‘রাজনৈতিক সহিংসতা আর নয়’ শীর্ষক প্রথম আলোর গোলটেবিল আলোচনা সমাধান খুঁজতে হবে রাজনীতিকদেরই
আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট
সমাধানের উপায় বের করা ছাড়া সহিংসতা বন্ধের সংক্ষিপ্ত কোনো পথ খোলা নেই। এই
আলাপ-আলোচনা হতে হবে ক্ষমতার রাজনীতির বাইরেও গণতন্ত্রকে সুসংহত করা,
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে।
তবে
রাজনৈতিক অঙ্গনে সমঝোতার পাশাপাশি সুশীল বা নাগরিক সমাজ সোচ্চার হতে
পারলেও সহিংসতা প্রশমন সম্ভব। অবশ্য এ জন্য নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিজ
নিজ রাজনৈতিক অবস্থানের বাইরে এসে একটি নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে হবে।
প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। গতকাল শনিবার প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘রাজনৈতিক সহিংসতা আর নয়’ শীর্ষক এ আলোচনার আয়োজন করা হয়।
আলোচনায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, ‘দেশের সব মানুষ রাজনৈতিক সহিংসতার অবসান চায়। কিন্তু আমরা চাইলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। সবকিছুর একটা প্রক্রিয়া আছে। এ সমস্যার সমাধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকেই আসতে হবে। যদি না আসে, তাহলে সচেতন দেশবাসী অতীতের মতো তাদের পথ বেছে নেবে। সেই প্রক্রিয়ায় নতুন রাজনৈতিক শক্তিরও আবির্ভাব হতে পারে। তবে তা প্রতিষ্ঠিত সরকারকে হটিয়ে অগণতান্ত্রিক পন্থায় আসা কোনো শক্তি নয়। গণতান্ত্রিক পন্থায়ই নতুন রাজনৈতিক শক্তি বের হয়ে আসতে পারে।’
আকবর আলি বলেন, ‘মাইনাস টু কিংবা বিরাজনীতিকীকরণ কোনো সমাধান বলে আমি নিজেও মনে করি না। বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করে আরও বেশি রাজনীতিকীকরণ করতে হবে।’ তিনি বলেন, গণতন্ত্র ও সব ধর্মের সহাবস্থানের আদর্শ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত ও প্রতিষ্ঠিত। এই আদর্শের সঠিক চর্চা হলে ধর্মান্ধতার যতই বিস্তার দেখা যাক না কেন, তাতে রাষ্ট্রের ভিত নড়বড়ে হতে পারে না। বর্তমানে যে ধর্মান্ধ শক্তি রাজনীতিতে আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে, তারও কারণ গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা না হওয়া। নাগরিক সমাজ সোচ্চার হলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। তা ছাড়া নাগরিক সমাজও রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, নাগরিক সমাজ বিভিন্ন সময় অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। অনেক কথা বলেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কখনো সাড়া পাওয়া যায়নি। বরং অনেক সময় বিরূপ প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। আর বর্তমানে রাজনৈতিক সহিংসতার মাত্রা যে পর্যায়ে গেছে, তা নিরসনের জন্য একটি সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার মতো নেতৃত্ব নাগরিক সমাজে গড়ে ওঠেনি।
বর্তমান অবস্থা ব্যাখ্যা করে সুলতানা কামাল বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর করার চেষ্টা হচ্ছে। বিচার বিভাগ স্বকীয়তা হারিয়েছে। কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার সঙ্গে যাঁদের সম্পর্ক আছে, তাঁরা ছাড়া সবাই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মানুষের নিরাপত্তাবোধ সংকুচিত হয়ে গেছে। রাস্তায় বের হওয়া যাবে কি না, সন্তানেরা স্কুলে যেতে পারবে কি না, কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে একত্র হওয়া নিরাপদ হবে কি না—এসব বিষয়ও এখন মানুষের বড় ভাবনায় পরিণত হয়েছে।
