চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন by এ এম এম শওকত আলী
গত ১৫ জুন রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট
সিটি করপোরেশন নির্বাচন শেষ হয়েছে। ১৬ জুন প্রায় সব দৈনিকেই প্রথম পাতায়
বড় করে বলা হয়েছে, চার জায়গায়ই বিএনপির প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।
জয়ী মেয়রদের সঙ্গে বিদায়ী মেয়রদের ভোটের ব্যবধানের পরিসংখ্যানও পাওয়া
গেছে। ব্যবধানের মাত্রা বেশ বড় আকারের, তবে সিটিভেদে কিছু তারতম্যও রয়েছে,
যা স্বাভাবিক। জয়ী ও পরাজিত মেয়র প্রার্থীদের সবচেয়ে বেশি ব্যবধান হয়েছে
খুলনায়। ৬০ হাজার ৬৭১ ভোট বেশি পেয়েছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোহাম্মদ
মনিরুজ্জামান। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিদায়ী মেয়র তালুকদার আবদুল
খালেক। যিনি ১৯৯৬-২০০১ সালে বর্তমান সরকারের ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।
পরবর্তী সময়ে তিনি স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত হন।
রাজশাহীর ফলাফলে দেখা যায়, এখানে দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যবধান। জয়ী প্রার্থী হলেন মোসাদ্দেক হোসেন। তাঁর সঙ্গে বিদায়ী মেয়রের ভোটের ব্যবধান হলো ৪৭ হাজার ৩৩২। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই বিএনপির ছাত্রদল ও পরে যুবদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সিলেটে জয়ী বনাম পরাজিত মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান ৩৫ হাজার ২৩০। এটা তৃতীয় বৃহত্তম। জয়ী প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী ৩৫ হাজার ২৩০ ভোট তাঁর অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান থেকে বেশি পেয়েছেন।
বরিশালে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আহসান হাবিব কামাল বিদায়ী মেয়র শওকত হোসেন হিরনকে ১৭ হাজার ২০ ভোটে পরাজিত করেছেন। উল্লেখ্য, ১৬ জুনের সিটি নির্বাচন পরিসংখ্যান ছিল বেসরকারি। কারণ প্রতি সিটিতে এক শ শতাংশ কেন্দ্রের ফলাফল ওই দিন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আইন অনুযায়ী জয়ী প্রার্থীদের নাম বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করবে।
বেসরকারি ফলাফল ঘোষণার পর শুরু হয় বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া ও জেতা-হারার পেছনের কারণ বিশ্লেষণ। এ বিশ্লেষণ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে প্রায় সব দৈনিক পত্রিকাই প্রকাশ করে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো করবে। এ-সংক্রান্ত একটি প্রধান মত ছিল, ক্ষমতাসীন জোটের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতাকেই বিরোধী জোট হাতিয়ার হিসেবে সফলতার সঙ্গে ব্যবহার করেছে। জাতীয় রাজনৈতিক পর্যায়ে ক্ষমতাসীন জোটের ব্যর্থতার প্রচারের চাপে স্থানীয়ভাবে অনেক সফলতার চিত্র ম্লান হয়ে যায়। কারণ সবাই স্বীকার করেছেন, চারটি সিটি করপোরেশনের বিদায়ী মেয়ররা অনেক ভালো কাজ করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট পরিচ্ছন্নতা, রাস্তাঘাটের সংস্কার ও কিছু অবকাঠামো প্রকল্পের বাস্তবায়ন। ক্ষমতাসীন জোটের জাতীয় পর্যায়ে ব্যর্থতা চিহ্নিত করে একটি ইংরেজি দৈনিক বলেছে যে, এক. শেয়ার মার্কেটে ধস, দুই. পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুই সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। শেয়ার মার্কেট ধসের কারণে বহু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী অর্থসংকটের সম্মুখীন হয়েছে বলে তাদের অভিযোগ। এর জন্য সরকার নানা প্রতিকারমূলক পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এ বেদনা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এখনো ভোলেনি। ১৭ জুনের একটি বাংলা দৈনিকে উপর্যুক্ত কারণগুলো ছাড়াও আরো কিছু কারণ এ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ি, আওয়ামী লীগ নেতাদের দুর্ব্যবহার ও দমন-পীড়ন।
