যে গল্পের শেষ নেই by কবির হোসেন
মালিকদের সীমাহীন লোভ, রাষ্ট্রযন্ত্রের
উদাসীনতা আর সর্বগ্রাসী বিশ্ব পুঁজিবাদের ফাঁদে পড়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত
বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের। বেঁচে থাকার জন্য জীবন যুদ্ধ প্রতিনিয়ত, তবুও
যেন নিস্তার নেই এসব অসহায় শ্রমিকের।
তাজরীনের আগুনে
শতাধিক প্রাণ জ্বলে পুড়ে ছারখার হওয়ার কয়েক মাস যেতে না যেতেই ২৪ এপ্রিল
রানা প্লাজা ধ্বংসস্তূপে চিড়ে চ্যাপ্টা ১ হাজার ১শ ২৯ জন শ্রমিক। এ যেন
অন্তহীন মৃত্যুর মিছিল।
দেশ-বিদেশের প্রায় সব সংবাদ মাধ্যমেই রানা প্লাজা ধস নিয়ে ওঠে তুমুল আলোচনার ঝড়। প্রকাশিত হয় অজস্র প্রতিবেদন। বেশির ভাগ প্রতিবেদনেই উঠে আসে পোশাক শ্রমিকদের জীবন সংগ্রামের কাহিনী, তাদের বেদনা আর বঞ্চনার আখ্যান।
এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকার অন্যতম দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের অনলাইন প্রচ্ছদে শনিবার প্রকাশিত এমনই আরেকটি গল্প।
ওই গল্পে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে বেঁচে যাওয়া পোশাক শ্রমিক মাহিনুর আক্তারের জীবন সংগ্রামের কাহিনী তুলে ধরা হয়। মাহিনুরের গল্পের আড়ালে এ যেন বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে কাজ করা আরও লাখ লাখ মাহিনুরের জীবন আখ্যান।
‘ফ্যাক্টরি পে চেক ট্রাম্প ডেঞ্জার, লং ডে ফর বাংলাদেশ ওমেন’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি তৈরি করেন গর্ডন ফেয়ারক্লাফ। ইংরেজি থেকে অনুদিত সেই প্রতিবেদনটি ঈষৎ সংক্ষেপে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
রানা প্লাজা থেকে রক্তাক্ত ও অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধারের পাঁচ সপ্তাহের মাথায় অবশেষে মাহিনুর আক্তার তার গ্রামের বাড়ি ফিরেছেন, তবে সঙ্গে এনেছেন মাথা ভর্তি দুশ্চিন্তার বোঝা।
ঢাকায় দ্রুত কাজে ফিরতে না পারলে তার বিধবা মা আর ছোট দুই ভাইয়ের মুখে খাবার তুলে দেবেন কি করে, এই চিন্তায় ছেয়ে আছে তার মন।
জীর্ণ বাড়ির মেঠো আঙ্গিনায় মাদুর পেতে বসে প্রতিবেদককে বলছিলেন নিজের জীবন যুদ্ধের কাহিনী।
রানা প্লাজার চারতলার ওই পোশাক কারখানায় কাজ করে দৈনিক ১২ ঘন্টা কঠোর পরিশ্রমের পরও মাস শেষে পেতেন ৬-৭ হাজার টাকা। ওই টাকায় হতো তার পরিবারের অন্ন সংস্থান, দুই ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ, ঘরভাড়া, নিজের হাতখরচ। হতো বললে ভুল হবে, আসলে তাকে চালিয়ে নিতে হতো।
কিন্তু রানা প্লাজার বিভীষিকার কথা স্মরণ করে চোখেমুখে রাজ্যের ভয় আর হতাশা নিয়ে ১৫ বছরের মাহিনুর জানালেন, এখনও ঘুমের ঘোরে আঁতকে ওঠেন তিনি। আর এই ভয় তাকে তাড়া করে বেড়াবে বাকি পুরো জীবন।
কিন্তু এ আতঙ্ককে একপাশে সরিয়ে রেখেই দারিদ্র্যের চাপে মাহিনুরকে আবারও কাজে যেতে হবে।শুরু করতে হবে বেঁচে থাকার নতুন সংগ্রাম।
রানা প্লাজার ধস থেকে প্রাণে বেঁচে ফেরার প্রশান্তির বদলে তার চোখে মুখে এখন খেলা করে দীর্ঘ দুই মাস বেকার বসে থাকার জ্বালা।