খ্যাতিমান এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, বর্তমানে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সহিংসতা সমাধানে নাগরিক সমাজের ভূমিকা নিয়ামক না হলেও সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে নাগরিক সমাজকে সোচ্চার হতে হবে। কারণ, গণতন্ত্র শুধু নির্বাচনকালীন বিষয় নয়। নির্বাচনের পরও যাতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সচল থাকে, সে বিষয়ে ভূমিকা রাখা নাগরিক সমাজের দায়িত্ব। তিনি বলেন, জনগণের করের টাকায় পরিচালিত জাতীয় সংসদে বসে রাজনীতিকেরা যে ভাষায় কথাবার্তা বলছেন, তারও প্রতিবাদ নাগরিক সমাজকে করতে হবে। তাঁদের কথার মধ্যে শুধু অশ্লীলতা নয়, আছে সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ এবং পরস্পরের প্রতি হুমকি-ধমকিও।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রধান ভাবনা নির্বাচনকেন্দ্রিক। কিন্তু নাগরিক সমাজের সামনে আরও কিছু আলোচ্য বিষয় আছে। যেমন সুশাসনের ক্ষেত্রে সার্বিক ধস; রাষ্ট্রক্ষমতার সহিংস ব্যবহার; মামলা-মোকদ্দমার অপব্যবহার প্রভৃতি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সহিংস গোষ্ঠীগুলো কাজ করছে এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি রাজনৈতিক নেতৃত্বও উগ্রতা ও উচ্ছৃঙ্খলতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
হোসেন জিল্লুর বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর রাজনৈতিক সহিংসতার বিরূপ প্রভাব ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। গত ২০ বছরে এ রকম প্রভাব ছিল না। এই প্রভাবের কারণে দেশের অর্থনীতি ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মধ্যে আটকা পড়ে আছে। এসব বিষয়ে নাগরিক সমাজের উদ্যোগে কিছু করার পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তবে নাগরিক সমাজের সামনেও একটা বড় চ্যালেঞ্জ আছে। সেটা হলো কিছু করে সফল হওয়া। নিষ্ফল আলাপ-আলোচনা করে তারা কার্যকর বা সাধারণ মানুষের জন্য হিতকর কিছু করতে পারবে না। আর পরিবর্তনের দায়িত্ব শুধু রাজনৈতিক দলের, নাগরিক সমাজ শুধু কথা বলবে—এই জায়গা থেকে উত্তরণ দরকার।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতার একটা রাজনৈতিক অর্থনীতি আছে। কারণ, অনেক বছর ধরে যেটা রাজনীতি সেটাই ব্যবসা, যেটা ব্যবসা সেটাই রাজনীতি। কাজেই কোনোভাবে ক্ষমতায় যেতে পারলে রাজনীতি এবং ব্যবসা দুটোই হবে—এই হচ্ছে ভাবনা। এ কারণে এখন রাজনীতি হচ্ছে যেকোনো উপায়ে নির্বাচনে জেতা। জিতলে প্রাপ্তি অনেক। না জিতলে সব হারানোর মতো ক্ষতি।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সহিংসতা বন্ধে রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকে কিছু উদ্যোগ না এলে হবে না। তার পাশাপাশি জনগণকে সোচ্চার হতে হবে। এ ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, যাঁরা যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা তখন নাগরিক সমাজকে শত্রুপক্ষ ভাবেন। কিন্তু নাগরিক সমাজ তাঁদের শুভাকাঙ্ক্ষী। কাজেই শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে সমালোচনা এলে তা রাজনীতিকদের গ্রহণ করার মানসিকতা থাকতে হবে।
সাংসদ তারানা হালিম বলেন, দল আগে না দেশ আগে, সেটা রাজনীতিকদের সর্বপ্রথম বিবেচনা করতে হবে। রাষ্ট্রের স্বার্থের আগে দল চলে গেলেই প্রশ্ন আসে যেকোনোভাবে ক্ষমতা দখলের। তখন রাষ্ট্রের সম্পদ ধ্বংস করা হয়। মানুষ হত্যা ও মানুষের অধিকার হরণ করার ঘটনা ঘটানো হয়। তিনি বলেন, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড যেমন নিন্দনীয়, পুলিশের লোকদের হত্যা করাও তেমনি নিন্দনীয়। সরকার বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিচার করছে। পুলিশ হত্যার বিচারও হতে হবে। এই বিচারের সমালোচনা হবে কেন। শুধু সরকারের সমালোচনা করাও একটা সহিংসতা।
তারানা হালিম বলেন, ‘এখন আবার শুরু হয়েছে পবিত্র সংসদে বাক-সহিংসতা। পরদিন সংসদে কী নাটক করা হবে, আগের দিন তার মহড়া দেওয়া হয়। এ ধরনের সহিংসতার পাল্টা উত্তর দেওয়া কোনো সভ্য লোকের উচিত নয়। এই কথাটা বলার জন্য সংসদে পাঁচবার পয়েন্ট অব অর্ডার চেয়েছি। কিন্তু পাইনি।’
