দিয়ে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের মোনাফেকদের চিহ্নিত করে তাদের হয় প্রতিরোধ, নয়তো ঘৃণা বর্ষণ করবেনÑ এই আশা ব্যক্ত করে শিরোনাম প্রসঙ্গে চলে যাই। শিরোনামে বলা হয়েছে, মোনাফেকি যখন অস্ত্র কিংবা অলঙ্কার হয়! অর্থাৎ সমাজ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সমাজপতিরা যদি মোনাফেকিকে প্রধান অস্ত্র বা হাতিয়ার কিংবা অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করেন, তখন পরিণতি কেমন হয়? আবার সমাজের গণ্যমান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিরা তাদের সব মানবিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কাজে মোনাফেকি করতে করতে পদবিকে তাদের অলঙ্কার বানিয়ে ফেলেন, তখন তাদের দেখতে কেমন মনে হয় এবং পরিণতিই বা কী হয়? এসব বিষয় নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করে আজকের বিষয়ের ইতি টানব।
আমাদের সমাজের গোত্রপতিদের সাথে আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের পার্থক্য হলোÑ তিনি জানতেন নিজে অপরাধ করছেন। কাজেই তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হলেও প্রকাশ্যে নিজের কর্ম নিয়ে গর্ব করতে সাহস পেতেন না; কিন্তু বর্তমান জমানার বেশির ভাগ রাজনীতিক ইবনে উবাইকে অনেক আগেই অতিক্রম করে ফেলেছেন আপন আপন কুকীর্তির বিস্ময়কর মহিমায়। এখনকার নেতারা তাদের মোনাফেকি নিয়ে রীতিমতো গর্ব করেন। তারা দম্ভ করেন। তাদের দ্বারা অত্যাচারিত লোকদের নয়Ñ বরং তাদের মতো অন্য মোনাফেকদের আহ্বান করে বলেনÑ আমার কাছে আসো! আমার কাছে আসো! আমার সাথে মোনাফেকির প্রতিযোগিতা করো, যদি তোমরা পারো! তাদের আসল কথা হলো, দেখো, আমাদের পোশাক পরিচ্ছদ, দেখো আমাদের অন্তর্বাস কিংবা প্রসাধনসামগ্রী। আমরা সব কিছুই মোনাফেকি নামক নিয়ামক দিয়ে তৈরি করেছি। তার পর পরিধান করে নিজেদের মনুষ্যত্বকে হত্যা করে আজব এক প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়েছি। আমরা আল্লাহ, রাসূল, ন্যায়নীতি, বেহেশত-দোজখ, দুনিয়া-আখিরাত-কিয়ামতÑ কিছু মানি না। তোমরা যদি পারোÑ তবে আমাদের কিছু করো। আর না পারলে আমাদের আনুগত্য করোÑ না হয় অত্যাচারিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও!
এখন প্রশ্ন হলোÑ মোনাফেকি যদি অস্ত্র ও অলঙ্কার হয়, তবে সমাজের কী পরিণতি হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদের আবারো আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের কাছে ফিরে যেতে হবে। তিনি ছিলেন মোনাফেক সরদার। তা সত্ত্বেও মোনাফেকি তার একমাত্র বা প্রধান অস্ত্র কিংবা অলঙ্কার ছিল না। ফলে তিনি অনায়াসে ভালো মানুষ সেজে তার প্রতিদ্বন্দ্বী মুমিন মুসলমানদের সাথে মেলামেশা করতে পারতেন। সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক অটুট রাখতে পেরেছিলেন। প্রতিপক্ষের সম্মানিত ব্যক্তিদের সমীহ করতে এবং শত অপরাধ সত্ত্বেও প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে নিজের মর্যাদা ও অবস্থান সমুন্নত রাখতে পেরেছিল। এখানে উল্লেখ্য, আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের মৃত্যু হলে আল্লাহর রাসূল সা: তার মৃতদেহ দেখতে আসেন, শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দেন এবং নিজে মৃতব্যক্তির জানাজা পড়ান। অন্য দিকে, মোনাফেকি যখন প্রধান অস্ত্র ও অলঙ্কার হয়, তখন মানুষ তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপমান, অবিশ্বাস ও নির্যাতন করে মজা পায়।