সিটি নির্বাচন-পরবর্তী পর্যায়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী জোটের নেতারা যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, তার মধ্যে প্রধান আলোচিত বিষয় ছিল বিএনপি প্রার্থীদের একক জয় জাতীয় নির্বাচনে কী প্রভাব বিস্তার করবে! মিডিয়ার কোনো পত্রিকায় বড় শিরোনাম ছিল 'ক্ষোভের প্রকাশ ব্যালটে'। এ শিরোনাম ১৭ জুনের সংখ্যায়। এর এক দিন আগেই বিএনপির মহাসচিব এক ধরনের উক্তি করেছিলেন। তাঁর মতে ব্যালটে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে। অন্যদিকে কিছু দৈনিকে জয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের ধর্মভিত্তিক প্রচারকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশেষ করে রাজশাহী ও সিলেটে। মিডিয়ায় বলা হয়েছে, নাস্তিকদের ভোট না দেওয়ার জন্য এ দুই দল বা গোষ্ঠী সক্রিয় ছিল।
নির্বাচনী আইন ও বিধি অনুযায়ী ধর্মভিত্তিক প্রচার নিষিদ্ধ। কিন্তু এটা করা হলেও নির্বাচন কমিশন কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তবে সার্বিকভাবে বলা যায়, নির্বাচন যে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে, এ বিষয়ে সব দলের নেতাই একমত। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা অবশ্যই ঘটতে পারে। তবে তা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। জাতীয় নির্বাচনে ফলাফল কী হবে তা এখনই নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। এ বিষয় নির্ভর করবে আগামী সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সময়ে দুই প্রধান দল কিভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এ ছাড়া মনে রাখা প্রয়োজন, চার সিটির নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের সমতুল্য হতে পারে না। পক্ষান্তরে এ যুক্তিও রয়েছে যে কোনো মেয়রের ক্ষেত্রে নয়, বরং চারটি করপোরেশনের সব কটিতেই কাউন্সিলর পদে বিএনপি বা ১৮ দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লক্ষ করা গেছে। মিডিয়ায় বলা হয়েছে, ১৭ জুন পর্যন্ত ১১৬ কাউন্সিলরের ৭৫ জনই ১৮ দলের। আওয়ামী লীগের ১৪ দল সমর্থিত প্রার্থীরা জিতেছেন ৩১টি আসনে। এমনকি সাধারণ নারী কাউন্সিলর পদে ১৮ দলীয় জোটের আধিক্য লক্ষ করা গেছে। এসব পরিসংখ্যান দেখলে মনে হয়, চার মহানগরীর তৃণমূল পর্যায়েও ১৮ দলীয় জোটের, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলের সমর্থন রয়েছে। এটা এ জোটের মনোবল বৃদ্ধি করতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
সিটি নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে ক্ষমতাসীন দুই মন্ত্রী স্বীকার করেছেন, এটা দলের জন্য অশনিসংকেত বা এক সতর্কবার্তা। তবে দলীয় অন্য দু-একজন নেতা সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী মন্তব্য করেছেন। দলের যুগ্ম মহাসচিব বলেছেন, সিটি নির্বাচন আগামী সংসদ নির্বাচনে কোনো প্রভাব বিস্তার করবে না। কারণ এ নির্বাচন কোনো 'রাজনৈতিক নির্বাচন' নয়। এ যুক্তি অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ একাধিক। এক. দুই দলের কিছু প্রভাবশালী নেতা স্ব স্ব দলীয় প্রার্থীর জন্য চার সিটিতেই ভ্রমণ করে। ভোটারদের সমর্থন প্রার্থনা করে। টিভিসহ কিছু দৈনিকে এটা ছিল দৃশ্যমান। দুই. এ বিষয় নিয়ে বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা অনেক কথাবার্তা বলেছেন, যার সারমর্ম হলো রাজনীতিকদের প্রচারকার্যে সক্রিয় হওয়া মানে একটি অরাজনৈতিক নির্বাচনকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া, যা বাঞ্ছনীয় নয়। তিন. সব মেয়র প্রার্থীই অতীতে নিজ নিজ দলের সমর্থন পেয়েছেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। চার. অরাজনৈতিক নির্বাচনে রাজনীতির সংশ্লেষ অসাংবিধানিক হিসেবে চিহ্নিত একজন সংক্ষুুব্ধ ব্যক্তি হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করেছেন। এ মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মেয়রদের শপথ স্থগিত রাখারও আবেদন করা হয়েছে। দুই পক্ষের হারাজেতার