তারানা হালিম বলেন, ‘রাজনৈতিক সহিংসতার ব্যাপারে আমাদের শুধু বর্তমানটাই দেখা উচিত নয়। অতীতটাও কিন্তু সুখকর ছিল না। এখন আবার শুনছি পরিবর্তনের ডাক। এই পরিবর্তনের নামে আমরা বিভ্রান্ত হচ্ছি কি না, ধর্মের নামে রাজনীতি সমর্থন করছি কি না, সেটা ভেবে দেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।’
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, গত এক বছরে আমদানি কমেছে। রপ্তানির লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। দেশের ব্যবসায়ীরাও বিনিয়োগ করছেন না। মূলধনি যন্ত্রপাতি এবং মৌলিক কাঁচামাল আমদানি নেতিবাচক পর্যায়ে চলে গেছে। কর্মসংস্থানও কমছে। প্রশাসন জনস্বার্থ রক্ষায় অকার্যকর। এসব কারণে প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। না হলে প্রবৃদ্ধি হতো ৮ শতাংশ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পেশাজীবীদের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ আশা করেন তিনি।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বদরুল আলম খান বলেন, রাজনীতিতে বিভিন্ন সময় সরকার ও বিরোধী দল দুই পক্ষই সহিংসতার সৃষ্টি করে এসেছে। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক তৎপরতা। ফলে বিভেদ সৃষ্টিকারী বিষয়টি শুধু রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নেই। তাই এ সমস্যার সমাধান সুশীল সমাজ করতে পারবে না। আবার রাষ্ট্র তথা আমলাতন্ত্রও এ সমস্যা সমাধান করার মতো শক্তিশালী নয়।
বদরুল আলম বলেন, তার পরও ‘এলিট কনসেনসাস’ বলে একটা কথা আছে। সেটা রাজনৈতিক পর্যায়ে হলে সবচেয়ে ভালো হয়। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও সে ধরনের উদ্যোগ থাকতে পারে।
সূচনা বক্তব্যে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দেশটাতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। নির্বাচনের এই বছরের প্রথম তিন মাসে ১৭১ জন লোক মারা গেছেন সহিংতায়। তার পরও অনেক নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। আমরা এ রকম নৃশংসতা ও মৃত্যু দেখতে চাই না। এখান থেকে বের হয়ে আসা আমাদের জন্য জরুরি। এই দায়িত্ব প্রধানত রাজনীতিকদের। তাঁরাই দেশ চালাবেন। সরকার ও বিরোধী দল মিলে তাঁদের এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। আমরা চাই শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর ও একটি শান্তিময় দেশ।’
গোলটেবিল আলোচনায় সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। গতকাল শনিবার প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘রাজনৈতিক সহিংসতা আর নয়’ শীর্ষক এ আলোচনার আয়োজন করা হয়।
আলোচনায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, ‘দেশের সব মানুষ রাজনৈতিক সহিংসতার অবসান চায়। কিন্তু আমরা চাইলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। সবকিছুর একটা প্রক্রিয়া আছে। এ সমস্যার সমাধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকেই আসতে হবে। যদি না আসে, তাহলে সচেতন দেশবাসী অতীতের মতো তাদের পথ বেছে নেবে। সেই প্রক্রিয়ায় নতুন রাজনৈতিক শক্তিরও আবির্ভাব হতে পারে। তবে তা প্রতিষ্ঠিত সরকারকে হটিয়ে অগণতান্ত্রিক পন্থায় আসা কোনো শক্তি নয়। গণতান্ত্রিক পন্থায়ই নতুন রাজনৈতিক শক্তি বের হয়ে আসতে পারে।’
আকবর আলি বলেন, ‘মাইনাস টু কিংবা বিরাজনীতিকীকরণ কোনো সমাধান বলে আমি নিজেও মনে করি না। বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করে আরও বেশি রাজনীতিকীকরণ করতে হবে।’ তিনি বলেন, গণতন্ত্র ও সব ধর্মের সহাবস্থানের আদর্শ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত ও প্রতিষ্ঠিত। এই আদর্শের সঠিক চর্চা হলে ধর্মান্ধতার যতই বিস্তার দেখা যাক না কেন, তাতে রাষ্ট্রের ভিত নড়বড়ে হতে পারে না। বর্তমানে যে ধর্মান্ধ শক্তি রাজনীতিতে আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে, তারও কারণ গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা না হওয়া। নাগরিক সমাজ সোচ্চার হলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। তা ছাড়া নাগরিক সমাজও রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, নাগরিক সমাজ বিভিন্ন সময় অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। অনেক কথা বলেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে কখনো সাড়া পাওয়া যায়নি। বরং অনেক সময় বিরূপ প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। আর বর্তমানে রাজনৈতিক সহিংসতার মাত্রা যে পর্যায়ে গেছে, তা নিরসনের জন্য একটি সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার মতো নেতৃত্ব নাগরিক সমাজে গড়ে ওঠেনি।