তাদের চেহারাসুরত থেকে মানুষের স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও পবিত্রতা উধাও হয়ে যায়। সব কিছু কেমন যেন বিকৃত মনে হয়। এক পক্ষ আরেক পক্ষের মৃত্যু কামনা করে। অপর পক্ষের মৃত্যুতে উল্লাস প্রকাশ করে এবং জানাজায় অংশগ্রহণ করে না। তারা একজন অন্যজনের চেহারা পর্যন্ত দেখতে পারে নাÑ এক সাথে বসে না, কথা বলে না এবং কায়মনোবাক্যে একে অপরকে অভিসম্পাত করে। ফলে আসমানের রহমতের দরজা বন্ধ হয়ে যায়Ñ সন্ধি ও সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায় এবং নেমে আসে আসমানি ফয়সালা।
আজকের লেখার প্রতিপাদ্যÑ রাজনীতিতে মোনাফেকি। রাজনীতির অঙ্গনে কিভাবে মোনাফেকি চলছে এবং কিভাবে সংশ্লিষ্টরা মোনাফেকিকে তাদের গলার মালা, নাকের ফুল কিংবা কানের দুল বানিয়ে নিজেদের অলঙ্কৃত করছে, সেসব বৃত্তান্ত লিখব; কিন্তু তার আগে মোনাফেকি ও মোনাফেক সম্পর্কে একটু ধারণা নেয়া দরকার। এটি একটি আরবি শব্দ। কুরআনে একাধিকবার শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। একাধিক হাদিসও রয়েছে মোনাফেকি সম্পর্কে। মোনাফেক এবং মোনাফেকি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেয়ার সুবিধার্থে কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যাকারকেরা সব সময় উদাহরণ হিসেবে একটি লোককে সামনে নিয়ে আসেন। এই লোকটির নাম হলোÑ আবদ-আল্লাহ ইবনে উবাই। সচরাচর তাকে ডাকা হয়Ñ আবদুল্লাহ বিন উবাই নামে। রাসূল সা:-এর মদিনার জমানার লোক ছিলেন তিনি। তার চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের মধ্যেই রয়েছে মোনাফেকির সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলো।
আল্লাহর রাসূল সা: যখন মদিনায় হিজরত করলেন, তখন আবদুল্লাহ বিন উবাই ছিলেন সেখানকার সবচেয়ে বড় এবং প্রভাবশালী নেতা। তার ডাক নাম ছিল ইবনে সালুল। তৎকালীন আরবে ছেলেমেয়েদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাবার নামের পরিচয় বহন করতে হতো। অনেকের আবার পিতৃ পরিচয়ে সঙ্কট দেখা দিলে মায়ের পরিচয় বহন করতে হতো। নিজেদের নাম তারপর ইবনে বা বিনতে শব্দটি বসিয়ে বাবা অথবা মায়ের নাম জুড়ে দেয়া হতো। আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মায়ের নাম ছিল সালুল। লোকজন তাকে কখনো ডাকত ইবনে উবাই, আবার কখনো বা ডাকত ইবনে সালুল বলে। মদিনা কিংবা মক্কার কোনো গোত্রপতিকে তার মা-বাবার দ্বৈত নাম বহন করতে হতো না। নিজের জন্মসংক্রান্ত এহেন সন্দেহ ও অবিশ্বাস ধারণ করা সত্ত্বেও তিনি মদিনাতুল মনওয়ারা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে বসবাসরত সবচেয়ে বড় গোত্র বনু খারাজের গোত্রপতির পদটি ধরে রেখেছিলেন প্রচণ্ড শক্তিমত্তা এবং প্রভাবসহকারে। তার ছিল অনেক সঙ্গী-সাথী এবং অনুসারী। এসব লোক নামে মুসলমান হলেও আল্লাহ-রাসূল সা:কে বাদ দিয়ে ইবনে উবাই বা ইবনে সালুলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করত।
এবার আমরা আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কর্ম এবং বৈশিষ্ট্য বর্ণনার মাধ্যমে মোনাফেকির ধরন-ধারণ বুঝতে চেষ্টা করব। তিনি ছিলেন গোত্রপতি এবং একজন ধনবান প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সার পথে প্রধান বাধা ছিলেন আল্লাহর রাসূল সা:। তিনি প্রকাশ্য যুদ্ধ কিংবা দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের মাধ্যমে রাসূল সা:-এর সাথে পেরে ওঠার কোনো সম্ভাবনা দেখতে না পেয়ে নামমাত্র মুসলিম হলেন; কিন্তু অন্তরে কুফরি ধারণ করে রইলেন। মদিনার সবচেয়ে প্রভাবশালী সরদার হিসেবে তিনি রাসূল সা:-এর দরবারে নিয়মিত হাজির থাকতেন এবং নিজের উপস্থিতির সুবাদে সাধারণ মুসলিম ও তার অনুসারীদের বিভ্রান্ত করতেন। তিনি মুসলমানদের গোপন সংবাদগুলো মক্কা এবং হেজাজ অঞ্চলের অপরাপর কাফেরদের কাছে পাচার করতেন। বিচার-সালিস, মদিনা রাষ্ট্র পরিচালনা, যুদ্ধ, সন্ধি প্রভৃতি ক্ষেত্রে তিনি ছলে-বলে-কৌশলে নিজের