বোরকা তাদের অস্ত্র by লায়েকুজ্জামান
ওরা মায়াবিনী। মায়ার জাদুতে কাবু করে পথচারীদের। বোরকা তাদের অস্ত্র। রাজধানীর ৮ স্পটে ফাঁদ পেতে আছে এমন ১৩০ মায়াবিনী নারী। বেপরোয়া এ বোরকা বাহিনীর মায়ার জাদুতে আটকা পড়ছেন অনেকেই। হারাচ্ছেন সর্বস্ব। বোরকার আড়ালে এরা ভয়ঙ্কর ছিনতাইকারী।
ইশারায় পথচারীদের কাবু করে ছিনতাইয়ের পথ খোঁজে এরা। এদের খপ্পরে পড়ে প্রায় প্রতিদিনই টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন খোয়াতে হচ্ছে অনেককে। রাজধানীর ওই ৮টি স্পটে অনুসন্ধান করে পাওয়া গেছে বেশ কয়েকটি ঘটনা, সর্বস্ব খোয়ানো কয়েকজনকে। সরজমিন অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে ফাঁদ পাতা ওইসব নারীর গডফাদারদের নাম। একই স্পটে দিনের পর দিন মানুষের টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়ার পর ও নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারা, নীরব দর্শক হয়ে থাকছে পুলিশ। অভিযোগ আছে পুলিশকে নিয়মিত বকশিশ দিয়েই কাজ করছে তারা।
১লা নভেম্বর বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যা রাতে পৌনে ৯টা। স্থান মিরপুর মাজার রোড়। স্থানীয় কয়েক যুবকের কাছে এসে হাউমাউ করে কাঁদছে মাঝবয়সী এক লোক। এলাকায় জটলা বেঁধে গেছে। ওইসব স্থানীয় যুবক চুপিসারে কি যেন বলে সরিয়ে নিয়ে গেল লোকটিকে। ঘণ্টাখানেক পরে পাওয়া গেল তাকে। তার কাছ থেকে জানা গেল, তিনি পেশায় একজন সবজি ব্যবসায়ী। বাড়ি ঝিনাইদহে। সেখান থেকে সবজি এনে মিরপুরের আড়তগুলোতে সরবরাহ করেন। মাজার রোড দিয়ে যাওয়ার সময় এক নারী ইশারা করে তাকে। ইশারায় কাবু হয়ে মাজার রোডের আধো আলো আধো আঁধার এলাকায় গিয়ে দেনদরবার ঠিক করে মহিলার সঙ্গে। মহিলা দাবি করে ১ হাজার টাকা, সে বলে ৫০০ টাকা। তাতেই রাজি হয় মহিলা। আলোতে এসে রিকশায় ওঠে দু’জনে, ওই সময় রাস্তা থেকে জোর করে রিকশায় ওঠে আরেক নারী। লোকটি আপত্তি জানালে সে বলে, ঠিক আছে ও আমার বোন, চলুক আমাদের সঙ্গে। রিকশাকে কিছু বলতে হয় না, আপনগতিতে রিকশাচালক চলতে থাকে মাজার রোড দিয়ে উত্তর দিকে। অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি জায়গায় যাওয়ামাত্র মহিলা লোকটির শার্টের কলার ধরে বলে, যা আছে বের কর! না হলে চিৎকার করে লোক যোগাড় করে তোকে নারী নির্যাতন মামলায় ফাঁসিয়ে দেবো। ওই কথাগুলো বলতে বলতে লোকটির পকেট হাতিয়ে ২৬ হাজার টাকাসহ মোবাইল সেটটি নিয়ে তাকে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় দু’নারী। মাজার রোড এলাকা ঘুরে জানা গেল এমন ধরনের ছিনতাই এখানকার নিত্যদিনের ঘটনা। স্থানীয়দের হিসাব মতে মিরপুর মাজার রোড এলাকায় কম করে হলেও ২০ জন নারী ইশারার ফাঁদ পেতে প্রতিদিন ছিনতাই করে এখানে। ওইসব নারীর আছে বেশ কয়েকজন স্থানীয় মাস্তান সহযোগী, কোন পুরুষ ঝামেলা করে এগিয়ে আসে তারা।
