দুই মন্ত্রীর টানাটানি-চাল রপ্তানি নিয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন আজ প্রধানমন্ত্রী by আশরাফুল হক রাজীব ও আবুল কাশেম
সরকারের গুদামগুলো চালে ঠাসা। বাজারে দামও উৎপাদন খরচের চেয়ে কম। আমন মৌসুমে বাজারদর স্বাভাবিক রাখতে দাম নির্ধারণ করলেও সরকার ধান-চাল কিনতে পারছে না গুদামে জায়গা না থাকায়। ফলে বাজারে ধানের দামও বাড়ছে না।
তাই গুদাম খালি করার পাশাপাশি ধানের দাম টেনে তুলতে চাল রপ্তানির পক্ষে খাদ্য মন্ত্রণালয়। তবে ভবিষ্যতে খাদ্যঘাটতি হতেও পারে- এমন আশঙ্কায় চাল রপ্তানির বিপক্ষে জোরালো অবস্থান কৃষি মন্ত্রণালয়ের। দুই মন্ত্রণালয়ের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে গত দিনগুলোতে কয়েকটি বৈঠকেও একমতে পৌঁছাতে পারেনি সরকার। অগত্যা এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছেড়ে দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। আজ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বৈঠকে চাল রপ্তানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ বৈঠকে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সদস্যরা উপস্থিত থাকবেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত বৈঠকে কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নেওয়ায় চাল রপ্তানির বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করে। বিশেষ করে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এখনই চাল রপ্তানির পক্ষে নন। ভবিষ্যৎ শঙ্কার কথা ভেবে তিনি রপ্তানির বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। কিন্তু খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক চাল রপ্তানির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বলে জানা গেছে। মূলত চাল মজুদ করার জায়গার অভাব আর কৃষকদের উৎপাদনে ধরে রাখার যুক্তি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। বিষয়টি নিয়ে দুই মন্ত্রী প্রকাশ্যে কিছু না বললেও খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির অন্য সদস্যরা ভাগ হয়ে দুই দিকে অবস্থান নিয়েছেন। উল্লেখ্য, খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি (এফপিএমসি) খাদ্য সংশ্লিষ্ট সর্বোচ্চ ফোরাম। এ দুই মন্ত্রী ছাড়াও অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী এ ফোরামের সদস্য। মন্ত্রিপরিষদসচিবসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সচিবরাও এর সদস্য। গত মাসে অনুষ্ঠিত এফপিএমসির বৈঠকেও বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল। কিন্তু কোনো সমাধানে পৌঁছা সম্ভব হয়নি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বছরে দুই কোটি ৬৭ লাখ টন চালের চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদা মেটানোর পরও উদ্বৃত্ত রয়েছে ২৩ লাখ টন। আমন ফসল থেকে আরো তিন লাখ টন চাল সংগ্রহ করার কথা। এই বিপুলপরিমাণ চাল মজুদ থাকলে গুদামে পুরাতন চালের পরিমাণ বেড়ে আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সরকার ধান-চাল সংগ্রহ জোরদার করলেও বর্তমান বাজারদর কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের চেয়ে নিচে রয়েছে। বর্তমানে আমন ধানের মণপ্রতি বাজার মূল্য ৫৪০-৫৫০ টাকা। অথচ প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ ৬২০ টাকা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আশঙ্কা, বাজারে ধানের দাম বাড়ানো সম্ভব না হলে ভবিষ্যতে উৎপাদনের ধারা ব্যাহত হবে। অর্থাৎ, কৃষক ধান উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এ অবস্থায় কিছু চাল রপ্তানি করা হলে বাজারে ধানের দাম বাড়বে। এতে কৃষক লাভবান হয়ে উৎপাদনে আগ্রহ পাবে। অন্যদিকে দেশও প্রথমবারের মতো চাল রপ্তানিকারক হিসেবে সুনাম অর্জন করবে।