হলমার্ক কেলেঙ্কারি : সংসদীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন-সোনালীর পরিচালনা কাঠামো ভেঙে দিয়েছে হলমার্ক কেলেঙ্কারি by নিখিল ভদ্র
হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সোনালী
ব্যাংকের শেরাটন শাখার ব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমানকে দায়ী করে সংসদীয়
তদন্ত কমিটি বলেছে, জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের এই প্রক্রিয়া
উদ্ভাবনের পাশাপাশি তিনি এ কাজে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন।
তাঁর
সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন ব্যাংকের উপশাখা ব্যবস্থাপক সাইফুল হাসান ও
সিনিয়র অফিসার ওয়াহিদুজ্জামান। এ ছাড়া ওই ঘটনার জন্য মহাব্যবস্থাপক (জিএম)
ননী গোপাল নাথ ও মীর মহিদুর রহমান, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন
কবির, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. মাইনুল হক ও মো. আতিকুর রহমানকে
দায়ী করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী বাহারুল ইসলামসহ পুরো
পরিচালনা পর্ষদেরও দায় রয়েছে উল্লেখ করে এ ঘটনায় ব্যাংকের পুরো পরিচালনা
কাঠামোই ভেঙে পড়েছে বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
বহুল আলোচিত এ কেলেঙ্কারির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সোনালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের কার্যক্রম পর্যালোচনা ও তদন্তের জন্য একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। প্রায় ছয় মাস আগে কমিটি প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে। প্রতিবেদনটি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উত্থাপন করা হলেও এ বিষয়ে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা কাঠামো ভেঙে পড়ার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বড় ধরনের এই জালিয়াতির ঘটনায় অবসরপ্রাপ্ত দুই ব্যাংক কর্মকর্তা কাগজপত্র তৈরি করেছেন। ওই সব কাগজপত্র ব্যাংকের ওই শাখায় রাখা হয়নি। হলমার্কের প্রধান কার্যালয় থেকে তা উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনাটিকে নজিরবিহীন উল্লেখ করে তদন্ত কমিটি বলেছে, জালিয়াতির মাধ্যমে হলমার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংকের দুই হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে হলমার্কের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ হয়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা। এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাংকের অনিয়ম তদন্তের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ায় সোনালী ব্যাংকের অনিয়মের বিষয়ে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলেও এই কেলেংকারির সঙ্গে জড়িত আরেক পক্ষ অর্থাৎ হলমার্ক গ্রুপের দায় সম্পর্কে তেমন কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি সংসদীয় কমিটির ৮৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে হলমার্ক গ্রুপ ছাড়াও পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে সোনালী ব্যাংকের দেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ তিন হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে ইনল্যান্ড বিল পারচেজ (আইবিপি) বাবদ ফান্ডেড ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা নন-ফান্ডেড লায়াবিলিটি। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এসব অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কমিটি ব্যাংকের অনিয়ম রোধে ১১ দফা সুপারিশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির কাছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন শেরাটন হোটেল শাখায় (বর্তমানে রূপসী বাংলা) ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়ে। এ ধরনের অনিয়মের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না উল্লেখ করে ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপকের কাছে দায় স্বীকার করে একটি চিঠিও