তানভীরের মারা টাকা মেরে দিল ঘনিষ্ঠরা! by আবুল কাশেম
দেশের ইতিহাসে বৃহত্তম আর্থিক কেলেঙ্কারির
হোতা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)
তানভীর মাহমুদ ব্যাংক থেকে নেওয়া টাকার হিসাব কখনোই মেলাতেন না।
তিনি
নিজে খবরও নিতেন না মোট কত টাকা ঋণ, কত টাকাই বা বিনিয়োগ। কারাগারে গিয়ে
তানভীর হিসাব মেলাতে গিয়ে দেখছেন বিশ্বস্ত কিছু মানুষ তাঁর অগোচরে তাঁরই
অর্থ মেরে দিয়ে অঢেল বিত্তের মালিক বনে গেছেন। এমনকি তানভীর কারাগারে
যাওয়ার আগে নগদ শত শত কোটি টাকা যাঁদের কাছে রেখেছিলেন তাঁরাও এখন সে অর্থ
মারার তালে আছেন। গত রবিবার কারাগারের গেটে জিজ্ঞাসাবাদে নিজের জালিয়াতির
টাকা মেরে দেওয়া লোকদের নামও দুদককে জানিয়েছেন তানভীর। নিজের সঙ্গে তাঁদের
কারাগারে দেখারও দাবি তুলেছেন তিনি।
তিন মাস ধরে হলমার্ক গ্রুপের আর্থিক কেলেঙ্কারি সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়েছে কালের কণ্ঠ। তানভীর মাহমুদের এক আত্মীয়র সঙ্গে তিনবার এ প্রতিবেদক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। এ সময় মহাব্যবস্থাপক (জিএম) তুষার আহমেদের সঙ্গেও কথা হয় এ প্রতিবেদকের। একই সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পরিচালক, তানভীরের বিশ্বস্ত একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে হলমার্ক কেলেঙ্কারি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে।
তানভীর দাবি করছেন, হলমার্ক গ্রুপ যে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল (সাবেক শেরাটন) শাখা থেকে দুই হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, তা তিনি জেনেছেন পত্রিকা পড়ে। তানভীরের হিসাবে, তিনি জালিয়াতি করে নিয়েছেন মাত্র এক হাজার ৬০০ কোটি টাকার মতো। তাঁর সঙ্গে বাটপারি করে বাকি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তাঁরই ঘনিষ্ঠজনরা। তাই তানভীর মাহমুদ যেখানে ঢাকায় একটি বাড়ির মালিক, সেখানে তাঁর কম্পানিতে চাকরি করে আট হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পেয়ে এখন ঢাকায় ছয়টি বাড়ি, ছয়টি ফ্ল্যাট, আশুলিয়ায় ৮৭ শতাংশ জমির ওপর বাগানবাড়ি, চারটি গাড়ি ও তিনটি মোটরসাইকেল কিনেছেন তাঁরই ভায়রা তুষার আহমেদ। আর ২০০৮ সালে হলমার্ক গ্রুপে আট হাজার টাকা বেতনে চাকরিতে যোগদানের পর এখন ঢাকার কাফরুলে ৭ শতাংশ জমি, ৪৭ লাখ টাকা দামের একটি টয়োটা প্রিমিও সুপিরিয়র গাড়ি চালাচ্ছেন হলমার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) আসলাম আলম। সংবাদমাধ্যমে হলমার্ক গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি প্রকাশ পাওয়ার পর তানভীর কয়েক শ কোটি টাকা রেখেছিলেন বিশ্বস্ত কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে। তাঁরাও সে টাকাগুলোর কথা স্বীকার করছেন না।
কারাগারে তানভীরের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়েছে সাংবাদিক পরিচয়েই। ওই সময় কখনো ক্ষোভ, কখনো অপরাধবোধ দেখা গেছে তাঁর কথায়, চেহারায়। তিনি বারবার দাবি করছিলেন, শ্যালিকার স্বামী তুষার আহমেদের জালিয়াতির কারণেই তাঁকে কারাগারে ঢুকতে হয়েছে। তানভীর আরো বলছিলেন, এই তুষারের প্ররোচনায় হলমার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) কমার্শিয়াল মো. আসলাম উদ্দিনকে নিয়োগই দেওয়া হয়নি, আসলামের ওপর তহবিলের ভারও ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই আসলামও যে মহাপ্রতারণা করেছেন তানভীরের সঙ্গে।
সোনালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, হলমার্ক গ্রুপের দুই হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হলেও এর বেশির ভাগ ঋণেই প্রধান কার্যালয়ের কোনো অনুমোদন নেই। যেসব ঋণ আবেদনের বিপরীতে এত বিশাল অঙ্কের অর্থ হলমার্ক গ্রুপকে দেওয়া হয়েছে, সেসব আবেদনের বেশির ভাগই গায়েব হয়ে গেছে। যেসব আবেদন পাওয়া গেছে, তার মধ্যে বেশ কিছু আবেদনে তানভীর মাহমুদের কোনো স্বাক্ষর নেই। তানভীরের ধারণা, তাঁর অজান্তে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে তুষার আহমেদ ও আসলাম উদ্দিনই হলমার্কের নামে ঋণ নিয়ে তা গায়েব করে দিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তানভীরের ভায়রা তুষার আহমেদ ২০০০ সালে এসএসসি পাস করেন। পরে হলমার্কের একটি কারখানায় ২০০৮ সালে প্রথম আট হাজার টাকা বেতনে যোগ দেন তিনি। সর্বশেষ ২০১২ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার সময় তাঁর বেতন ছিল ৪৫ হাজার টাকা। সেই তুষার আশুলিয়ার নরসিংহপুরে হা-মীম গ্রুপের কারখানার পূর্ব পাশে ৮৭ শতাংশ বাগানবাড়ি কিনেছেন নিজের নামে। জানা গেছে, নিজের কারখানার পাশে হওয়ায় ওই জমির আগ্রহী ক্রেতাদের মধ্যে ছিলেন হা-মীম গ্রুপের মালিক ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ। কিন্তু টাকার গরমে পোশাক খাতের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়ী এ কে আজাদকে টেক্কা দিয়ে বেশি দামে বাগানবাড়িটি কিনে নেন তুষার। এ বিষয়ে তুষারের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি একে আজাদের সঙ্গে খুবই দুর্ব্যবহার করেন বলে জানা গেছে।
বিশাল আকারের ওই বাগানবাড়ি ছাড়াও তুষার মিরপুর এলাকায় আরো ছয়টি বাড়ি কিনেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ১৩/৩ আনন্দনগর, ৮২/২ হরিরামপুর, ৫০/এ বর্ধনবাড়ী, ২৮ গোলারটেক, ২২১/১ হরিরামপুর ও রামপুরায় বাড়ি রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া ৫০/এ বর্ধনবাড়ীর একটি ভবনে দুটি ফ্ল্যাট (এ-৩ ও ডি-৫), খিলগাঁওয়ে একটি ফ্ল্যাট ও মহাখালীতে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে তাঁর নিজের। তানভীরের ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, তুষারের স্ত্রী মাসখানেক আগেও একটি নতুন গাড়ি কিনেছেন। এর আগেও তুষারের তিনটি গাড়ি ও তিনটি মোটরসাইকেল ছিল।
তানভীর মাহমুদ এ প্রতিবেদককে বলেন, 'তুষার কমপক্ষে ৩৫০ কোটি টাকা লুট করেছে। সেই টাকায় সে বাড়ি, গাড়ি ও জমি কেনা ছাড়াও তার মা-বাবা ও বাসার কাজের ছেলেদের নামে ব্যাংক হিসাবে বিপুল অঙ্কের অর্থ জমা রেখেছে।' তানভীর আরো বলেন, দুদক বা সোনালী ব্যাংক চাইলেই তুষারের এসব সম্পদ ও নগদ টাকা বাজেয়াপ্ত করতে পারে! কারণ, তুষার কখনই তাঁর এত অর্থের আয়ের উৎস দেখাতে পারবেন না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখায় হলমার্কসহ মোট ছয়টি কম্পানি সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি করে। জালিয়াতি করা এসব প্রতিষ্ঠানের একটি হলো টিঅ্যান্ড ব্রাদার্স। হলমার্ক গ্রুপের জিএম (বাণিজ্যিক) মো. আসলাম