দুরভিসন্ধি, চক্রান্ত এবং বিভ্রান্ত মতবাদ মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দিতেন। মুসলমানদের দুর্দিনে শয়তানি চাল এবং প্রতারণামূলক অভিপ্রায় নিয়ে এগিয়ে আসতেন এবং বিপদগ্রস্ত অবস্থায় সাহায্য দেয়ার আশ্বাস দিতেন। মুসলমানেরা তার প্রতি আস্থা রেখে বিকল্প সাহায্যের বাকি সব পন্থা অবলম্বন না করে যখন বিপদ-আপদের প্রান্তসীমায় পৌঁছাত, তখন ইবনে উবাই কোনো সাহায্য না করেই বিপদগ্রস্তদের দুর্দশা বহু গুণে বাড়িয়ে দিতেন। তার চক্রান্ত ছিল অতিশয় সূক্ষ্ম এবং বুদ্ধিদীপ্ত। তার বাহ্যিক আচরণ ছিল বন্ধুর মতো। ফলে মুসলমানেরা বারবার প্রতারিত হতেন। তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ রাসূল সা:কে সতর্ক করে দিতেন।
এবার আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলেই মোনাফেকি সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হয়ে যাবে। তিনি রাজনীতি করতেন। ছিলেন একটি গোত্র বা দলের প্রধান। সমগ্র মদিনা বা ইয়াসরিব অঞ্চলের বাদশাহ হওয়ার জন্য দল, সাংগঠনিক শক্তি, দলীয় লোকজনের অর্থবিত্ত ও সামরিক শক্তি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেছিলেন। সোজা পথে তার প্রতিপক্ষের সাথে পেরে উঠছিলেন না। নানামুখী চক্রান্ত ও প্রতারণার মাধ্যমে সে প্রথম প্রথম বিরোধী দলের সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতায় নেমে ব্যর্থ হন। এর পর নিজের ধর্ম ও চরিত্র গোপন রেখে প্রতিপক্ষের ধর্ম ও চরিত্রের মধ্যে একাকার হয়ে যান। ছিলেন চমৎকার একজন অভিনেতা। তার ব্যক্তিত্ব, কথা বলার ধরন এবং মজলিসকে নিয়ন্ত্রণ করার জাদুকরী ও সম্মোহনী ক্ষমতার কারণে অনায়াসে যেকোনো বৈঠকে উপস্থিত লোকজনকে বিভ্রান্ত করে তাদের ওপর নিজের মতামত চাপিয়ে দিতে পারতেন।
তিনি ছিলেন যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং যার পুরোটাই ব্যবহার করত কূটকৌশলে। শুধু মদিনা নয়, সমগ্র আরব উপদ্বীপের পরস্পরবিরোধী প্রায় সব প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের সাথে তার ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এসব যোগাযোগকে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন। তার অন্তর ছিল ঈর্ষায় পরিপূর্ণ। তিনি ক্ষমা করতে জানতেন না। সময় ও সুযোগ পেলেই প্রতিপক্ষের ওপর অত্যাচার, অনাচার এবং অবিচার করতেন। আবার অবস্থা পাল্টে গেলে অত্যাচারিত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সাথে কী করে যেন সম্পর্ক স্বাভাবিক করে ফেলতেন। তার ছিল অসাধারণ বাগ্মিতা। অনবরত কথার দ্বারা প্রতিপক্ষের মনোবল দুর্বল করে দিতেন এবং প্রতিপক্ষের মনে সন্দেহ ও অবিশ্বাস ঢুকিয়ে দিতেন। কোনো কাজ না করেও হতেন সব কাজের কাজী।
ছিলেন ভণ্ড ধার্মিক। মসজিদে যেতেন অনেকের পরে; কিন্তু অন্য সবাইকে অতিক্রম করে সে চলে যেতেন জামাতের প্রথম সারিতে। দাঁড়াতেন প্রতিপক্ষের প্রধান ব্যক্তিদের কাতারে। সবাই যখন রুকু বা সিজদায় ব্যস্ত থাকতেন তখন তিনি ঘাড় বাঁকিয়ে বা মাথা উঁচু করে তার প্রতিপক্ষের একাগ্রতা যাচাই করার চেষ্টা করতেন। নামাজে দাঁড়ানো অবস্থায় চার পাশে, ওপরে এবং নিচে অবলীলায় তাকিয়ে দেখতেনÑ কে কী করে! মূলত ধর্মকে মানতেন না; তবে ধার্মিক হওয়ার ভান করে মানুষজনকে বিভ্রান্ত করতেন।
