প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও এগোতে চায় জামায়াত by ফয়েজ উল্লাহ ভূঁইয়া
বছরের পর বছর অফিস বন্ধ, শীর্ষ নেতারা
কারাগারে, নেতাকর্মীদের ফেরারি জীবন, মিছিল, সভা-সমাবেশে অঘোষিত
নিষেধাজ্ঞা, হাজার হাজার মামলার বোঝা, হাজার হাজার নেতাকর্মীর কারাবন্দী
জীবন, প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কর্মসূচি ঘোষণা এবং ঘরোয়াভাবে গোপনে
কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে চলছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল ও প্রধান
ইসলামপন্থী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। পাশাপাশি মানবতাবিরোধী অপরাধের
মামলাসহ অন্যান্য মামলায় শীর্ষ নেতাদের শাস্তির মুখোমুখি হওয়া এবং নির্বাচন
কমিশনে নিবন্ধন বাতিল হওয়ার মতো পরিস্থিতিও রয়েছে। সাংগঠনিক দক্ষতা এবং
শৃঙ্খলার ওপর ভর করে এ ধরনের চরম প্রতিকূল ও কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে
সামনে এগোচ্ছে দলটি। প্রথম সারির নেতাদের অনুপস্থিতিতে দ্বিতীয় ও তৃতীয়
সারির নেতাদের নেতৃত্বে জামায়াতের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। সঙ্গত কারণেই দলের
সামগ্রিক কাজে স্বাভাবিক গতি নেই। জামায়াতের অন্যতম লক্ষ্য দক্ষ, যোগ্য ও
চরিত্রবান জনশক্তি সৃষ্টি কাজসহ অন্যান্য নিয়মিত কাজও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তবে চরম বৈরী পরিবেশ মোকাবেলা করে রাজপথে সাহসী ভূমিকা পালন এবং বিগত
বছরগুলোয় জামায়াতের প্রতি সরকারি দমন-পীড়নমূলক আচরণের কারণে দলটির
জনপ্রিয়তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে বছরের শুরুতে
অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে জামায়াতের বিপুল বিজয়ের মধ্য দিয়ে সেই চিত্রই
ফুটে ওঠে।
জামায়াতের নীতিনিধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, একটি আদর্শবাদী রাজনৈতিক দল হিসেবে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করে সামনে এগোনোর মতো শক্তি-সামর্থ্য জামায়াতের রয়েছে এবং জামায়াত সেভাবেই এগোচ্ছে। যে পদ্ধতিতেই হোক জামায়াত সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে চাচ্ছে। শীর্ষ নেতাদের অনুপস্থিতিতে ভীষণ শূন্যতা অনুভব করলেও দলের কোনো পর্যায়ে নেতৃত্ব সঙ্কট দেখা দেয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। ৫ জানুয়ারির আগে জামায়াত নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে যেভাবে সক্রিয় ছিল এখনো আন্দোলন প্রশ্নে সেই অবস্থানে রয়েছে এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রস্তুতি রয়েছে। সরকারি দলের সাথে জামায়াতের সমঝোতা বা আঁতাতের গুঞ্জনকে স্রেফ অপপ্রচার আখ্যায়িত করছেন নেতারা। তারা বলছেন, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত সরকার জামায়াতের সাথে যে আচরণ করেছে এবং করছে, তাতে এই সরকারের সাথে কোনো রকমের সমঝোতার প্রশ্নই আসে না। জামায়াত ২০ দলীয় জোটের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে। পাশাপাশি নিজস্ব দলীয় কর্মসূচিও পালন করছে। জামায়াত নেতারা মনে করছেন, সংগঠনিক দক্ষতা, রাজনৈতিক দৃঢ়তা এবং গণতান্ত্রিক পন্থা অনুসরণের কারণেই জামায়াত মানুষের আস্থা অর্জন করছে। গত উপজেলা নির্বাচনে ৩৬টি চেয়ারম্যান পদসহ ২০১টি পদে বিজয়ের মধ্য দিয়ে জামায়াতের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির দিকটি পরিষ্কার হয়ে ওঠে বলেও তারা মনে করছেন। প্রথম দফার পর নির্বাচনে চরম অনিয়ম ও কারচুপি না হলে জামায়াত আরো অনেক পদে বিজয়ী হতো বলে নেতারা দাবি করছেন।