উদ্দিন টিঅ্যান্ড ব্রাদার্সে চাকরি করতেন এবং তখনই তুষারের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। টিঅ্যান্ড ব্রাদার্সের ঋণ কেলেঙ্কারির সময়ই মূলত সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখার উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) আজিজুর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় আসলামের। সেটাকে কাজে লাগিয়ে হলমার্ককেও মোটা অঙ্কের অর্থ ঋণ হিসেবে নিয়ে দেওয়ার লোভ দেখান আসলাম। প্রথমে তাতে তানভীর রাজী না হলেও পরে ব্যবসা সম্প্রসারণের চিন্তা করে আসলামকে নিয়োগ দেন।
তানভীর কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়েছি। আমি নিজে ব্যাংকের ঋণ ও এলসি-সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্ম আসলাম ও তুষারের ওপর ছেড়ে দিই। আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে আসলাম আমার কাছ থেকে কাফরুল মৌজায় ৭ শতাংশ জমিসহ ২০৪ নম্বর বাড়িটি নিজের নামে লিখে নিয়েছে, যার সিএস খতিয়ান নম্বর-১০০, এসএ খতিয়ান নম্বর-৮৫, সিএস ও এসএ দাগ নম্বর-৬৩। এখন সেখানে আটতলা ভবন নির্মাণ করছে আসলাম। এ ছাড়া ৪৭ লাখ টাকা মূল্যের হলমার্কের টয়োটা প্রিমিও সুপিরিয়র গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-গ-৩১-৩৫৭৩) নিজের নামে লিখে নিয়েছে আসলাম। এ ছাড়া মিরপুর-১০ নম্বরে ৫০১ নম্বর ভবনে একটি ফ্ল্যাট আছে আসলামের নিজ নামে।'
গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তানভীর মাহমুদ আসলামের শ্যালিকা গুলশান আরা মুক্তার কাছে ৫০ কোটি টাকা রেখে যান বলে জানা গেছে। মুক্তা এখনো গ্রুপটির ডিজিএম (প্রশাসন) পদে দায়িত্ব পালন করলেও ওই ৫০ কোটি টাকার কোনো হিসাব তিনি দিতে পারছেন না বলে জানা গেছে। মুক্তার নামে ঢাকার পীরেরবাগে চারটি ফ্ল্যাট ও একটি বাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে।
হলমার্ক গ্রুপের আরেক জিএম হারুন অর রশিদের দায়িত্ব ছিল হলমার্ক গ্রুপের সব যন্ত্রপাতি আমদানি করার বিষয়টি দেখভাল করা। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যস্ত এ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। চাকরিকালে তাঁর বেতন ছিল ৩০ হাজার টাকা। আর হারুন এখন এআরএইস নিট কম্পোজিট লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানার মালিক।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, হলমার্ক যে জালিয়াতি করে দুই হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, তার অনেকগুলোর আবেদনই পাওয়া যাচ্ছে না। আবার বেশকিছু আবেদনে তানভীর মাহমুদের স্বাক্ষর নেই। এতেই বুঝা যায়, তুষার ও রূপসী বাংলা হোটেল শাখার ডিজিএম আজিজুর রহমান অন্যদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ভুয়া এলসি বিক্রি করে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেন, তুষার বা অন্যরা বৈধ কোনো আয়ের পথ ছাড়া হঠাৎ করেই অনেক সম্পদের মালিক হলেও সোনালী ব্যাংক তাঁদের সম্পদ জব্দ করে নিতে পারবে না। কারণ, ব্যাংক তাঁদের ঋণ দেয়নি। তবে দুদক বা সরকারের অন্য কোনো সংস্থা যদি খতিয়ে দেখে প্রমাণ করতে পারে, রূপসী বাংলা হোটেল শাখা থেকে নেওয়া হলমার্কের টাকাগুলো তাঁরা আত্মসাৎ করেছেন, সেক্ষেত্রে সরকার বা দুদক তাঁদের সম্পদ জব্দ করতে পারে। দুদক বা আদালতের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ওই সব সম্পদ বিক্রি করে সোনালী ব্যাংক পাওনা আদায় করতে পারবে।