লেখেন শাখা ব্যবস্থাপক আজিজুর রহমান। কিন্তু এর পরও বন্ধ থাকেনি তাঁর বেপরোয়া দুর্নীতি। কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও জামানত ছাড়াই ভুয়া এলসি, এক্সপোর্ট কনট্রাক্ট বিলসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র তৈরি করে ঋণ অনুমোদন এবং টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন হলমার্ক গ্রুপকে। সংসদীয় তদন্ত কমিটির কাছে আজিজুর রহমান এসব কথা স্বীকার করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটি বলেছে, সোনালী ব্যাংকের উপ-শাখা ব্যবস্থাপক সাইফুল হাসান লোকবলের অভাবে দলিলাদি গুছিয়ে রাখতে পারেননি বলে দাবি করলেও তা অযৌক্তিক। বড় ধরনের অনিয়মের ঘটনা জানা সত্ত্বেও তিনি আজিজুর রহমানের নির্দেশে এসব অনিয়মে সহযোগিতা করেছেন। এসব ঘটনা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে একটি সংঘবদ্ধ চক্রের অন্যতম সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। অনিয়মের সঙ্গে ব্যাংকটির সিনিয়র অফিসার ওয়াহিদুজ্জামান জড়িত ছিলেন উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তিনি ২০১০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর অবসরে গেলেও ২০১২ সালের ৩১ মে পর্যন্ত শাখার রপ্তানিকারকদের বেতনে ওই শাখায় আউটসোর্সিং জনবল হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ক্যাশ এলসি (লোকাল), ব্যাক টু ব্যাক এলসিসহ (ফরেন) লোন অ্যাগেইনস্ট ইমপোর্টেড মার্চেন্ডাইজ (এআইএম) হিসাবসংক্রান্ত অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাঁর পরামর্শে ওই কাজে অনিয়ম হয়েছে বলে সোনালী ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে।
সংসদীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে প্রিন্সিপাল অফিসের তদন্তে শেরাটন শাখায় ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়লেও তৎকালীন ডিজিএম বিষয়টির তদারকি করেননি। তিনি ২০১২ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এসব ঘটনা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনেননি। যথাযথ তদারকি হলে এত বড় জালিয়াতি রোধ করা সম্ভব হতো। এ ছাড়া মীর মহিদুর রহমান ২০১০ সালের ২১ মার্চ থেকে ২০১২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত জিএম অফিসের দায়িত্বে থাকাকালে শেরাটন শাখা পরিদর্শনের কোনো ব্যবস্থা নেননি। অথচ তিনি দায়িত্বে থাকাকালে ওই শাখায় গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়ে। এ ছাড়া ব্যাংকের জিএম ননী গোপাল নাথ প্রিন্সিপাল অফিসের দায়িত্বে থাকাকালে ২০১১ সালের ৩০ মার্চ পরিচালিত টেস্ট ইন্সপেকশনে অনিয়ম উদ্ঘাটিত হয় এবং তা চিঠির মাধ্যমে ওই শাখাকে জানানো হয়। তিনি কেবল চিঠি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়টি এমডি বা ডিএমডির নজরে আনেননি। এরপর ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত টেস্ট ইন্সপেকশনে গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়লেও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি। তিনি ব্যবস্থা নিলে ব্যাংকের এক হাজার ৮৬০ কোটি টাকা রক্ষা পেত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালে সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখাকে ঋণ ও অগ্রিমের টার্গেট দেওয়া হয় ১৯১ কোটি টাকা, যার বিপরীতে ঋণ প্রদানের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯১৫ কোটি টাকা। ঋণের এই অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও কোনো প্রশ্ন তোলেনি। ২০০৯ ও ২০১০ সালে গুরুতর অনিয়ম এবং ২০১১ সালে ঋণ ও অগ্রিমের অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ওই শাখায় বিস্তারিত পরিদর্শন করা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোনালী ব্যাংকের ডিএমডি মো. মাইনুল হক ২০১১ সালের ১৭ আগস্ট থেকে ২০১২ সালের জুলাই পর্যন্ত আইটিএফডির (ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফিন্যান্স ডিভিশন) দায়িত্বে থাকাকালে শেরাটন হোটেল শাখার অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির (২২৩ শতাংশ) কারণ চিহ্নিত, মনিটরিং এবং তদারকি করেননি। উপরন্ত আইটিএফডি ২০১২ সালের জানুয়ারিতে অনিয়মের বিষয়টি চিহ্নিত করে ওই শাখা পরিদর্শনের জন্য এমডির অনুমোদন নিলেও তিনি পরিদর্শন করতে দুই মাস সময় পার করেন। আরেক ডিএমডি মো. আতিকুর রহমান ২০১০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হতে ২০১১ সালের ১৬ আগস্ট পর্যন্ত আইটিএফডির দায়িত্বে থাকাকালে ওই শাখায় ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ১৩৯ শতাংশে। তিনিও এর কারণ যথাযথভাবে পর্যালোচনা ও তদারকি করেননি।