দলের সরদার হিসেবে কেবল নিজের ও তার পরিবারের স্বার্থই দেখতেন। দলের দরিদ্র লোকদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থটুকু ষোলআনাই আদায় করে নিতেন। তিনি যাদের ব্যবহার করে বিরোধী দলের কাছ থেকে ফায়দা হাসিল করতেন, সেই লোকদের কল্যাণের জন্য কিছুই করতেন না। কেবল নিজের ভণ্ডামি, প্রতারণা ও কথামালার জাদুতে দলীয় লোকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন দিনের পর দিন। মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি যুদ্ধে তার মোনাফেকির কারণে ভয়ানক বিপর্যয় নেমে আসে। ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে বনু কায়নুকার যুদ্ধ, ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে ওহুদের যুদ্ধ, বনু নাজির গোত্রের সঙ্ঘাত ও ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত বনু মোস্তালিফের ঘটনায় আবদুল্লাহ বিন উবাই মুসলমানদের নানামুখী বিপর্যয়ে ফেলেছিলেন। বিশেষ করে বনু মোস্তালিফের ঘটনায় তার কূটকৌশলে মুসলমানদের মধ্যে শুরু হয় অবিশ্বাস, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও আত্মকলহ। এমনকি হজরত ওমর রা: পর্যন্ত আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের দ্বারা বিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়লে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আল কুরআনের ৬৩ নম্বর সূরা নাজিল করেন, যার নাম সূরা মুনাফিক্কুন। এই সূরার আট নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তারা এরূপই বলে যে, মদিনায় ফিরে আমরা দুর্বলদের অবশ্যই সেখান থেকে বের করে দেবো; কিন্তু প্রকৃত মর্যাদা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের এবং মুমিনদের জন্য; কিন্তু মোনাফিকরা তা অবগত নয়।’
ওই আয়াতের ব্যাখ্যা বা তফসিরে গেলে বহু সময় লেগে যাবে। তাই আমরা আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের অন্যসব কুকীর্তির মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখি। তিনি দশমুখে প্রতিপক্ষের নামে কুৎসা রটনা করতেন। মা আয়েশা সিদ্দিকা রা: সম্পর্কে কুৎসা ভয়াবহরূপে মদিনায় ছড়িয়ে পড়েছিল কেবল তারই কারণে। ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্পাদিত হুদাইবিয়ার সন্ধির সময়ও তিনি উপস্থিত ছিলেন। অত্যন্ত সফলভাবে মুসলমান ও কাফের উভয় সম্প্রদায়কেই চুক্তিটির নেতিবাচক দিক বর্ণনা করার মাধ্যমে বিভ্রান্ত করেন। মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার অন্যতম চক্রান্ত ছিল ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে, যখন আল্লাহর রাসূল সা: সিরিয়ার বাইজান্টাইন সম্রাটের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন।
মারা যাওয়ার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত এই মোনাফিক সরদার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন মুসলমানদের ঐক্য, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং সব শক্তি বিনষ্ট করার। দলের মধ্যে উপদল সৃষ্টি, বিরোধী দলে ভাঙন, লোভী ব্যক্তিদের একত্র করা, দুর্নীতিবাজদের সংগঠিত করা এবং অন্যায়কারী, জুলুমবাজ ও অপরাধীদের ভালো মানুষদের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়ার দক্ষতার কারণে সমাজের সবাই তাকে যমের মতো ভয় পেত। ৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আবদুল্লাহ বিন উবাই তার কুকর্ম চালিয়ে যেতে থাকেন বিপুল বিক্রমে।
এখন বাংলাদেশের রাজনীতি প্রসঙ্গে আসা যাক। আমাদের সমাজে কে বা কারা আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের চরিত্রের অধিকারী, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলাপের দরকার নেই। সম্মানিত পাঠক-পাঠিকারা তাদের আপন মেধা ও মননশীলতা দিয়ে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের মোনাফেকদের চিহ্নিত করে তাদের হয় প্রতিরোধ, নয়তো ঘৃণা বর্ষণ করবেনÑ এই আশা ব্যক্ত করে শিরোনাম প্রসঙ্গে চলে যাই। শিরোনামে বলা হয়েছে, মোনাফেকি যখন অস্ত্র কিংবা অলঙ্কার হয়! অর্থাৎ সমাজ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সমাজপতিরা যদি