বিতর্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথার পুনঃপ্রবর্তনের বিষয়টি চাপা পড়েনি। ক্ষমতাসীন দল শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু সিটি নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়ে যুক্তি দিয়েছে, এ নির্বাচন প্রমাণ করে দলীয় সরকারের অধীনেও অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এখনো অনড়। নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে কয়েক সিটির বিরোধীদলীয় মেয়র প্রার্থীদের দাবি ছিল সেনা মোতায়েন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন এ দাবি মেনে নেয়নি। নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফলের পর এ বিষয়ও বিতর্কে এসেছে। এ সম্পর্কে বিরোধীদলীয় দুই প্রভাবশালী নেতা কিছুটা একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। একজন বলেছেন, সেনা মোতায়েন করলে ক্ষমতাসীন দলের মেয়র প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হতো। অন্যজন বলেছেন, সেনা মোতায়েন করলে বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা আরো অনেক ভোটে জয়ী হতেন।
নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে ভালো বৈশিষ্ট্য ছিল জয়ী ও বিদায়ী মেয়রদের বন্ধুসুলভ আচরণ। এ দৃশ্য সাধারণ জনমানুষকে আশার আলো দেখিয়েছে। কারণ অতীতেও এ ধরনের দৃশ্য বিরল ছিল। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সংঘাতপূর্ণ অবস্থানের দৃশ্য দেখা যায়নি। এ ছাড়া জয়ী দলের আনন্দ-উল্লাসের মিছিল বা সমাবেশও দেখা যায়নি। জয়ী মেয়ররাই কর্মীদের এ ধরনের মিছিল বা সমাবেশ না করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এমনকি প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা একই নির্দেশ ঘোষণা করেছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের ভরাডুবি কেন হলো, তা অনুসন্ধানের জন্য একজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ প্রতিবেদন পাওয়া গেলে আরো তথ্য জানা যাবে।
এরপর গাজীপুর সিটি নির্বাচন আগামী ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে। এ বিষয় নিয়ে ক্ষমতাসীন দল কিছুটা শঙ্কাগ্রস্ত। এর কারণ এ নির্বাচনে দলের একজন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। এ প্রার্থীকে তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার জন্য জানামতে একজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দেখা যাক ফল কী হয়।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
রাজশাহীর ফলাফলে দেখা যায়, এখানে দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যবধান। জয়ী প্রার্থী হলেন মোসাদ্দেক হোসেন। তাঁর সঙ্গে বিদায়ী মেয়রের ভোটের ব্যবধান হলো ৪৭ হাজার ৩৩২। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই বিএনপির ছাত্রদল ও পরে যুবদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সিলেটে জয়ী বনাম পরাজিত মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান ৩৫ হাজার ২৩০। এটা তৃতীয় বৃহত্তম। জয়ী প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী ৩৫ হাজার ২৩০ ভোট তাঁর অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান থেকে বেশি পেয়েছেন।
বরিশালে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আহসান হাবিব কামাল বিদায়ী মেয়র শওকত হোসেন হিরনকে ১৭ হাজার ২০ ভোটে পরাজিত করেছেন। উল্লেখ্য, ১৬ জুনের সিটি নির্বাচন পরিসংখ্যান ছিল বেসরকারি। কারণ প্রতি সিটিতে এক শ শতাংশ কেন্দ্রের ফলাফল ওই দিন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আইন অনুযায়ী জয়ী প্রার্থীদের নাম বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করবে।