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মো. কামরুল হোসেন খানের নেতৃত্বে ইন্সপেকশন অ্যান্ড অডিট ডিভিশন-২ (আইএডি-২) শেরাটন শাখা পরিদর্শন করলেও তখন বৈদেশিক বাণিজ্য কার্যক্রমের ওপর কোনো অনিয়ম উল্লেখ করা হয়নি। বরং অনিয়ম গোপন করে ওই শাখাকে লো রিক্স গ্রেডে যুক্ত করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে শাখা ব্যবস্থাপকের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। এটা ওই শাখা ব্যবস্থাপককে অনিয়মতান্ত্রিক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য আরো উৎসাহিত করে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হোটেল শেরাটন শাখাটি ব্যাংকটির নিয়মিত নিরীক্ষা পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১২ সালের জানুয়ারিতে নিরীক্ষা করার কথা থাকলেও তা এপ্রিল পর্যন্ত বিলম্বিত হয়। এই নিরীক্ষাকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহাব্যবস্থাপক মাসরুরুল হুদা সিরাজীকে তিনবার বদলি করা হয়। তাঁকে বদলি না করা হলে এই অনিয়ম আগেই উদ্ঘাটন করা যেত। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনুমোদন ছাড়া এই বদলি সম্ভব ছিল না। ফলে এমডি এ ক্ষেত্রে দায় এড়াতে পারেন না।
তদন্ত কমিটির মতামতে বলা হয়েছে, প্রতিটি ৩০ কোটি টাকা করে আলাদা আলাদা আটটি ঋণ প্রস্তাবের মাধ্যমে ২৪০ কোটি টাকা ঋণ প্রস্তাব প্রধান কার্যালয় থেকে অনুমোদিত না হওয়া সত্ত্বেও হলমার্ক গ্রুপের ঋণসীমার অতিরিক্ত এবং ২৪০ কোটির পরিবর্তে ৯৯৯ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে চলে যাবে আর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানবে না, এটা হতে পারে না। আরো বলা হয়েছে, সোনালী ব্যাংকের মানবসম্পদ নীতিমালা অনুযায়ী তিন বছর অন্তর সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদোন্নতি ও বদলি হয়ে থাকে। কিন্তু শেরাটন শাখা ব্যবস্থাপক আজিজুর রহমানকে পাঁচ বছরেও বদলি করা হয়নি। নিয়মানুযায়ী তাঁকে বদলি করা গেলে ওই অনিয়ম এড়ানো যেত।
তদন্ত কমিটির মতামতে বলা হয়েছে, ব্যাংকের শেরাটন শাখা থেকে হলমার্ক গ্রুপ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মবহির্ভূতভাবে দেওয়া ঋণের দায় হলমার্ক গ্রপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ তদন্ত কমিটির কাছে স্বীকার করেছেন। এই বিপুল পরিমাণ ঋণের অর্থ তাঁর রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তাই নিয়মবহির্ভূতভাবে এই ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। একই সঙ্গে ঋণের টাকা আদায়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
এ বিষয়ে আরো বলা হয়েছে, ব্যাংকের পুরো পরিচালনা কাঠামোই ভেঙে পড়েছে। এখানে পর্ষদের নির্দেশনা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ মেনে চলেনি এবং পর্ষদকে ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি সময়মতো ও সঠিকভাবে জানানো হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী এসব অনিয়মের কথা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের জানা থাকার কথা। আর পর্ষদ চাইলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারত। পর্ষদ চেয়ারম্যান সরাসরি শাখা ভিজিট করতে পারতেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হয়নি। ফলে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এ ক্ষেত্রে দায় এড়াতে পারে না বলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির সদস্য এ কে এম মাইদুল ইসলাম প্রতিবেদনের বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন কমিটিতে জমা দিয়েছি। এ বিষয়ে কমিটির সভাপতি বিস্তারিত বলতে পারবেন।'
এর আগে গত ৮ নভেম্বর উপকমিটির সর্বশেষ বৈঠকে তদন্ত প্রতিবেদনটি অনুমোদন করা হয়। ওই বৈঠক শেষে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক তাজুল ইসলাম বলেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারিই এ দেশে প্রথম নয়। এর আগে ওরিয়েন্টাল ও রূপালী ব্যাংকে এ রকম ঘটনা ঘটেছে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে মূল কমিটির কাছে জমা দেওয়া হবে।
১১ সুপারিশ
বহুল আলোচিত এ কেলেঙ্কারির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সোনালী ব্যাংকসহ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের কার্যক্রম পর্যালোচনা ও তদন্তের জন্য একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। প্রায় ছয় মাস আগে কমিটি প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে। প্রতিবেদনটি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উত্থাপন করা হলেও এ বিষয়ে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা কাঠামো ভেঙে পড়ার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বড় ধরনের এই জালিয়াতির ঘটনায় অবসরপ্রাপ্ত দুই ব্যাংক কর্মকর্তা কাগজপত্র তৈরি করেছেন। ওই সব কাগজপত্র ব্যাংকের ওই শাখায় রাখা হয়নি। হলমার্কের প্রধান কার্যালয় থেকে তা উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনাটিকে নজিরবিহীন উল্লেখ করে তদন্ত কমিটি বলেছে, জালিয়াতির মাধ্যমে হলমার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংকের দুই হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে হলমার্কের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ হয়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা। এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাংকের অনিয়ম তদন্তের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ায় সোনালী ব্যাংকের অনিয়মের বিষয়ে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলেও এই কেলেংকারির সঙ্গে জড়িত আরেক পক্ষ অর্থাৎ হলমার্ক গ্রুপের দায় সম্পর্কে তেমন কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি সংসদীয় কমিটির ৮৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে হলমার্ক গ্রুপ ছাড়াও পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে সোনালী ব্যাংকের দেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ তিন হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে ইনল্যান্ড বিল পারচেজ (আইবিপি) বাবদ ফান্ডেড ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা নন-ফান্ডেড লায়াবিলিটি। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এসব অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। কমিটি ব্যাংকের অনিয়ম রোধে ১১ দফা সুপারিশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির কাছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন শেরাটন হোটেল শাখায় (বর্তমানে রূপসী বাংলা) ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়ে। এ ধরনের অনিয়মের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না উল্লেখ করে ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপকের কাছে দায় স্বীকার করে একটি চিঠিও লেখেন শাখা ব্যবস্থাপক আজিজুর রহমান। কিন্তু এর পরও বন্ধ থাকেনি তাঁর বেপরোয়া দুর্নীতি। কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও জামানত ছাড়াই ভুয়া এলসি, এক্সপোর্ট কনট্রাক্ট বিলসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র তৈরি করে ঋণ অনুমোদন এবং টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন হলমার্ক গ্রুপকে। সংসদীয় তদন্ত কমিটির কাছে আজিজুর রহমান এসব কথা স্বীকার করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটি বলেছে, সোনালী ব্যাংকের উপ-শাখা ব্যবস্থাপক সাইফুল হাসান লোকবলের অভাবে দলিলাদি গুছিয়ে রাখতে