এ বিষয়ে কথা বলতে মো. আসলাম উদ্দিনের দুটি মোবাইল ফোনে ও গুলশান আরা মুক্তার একটি মোবাইল ফোনে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় একাধিকবার ফোন দেওয়া হয়। প্রতিবারই রিং হয়, কিন্তু কেউ তা গ্রহণ করেনি।
তিন মাস ধরে হলমার্ক গ্রুপের আর্থিক কেলেঙ্কারি সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়েছে কালের কণ্ঠ। তানভীর মাহমুদের এক আত্মীয়র সঙ্গে তিনবার এ প্রতিবেদক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। এ সময় মহাব্যবস্থাপক (জিএম) তুষার আহমেদের সঙ্গেও কথা হয় এ প্রতিবেদকের। একই সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পরিচালক, তানভীরের বিশ্বস্ত একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে হলমার্ক কেলেঙ্কারি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে।
তানভীর দাবি করছেন, হলমার্ক গ্রুপ যে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল (সাবেক শেরাটন) শাখা থেকে দুই হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, তা তিনি জেনেছেন পত্রিকা পড়ে। তানভীরের হিসাবে, তিনি জালিয়াতি করে নিয়েছেন মাত্র এক হাজার ৬০০ কোটি টাকার মতো। তাঁর সঙ্গে বাটপারি করে বাকি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তাঁরই ঘনিষ্ঠজনরা। তাই তানভীর মাহমুদ যেখানে ঢাকায় একটি বাড়ির মালিক, সেখানে তাঁর কম্পানিতে চাকরি করে আট হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পেয়ে এখন ঢাকায় ছয়টি বাড়ি, ছয়টি ফ্ল্যাট, আশুলিয়ায় ৮৭ শতাংশ জমির ওপর বাগানবাড়ি, চারটি গাড়ি ও তিনটি মোটরসাইকেল কিনেছেন তাঁরই ভায়রা তুষার আহমেদ। আর ২০০৮ সালে হলমার্ক গ্রুপে আট হাজার টাকা বেতনে চাকরিতে যোগদানের পর এখন ঢাকার কাফরুলে ৭ শতাংশ জমি, ৪৭ লাখ টাকা দামের একটি টয়োটা প্রিমিও সুপিরিয়র গাড়ি চালাচ্ছেন হলমার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) আসলাম আলম। সংবাদমাধ্যমে হলমার্ক গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি প্রকাশ পাওয়ার পর তানভীর কয়েক শ কোটি টাকা রেখেছিলেন বিশ্বস্ত কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে। তাঁরাও সে টাকাগুলোর কথা স্বীকার করছেন না।
কারাগারে তানভীরের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়েছে সাংবাদিক পরিচয়েই। ওই সময় কখনো ক্ষোভ, কখনো অপরাধবোধ দেখা গেছে তাঁর কথায়, চেহারায়। তিনি বারবার দাবি করছিলেন, শ্যালিকার স্বামী তুষার আহমেদের জালিয়াতির কারণেই তাঁকে কারাগারে ঢুকতে হয়েছে। তানভীর আরো বলছিলেন, এই তুষারের প্ররোচনায় হলমার্ক গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) কমার্শিয়াল মো. আসলাম উদ্দিনকে নিয়োগই দেওয়া হয়নি, আসলামের ওপর তহবিলের ভারও ছেড়ে দেওয়া হয়। সেই আসলামও যে মহাপ্রতারণা করেছেন তানভীরের সঙ্গে।
সোনালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, হলমার্ক গ্রুপের দুই হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হলেও এর বেশির ভাগ ঋণেই প্রধান কার্যালয়ের কোনো অনুমোদন নেই। যেসব ঋণ আবেদনের বিপরীতে এত বিশাল অঙ্কের অর্থ হলমার্ক গ্রুপকে দেওয়া হয়েছে, সেসব আবেদনের বেশির ভাগই গায়েব হয়ে গেছে। যেসব আবেদন পাওয়া গেছে, তার মধ্যে বেশ কিছু আবেদনে তানভীর মাহমুদের কোনো স্বাক্ষর নেই। তানভীরের ধারণা, তাঁর অজান্তে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে তুষার আহমেদ ও আসলাম উদ্দিনই হলমার্কের নামে ঋণ নিয়ে তা গায়েব করে দিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তানভীরের ভায়রা তুষার আহমেদ ২০০০ সালে এসএসসি পাস করেন। পরে হলমার্কের একটি কারখানায় ২০০৮ সালে প্রথম আট হাজার টাকা বেতনে যোগ দেন তিনি। সর্বশেষ ২০১২ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার সময় তাঁর বেতন ছিল ৪৫ হাজার টাকা। সেই তুষার আশুলিয়ার নরসিংহপুরে হা-মীম গ্রুপের কারখানার পূর্ব পাশে ৮৭ শতাংশ বাগানবাড়ি কিনেছেন নিজের নামে। জানা গেছে, নিজের কারখানার পাশে হওয়ায় ওই জমির আগ্রহী ক্রেতাদের মধ্যে ছিলেন হা-মীম গ্রুপের মালিক ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ। কিন্তু টাকার গরমে পোশাক খাতের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়ী এ কে আজাদকে টেক্কা দিয়ে বেশি দামে বাগানবাড়িটি কিনে নেন তুষার। এ বিষয়ে তুষারের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি একে আজাদের সঙ্গে খুবই দুর্ব্যবহার করেন বলে জানা গেছে।
বিশাল আকারের ওই বাগানবাড়ি ছাড়াও তুষার মিরপুর এলাকায় আরো ছয়টি বাড়ি কিনেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ১৩/৩ আনন্দনগর, ৮২/২ হরিরামপুর, ৫০/এ বর্ধনবাড়ী, ২৮ গোলারটেক, ২২১/১ হরিরামপুর ও রামপুরায় বাড়ি রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া ৫০/এ বর্ধনবাড়ীর একটি ভবনে দুটি ফ্ল্যাট (এ-৩ ও ডি-৫), খিলগাঁওয়ে একটি ফ্ল্যাট ও মহাখালীতে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে তাঁর নিজের। তানভীরের ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, তুষারের স্ত্রী মাসখানেক আগেও একটি নতুন গাড়ি কিনেছেন। এর আগেও তুষারের তিনটি গাড়ি ও তিনটি মোটরসাইকেল ছিল।
তানভীর মাহমুদ এ প্রতিবেদককে বলেন, 'তুষার কমপক্ষে ৩৫০ কোটি টাকা লুট করেছে। সেই টাকায় সে বাড়ি, গাড়ি ও জমি কেনা ছাড়াও তার মা-বাবা ও বাসার কাজের ছেলেদের নামে ব্যাংক হিসাবে বিপুল অঙ্কের অর্থ জমা রেখেছে।' তানভীর আরো বলেন, দুদক বা সোনালী ব্যাংক চাইলেই তুষারের এসব সম্পদ ও নগদ টাকা বাজেয়াপ্ত করতে পারে! কারণ, তুষার কখনই তাঁর এত অর্থের আয়ের উৎস দেখাতে পারবেন না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখায় হলমার্কসহ মোট ছয়টি কম্পানি সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি করে। জালিয়াতি করা এসব প্রতিষ্ঠানের একটি হলো টিঅ্যান্ড ব্রাদার্স। হলমার্ক গ্রুপের জিএম (বাণিজ্যিক) মো. আসলাম উদ্দিন টিঅ্যান্ড ব্রাদার্সে চাকরি করতেন এবং তখনই তুষারের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। টিঅ্যান্ড ব্রাদার্সের ঋণ কেলেঙ্কারির সময়ই মূলত সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখার উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) আজিজুর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় আসলামের। সেটাকে কাজে লাগিয়ে হলমার্ককেও মোটা অঙ্কের অর্থ ঋণ হিসেবে নিয়ে দেওয়ার লোভ দেখান আসলাম। প্রথমে তাতে তানভীর রাজী না হলেও পরে ব্যবসা সম্প্রসারণের চিন্তা করে আসলামকে নিয়োগ দেন।