বেসরকারি ফলাফল ঘোষণার পর শুরু হয় বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া ও জেতা-হারার পেছনের কারণ বিশ্লেষণ। এ বিশ্লেষণ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে প্রায় সব দৈনিক পত্রিকাই প্রকাশ করে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো করবে। এ-সংক্রান্ত একটি প্রধান মত ছিল, ক্ষমতাসীন জোটের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতাকেই বিরোধী জোট হাতিয়ার হিসেবে সফলতার সঙ্গে ব্যবহার করেছে। জাতীয় রাজনৈতিক পর্যায়ে ক্ষমতাসীন জোটের ব্যর্থতার প্রচারের চাপে স্থানীয়ভাবে অনেক সফলতার চিত্র ম্লান হয়ে যায়। কারণ সবাই স্বীকার করেছেন, চারটি সিটি করপোরেশনের বিদায়ী মেয়ররা অনেক ভালো কাজ করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট পরিচ্ছন্নতা, রাস্তাঘাটের সংস্কার ও কিছু অবকাঠামো প্রকল্পের বাস্তবায়ন। ক্ষমতাসীন জোটের জাতীয় পর্যায়ে ব্যর্থতা চিহ্নিত করে একটি ইংরেজি দৈনিক বলেছে যে, এক. শেয়ার মার্কেটে ধস, দুই. পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুই সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। শেয়ার মার্কেট ধসের কারণে বহু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী অর্থসংকটের সম্মুখীন হয়েছে বলে তাদের অভিযোগ। এর জন্য সরকার নানা প্রতিকারমূলক পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এ বেদনা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা এখনো ভোলেনি। ১৭ জুনের একটি বাংলা দৈনিকে উপর্যুক্ত কারণগুলো ছাড়াও আরো কিছু কারণ এ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ি, আওয়ামী লীগ নেতাদের দুর্ব্যবহার ও দমন-পীড়ন।
সিটি নির্বাচন-পরবর্তী পর্যায়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী জোটের নেতারা যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, তার মধ্যে প্রধান আলোচিত বিষয় ছিল বিএনপি প্রার্থীদের একক জয় জাতীয় নির্বাচনে কী প্রভাব বিস্তার করবে! মিডিয়ার কোনো পত্রিকায় বড় শিরোনাম ছিল 'ক্ষোভের প্রকাশ ব্যালটে'। এ শিরোনাম ১৭ জুনের সংখ্যায়। এর এক দিন আগেই বিএনপির মহাসচিব এক ধরনের উক্তি করেছিলেন। তাঁর মতে ব্যালটে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে। অন্যদিকে কিছু দৈনিকে জয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের ধর্মভিত্তিক প্রচারকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশেষ করে রাজশাহী ও সিলেটে। মিডিয়ায় বলা হয়েছে, নাস্তিকদের ভোট না দেওয়ার জন্য এ দুই দল বা গোষ্ঠী সক্রিয় ছিল।
নির্বাচনী আইন ও বিধি অনুযায়ী ধর্মভিত্তিক প্রচার নিষিদ্ধ। কিন্তু এটা করা হলেও নির্বাচন কমিশন কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তবে সার্বিকভাবে বলা যায়, নির্বাচন যে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে, এ বিষয়ে সব দলের নেতাই একমত। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা অবশ্যই ঘটতে পারে। তবে তা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। জাতীয় নির্বাচনে ফলাফল কী হবে তা এখনই নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। এ বিষয় নির্ভর করবে আগামী সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সময়ে দুই প্রধান দল কিভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এ ছাড়া মনে রাখা প্রয়োজন, চার সিটির নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের সমতুল্য হতে পারে না। পক্ষান্তরে এ যুক্তিও রয়েছে যে কোনো মেয়রের ক্ষেত্রে নয়, বরং চারটি করপোরেশনের সব কটিতেই কাউন্সিলর পদে বিএনপি বা ১৮ দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লক্ষ করা গেছে। মিডিয়ায় বলা হয়েছে, ১৭ জুন পর্যন্ত ১১৬ কাউন্সিলরের ৭৫ জনই ১৮ দলের। আওয়ামী লীগের ১৪ দল সমর্থিত প্রার্থীরা জিতেছেন ৩১টি আসনে। এমনকি সাধারণ নারী কাউন্সিলর পদে ১৮ দলীয় জোটের আধিক্য লক্ষ করা গেছে। এসব পরিসংখ্যান দেখলে মনে হয়, চার মহানগরীর তৃণমূল পর্যায়েও ১৮ দলীয় জোটের, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলের সমর্থন রয়েছে। এটা এ জোটের মনোবল বৃদ্ধি করতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