পারেননি বলে দাবি করলেও তা অযৌক্তিক। বড় ধরনের অনিয়মের ঘটনা জানা সত্ত্বেও তিনি আজিজুর রহমানের নির্দেশে এসব অনিয়মে সহযোগিতা করেছেন। এসব ঘটনা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে একটি সংঘবদ্ধ চক্রের অন্যতম সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। অনিয়মের সঙ্গে ব্যাংকটির সিনিয়র অফিসার ওয়াহিদুজ্জামান জড়িত ছিলেন উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তিনি ২০১০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর অবসরে গেলেও ২০১২ সালের ৩১ মে পর্যন্ত শাখার রপ্তানিকারকদের বেতনে ওই শাখায় আউটসোর্সিং জনবল হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ক্যাশ এলসি (লোকাল), ব্যাক টু ব্যাক এলসিসহ (ফরেন) লোন অ্যাগেইনস্ট ইমপোর্টেড মার্চেন্ডাইজ (এআইএম) হিসাবসংক্রান্ত অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাঁর পরামর্শে ওই কাজে অনিয়ম হয়েছে বলে সোনালী ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে।
সংসদীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে প্রিন্সিপাল অফিসের তদন্তে শেরাটন শাখায় ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়লেও তৎকালীন ডিজিএম বিষয়টির তদারকি করেননি। তিনি ২০১২ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত এসব ঘটনা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনেননি। যথাযথ তদারকি হলে এত বড় জালিয়াতি রোধ করা সম্ভব হতো। এ ছাড়া মীর মহিদুর রহমান ২০১০ সালের ২১ মার্চ থেকে ২০১২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত জিএম অফিসের দায়িত্বে থাকাকালে শেরাটন শাখা পরিদর্শনের কোনো ব্যবস্থা নেননি। অথচ তিনি দায়িত্বে থাকাকালে ওই শাখায় গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়ে। এ ছাড়া ব্যাংকের জিএম ননী গোপাল নাথ প্রিন্সিপাল অফিসের দায়িত্বে থাকাকালে ২০১১ সালের ৩০ মার্চ পরিচালিত টেস্ট ইন্সপেকশনে অনিয়ম উদ্ঘাটিত হয় এবং তা চিঠির মাধ্যমে ওই শাখাকে জানানো হয়। তিনি কেবল চিঠি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়টি এমডি বা ডিএমডির নজরে আনেননি। এরপর ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত টেস্ট ইন্সপেকশনে গুরুতর অনিয়ম ধরা পড়লেও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি। তিনি ব্যবস্থা নিলে ব্যাংকের এক হাজার ৮৬০ কোটি টাকা রক্ষা পেত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালে সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখাকে ঋণ ও অগ্রিমের টার্গেট দেওয়া হয় ১৯১ কোটি টাকা, যার বিপরীতে ঋণ প্রদানের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯১৫ কোটি টাকা। ঋণের এই অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও কোনো প্রশ্ন তোলেনি। ২০০৯ ও ২০১০ সালে গুরুতর অনিয়ম এবং ২০১১ সালে ঋণ ও অগ্রিমের অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ওই শাখায় বিস্তারিত পরিদর্শন করা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোনালী ব্যাংকের ডিএমডি মো. মাইনুল হক ২০১১ সালের ১৭ আগস্ট থেকে ২০১২ সালের জুলাই পর্যন্ত আইটিএফডির (ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফিন্যান্স ডিভিশন) দায়িত্বে থাকাকালে শেরাটন হোটেল শাখার অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির (২২৩ শতাংশ) কারণ চিহ্নিত, মনিটরিং এবং তদারকি করেননি। উপরন্ত আইটিএফডি ২০১২ সালের জানুয়ারিতে অনিয়মের বিষয়টি চিহ্নিত করে ওই শাখা পরিদর্শনের জন্য এমডির অনুমোদন নিলেও তিনি পরিদর্শন করতে দুই মাস সময় পার করেন। আরেক ডিএমডি মো. আতিকুর রহমান ২০১০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হতে ২০১১ সালের ১৬ আগস্ট পর্যন্ত আইটিএফডির দায়িত্বে থাকাকালে ওই শাখায় ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ১৩৯ শতাংশে। তিনিও এর কারণ যথাযথভাবে পর্যালোচনা ও তদারকি করেননি।