মোনাফেকিকে প্রধান অস্ত্র বা হাতিয়ার কিংবা অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করেন, তখন পরিণতি কেমন হয়? আবার সমাজের গণ্যমান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিরা তাদের সব মানবিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কাজে মোনাফেকি করতে করতে পদবিকে তাদের অলঙ্কার বানিয়ে ফেলেন, তখন তাদের দেখতে কেমন মনে হয় এবং পরিণতিই বা কী হয়? এসব বিষয় নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করে আজকের বিষয়ের ইতি টানব।
আমাদের সমাজের গোত্রপতিদের সাথে আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের পার্থক্য হলোÑ তিনি জানতেন নিজে অপরাধ করছেন। কাজেই তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হলেও প্রকাশ্যে নিজের কর্ম নিয়ে গর্ব করতে সাহস পেতেন না; কিন্তু বর্তমান জমানার বেশির ভাগ রাজনীতিক ইবনে উবাইকে অনেক আগেই অতিক্রম করে ফেলেছেন আপন আপন কুকীর্তির বিস্ময়কর মহিমায়। এখনকার নেতারা তাদের মোনাফেকি নিয়ে রীতিমতো গর্ব করেন। তারা দম্ভ করেন। তাদের দ্বারা অত্যাচারিত লোকদের নয়Ñ বরং তাদের মতো অন্য মোনাফেকদের আহ্বান করে বলেনÑ আমার কাছে আসো! আমার কাছে আসো! আমার সাথে মোনাফেকির প্রতিযোগিতা করো, যদি তোমরা পারো! তাদের আসল কথা হলো, দেখো, আমাদের পোশাক পরিচ্ছদ, দেখো আমাদের অন্তর্বাস কিংবা প্রসাধনসামগ্রী। আমরা সব কিছুই মোনাফেকি নামক নিয়ামক দিয়ে তৈরি করেছি। তার পর পরিধান করে নিজেদের মনুষ্যত্বকে হত্যা করে আজব এক প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়েছি। আমরা আল্লাহ, রাসূল, ন্যায়নীতি, বেহেশত-দোজখ, দুনিয়া-আখিরাত-কিয়ামতÑ কিছু মানি না। তোমরা যদি পারোÑ তবে আমাদের কিছু করো। আর না পারলে আমাদের আনুগত্য করোÑ না হয় অত্যাচারিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও!
এখন প্রশ্ন হলোÑ মোনাফেকি যদি অস্ত্র ও অলঙ্কার হয়, তবে সমাজের কী পরিণতি হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদের আবারো আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের কাছে ফিরে যেতে হবে। তিনি ছিলেন মোনাফেক সরদার। তা সত্ত্বেও মোনাফেকি তার একমাত্র বা প্রধান অস্ত্র কিংবা অলঙ্কার ছিল না। ফলে তিনি অনায়াসে ভালো মানুষ সেজে তার প্রতিদ্বন্দ্বী মুমিন মুসলমানদের সাথে মেলামেশা করতে পারতেন। সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক অটুট রাখতে পেরেছিলেন। প্রতিপক্ষের সম্মানিত ব্যক্তিদের সমীহ করতে এবং শত অপরাধ সত্ত্বেও প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে নিজের মর্যাদা ও অবস্থান সমুন্নত রাখতে পেরেছিল। এখানে উল্লেখ্য, আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের মৃত্যু হলে আল্লাহর রাসূল সা: তার মৃতদেহ দেখতে আসেন, শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দেন এবং নিজে মৃতব্যক্তির জানাজা পড়ান। অন্য দিকে, মোনাফেকি যখন প্রধান অস্ত্র ও অলঙ্কার হয়, তখন মানুষ তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপমান, অবিশ্বাস ও নির্যাতন করে মজা পায়।
তাদের চেহারাসুরত থেকে মানুষের স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও পবিত্রতা উধাও হয়ে যায়। সব কিছু কেমন যেন বিকৃত মনে হয়। এক পক্ষ আরেক পক্ষের মৃত্যু কামনা করে। অপর পক্ষের মৃত্যুতে উল্লাস প্রকাশ করে এবং জানাজায় অংশগ্রহণ করে না। তারা একজন অন্যজনের চেহারা পর্যন্ত দেখতে পারে নাÑ এক সাথে বসে না, কথা বলে না এবং কায়মনোবাক্যে একে অপরকে অভিসম্পাত করে। ফলে আসমানের রহমতের দরজা বন্ধ হয়ে যায়Ñ সন্ধি ও সমঝোতার সব পথ রুদ্ধ হয়ে যায় এবং নেমে আসে আসমানি ফয়সালা।
No comments