নরসিংদীর রায়পুরা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন শাহান নামের এক যুবক। রায়পুরায় ছোটখাটো ব্যবসা করে। ডেমরা এলাকায় এক আত্মীয়র বাড়িতে রাতে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেদিন আর নরসিংদী যায়নি। এ ঘটনা ২রা নভেম্বরের। রাত সাড়ে ন’টার দিকে ডেমরা গলাকাট ব্রিজের কাছে এলে এক বোরকা পরা মহিলা তাকে হাতে ইশারা করে। ওই যুবক ইশারা বুঝতে না পারায় মহিলাটি ধীরে ধীরে তার কাছে এসে প্রস্তাব দেয়। যুবকটি রাজি হলে এগিয়ে আসে আরও তিন মহিলা। তারা হাঁটতে হাঁটতে যায় প্রভাতী রিরোলিং মিলের পেছনে। সেখানে গিয়ে হাতিয়ে নেয় যুবকটির ৭ হাজার টাকা ও একটি মোবাইল ফোন সেট। গলাকাটা পুল এলাকার স্থানীয় দোকানদারা পর্যন্ত জানে এখানকার নারীদের মানুষ ধরার ফাঁদের কাহিনী। স্থানীয় এক দোকানদার ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে এগুলো চললেও কোন প্রতিকার হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে পুলিশ আসে, আবার ওদের সঙ্গে কথা বলে চলে যায়। স্থানীয় সূত্র জানায়, এখানে ফাঁদ পাতার কাজ করে ১৫ জন মহিলা।
যাত্রাবাড়ীর ৪ পয়েন্টে দিনে-রাতে জটলা থাকে ওইসব নারীর। সরজমিন অনুসন্ধানে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, যাত্রাবাড়ীর বিসমিল্লাহ হোটেলের সামনে আছে ১৫ জন। বিবির বাগিচা এলাকায় আছে ২০ জন। মৎস্য আড়তের সামনে আছে ১০ জন আর থানার সামনে থাকে ১০ জন। বিভিন্ন সময়ে ওইসব নারীর ফাঁদে পড়া ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে- এদের বেশির ভাগই থাকে বোরকা পরা, পুরুষদের পছন্দ করে এরা চোখে চোখে বা হাতে ইশারা করে, কেউ ইশারা না বুঝলে অনেক সময় কাছে এসে সেক্সের কথা বলে, তাদের সঙ্গে যাওয়ার কথা বলে। কথার মাঝে দরদাম ঠিক করে। দরদাম ঠিক হলে ওইসব নারী বলে- তাদের বাসা আছে সেখানে যেতে, কোনভাবেই তারা পুরুষটির সঙ্গে যেতে রাজি হয় না। দরদাম ঠিক হওয়ার পর রিকশায় যাত্রা করে খদ্দের নিয়ে। কিছু দূর যাওয়ার পর খদ্দেরের ওপর চড়াও হয়। বলতে থাকে- পকেটের সবকিছু দিয়ে দিতে, না হলে চিৎকার করে লোক জড়ো করার হুমকি দেয়। অনেক সময় তাতেও কাজ না হলে মহিলা ফোন করে জড়ো করে তার পুরুষ সহযোগী মাস্তানদের। আবার কখনও ডেকে আনে পুলিশ। গত সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে ফার্মগেট ওভার ব্রিজ পার হওয়ার সময় এক নারীর ফাঁদে পড়েন এক সরকারি কর্মকর্তা, ইন্দিরা রোডের সড়কে গিয়ে ওই সরকারি কর্মকর্তার টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়ার সময় মহিলাকে ঘুষি মেরে পালাতে চেষ্টা করেন তিনি। ওই সরকারি কর্মকর্তা প্রতিবেদককে বলেন, তিনি রিকশা থেকে দৌড় দিতে গেলে তাদের রিকশাকে অনুসরণ করা দুই রিকশা থেকে পাঁচজন নেমে মারধর শুরু করে তাকে। মাথায় আঘাত লেগে অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। পরে অচেনা কিছু লোক তাকে নিয়ে রেখে আসে ঢাকা মেডিকেল কলেজে। তিন দিন পর বাসায় ফেরেন তিনি।
অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী বিসমিল্লাহ হোটেলের সামনে থেকে ইশারায় খদ্দের ধরে এখানকার ফাঁদপাতা গ্রুপ নিয়ে যায় একটু এগিয়ে ঢাকা টিম্বারের কাছে। তারপর হাতিয়ে নেয় তাদের সর্বস্ব। স্থানীয় লোকেরা জানিয়েছে, এখানে ওইসব ফাঁদ পাতা নারীদের পুরুষ সহযোগী রাসেল নামের এক মাস্তান যুবক।