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মো. কামরুল হোসেন খানের নেতৃত্বে ইন্সপেকশন অ্যান্ড অডিট ডিভিশন-২ (আইএডি-২) শেরাটন শাখা পরিদর্শন করলেও তখন বৈদেশিক বাণিজ্য কার্যক্রমের ওপর কোনো অনিয়ম উল্লেখ করা হয়নি। বরং অনিয়ম গোপন করে ওই শাখাকে লো রিক্স গ্রেডে যুক্ত করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে শাখা ব্যবস্থাপকের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। এটা ওই শাখা ব্যবস্থাপককে অনিয়মতান্ত্রিক ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য আরো উৎসাহিত করে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হোটেল শেরাটন শাখাটি ব্যাংকটির নিয়মিত নিরীক্ষা পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১২ সালের জানুয়ারিতে নিরীক্ষা করার কথা থাকলেও তা এপ্রিল পর্যন্ত বিলম্বিত হয়। এই নিরীক্ষাকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহাব্যবস্থাপক মাসরুরুল হুদা সিরাজীকে তিনবার বদলি করা হয়। তাঁকে বদলি না করা হলে এই অনিয়ম আগেই উদ্ঘাটন করা যেত। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনুমোদন ছাড়া এই বদলি সম্ভব ছিল না। ফলে এমডি এ ক্ষেত্রে দায় এড়াতে পারেন না।
তদন্ত কমিটির মতামতে বলা হয়েছে, প্রতিটি ৩০ কোটি টাকা করে আলাদা আলাদা আটটি ঋণ প্রস্তাবের মাধ্যমে ২৪০ কোটি টাকা ঋণ প্রস্তাব প্রধান কার্যালয় থেকে অনুমোদিত না হওয়া সত্ত্বেও হলমার্ক গ্রুপের ঋণসীমার অতিরিক্ত এবং ২৪০ কোটির পরিবর্তে ৯৯৯ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে চলে যাবে আর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানবে না, এটা হতে পারে না। আরো বলা হয়েছে, সোনালী ব্যাংকের মানবসম্পদ নীতিমালা অনুযায়ী তিন বছর অন্তর সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদোন্নতি ও বদলি হয়ে থাকে। কিন্তু শেরাটন শাখা ব্যবস্থাপক আজিজুর রহমানকে পাঁচ বছরেও বদলি করা হয়নি। নিয়মানুযায়ী তাঁকে বদলি করা গেলে ওই অনিয়ম এড়ানো যেত।
তদন্ত কমিটির মতামতে বলা হয়েছে, ব্যাংকের শেরাটন শাখা থেকে হলমার্ক গ্রুপ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মবহির্ভূতভাবে দেওয়া ঋণের দায় হলমার্ক গ্রপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ তদন্ত কমিটির কাছে স্বীকার করেছেন। এই বিপুল পরিমাণ ঋণের অর্থ তাঁর রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তাই নিয়মবহির্ভূতভাবে এই ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। একই সঙ্গে ঋণের টাকা আদায়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
এ বিষয়ে আরো বলা হয়েছে, ব্যাংকের পুরো পরিচালনা কাঠামোই ভেঙে পড়েছে। এখানে পর্ষদের নির্দেশনা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ মেনে চলেনি এবং পর্ষদকে ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি সময়মতো ও সঠিকভাবে জানানো হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী এসব অনিয়মের কথা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের জানা থাকার কথা। আর পর্ষদ চাইলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারত। পর্ষদ চেয়ারম্যান সরাসরি শাখা ভিজিট করতে পারতেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হয়নি। ফলে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এ ক্ষেত্রে দায় এড়াতে পারে না বলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির সদস্য এ কে এম মাইদুল ইসলাম প্রতিবেদনের বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন কমিটিতে জমা দিয়েছি। এ বিষয়ে কমিটির সভাপতি বিস্তারিত বলতে পারবেন।'
এর আগে গত ৮ নভেম্বর উপকমিটির সর্বশেষ বৈঠকে তদন্ত প্রতিবেদনটি অনুমোদন করা হয়। ওই বৈঠক শেষে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক তাজুল ইসলাম বলেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারিই এ দেশে প্রথম নয়। এর আগে ওরিয়েন্টাল ও রূপালী ব্যাংকে এ রকম ঘটনা ঘটেছে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সুপারিশসহ প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে মূল কমিটির কাছে জমা দেওয়া হবে।
১১ সুপারিশ
No comments