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি মোটা চালের চাহিদা কম। সুগন্ধী চালের চাহিদা রয়েছে। আমরা সুগন্ধী চালের রপ্তানির অনুমতি দিয়েছি। মোটা চাল রপ্তানি করার আগে অনেক কিছু ভাবতে হবে। কারণ এক বছর উৎপাদন না হলে আমাদের দেশে কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেটা সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, উৎপাদন খরচের কথাটি বারবার বলা হচ্ছে। কৃষকের উৎপাদন খরচ না উঠলে তারা ধান চাষ করত না। কৃষক প্রতি মণ খড় বিক্রি করে দেড় হাজার টাকা পায়। তুষের অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে তাদের লাভ হয়। রপ্তানির সিদ্ধান্ত সব সময়ই শুভ ফল বয়ে আনে না। ১৯৯৫ সালে ১৮ জন কৃষক মারা গিয়েছিলেন সার চাওয়ার অপরাধে। ওই সার সংকটের নেপথ্যে ছিল সার রপ্তানি। কিছু সার রপ্তানির অনুমতি দিয়ে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, তখনকার সরকার তা থেকে আর বের হয়ে আসতে পারেনি। কাজেই আমাদের ভেবে-চিন্তেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।'
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিন বছর ধরে দেশে ধানের বাম্পার ফলন হচ্ছে। সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি এ বাম্পার ফলনে সহায়তা করলেও এখনো কৃষক ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। এমনকি ধান-চাল বিক্রি করে কৃষক উৎপাদন খরচই তুলতে পারছে না। ধানের বাম্পার ফলনের বিষয়টি ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির গত মাসের বৈঠকেও বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এ ছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষও এ নিয়ে সোচ্চার। একইভাবে খাদ্য বিশেষজ্ঞরাও বিষয়টি গুরুত্বসহ ভাবতে সরকারকে অনুরোধ করেছেন। সরকারি হিসেবে বর্তমানে আমন ধানের মণপ্রতি বাজার মূল্য ৫৪০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা। অথচ মণপ্রতি উৎপাদন খরচ ৬২০ টাকা। প্রতি মণে কৃষককে ৭০ থেকে ৮০ টাকা লোকসান দিতে হয়। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে ভবিষ্যতে খাদ্য উৎপাদনের বর্তমান ধারা ব্যহত হবে বলে সরকারি প্রতিবেদনেই সতর্ক করা হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আমন ধানের বাজার দর সর্বনিম্ন ৫৪০ টাকা বলা হলেও বাস্তবতা আরো কঠিন। দেশের কোথাও কোথাও ৪৫০ টাকা দরে আমন ধান বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) জানিয়েছে, দৈনিক জনপ্রতি খাদ্যশস্যের চাহিদা ৫০৯ গ্রাম। এর মধ্যে চাল ৪৬৩ গ্রাম এবং গম ৪৬ গ্রাম। এ ক্ষেত্রে দৈনিক জনপ্রতি ৪৬৩ গ্রাম চালের চাহিদা হিসেবে দেশের মোট বার্ষিক চাহিদার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় দুই কোটি ৬৭ লাখ টন। এ হিসাবে বর্তমানে ২৩ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে। বর্তমানে চাল উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়লেও গমের উৎপাদন সেভাবে বাড়েনি। গমের উৎপাদন বার্ষিক ৯ লাখ ৯০ হাজার টন। কিন্তু চাহিদা প্রায় ৩৫ লাখ টন। ফলে দেশে প্রায় ২৫ লাখ টন গমের ঘাটতি রয়েছে। আমদানি করে এসব গমের ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব না হলে দেশে চালের দাম বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে বড় উপায় হচ্ছে সরকারের চ্যানেলগুলো ব্যবহার করা। সরকার কাবিখা, টিআর, ভিজিএফ, জিআর এসব চ্যানেলে খাদ্য সরবরাহ করে। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে রেশন, ফেয়ারপ্রাইস কার্ড, খোলা বাজারে চাল বিক্রি- এসব চ্যানেলেও চাল বিতরণ করা হয়। ফেয়ারপ্রাইস কার্ড, খোলাবাজারে চাল বিক্রি এসব চ্যানেল অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। কারণ এসব কর্মসূচিতে যে দরে চাল দেওয়া হয় বাজার দর অনেক ক্ষেত্রে তার চাইতেও কম। বর্তমানে মোটা চালের বাজার দর প্রতি কেজি ২২ থেকে ২৪ টাকা। অথচ সরকারের ওএমএস এবং সুলভ মূল্যে চাল বিক্রির কর্মসূচিতে চালের বাজার দর ২৪ টাকা। এসব চালের চাহিদা কম থাকায় সরকারের গুদাম খালি হচ্ছে না। ফলে সরকারি বিতরণ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি খাদ্যশস্য সংরক্ষণের ঝুঁকি বাড়ছে। তাই রপ্তানি সম্ভব না হলে এসব চ্যানেলের সরবরাহ বাড়াতে হবে। এই অবস্থায় খাদ্য অধিদপ্তর ওএমএস, ফেয়ারপ্রাইস কার্ডের চালের দাম কমানোর প্রস্তাব দেবে প্রধানমন্ত্রীকে। পাশাপাশি পোশাক শ্রমিকদের কম দামে চাল দেওয়ার প্রস্তাবটিও নতুন করে তোলা হবে।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ও কৃষিবিদ মাহবুব হোসেন বলেন, খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক চাল রপ্তানির পক্ষে। চাল রপ্তানির বিষয়ে ইতিমধ্যে কয়েকটি বৈঠকও হয়েছে। তবে ভবিষ্যতের শঙ্কায় কিছু মন্ত্রী এতে আপত্তি জানাচ্ছেন। বাস্তবতা হলো- ধান উৎপাদনে কৃষকের আগ্রহ ধরে রাখতে কিছুটা চাল রপ্তানি করা প্রয়োজন। এতে দেশেরও ভালো হবে, কৃষকেরও ভালো হবে।
মাহবুব হোসেন বলেন, স্থানীয় বাজারে ধানের দাম বাড়ানোর জন্যই চাল রপ্তানি শুরু করা প্রয়োজন। এখন সরকারের গুদামগুলো চালে ভরা। ব্যবসায়ী ও মিলগুলোতেও বিপুলপরিমাণ চাল মজুদ রয়েছে। বড় ও মাঝারি কৃষকরা বেশি দাম পাওয়ার আশায় ধান মজুদ রেখেছে। ১৫-১৬ মাস ধরে ধানের দাম খুবই কম। কিছুটা চাল রপ্তানি করলে ধানের দাম বাড়বে। এতে কৃষকরা আগামী বোরো মৌসুমে উৎপাদনে আগ্রহী হবে।
নিজেদের করা একটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরে মাহবুব হোসেন বলেন, ন্যায্য মূল্য না পাওয়া ও চাষাবাদের খরচ বাড়ার কারণে এ বছর গতবারের তুলনায় বোরো আবাদ ৭ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাবে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের তিন ভাগের দুই ভাগ বলেছে, উৎপাদিত ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় বোরো মৌসুমে তারা আবাদ কমিয়ে দেবে। আর চার ভাগের এক ভাগ উত্তরদাতা বলেছে, কৃষি উপকরণের দাম বাড়ায় তারা ধান চাষ কমিয়ে দেবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত বৈঠকে কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নেওয়ায় চাল রপ্তানির বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করে। বিশেষ করে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এখনই চাল রপ্তানির পক্ষে নন। ভবিষ্যৎ শঙ্কার কথা ভেবে তিনি রপ্তানির বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। কিন্তু খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক চাল রপ্তানির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বলে জানা গেছে। মূলত চাল মজুদ করার জায়গার অভাব আর কৃষকদের উৎপাদনে ধরে রাখার যুক্তি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। বিষয়টি নিয়ে দুই মন্ত্রী প্রকাশ্যে কিছু না বললেও খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির অন্য সদস্যরা ভাগ হয়ে দুই দিকে অবস্থান নিয়েছেন। উল্লেখ্য, খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি (এফপিএমসি) খাদ্য সংশ্লিষ্ট সর্বোচ্চ ফোরাম। এ দুই মন্ত্রী ছাড়াও অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী এ ফোরামের সদস্য। মন্ত্রিপরিষদসচিবসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সচিবরাও