বললেন, “খুব কষ্ট করে চলছি। জানি না আমার বেতন ছাড়া পরিবার কিভাবে চলবে।” আসলে পরিবারের চিন্তাই তার আসল শঙ্কার জায়গা। তার ১৫ বছরের কচি কাঁধে যে পুরো পরিবারের বোঝা।
এভাবেই নিজ নিজ পরিবারকে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে রক্ষা করতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে কাজ করে যাচ্ছেন মাহিনুরের মত লাখ লাখ পোশাক কর্মী, যাদের অধিকাংশেরই বয়স ১৪ থেকে ২০।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্বল শাসন ব্যবস্থা ও জ্বালানি সমস্যা সত্ত্বেও এসব শ্রমিকের কাঁধে ভর রেখেই বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, ২০০০ সালের পর থেকে এ দেশের দারিদ্র্যের হার ২৫ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে জিডিপিও।
কিন্তু এটা তো মুদ্রার একপিঠ। আরেক পিঠেই তো আছে শোষণ, বঞ্চনা আর বেদনার করুণ চিত্র।
ওয়াল স্ট্রিটের জার্নালের ওই প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে কিভাবে বাংলাদেশের এসব শ্রমিকদের সস্তা শ্রমকে জিম্মি করে মুনাফার পাহাড় গড়ছে উন্নত বিশ্বের নামীদামী ব্রান্ডগুলো।
ওয়ালমার্ট, এইচ এন্ড এম, ডব্লিউএমটি, আইটিএক্স এর মতো বিশ্বের নামকরা ব্রান্ডগুলো দেদারসে মুনাফা করে যাচ্ছে এই বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির কাঁধে ভর করে।
পেটের তাগিদে গ্রাম-পরিবার-বিদ্যালয় সব ছেড়ে শহরে এসে মাহিনুরের মত কিশোরী তরুণীরা পোশাক কারখানায় কাজ নেয়। কিন্তু সেখানেও তাদের শিকার হতে হয় নির্যাতনের। মুনাফালোভী পোশাক মালিকরা দৈনিক ১২ ঘণ্টা কিংবা তারও বেশি সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য করেন তাদের।
মাহিনুরের পরিবার বাস করতো বঙ্গোপসাগরের কোলঘেষা বৃহত্তর বরিশালের একটি গ্রামে। ঋণে জর্জরিত হয়ে একটা সময় গ্রাম ছেড়ে সপরিবারে ঢাকায় আসতে বাধ্য হয় তারা। মাহিনুরের বাবা আদম আলী ঢাকায় একটি মার্কেটে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ নেয়। মা, সুফিয়া বেগম বাড়িতে থেকে তার দুই ছোট ভাইয়ের দেখাশোনা করতেন। বাবার সামান্য আয় দিয়েই সংসার চলছিল তাদের।
নিজের অর্থকষ্টের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে মাহিনুর আক্তার বলেন, “আমার মাত্র এক জোড়া কাপড় ছিল। দুইটা একসঙ্গে কখনো ধুয়ে দিতে পারতাম না।”
পরিবারের দুঃখ ঘোচাতে অবশেষে মাত্র ১২ বছর বয়সে মাসিক মাত্র ২ হাজার টাকা বেতনে রানা প্লাজায় একটি কারখানায় কাজ নেন তিনি।
প্রথমদিকে হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করলেও ধীরে ধীরে অপারেটরের কাজ শিখে নেন। অবশেষে পূর্ণাঙ্গ অপারেটর হিসেবে তার বেতন হয় ৪ হাজার টাকা।
গার্মেন্টেসে কাজের কথা বলতে গিয়ে মাহিনুর বলেন,“দারুণ কষ্ট করতে হতো আমাকে। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে যেনতেন মুখে কিছু একটা দিয়েই আটটার মধ্যে কারখানায় পৌঁছাতে হতো। দীর্ঘ পথ হেঁটে অফিসে পৌঁছেও শান্তি ছিল না। দ্রুত কাজ করার জন্য বার বার তাগিদ দিতেন সুপারভাইজাররা। এমনকি প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ না হলে বাথরুম পর্যন্ত যেতে দিতে চাইতেন না তারা।