সর্বশেষ দলের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের নামাজে জানাজায় বায়তুল মোকাররমে লাখো মানুষের অংশগ্রহণের ঘটনায় জামায়াতের নেতাকর্মীরা কিছুটা উজ্জীবিত। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক একে একে অধ্যাপক গোলাম আযমসহ অন্য কয়েকজন নেতার শাস্তির রায় ঘোষিত হওয়া এবং মিডিয়ার বৈরী প্রচারণার মুখেও কয়েক ঘণ্টার নোটিশে বায়তুল মোকাররমে নামাজে জানাজায় লাখো মানুষের অংশ নেয়ার ঘটনা ঘটে। নামাজে জানাজায় মানুষের ঢল নামার বিষয়টি এখন আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। তবে স্বাভাবিক পরিবেশ থাকলে এই নামাজে জানাজায় উপস্থিতি আরো অনেক বেশি হতো বলে নেতারা বলছেন। সরকারি তরফে নামাজে জানাজায় বাধা দেয়া না হলেও নামাজে জানাজায় অংশ নিতে পারেননি দলের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা: শফিকুর রহমান, ঢাকা মহানগর আমির রফিকুল ইসলাম খানসহ কেন্দ্রীয় ও মহানগরীর অনেক নেতা।
মূলত ২০১০ সালের ২৯ জুন জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে জামায়াতে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়ার সূচনা হয়। এরপর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং বাকিদের গ্রেফতার, বিচারপ্রক্রিয়া এবং সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমসহ পাঁচ শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে রায় দেয়ার ঘটনা ঘটে। তাদের মধ্যে গত ডিসেম্বরে সহকারী সেক্রেটারি আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরও করা হয়। গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদানের মধ্য দিয়ে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের রায়ের সূচনা হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির দণ্ড দিয়ে রায় দেয়া হলে সারা দেশে ব্যাপক বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। বিক্ষোভ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে সাধারণ মানুষসহ দেড় শতাধিক লোক নিহত হন। পরে কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট তাকে ফাঁসির দণ্ড প্রদান করে এবং সর্বশেষ গত ১২ ডিসেম্বর সে রায় কার্যকর করে সরকার। এ দিকে গত বছরের ১ আগস্ট হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে রায় দেন। পরে জামায়াত রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করে। এসব ঘটনায় ২০১২ সালের নভেম্বর মাস থেকে জামায়াত হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। একইসাথে আইনি লড়াইও চালিয়ে যাচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ২০ দলের আন্দোলনেও জামায়াত সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে আসছে। এসব আন্দোলন-সংগ্রামে জামায়াতের দুই শতাধিক নেতাকর্মী নিহত হন।
প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে জামায়াতের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর অফিসসহ দেশের প্রায় সব অফিস বন্ধ রয়েছে। জামায়াতকে কোথাও সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। বাসাবাড়িতে বৈঠক করতে গেলেও ধরে নিয়ে গিয়ে মামলায় জড়ানো হচ্ছে। এরই মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শুরু হওয়া ছয় দফায় অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে জামায়াত ভালো ফলাফল করে। প্রথম দফার পর কার্যত নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির ঘটনা ঘটলেও জামায়াত সব মিলিয়ে ২০১টি পদে জয় লাভ করে। এর মধ্যে চেয়ারম্যান ৩৬টি, ভাইস চেয়ারম্যান ( পুরুষ) ১২৯টি ও ভাইস চেয়ারম্যান (মহিলা) ৩৬টি পদে বিজয় লাভ করে, যা এর আগের উপজেলা নির্বাচনের চেয়ে অনেক বেশি। উপজেলা নির্বাচনে বিজয়ী হলেও নির্বাচিতদের অনেককে শপথ নেয়ার সময় গ্রেফতার করা হয়। এখনো বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান কারাগারে রয়েছেন। বাকিরা জামিনে থাকলেও অনেক উপজেলায় প্রকাশ্যে ঠিকভাবে কার্যক্রম চালাতে পারছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মামলার রায় অপেক্ষমাণ রয়েছে। ইতোমধ্যেই নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে ট্রাইব্যুনালে দেয়া ফাঁসির দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আপিল বিভাগ। মামলা চলাকালীন আরেক নায়েবে আমির মাওলানা এ কে এম ইউসুফ ইন্তেকাল করেছেন। ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানকে। গত বছর আপিল বিভাগের দেয়া ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার। এ ছাড়া এখনো কারাবন্দী ও বিচারের মুখোমুখি রয়েছেন নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুস সুবহান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম এবং নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী। দলের আরেক নায়েবে আমির অধ্যাপক নাজির আহমদ কয়েক মাস আগে ইন্তেকাল করেছেন। বর্তমানে দলের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ আত্মগোপনে রয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি ডা: শফিকুর রহমানেরও একই অবস্থা। একই অবস্থায় দীর্ঘ দিন ধরে আত্মগোপনে রয়েছেন দলের ঢাকা মহানগর আমির মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, নায়েবে আমির হামিদুর রহমান আযাদ ও সেক্রেটারি নূরুল ইসলাম বুলবুল। মহানগরীর সহকারী সেক্রেটারি ডা: শফিকুল ইসলাম মাসুদকে গত ৯ আগস্ট গ্রেফতার করা হয়।
এভাবে চার বছরেরও বেশি সময় ধরে জামায়াত অঘোষিত নিষেধাজ্ঞার মতো অবস্থায় রয়েছে। গোপন স্থান থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কর্মসূচি ঘোষণা করে আসছে। পুলিশ প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে চোরাগোপ্তা মিছিল সমাবেশ এবং ঘরোয়াভাবে গোপনে কর্মসূচি পালন করে আসছে। একই সাথে বর্তমানে ২০ দলীয় জোটের ঘোষিত কর্মসূচিতেও নেতাকর্মীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন।
জামায়াতের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে দলের প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অধ্যাপক তাসনীম আলম বলেন, মূলত রাজনৈতিক দলের তৎপরতা থাকে অফিস কেন্দ্রিক। কিন্তু সরকার বছরের পর বছর জামায়াতের অফিস বন্ধ করে রেখেছে। কাউকে বসতে দিচ্ছে না। মিছিল-মিটিং ও সমাবেশ করতে দিচ্ছে না। ঘরোয়াভাবেও নেতাকর্মীরা মিলিত হলে নাশকতার পরিকল্পনার অজুহাত দাঁড় করিয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে। ধরে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এসব প্রতিকূলতার মধ্যেই জামায়াতকে কাজ করতে হচ্ছে। যতটুকু সম্ভব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শীর্ষ নেতাদের অনুপস্থিতিতে তাদের অভাব সবাই উপলব্ধি করে এবং তাদের মুক্তির আন্দোলনও অব্যাহত আছে; কিন্তু তাদের অনুপস্থিতিতেও নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্য-দক্ষ নেতা জামায়াতে রয়েছে। সেভাবেই সংগঠন পরিচালিত হচ্ছে। সরকারের সাথে আঁতাতের গুঞ্জনের ব্যাপারে তিনি বলেন, আঁতাতের প্রশ্নই আসে না। এসব অপপ্রচার জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য। রাজপথে জামায়াতের অতীত ভূমিকায় ভীত হয়ে ২০ দলীয় জোটে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির জন্যই এসব মনগড়া কথা বাজারে ছাড়া হচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন এবং দাবি আদায়ের ব্যাপারে জামায়াত কতটুকু আশাবাদী জানতে চাইলে তাসনীম আলম বলেন, এটা পরিষ্কার, এই সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। এই সরকারের ওপর জনগণের কোনো আস্থা নেই। কার্যত দেশ অচল। মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। জনগণ সরকারের ওপর ুব্ধ। গণবিচ্ছিন্ন এমন একটি সরকার প্রশাসনের ওপর ভর করে বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। আন্দোলন অবশ্যই একটা পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবে এবং তার সাথে জনগণও সম্পৃত্ত হবে। আন্দোলনে এই সরকার বিদায় হবে এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন আসবে বলে আমরা আশাবাদী।
No comments