বর্তমান অবস্থা ব্যাখ্যা করে সুলতানা কামাল বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর করার চেষ্টা হচ্ছে। বিচার বিভাগ স্বকীয়তা হারিয়েছে। কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার সঙ্গে যাঁদের সম্পর্ক আছে, তাঁরা ছাড়া সবাই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মানুষের নিরাপত্তাবোধ সংকুচিত হয়ে গেছে। রাস্তায় বের হওয়া যাবে কি না, সন্তানেরা স্কুলে যেতে পারবে কি না, কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে একত্র হওয়া নিরাপদ হবে কি না—এসব বিষয়ও এখন মানুষের বড় ভাবনায় পরিণত হয়েছে।
খ্যাতিমান এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, বর্তমানে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সহিংসতা সমাধানে নাগরিক সমাজের ভূমিকা নিয়ামক না হলেও সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে নাগরিক সমাজকে সোচ্চার হতে হবে। কারণ, গণতন্ত্র শুধু নির্বাচনকালীন বিষয় নয়। নির্বাচনের পরও যাতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সচল থাকে, সে বিষয়ে ভূমিকা রাখা নাগরিক সমাজের দায়িত্ব। তিনি বলেন, জনগণের করের টাকায় পরিচালিত জাতীয় সংসদে বসে রাজনীতিকেরা যে ভাষায় কথাবার্তা বলছেন, তারও প্রতিবাদ নাগরিক সমাজকে করতে হবে। তাঁদের কথার মধ্যে শুধু অশ্লীলতা নয়, আছে সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ এবং পরস্পরের প্রতি হুমকি-ধমকিও।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রধান ভাবনা নির্বাচনকেন্দ্রিক। কিন্তু নাগরিক সমাজের সামনে আরও কিছু আলোচ্য বিষয় আছে। যেমন সুশাসনের ক্ষেত্রে সার্বিক ধস; রাষ্ট্রক্ষমতার সহিংস ব্যবহার; মামলা-মোকদ্দমার অপব্যবহার প্রভৃতি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সহিংস গোষ্ঠীগুলো কাজ করছে এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি রাজনৈতিক নেতৃত্বও উগ্রতা ও উচ্ছৃঙ্খলতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।
হোসেন জিল্লুর বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর রাজনৈতিক সহিংসতার বিরূপ প্রভাব ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। গত ২০ বছরে এ রকম প্রভাব ছিল না। এই প্রভাবের কারণে দেশের অর্থনীতি ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মধ্যে আটকা পড়ে আছে। এসব বিষয়ে নাগরিক সমাজের উদ্যোগে কিছু করার পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তবে নাগরিক সমাজের সামনেও একটা বড় চ্যালেঞ্জ আছে। সেটা হলো কিছু করে সফল হওয়া। নিষ্ফল আলাপ-আলোচনা করে তারা কার্যকর বা সাধারণ মানুষের জন্য হিতকর কিছু করতে পারবে না। আর পরিবর্তনের দায়িত্ব শুধু রাজনৈতিক দলের, নাগরিক সমাজ শুধু কথা বলবে—এই জায়গা থেকে উত্তরণ দরকার।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতার একটা রাজনৈতিক অর্থনীতি আছে। কারণ, অনেক বছর ধরে যেটা রাজনীতি সেটাই ব্যবসা, যেটা ব্যবসা সেটাই রাজনীতি। কাজেই কোনোভাবে ক্ষমতায় যেতে পারলে রাজনীতি এবং ব্যবসা দুটোই হবে—এই হচ্ছে ভাবনা। এ কারণে এখন রাজনীতি হচ্ছে যেকোনো উপায়ে নির্বাচনে জেতা। জিতলে প্রাপ্তি অনেক। না জিতলে সব হারানোর মতো ক্ষতি।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সহিংসতা বন্ধে রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকে কিছু উদ্যোগ না এলে হবে না। তার পাশাপাশি জনগণকে সোচ্চার হতে হবে। এ ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, যাঁরা যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা তখন নাগরিক সমাজকে শত্রুপক্ষ ভাবেন। কিন্তু নাগরিক সমাজ তাঁদের শুভাকাঙ্ক্ষী। কাজেই শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে সমালোচনা এলে তা রাজনীতিকদের গ্রহণ করার মানসিকতা থাকতে হবে।
সাংসদ তারানা হালিম বলেন, দল আগে না দেশ আগে, সেটা রাজনীতিকদের সর্বপ্রথম বিবেচনা করতে হবে। রাষ্ট্রের স্বার্থের আগে দল চলে গেলেই প্রশ্ন আসে যেকোনোভাবে ক্ষমতা দখলের। তখন রাষ্ট্রের সম্পদ ধ্বংস করা হয়। মানুষ হত্যা ও মানুষের অধিকার হরণ করার ঘটনা ঘটানো হয়। তিনি বলেন, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড যেমন নিন্দনীয়, পুলিশের লোকদের হত্যা করাও তেমনি নিন্দনীয়। সরকার বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিচার করছে। পুলিশ হত্যার বিচারও হতে হবে। এই বিচারের সমালোচনা হবে কেন। শুধু সরকারের সমালোচনা করাও একটা সহিংসতা।
তারানা হালিম বলেন, ‘এখন আবার শুরু হয়েছে পবিত্র সংসদে বাক-সহিংসতা। পরদিন সংসদে কী নাটক করা হবে, আগের দিন তার মহড়া দেওয়া হয়। এ ধরনের সহিংসতার পাল্টা উত্তর দেওয়া কোনো সভ্য লোকের উচিত নয়। এই কথাটা বলার জন্য সংসদে পাঁচবার পয়েন্ট অব অর্ডার চেয়েছি। কিন্তু পাইনি।’
তারানা হালিম বলেন, ‘রাজনৈতিক সহিংসতার ব্যাপারে আমাদের শুধু বর্তমানটাই দেখা উচিত নয়। অতীতটাও কিন্তু সুখকর ছিল না। এখন আবার শুনছি পরিবর্তনের ডাক। এই পরিবর্তনের নামে আমরা বিভ্রান্ত হচ্ছি কি না, ধর্মের নামে রাজনীতি সমর্থন করছি কি না, সেটা ভেবে দেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।’
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, গত এক বছরে আমদানি কমেছে। রপ্তানির লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। দেশের ব্যবসায়ীরাও বিনিয়োগ করছেন না। মূলধনি যন্ত্রপাতি এবং মৌলিক কাঁচামাল আমদানি নেতিবাচক পর্যায়ে চলে গেছে। কর্মসংস্থানও কমছে। প্রশাসন জনস্বার্থ রক্ষায় অকার্যকর। এসব কারণে প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। না হলে প্রবৃদ্ধি হতো ৮ শতাংশ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পেশাজীবীদের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ আশা করেন তিনি।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বদরুল আলম খান বলেন, রাজনীতিতে বিভিন্ন সময় সরকার ও বিরোধী দল দুই পক্ষই সহিংসতার সৃষ্টি করে এসেছে। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক তৎপরতা। ফলে বিভেদ সৃষ্টিকারী বিষয়টি শুধু রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নেই। তাই এ সমস্যার সমাধান সুশীল সমাজ করতে পারবে না। আবার রাষ্ট্র তথা আমলাতন্ত্রও এ সমস্যা সমাধান করার মতো শক্তিশালী নয়।
বদরুল আলম বলেন, তার পরও ‘এলিট কনসেনসাস’ বলে একটা কথা আছে। সেটা রাজনৈতিক পর্যায়ে হলে সবচেয়ে ভালো হয়। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও সে ধরনের উদ্যোগ থাকতে পারে।
সূচনা বক্তব্যে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দেশটাতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। নির্বাচনের এই বছরের প্রথম তিন মাসে ১৭১ জন লোক মারা গেছেন সহিংতায়। তার পরও অনেক নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। আমরা এ রকম নৃশংসতা ও মৃত্যু দেখতে চাই না। এখান থেকে বের হয়ে আসা আমাদের জন্য জরুরি। এই দায়িত্ব প্রধানত রাজনীতিকদের। তাঁরাই দেশ চালাবেন। সরকার ও বিরোধী দল মিলে তাঁদের এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। আমরা চাই শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর ও একটি শান্তিময় দেশ।’
গোলটেবিল আলোচনায় সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
No comments