সিটি নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে ক্ষমতাসীন দুই মন্ত্রী স্বীকার করেছেন, এটা দলের জন্য অশনিসংকেত বা এক সতর্কবার্তা। তবে দলীয় অন্য দু-একজন নেতা সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী মন্তব্য করেছেন। দলের যুগ্ম মহাসচিব বলেছেন, সিটি নির্বাচন আগামী সংসদ নির্বাচনে কোনো প্রভাব বিস্তার করবে না। কারণ এ নির্বাচন কোনো 'রাজনৈতিক নির্বাচন' নয়। এ যুক্তি অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ একাধিক। এক. দুই দলের কিছু প্রভাবশালী নেতা স্ব স্ব দলীয় প্রার্থীর জন্য চার সিটিতেই ভ্রমণ করে। ভোটারদের সমর্থন প্রার্থনা করে। টিভিসহ কিছু দৈনিকে এটা ছিল দৃশ্যমান। দুই. এ বিষয় নিয়ে বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা অনেক কথাবার্তা বলেছেন, যার সারমর্ম হলো রাজনীতিকদের প্রচারকার্যে সক্রিয় হওয়া মানে একটি অরাজনৈতিক নির্বাচনকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া, যা বাঞ্ছনীয় নয়। তিন. সব মেয়র প্রার্থীই অতীতে নিজ নিজ দলের সমর্থন পেয়েছেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। চার. অরাজনৈতিক নির্বাচনে রাজনীতির সংশ্লেষ অসাংবিধানিক হিসেবে চিহ্নিত একজন সংক্ষুুব্ধ ব্যক্তি হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করেছেন। এ মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মেয়রদের শপথ স্থগিত রাখারও আবেদন করা হয়েছে। দুই পক্ষের হারাজেতার বিতর্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথার পুনঃপ্রবর্তনের বিষয়টি চাপা পড়েনি। ক্ষমতাসীন দল শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু সিটি নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়ে যুক্তি দিয়েছে, এ নির্বাচন প্রমাণ করে দলীয় সরকারের অধীনেও অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এখনো অনড়। নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে কয়েক সিটির বিরোধীদলীয় মেয়র প্রার্থীদের দাবি ছিল সেনা মোতায়েন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন এ দাবি মেনে নেয়নি। নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফলের পর এ বিষয়ও বিতর্কে এসেছে। এ সম্পর্কে বিরোধীদলীয় দুই প্রভাবশালী নেতা কিছুটা একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। একজন বলেছেন, সেনা মোতায়েন করলে ক্ষমতাসীন দলের মেয়র প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হতো। অন্যজন বলেছেন, সেনা মোতায়েন করলে বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা আরো অনেক ভোটে জয়ী হতেন।
নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে ভালো বৈশিষ্ট্য ছিল জয়ী ও বিদায়ী মেয়রদের বন্ধুসুলভ আচরণ। এ দৃশ্য সাধারণ জনমানুষকে আশার আলো দেখিয়েছে। কারণ অতীতেও এ ধরনের দৃশ্য বিরল ছিল। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সংঘাতপূর্ণ অবস্থানের দৃশ্য দেখা যায়নি। এ ছাড়া জয়ী দলের আনন্দ-উল্লাসের মিছিল বা সমাবেশও দেখা যায়নি। জয়ী মেয়ররাই কর্মীদের এ ধরনের মিছিল বা সমাবেশ না করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এমনকি প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা একই নির্দেশ ঘোষণা করেছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের ভরাডুবি কেন হলো, তা অনুসন্ধানের জন্য একজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ প্রতিবেদন পাওয়া গেলে আরো তথ্য জানা যাবে।
এরপর গাজীপুর সিটি নির্বাচন আগামী ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে। এ বিষয় নিয়ে ক্ষমতাসীন দল কিছুটা শঙ্কাগ্রস্ত। এর কারণ এ নির্বাচনে দলের একজন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। এ প্রার্থীকে তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার জন্য জানামতে একজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দেখা যাক ফল কী হয়।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments