গচ্চা দিয়ে গম আমদানি by দীন ইসলাম
প্রতি টনে ৫০ দশমিক ৫০ ডলার বা ৩৯৮৯ দশমিক ৫০ টাকা (প্রতি ডলার ৭৯ টাকা হিসাবে) বেশিতে ইউক্রেন থেকে জিটুজি ভিত্তিতে গম কিনতে যাচ্ছে সরকার। তাই আড়াই লাখ টন গম কিনতে শত কোটি টাকা গচ্চা যাবে খাদ্য অধিদপ্তরের। আন্তর্জাতিক বাজারে গমের সঙ্কট না থাকলেও দরপত্র ছাড়া এভাবে গম কেনা নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই গম কেনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর। বরং একটি সিন্ডিকেটকে অনৈতিক সুবিধা দিতে জোর কদমে এগিয়ে যাচ্ছেন তারা। অর্থনৈতিক বিষয়ক-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে জরুরি প্রয়োজনে সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গম কেনার প্রস্তাবে অনাপত্তি দেয়ার একদিনের ব্যবধানে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের জন্য একটি প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে খাদ্য অধিদপ্তর এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ে নানা কানাঘুষা শুরু হয়েছে। নিজেদের মধ্যে বলাবলি ছাড়া কেউ কিছু জানাতে রাজি হচ্ছেন না। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইউক্রেন থেকে প্রতি টন ২৯৭ দশমিক ৫০ ডলার দরে আড়াই লাখ টন গম কিনতে লাগছে ৭ কোটি ৪৩ লাখ ৭৫ হাজার ডলার বা ৫৮৭ কোটি ৫৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। অ্যাগ্রি মার্কেট উইকলি’র ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ইউক্রেনের বাজারে প্রতি টন গমের দাম ২৪৭ ডলারের বেশি নয়। ওই হিসাবে প্রতি টন গম ৫০ দশমিক ৫০ ডলার বেশি দরে কেনা হচ্ছে। সব মিলিয়ে আড়াই লাখ টন গম কিনতে ১ কোটি ২৬ লাখ ২৫ হাজার ডলার বা ৯৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা গচ্চা যাবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সারওয়ার খান মানবজমিনকে বলেন, ইউক্রেন থেকে কেনা গমের দাম আমার মনে হয় ঠিকই আছে। ২০১১ সালের পর থেকে রেট দেখলে এটা আপনিও ঠিক বলবেন। এ বিষয়ে অনেক বার্গেনিং হয়েছে। সাপোর্টিং কাগজপত্রও তাই বলে। গম মজুত পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে জিটুজি ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। তিনি বলেন, আগামীতে আরও গম কিনতে হবে। সেটা জিটুজি বা আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে হতে পারে। দেশে দেড় লাখ টনের বেশি উৎপাদন হয় না। তাই আমাদের গম কিনেই চাহিদা পূরণ করতে হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জিটুজি ভিত্তিতে গম কেনার ক্ষেত্রে পুরনো তথ্যকে পুঁজি করা হয়েছে। নতুন কোন তথ্য সামনের দিকে নিয়ে আসা হয়নি। জিটুজি ভিত্তিতে গম আমদানির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো ৩০শে সেপ্টেম্বরের সার সংক্ষেপে নানা তথ্য গোপন করা হয়েছে। বর্তমানে গমের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে পড়তির দিকে এ তথ্যটি উল্লেখ করা হয়নি। এদিকে তিন মাস আগে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে গম কেনার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এটা বাদ দিয়ে জিটুজি পর্যায়ে উচ্চমূল্যে আড়াই লাখ টন গম কেনা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ইউক্রেন সফর করেন খাদ্যমন্ত্রী। এরপর ১৮ই সেপ্টেম্বর ইউক্রেনের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সমঝোতায় প্রতি টন ২৯৭ দশমিক ৫০ ডলার দর চূড়ান্ত করা হয়েছে। গত ১৭ ও ১৮ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে এ বৈঠক হয়। এ বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সারওয়ার খান, পরিচালক (ক্রয়) মো. তোফাজ্জল হোসেন, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. আতাউর রহমান এবং এফপিএমইউ’র মহাপরিচালক নাসরীন ফরিদ উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে ইউক্রেন সরকারের পক্ষে ওই দেশের খাদ্য দপ্তরের ডেপুটি চেয়ারম্যান এবং ওই দেশের খাদ্যমন্ত্রীর দু’জন উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। এদের মধ্যে একজন উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম। গম কেনার নেগোসিয়েশন বৈঠকের কার্যবিবরণী সূত্রে জানা গেছে, ইউক্রেনের পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ টন গম বিক্রির প্রস্তাব দেয়া হয়। ওই সময় বাংলাদেশ পক্ষ জানায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আড়াই লাখ টন এবং বাকি আড়াই লাখ টন ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে কেনা হবে। এর মধ্যে শতকরা ৯৯ ভাগ অর্থ শিপমেন্টের সময়ই পরিশোধ করতে হবে। শুধু শতকরা ১ ভাগ অর্থ সর্বশেষ চালান আসার পর পরিশোধ করতে হবে। নেগোসিয়েশন সভায় বলা হয়, ইউক্রেনপক্ষ প্রতি টন গম মংলা বা চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সরবরাহে ৩৩৫ ডলার দর প্রস্তাব দেয়। ওই সময় তাদের তিন ধাপে জিটুজি ভিত্তিতে ইউক্রেন থেকে গম কেনার দর জানিয়ে বলা হয়, আপনাদের উল্লিখিত গমের মূল্য অত্যন্ত বেশি। এরপর বাংলাদেশ পক্ষ প্রথমে প্রতি টন ২৮৪ ডলার দেয়ার কথা জানায়। এ কারণে ১৭ই সেপ্টেম্বর কোন ধরনের সমঝোতা হয়নি। এরপর ১৮ই সেপ্টেম্বরের নেগোসিয়েশন সভায় প্রতি টন গমের দাম ৩০২ ডলার পুনঃপ্রস্তাব করে ইউক্রেন। এরপর প্রতি টন গমের দাম ২৯৭ দশমিক ৫০ ডলার চূড়ান্ত করা হয়। খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে গমের সাম্প্রতিক মূল্য পরিস্থিতি পড়তির দিকে। গত ১৫ই সেপ্টেম্বর অ্যাগ্রি মার্কেট উইকলি-এর ওয়েবসাইটে ইউক্রেনের গমের মূল্য প্রতি টন ২৪৭ ডলার দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া একই দিনে পার্শ্ববর্তী দেশ রাশিয়াতে প্রতি টন ২২০ ডলার ও কাজাখস্থানে ২৪৫ ডলার দেখানো হয়। তিন দেশের গড় মূল্য দাঁড়ায় ২৩৭ ডলার। এর পরও খাদ্য অধিদপ্তরের বাজার দর যাচাই কমিটি গমের প্রাক্কলিত বাজার মূল্য প্রতি টন ২৯৫ থেকে ৩০৫ ডলার হতে পারে বলে মত দেয়। ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো সার সংক্ষেপ সূত্রে জানা গেছে, খাদ্য অধিদপ্তরের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী গম রপ্তানি করবে ইউক্রেন। শিপমেন্টের সময়সীমা হবে চুক্তি স্বাক্ষরের দিন থেকে ১৫০ দিন বা পাঁচ মাস এবং চুক্তি স্বাক্ষরের দিন থেকে ৬০ দিন বা দুই মাসের মধ্যে প্রথম জাহাজ শিপমেন্ট করতে হবে। এদিকে জিটুজি ভিত্তিতে গম কিনতে খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করানো হয়েছে। মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো সার সংক্ষেপে বলা হয়েছে, জিটুজি ভিত্তিতে চুক্তির আওতায় ইউক্রেন থেকে বিভিন্ন সময় তিন লাখ ১২ হাজার টন গম আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২ লাখ টন গম আমদানি করা হয়েছে। গত অর্থবছরে দেখা যায় আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে সর্বনিম্ন দরদাতার সঙ্গে চুক্তি করা হলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে দরদাতা প্রতিষ্ঠান গম সরবরাহে ব্যর্থ হয়। ওই দরদাতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিধিগত ব্যবস্থা নিতে গেলে দরদাতা প্রতিষ্ঠান আইনের আশ্রয় নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি করে। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গম পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে না। গত অর্থবছরে ১০টি প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান করা হলেও ঠিক সময়ে গম সরবরাহ করতে না পারায় কার্যাদেশপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের চারটি চুক্তি বাতিল এবং পারফরমেন্স গ্যারান্টি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এ কারণে আন্তর্জাতিক দরপত্রের পাশাপাশি জিটুজি পর্যায়ে গম আমদানির লক্ষ্যমাত্রার একটি অংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হলে গমের সন্তোষজনক মজুত বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গণখাতে ক্রয় আইন, ২০০৬ (পিপিএ) ও গণখাতে ক্রয় বিধি, ২০০৮ (পিপিআর) এ ‘জিটুজি’ বলে কোন ক্রয় পদ্ধতি নেই। বরং পিপিএ ও পিপিআর এ উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক সর্বনিম্ন দরে পণ্য/সেবা ক্রয়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আমদানিনীতি আদেশেও রয়েছে একই ধরনের বাধ্যবাধকতা। ক্রয় আইন পিপিএ’র ৬৮(১) ধারায় বলা আছে: রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয়সম্পর্কিত বিশেষ বিধান-(১) সরকার, রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজনে বা বিপর্যয়কর কোন ঘটনা মোকাবিলার জন্য, জনস্বার্থে, সরকার কর্তৃক গঠিত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সুপারিশক্রমে, ধারা ৩২-এ বর্ণিত সরাসরি ক্রয়পদ্ধতি বা অন্য কোন ক্রয়পদ্ধতি অনুসরণ করিয়া ক্রয়কার্য সম্পন্ন করিতে পারিবে। তাই পিপিএ’র এর কোন ধারায় ‘জিটুজি’ বলে কিছু নেই। বরং রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজন বা বিপর্যয়কর কোন ঘটনা ছাড়াই স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দরপত্র আহ্বান না করে ‘জিটুজি’র আশ্রয়ে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় গম কেনা হচ্ছে। এদিকে চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে ৯ লাখ টন গম আমদানি খাতে দুই হাজার ৪১৭ কোটি ৪০ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে ১৬০ কোটি ৫২ লাখ ৯৯ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ অর্থ দিয়েই ৯ লাখ টন গম কেনা হবে। বর্তমানে দেশে গম মজুতের পরিমাণ ২ লাখ ৭০ হাজার টন।
No comments