অপারেটরের কাজ শেষে যখন ফিনিশিংয়ে কাজে সম্পৃক্ত হই তখন কাজের পরিধি আরো বেড়ে যায়। প্রতি মিনিটে দশটির বেশি বোতাম সেলাই করতে হতো। অথবা এক ঘণ্টায় লাগাতে হতো ৫ শতাধিক প্যান্টের বাটন।”
মাহিনুর বলেন, “আমি সবসময় কাজে মনোযাগী ছিলাম। আবার আমি চিন্তিত ছিলাম এই ভেবে যদি কোন ভুল হয়ে যায়, তাহলে তো তারা আমাকে চাকরি থেকে বের করে দেবে।”
কারখানায় কাজ করার সময় নারী পোশাক শ্রমিকদের কারণে অকারণে নির্যাতনের শিকার হওয়ার চিত্রও উঠে আসে মাহিনুরের জবানিতে।
মাহিনুর বলেন, “কারণে-অকারণে ম্যানেজার আমাদের সঙ্গে দুর্বব্যবহার করত। এমনকি অনেক সময় আমাদের শরীরেও হাত দিতেন।”
অনেক সময় রাত নয়টা থেকে দশটা পর্যন্ত কাজ করতে হতো তাদের। আর মাসে চারবার ওভারটাইম তো ছিলই।
কিন্তু এ ওভারটাইমও তার জীবনে স্বচ্ছলতা আনতে পারেনি। সর্বমোট তার আয় ছিলো ৭ হাজার টাকা। অর্ধেকের বেশিই চলে যেত বাড়ি ভাড়ায়। বাকি অর্থ লাগতো দুই ভাইয়ের পড়াশোনা অার দুমুঠো খাবারের খরচের পেছনে।
এর মধ্যেই যখন গত বছর মাহিনুরের বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন তখন যেন ঘোর অমানিশা নেমে আসে মাহিনুরের পরিবারে।
এমন পরিস্থিতিতে মা ও দুই ভাইকে গ্রামে পাঠিয়ে দেন মাহিনুর। নিজের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ রেখে বেতনের বাকি সব টাকাই গ্রামে পাঠিয়ে দিতেন তিনি।
মাহিনুরের আশঙ্কা কম টাকা পাঠালে হয়তো তার পরিবারের দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের পথও রুদ্ধ হয়ে যাবে।
মাহিনুরের জবানিতে, “আমি সবসময় এটাই ভাবতাম। আমার আয়ের উপরই নির্ভর করে আমার পরিবার কতটুকু খাবে।”
সাভারে ঠিক মতো দিনের আলো পৌঁছায় না, এমন একটি জরাজীর্ণ কক্ষে গাদাগাদি করে কয়েকজনের সঙ্গে থাকতেন মাহিনুর। একটি বাথরুম ব্যবহার করতো হতো আরও তিন পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে।
রানা প্লাজার ধ্বংস্তূপ থেকে বেঁচে আসা মাহিনুর জানালেন, এখনও তার পায়ে ব্যথা আছে। তারপরও শিগগিরই কাজের সন্ধানে নেমে পড়তে হবে তাকে।
প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপের সময় বাড়ির উঠোনে খেলছিলো তার ছোটভাই সহ অন্যান্য বাচ্চারা।
সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে মাহিনুর জানান, “আমার বয়সের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়, খেলাধুলা করে। কিন্তু পরিবারের দারিদ্র্যতার কারণে আমাকে কাজে যেতে হবে। আমার খুব ইচ্ছে হয় ওদের মতো খেলতে, দৌড়াতে।” কঠোর বাস্তবতায় হয়তো পুরোপুরি চাপা পড়েনি তার কিশোরী সুলভ মনন।
মাহিনুরের দুই মাস চাকরিতে অনুপস্থিতিকালীন সময়ে তাদের পরিবারকে সাহায্য করে আসছেন চাচাতো ভাই আলম। কিন্তু আলমেরও নিজের পরিবারের ভরণপোষণ করতে হয়।তাই ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও আবারও কাজে যেতে হয় মাহিনুরকে।
মাহিনুরের মা বললেন, “আমি তার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। কিন্তু তারপরও তাকে যেতে দিতে হবে।”
শত ভয়-শঙ্কা নিয়ে আবারও তাই কাজের উদ্দেশ্যে ঢাকার পথে পা বাড়ায় মাহিনুর।
বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে মাহিনুর যখন ভ্যানে চড়ে বসেন, তখন লাল-কমলা ঘোমটার মাঝে তার মায়ের অশ্রুভেজা চোখ।
তবে ভ্যানে বসে একবারও পিছনে ফিরলেন না মাহিনুর। হয়তো নিজের অশ্রুসজল চোখ মায়ের কাছ থেকে লুকোতেই আর পিছু ফিরলেন না তিনি।
দেশ-বিদেশের প্রায় সব সংবাদ মাধ্যমেই রানা প্লাজা ধস নিয়ে ওঠে তুমুল আলোচনার ঝড়। প্রকাশিত হয় অজস্র প্রতিবেদন। বেশির ভাগ প্রতিবেদনেই উঠে আসে পোশাক শ্রমিকদের জীবন সংগ্রামের কাহিনী, তাদের বেদনা আর বঞ্চনার আখ্যান।
এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকার অন্যতম দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের অনলাইন প্রচ্ছদে শনিবার প্রকাশিত এমনই আরেকটি গল্প।
ওই গল্পে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে বেঁচে যাওয়া পোশাক শ্রমিক মাহিনুর আক্তারের জীবন সংগ্রামের কাহিনী তুলে ধরা হয়। মাহিনুরের গল্পের আড়ালে এ যেন বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে কাজ করা আরও লাখ লাখ মাহিনুরের জীবন আখ্যান।
‘ফ্যাক্টরি পে চেক ট্রাম্প ডেঞ্জার, লং ডে ফর বাংলাদেশ ওমেন’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি তৈরি করেন গর্ডন ফেয়ারক্লাফ। ইংরেজি থেকে অনুদিত সেই প্রতিবেদনটি ঈষৎ সংক্ষেপে বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
রানা প্লাজা থেকে রক্তাক্ত ও অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধারের পাঁচ সপ্তাহের মাথায় অবশেষে মাহিনুর আক্তার তার গ্রামের বাড়ি ফিরেছেন, তবে সঙ্গে এনেছেন মাথা ভর্তি দুশ্চিন্তার বোঝা।
ঢাকায় দ্রুত কাজে ফিরতে না পারলে তার বিধবা মা আর ছোট দুই ভাইয়ের মুখে খাবার তুলে দেবেন কি করে, এই চিন্তায় ছেয়ে আছে তার মন।
জীর্ণ বাড়ির মেঠো আঙ্গিনায় মাদুর পেতে বসে প্রতিবেদককে বলছিলেন নিজের জীবন যুদ্ধের কাহিনী।
রানা প্লাজার চারতলার ওই পোশাক কারখানায় কাজ করে দৈনিক ১২ ঘন্টা কঠোর পরিশ্রমের পরও মাস শেষে পেতেন ৬-৭ হাজার টাকা। ওই টাকায় হতো তার পরিবারের অন্ন সংস্থান, দুই ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ, ঘরভাড়া, নিজের হাতখরচ। হতো বললে ভুল হবে, আসলে তাকে চালিয়ে নিতে হতো।
কিন্তু রানা প্লাজার বিভীষিকার কথা স্মরণ করে চোখেমুখে রাজ্যের ভয় আর হতাশা নিয়ে ১৫ বছরের মাহিনুর জানালেন, এখনও ঘুমের ঘোরে আঁতকে ওঠেন তিনি। আর এই ভয় তাকে তাড়া করে বেড়াবে বাকি পুরো জীবন।
কিন্তু এ আতঙ্ককে একপাশে সরিয়ে রেখেই দারিদ্র্যের চাপে মাহিনুরকে আবারও কাজে যেতে হবে।শুরু করতে হবে বেঁচে থাকার নতুন সংগ্রাম।
রানা প্লাজার ধস থেকে প্রাণে বেঁচে ফেরার প্রশান্তির বদলে তার চোখে মুখে এখন খেলা করে দীর্ঘ দুই মাস বেকার বসে থাকার জ্বালা।
বললেন, “খুব কষ্ট করে চলছি। জানি না আমার বেতন ছাড়া পরিবার কিভাবে চলবে।” আসলে পরিবারের চিন্তাই তার আসল শঙ্কার জায়গা। তার ১৫ বছরের কচি কাঁধে যে পুরো পরিবারের বোঝা।
এভাবেই নিজ নিজ পরিবারকে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে রক্ষা করতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে কাজ করে যাচ্ছেন মাহিনুরের মত লাখ লাখ পোশাক কর্মী, যাদের অধিকাংশেরই বয়স ১৪ থেকে ২০।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্বল শাসন ব্যবস্থা ও জ্বালানি সমস্যা সত্ত্বেও এসব শ্রমিকের কাঁধে ভর রেখেই বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, ২০০০ সালের পর থেকে এ দেশের দারিদ্র্যের হার ২৫ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে জিডিপিও।
কিন্তু এটা তো মুদ্রার একপিঠ। আরেক পিঠেই তো আছে শোষণ, বঞ্চনা আর বেদনার করুণ চিত্র।
ওয়াল স্ট্রিটের জার্নালের ওই প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে কিভাবে বাংলাদেশের এসব শ্রমিকদের সস্তা শ্রমকে জিম্মি করে মুনাফার পাহাড় গড়ছে উন্নত বিশ্বের নামীদামী ব্রান্ডগুলো।
ওয়ালমার্ট, এইচ এন্ড এম, ডব্লিউএমটি, আইটিএক্স এর মতো বিশ্বের নামকরা ব্রান্ডগুলো দেদারসে মুনাফা করে যাচ্ছে এই বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির কাঁধে ভর করে।
পেটের তাগিদে গ্রাম-পরিবার-বিদ্যালয় সব ছেড়ে শহরে এসে মাহিনুরের মত কিশোরী তরুণীরা পোশাক কারখানায় কাজ নেয়। কিন্তু সেখানেও তাদের শিকার হতে হয় নির্যাতনের। মুনাফালোভী পোশাক মালিকরা দৈনিক ১২ ঘণ্টা কিংবা তারও বেশি সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য করেন তাদের।
মাহিনুরের পরিবার বাস করতো বঙ্গোপসাগরের কোলঘেষা বৃহত্তর বরিশালের একটি গ্রামে। ঋণে জর্জরিত হয়ে একটা সময় গ্রাম ছেড়ে সপরিবারে ঢাকায় আসতে বাধ্য হয় তারা। মাহিনুরের বাবা আদম আলী ঢাকায় একটি মার্কেটে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ নেয়। মা, সুফিয়া বেগম বাড়িতে থেকে তার দুই ছোট ভাইয়ের দেখাশোনা করতেন। বাবার সামান্য আয় দিয়েই সংসার চলছিল তাদের।
নিজের অর্থকষ্টের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে মাহিনুর আক্তার বলেন, “আমার মাত্র এক জোড়া কাপড় ছিল। দুইটা একসঙ্গে কখনো ধুয়ে দিতে পারতাম না।”
পরিবারের দুঃখ ঘোচাতে অবশেষে মাত্র ১২ বছর বয়সে মাসিক মাত্র ২ হাজার টাকা বেতনে রানা প্লাজায় একটি কারখানায় কাজ নেন তিনি।
প্রথমদিকে হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করলেও ধীরে ধীরে অপারেটরের কাজ শিখে নেন। অবশেষে পূর্ণাঙ্গ অপারেটর হিসেবে তার বেতন হয় ৪ হাজার টাকা।
গার্মেন্টেসে কাজের কথা বলতে গিয়ে মাহিনুর বলেন,“দারুণ কষ্ট করতে হতো আমাকে। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে যেনতেন মুখে কিছু একটা দিয়েই আটটার মধ্যে কারখানায় পৌঁছাতে হতো। দীর্ঘ পথ হেঁটে অফিসে পৌঁছেও শান্তি ছিল না। দ্রুত কাজ করার জন্য বার বার তাগিদ দিতেন সুপারভাইজাররা। এমনকি প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ না হলে বাথরুম পর্যন্ত যেতে দিতে চাইতেন না তারা।
অপারেটরের কাজ শেষে যখন ফিনিশিংয়ে কাজে সম্পৃক্ত হই তখন কাজের পরিধি আরো বেড়ে যায়। প্রতি মিনিটে দশটির বেশি বোতাম সেলাই করতে হতো। অথবা এক ঘণ্টায় লাগাতে হতো ৫ শতাধিক প্যান্টের বাটন।”