এর সদস্য। গত মাসে অনুষ্ঠিত এফপিএমসির বৈঠকেও বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল। কিন্তু কোনো সমাধানে পৌঁছা সম্ভব হয়নি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বছরে দুই কোটি ৬৭ লাখ টন চালের চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদা মেটানোর পরও উদ্বৃত্ত রয়েছে ২৩ লাখ টন। আমন ফসল থেকে আরো তিন লাখ টন চাল সংগ্রহ করার কথা। এই বিপুলপরিমাণ চাল মজুদ থাকলে গুদামে পুরাতন চালের পরিমাণ বেড়ে আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সরকার ধান-চাল সংগ্রহ জোরদার করলেও বর্তমান বাজারদর কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের চেয়ে নিচে রয়েছে। বর্তমানে আমন ধানের মণপ্রতি বাজার মূল্য ৫৪০-৫৫০ টাকা। অথচ প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ ৬২০ টাকা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আশঙ্কা, বাজারে ধানের দাম বাড়ানো সম্ভব না হলে ভবিষ্যতে উৎপাদনের ধারা ব্যাহত হবে। অর্থাৎ, কৃষক ধান উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এ অবস্থায় কিছু চাল রপ্তানি করা হলে বাজারে ধানের দাম বাড়বে। এতে কৃষক লাভবান হয়ে উৎপাদনে আগ্রহ পাবে। অন্যদিকে দেশও প্রথমবারের মতো চাল রপ্তানিকারক হিসেবে সুনাম অর্জন করবে।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি মোটা চালের চাহিদা কম। সুগন্ধী চালের চাহিদা রয়েছে। আমরা সুগন্ধী চালের রপ্তানির অনুমতি দিয়েছি। মোটা চাল রপ্তানি করার আগে অনেক কিছু ভাবতে হবে। কারণ এক বছর উৎপাদন না হলে আমাদের দেশে কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেটা সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, উৎপাদন খরচের কথাটি বারবার বলা হচ্ছে। কৃষকের উৎপাদন খরচ না উঠলে তারা ধান চাষ করত না। কৃষক প্রতি মণ খড় বিক্রি করে দেড় হাজার টাকা পায়। তুষের অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে তাদের লাভ হয়। রপ্তানির সিদ্ধান্ত সব সময়ই শুভ ফল বয়ে আনে না। ১৯৯৫ সালে ১৮ জন কৃষক মারা গিয়েছিলেন সার চাওয়ার অপরাধে। ওই সার সংকটের নেপথ্যে ছিল সার রপ্তানি। কিছু সার রপ্তানির অনুমতি দিয়ে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, তখনকার সরকার তা থেকে আর বের হয়ে আসতে পারেনি। কাজেই আমাদের ভেবে-চিন্তেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।'
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিন বছর ধরে দেশে ধানের বাম্পার ফলন হচ্ছে। সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি এ বাম্পার ফলনে সহায়তা করলেও এখনো কৃষক ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। এমনকি ধান-চাল বিক্রি করে কৃষক উৎপাদন খরচই তুলতে পারছে না। ধানের বাম্পার ফলনের বিষয়টি ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির গত মাসের বৈঠকেও বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এ ছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষও এ নিয়ে সোচ্চার। একইভাবে খাদ্য বিশেষজ্ঞরাও বিষয়টি গুরুত্বসহ ভাবতে সরকারকে অনুরোধ করেছেন। সরকারি হিসেবে বর্তমানে আমন ধানের মণপ্রতি বাজার মূল্য ৫৪০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা। অথচ মণপ্রতি উৎপাদন খরচ ৬২০ টাকা। প্রতি মণে কৃষককে ৭০ থেকে ৮০ টাকা লোকসান দিতে হয়। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে ভবিষ্যতে খাদ্য উৎপাদনের বর্তমান ধারা ব্যহত হবে বলে সরকারি প্রতিবেদনেই সতর্ক করা হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আমন ধানের বাজার দর সর্বনিম্ন ৫৪০ টাকা বলা হলেও বাস্তবতা আরো কঠিন। দেশের কোথাও কোথাও ৪৫০ টাকা দরে আমন ধান বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) জানিয়েছে, দৈনিক জনপ্রতি খাদ্যশস্যের চাহিদা ৫০৯ গ্রাম। এর মধ্যে চাল ৪৬৩ গ্রাম এবং গম ৪৬ গ্রাম। এ ক্ষেত্রে দৈনিক জনপ্রতি ৪৬৩ গ্রাম চালের চাহিদা হিসেবে দেশের মোট বার্ষিক চাহিদার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় দুই কোটি ৬৭ লাখ টন। এ হিসাবে বর্তমানে ২৩ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে। বর্তমানে চাল উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়লেও গমের উৎপাদন সেভাবে বাড়েনি। গমের উৎপাদন বার্ষিক ৯ লাখ ৯০ হাজার টন। কিন্তু চাহিদা প্রায় ৩৫ লাখ টন। ফলে দেশে প্রায় ২৫ লাখ টন গমের ঘাটতি রয়েছে। আমদানি করে এসব গমের ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব না হলে দেশে চালের দাম বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে বড় উপায় হচ্ছে সরকারের চ্যানেলগুলো ব্যবহার করা। সরকার কাবিখা, টিআর, ভিজিএফ, জিআর এসব চ্যানেলে খাদ্য সরবরাহ করে। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে রেশন, ফেয়ারপ্রাইস কার্ড, খোলা বাজারে চাল বিক্রি- এসব চ্যানেলেও চাল বিতরণ করা হয়। ফেয়ারপ্রাইস কার্ড, খোলাবাজারে চাল বিক্রি এসব চ্যানেল অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। কারণ এসব কর্মসূচিতে যে দরে চাল দেওয়া হয় বাজার দর অনেক ক্ষেত্রে তার চাইতেও কম। বর্তমানে মোটা চালের বাজার দর প্রতি কেজি ২২ থেকে ২৪ টাকা। অথচ সরকারের ওএমএস এবং সুলভ মূল্যে চাল বিক্রির কর্মসূচিতে চালের বাজার দর ২৪ টাকা। এসব চালের চাহিদা কম থাকায় সরকারের গুদাম খালি হচ্ছে না। ফলে সরকারি বিতরণ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি খাদ্যশস্য সংরক্ষণের ঝুঁকি বাড়ছে। তাই রপ্তানি সম্ভব না হলে এসব চ্যানেলের সরবরাহ বাড়াতে হবে। এই অবস্থায় খাদ্য অধিদপ্তর ওএমএস, ফেয়ারপ্রাইস কার্ডের চালের দাম কমানোর প্রস্তাব দেবে প্রধানমন্ত্রীকে। পাশাপাশি পোশাক শ্রমিকদের কম দামে চাল দেওয়ার প্রস্তাবটিও নতুন করে তোলা হবে।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ও কৃষিবিদ মাহবুব হোসেন বলেন, খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক চাল রপ্তানির পক্ষে। চাল রপ্তানির বিষয়ে ইতিমধ্যে কয়েকটি বৈঠকও হয়েছে। তবে ভবিষ্যতের শঙ্কায় কিছু মন্ত্রী এতে আপত্তি জানাচ্ছেন। বাস্তবতা হলো- ধান উৎপাদনে কৃষকের আগ্রহ ধরে রাখতে কিছুটা চাল রপ্তানি করা প্রয়োজন। এতে দেশেরও ভালো হবে, কৃষকেরও ভালো হবে।
মাহবুব হোসেন বলেন, স্থানীয় বাজারে ধানের দাম বাড়ানোর জন্যই চাল রপ্তানি শুরু করা প্রয়োজন। এখন সরকারের গুদামগুলো চালে ভরা। ব্যবসায়ী ও মিলগুলোতেও বিপুলপরিমাণ চাল মজুদ রয়েছে। বড় ও মাঝারি কৃষকরা বেশি দাম পাওয়ার আশায় ধান মজুদ রেখেছে। ১৫-১৬ মাস ধরে ধানের দাম খুবই কম। কিছুটা চাল রপ্তানি করলে ধানের দাম বাড়বে। এতে কৃষকরা আগামী বোরো মৌসুমে উৎপাদনে আগ্রহী হবে।
নিজেদের করা একটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরে মাহবুব হোসেন বলেন, ন্যায্য মূল্য না পাওয়া ও চাষাবাদের খরচ বাড়ার কারণে এ বছর গতবারের তুলনায় বোরো আবাদ ৭ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাবে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের তিন ভাগের দুই ভাগ বলেছে, উৎপাদিত ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় বোরো মৌসুমে তারা আবাদ কমিয়ে দেবে। আর চার ভাগের এক ভাগ উত্তরদাতা বলেছে, কৃষি উপকরণের দাম বাড়ায় তারা ধান চাষ কমিয়ে দেবে।
No comments