সূত্র মতে, বিবির বাগিচা এলাকায় আছে প্রায় ২০ জনের একটি গ্রুপ। সকাল থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত তাদের দেখা যায় ওই এলাকায়। ওই গ্রুপের নেত্রী নাজমা নামের এক মহিলা। তার সঙ্গে গভীর সখ্য থানা পুলিশ ও স্থানীয় মাস্তানদের সঙ্গে। গত কয়েক বছর ধরে সে ওই ফাঁদ পাতার ব্যবসা করে এলেও কখনও পুলিশ তাকে বাধা দেয়নি। যাত্রাবাড়ী মৎস্য আড়ত ও থানার সামনে যেসব মহিলা ফাঁদ পাতার ধান্ধায় দাঁড়িয়ে থাকে তাদের ছিনতাইয়ের জায়গা হচ্ছে কাজলা ব্রিজ। সূত্র মতে, ওই দুই স্পট থেকে খদ্দের ধরে এরা নিয়ে যায় মধ্য কাজলা ও দক্ষিণ কাজলার মাঝামাঝি নিরিবিলি জায়গায়। এখানকার ফাঁদ পাতা গ্রুপ বেশির ভাগ খাদ্দের ধরে রাতের বেলায়। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এদের সহযোগিতা করে ওই এলাকার টহল পুলিশ। সূত্র মতে, ফাঁদ পেতে মহিলার যা হাতিয়ে নেয়ার সেটা তো নেয়ই- উপরন্তু টহল পুলিশের খপ্পরে পড়ে বাড়ি থেকে টাকা এনে পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে হয় নারী ফাঁদে পড়া মানুষদের। বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে জেলে পাঠাবার ভয় দেখিয়ে টাকা নেয় পুলিশ। আবার ওইসব নারীর কাছ থেকেও তাদের হাতিয়ে নেয়া টাকার ভাগ নেয় তারা। শ্যামলী ওভারব্রিজের ওপর দীর্ঘদিন ধরে মুন্নী নামের এক মহিলার নেতৃত্বে ফাঁদ পাতার ব্যবসা চলে আছে। ওভার ব্রিজেরে নিচে একটি হোটেলে প্রায় পুরো দিন বসে থাকে মুন্নী। সেখানে আড্ডা দেয়। মুন্নীর নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্য যুবতীরা খদ্দের ধরে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে ফিরে আসে মুন্নীর কাছে। সেখানে বসেই টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন সেট ভাগবাটোয়ারা হয়।
রাজধানীতে নারী ফাঁদের একটি বড় স্পট ফার্মগেট এলাকা। এখানে তিনটি ওভারব্রিজ। ইন্দিরা রোড পর্যন্ত এলাকাজুড়ে ফাঁদ পাতার কাজ করে ২৫ নারী। তেজগাঁ থানার গেট পর্যন্ত ওদের পদচারণা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এখানকার নারী চক্রটি খদ্দের ধরে কখনও তেজগাঁ কলেজের দিকে, কখনও ইন্দিরা রোডের দিকের নিরিবিলি সড়কগুলোতে নিয়ে খদ্দেরদের টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। সূত্র মতে, ওইসব নারীকে আশ্রয় দেয় ফার্মগেট এলাকার একজন হোটেল মালিক। তাদের আশ্রয় দেয়া এবং তাদের কাছ থেকে ভাগ দেয়ার অভিযোগ আছে পুলিশের বিরুদ্ধেও। তবে তেজগাঁ থানার ওসি পুরোপুরিভাবে বিষয়টি অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি বরং প্রায় নিয়মিতভাবে ফার্মগেট এলাকা থেকে ওদের তাড়ানোর ব্যবস্থা করেন, তবুও মাঝে মধ্যে এরা চলে আসে।
ইশারায় ফাঁদ পেতে মানুষের টাকা-পয়সা কেড়ে নেয়ার বিষয় সম্পর্কে পুলিশের ওয়ারী জোনের ডিসি গাজী মোজাম্মেল হক মানবজমিনকে বলেন, ওই ধরনের ফাঁদ পাতার বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত, এর আগে পুলিশের ক্রাইম কনফারেন্স এ আমি বিষয়টি উত্থাপন করে তা বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে বলি। পুলিশ ওইসব নারীকে সহযোগিতা করে এমন তথ্য ঠিক নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ঢাকা একটি বড় শহর এখানে কেউ কাউকে চেনে না, ওই ধরনের ফাঁদে পড়লে কেবলমাত্র টাকা-পয়সা খোয়া যাওয়াই নয় জীবনহানির ঘটনাও ঘটতে পারে, সে কারণে আমার অনুরোধ নাগরিকরা যেন ওই ধরনের ইশারায় কাবু না হয়, প্রলুব্ধ না হয়।
No comments