মাহিনুর বলেন, “আমি সবসময় কাজে মনোযাগী ছিলাম। আবার আমি চিন্তিত ছিলাম এই ভেবে যদি কোন ভুল হয়ে যায়, তাহলে তো তারা আমাকে চাকরি থেকে বের করে দেবে।”
কারখানায় কাজ করার সময় নারী পোশাক শ্রমিকদের কারণে অকারণে নির্যাতনের শিকার হওয়ার চিত্রও উঠে আসে মাহিনুরের জবানিতে।
মাহিনুর বলেন, “কারণে-অকারণে ম্যানেজার আমাদের সঙ্গে দুর্বব্যবহার করত। এমনকি অনেক সময় আমাদের শরীরেও হাত দিতেন।”
অনেক সময় রাত নয়টা থেকে দশটা পর্যন্ত কাজ করতে হতো তাদের। আর মাসে চারবার ওভারটাইম তো ছিলই।
কিন্তু এ ওভারটাইমও তার জীবনে স্বচ্ছলতা আনতে পারেনি। সর্বমোট তার আয় ছিলো ৭ হাজার টাকা। অর্ধেকের বেশিই চলে যেত বাড়ি ভাড়ায়। বাকি অর্থ লাগতো দুই ভাইয়ের পড়াশোনা অার দুমুঠো খাবারের খরচের পেছনে।
এর মধ্যেই যখন গত বছর মাহিনুরের বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন তখন যেন ঘোর অমানিশা নেমে আসে মাহিনুরের পরিবারে।
এমন পরিস্থিতিতে মা ও দুই ভাইকে গ্রামে পাঠিয়ে দেন মাহিনুর। নিজের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ রেখে বেতনের বাকি সব টাকাই গ্রামে পাঠিয়ে দিতেন তিনি।
মাহিনুরের আশঙ্কা কম টাকা পাঠালে হয়তো তার পরিবারের দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের পথও রুদ্ধ হয়ে যাবে।
মাহিনুরের জবানিতে, “আমি সবসময় এটাই ভাবতাম। আমার আয়ের উপরই নির্ভর করে আমার পরিবার কতটুকু খাবে।”
সাভারে ঠিক মতো দিনের আলো পৌঁছায় না, এমন একটি জরাজীর্ণ কক্ষে গাদাগাদি করে কয়েকজনের সঙ্গে থাকতেন মাহিনুর। একটি বাথরুম ব্যবহার করতো হতো আরও তিন পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করে।
রানা প্লাজার ধ্বংস্তূপ থেকে বেঁচে আসা মাহিনুর জানালেন, এখনও তার পায়ে ব্যথা আছে। তারপরও শিগগিরই কাজের সন্ধানে নেমে পড়তে হবে তাকে।
প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপের সময় বাড়ির উঠোনে খেলছিলো তার ছোটভাই সহ অন্যান্য বাচ্চারা।
সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে মাহিনুর জানান, “আমার বয়সের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়, খেলাধুলা করে। কিন্তু পরিবারের দারিদ্র্যতার কারণে আমাকে কাজে যেতে হবে। আমার খুব ইচ্ছে হয় ওদের মতো খেলতে, দৌড়াতে।” কঠোর বাস্তবতায় হয়তো পুরোপুরি চাপা পড়েনি তার কিশোরী সুলভ মনন।
মাহিনুরের দুই মাস চাকরিতে অনুপস্থিতিকালীন সময়ে তাদের পরিবারকে সাহায্য করে আসছেন চাচাতো ভাই আলম। কিন্তু আলমেরও নিজের পরিবারের ভরণপোষণ করতে হয়।তাই ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও আবারও কাজে যেতে হয় মাহিনুরকে।
মাহিনুরের মা বললেন, “আমি তার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। কিন্তু তারপরও তাকে যেতে দিতে হবে।”
শত ভয়-শঙ্কা নিয়ে আবারও তাই কাজের উদ্দেশ্যে ঢাকার পথে পা বাড়ায় মাহিনুর।
বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে মাহিনুর যখন ভ্যানে চড়ে বসেন, তখন লাল-কমলা ঘোমটার মাঝে তার মায়ের অশ্রুভেজা চোখ।
তবে ভ্যানে বসে একবারও পিছনে ফিরলেন না মাহিনুর। হয়তো নিজের অশ্রুসজল চোখ মায়ের কাছ থেকে লুকোতেই আর পিছু ফিরলেন না তিনি।
No comments