তানভীর কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়েছি। আমি নিজে ব্যাংকের ঋণ ও এলসি-সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্ম আসলাম ও তুষারের ওপর ছেড়ে দিই। আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে আসলাম আমার কাছ থেকে কাফরুল মৌজায় ৭ শতাংশ জমিসহ ২০৪ নম্বর বাড়িটি নিজের নামে লিখে নিয়েছে, যার সিএস খতিয়ান নম্বর-১০০, এসএ খতিয়ান নম্বর-৮৫, সিএস ও এসএ দাগ নম্বর-৬৩। এখন সেখানে আটতলা ভবন নির্মাণ করছে আসলাম। এ ছাড়া ৪৭ লাখ টাকা মূল্যের হলমার্কের টয়োটা প্রিমিও সুপিরিয়র গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-গ-৩১-৩৫৭৩) নিজের নামে লিখে নিয়েছে আসলাম। এ ছাড়া মিরপুর-১০ নম্বরে ৫০১ নম্বর ভবনে একটি ফ্ল্যাট আছে আসলামের নিজ নামে।'
গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তানভীর মাহমুদ আসলামের শ্যালিকা গুলশান আরা মুক্তার কাছে ৫০ কোটি টাকা রেখে যান বলে জানা গেছে। মুক্তা এখনো গ্রুপটির ডিজিএম (প্রশাসন) পদে দায়িত্ব পালন করলেও ওই ৫০ কোটি টাকার কোনো হিসাব তিনি দিতে পারছেন না বলে জানা গেছে। মুক্তার নামে ঢাকার পীরেরবাগে চারটি ফ্ল্যাট ও একটি বাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে।
হলমার্ক গ্রুপের আরেক জিএম হারুন অর রশিদের দায়িত্ব ছিল হলমার্ক গ্রুপের সব যন্ত্রপাতি আমদানি করার বিষয়টি দেখভাল করা। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যস্ত এ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। চাকরিকালে তাঁর বেতন ছিল ৩০ হাজার টাকা। আর হারুন এখন এআরএইস নিট কম্পোজিট লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানার মালিক।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, হলমার্ক যে জালিয়াতি করে দুই হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, তার অনেকগুলোর আবেদনই পাওয়া যাচ্ছে না। আবার বেশকিছু আবেদনে তানভীর মাহমুদের স্বাক্ষর নেই। এতেই বুঝা যায়, তুষার ও রূপসী বাংলা হোটেল শাখার ডিজিএম আজিজুর রহমান অন্যদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ভুয়া এলসি বিক্রি করে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেন, তুষার বা অন্যরা বৈধ কোনো আয়ের পথ ছাড়া হঠাৎ করেই অনেক সম্পদের মালিক হলেও সোনালী ব্যাংক তাঁদের সম্পদ জব্দ করে নিতে পারবে না। কারণ, ব্যাংক তাঁদের ঋণ দেয়নি। তবে দুদক বা সরকারের অন্য কোনো সংস্থা যদি খতিয়ে দেখে প্রমাণ করতে পারে, রূপসী বাংলা হোটেল শাখা থেকে নেওয়া হলমার্কের টাকাগুলো তাঁরা আত্মসাৎ করেছেন, সেক্ষেত্রে সরকার বা দুদক তাঁদের সম্পদ জব্দ করতে পারে। দুদক বা আদালতের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ওই সব সম্পদ বিক্রি করে সোনালী ব্যাংক পাওনা আদায় করতে পারবে।
এ বিষয়ে কথা বলতে মো. আসলাম উদ্দিনের দুটি মোবাইল ফোনে ও গুলশান আরা মুক্তার একটি মোবাইল ফোনে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় একাধিকবার ফোন দেওয়া হয়। প্রতিবারই রিং হয়, কিন্তু কেউ তা গ্রহণ করেনি।
No comments