গৃহবধূকে পুড়িয়ে হত্যা-মামলার সব আসামিরই একে একে জামিন by আশরাফ-উল-আলম

গাজীপুরের গৃহবধূ জান্নাতুল ফেরদৌস বৃষ্টিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলার প্রধান আসামি হানিফ সরকার আদালত থেকে জামিন নিয়ে পালিয়েছে। হানিফ বৃষ্টির স্বামী। জামিন নেওয়ার সময় আসামিপক্ষ হাইকোর্টের তথ্য গোপন করে ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।


গাজীপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক ফাতেমা নজীব গত ১৫ জুলাই আসামি হানিফ সরকারকে জামিন দেন।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর থানার গজারিয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হানিফ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং তার স্নাতকোত্তর পরীক্ষা ছিল ১৬ জুলাই থেকে। আসামি পরীক্ষার্থী মর্মে আদালতে প্রবেশপত্র দাখিল করে। এ কারণে মানবিক কারণে তাকে ১৫ জুলাই জামিন দেওয়া হয়। আসামি হানিফ পলাতক থেকে এখন বৃষ্টির পরিবারকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মামলার নথি অনুসারে, বৃষ্টির শাশুড়ি আয়শা খাতুন ও ভাসুরের স্ত্রী খাদিজা বেগম ২০১১ সালের ২৪ আগস্ট হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। আয়শা খাতুনই বৃষ্টির শরীরে কেরোসিন ঢেলে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বৃষ্টির দেবর মজিবর রহমান গাজীপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর এবং আবদুল কাদির নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল থেকে জামিন পান। বৃষ্টির ননদের জামাই নজরুল ইসলামকে জেলা ও দায়রা জজ আদালত জামিন দেন একই বছর ১৮ সেপ্টেম্বর। তাঁদের সবার বিরুদ্ধে হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।
বৃষ্টির বাবা বাবুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, হানিফ মাস্টার্সের পরীক্ষার্থী ছিল না। ভুয়া প্রবেশপত্র তৈরি করে সে আদালত থেকে জামিন নিয়েছে। পরে অবশ্য ট্রাইব্যুনাল গত ২৫ জুলাই আসামির জামিন বাতিল ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। কিন্তু এর মধ্যে সে পালিয়ে যায়। জানা গেছে, হানিফ সরকার তার জামিন বহাল রাখার জন্য হাইকোর্টে আবার আবেদন করেছে। আবেদনটি শুনানির জন্য আগামী মঙ্গলবার হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে তারিখ ধার্য করা হয়েছে।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ২০১১ সালের ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ৮টায় গৃহবধূ বৃষ্টির শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় তাঁর স্বামী, শাশুড়িসহ অন্যরা। ওই আগুনে বৃষ্টির মুখমণ্ডলসহ সারা শরীর পুড়ে ঝলসে যায়। চিৎকার শোনে আশপাশের লোকজন এসে তাঁকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়। ঘটনার ২০ দিন পর গত বছর ২৫ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃষ্টি মারা যান।
ঘটনার পর বৃষ্টির চাচা জয়দেবপুর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩)-এর ৪(১) ধারায় (যৌতুকের দাবিতে মারাত্মক জখম) স্বামী, শাশুড়িসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। জয়দেবপুর থানার পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) সৈয়দ আজহারুল ইসলাম ঘটনাটি তদন্ত করেন। গত বছরের নভেম্বর ছয় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় একই আইনের ১১(ক) ধারায় (যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন করে হত্যা) অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করা হয়। বর্তমানে মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন।
মৃত্যুকালীন জবানবন্দি : নিহত বৃষ্টি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বছর ১১ আগস্ট একজন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মৃত্যুকালীন জবানবন্দি দেন। তাঁর জবানবন্দি থেকে যানা যায়, বিয়ের পর থেকে স্বামীর পরকীয়া নিয়ে তাঁর মনোমালিন্য শুরু হয়। এতে বাধা দেওয়ায় প্রায়ই বৃষ্টিকে নির্যাতন করা হতো। বৃষ্টিকে বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্যও চাপ দিত স্বামী। এতে রাজি না হওয়ায় ঘটনার দিন সকালে বৃষ্টির শরীরে শাশুড়ি আয়শা খাতুন কেরোসিন ঢেলে দেন। স্বামী ম্যাচলাইট দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ কাজে দেবর ও অন্যরা সহায়তা করে। বৃষ্টি নির্যাতনের ঘটনা এবং তাঁকে হত্যা করা হতে পারে- জনিয়ে জয়দেবপুর থানায় আগেই সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করা হয়।
সাক্ষ্য আইনের বিধানমতে আহত ব্যক্তির মৃত্যুকালীন জবানবন্দি বিশ্বাসযোগ্য।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে জানান, এলাকার সবাই জানে বৃষ্টির শরীরে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, 'ঘটনার সময় আমি ছিলাম না। কিন্তু যারা ছিল, তাঁদের সবাই বলেছে বৃষ্টিকে হত্যা করা হয়েছে। এমন ঘটনায় সব আসামির জামিন অবশ্যই আশ্চর্যজনক ঘটনা।'
প্রধান আসামির জামিন যেভাবে : মামলার প্রধান আসামি বৃষ্টির স্বামী হানিফ সরকারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে গত বছর ৭ অক্টোবর। রিমান্ডে নেওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে আসামি স্বীকার করে, কেরোসিন ঢেলে বৃষ্টির শরীরে আগুন দেওয়া হয়। এর আগে বৃষ্টিকে মারধরও করা হয়। গ্রেপ্তারের পর গাজীপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে একাধিকবার হানিফের জামিনের আবেদন করা হয়। কিন্তু জামিন নামঞ্জুর করা হয়। এরপর তার জামিনের জন্য হাইকোর্টে আপিল করা হয় (ফৌজদারি আপিল নম্বর ৮০৭০/১২)। আপিল শুনানির পর হাইকোর্ট জামিন দিতে অস্বীকৃতি জানালে আসামিপক্ষ জামিনের আবেদন প্রত্যাহার করে। পরে আবার আপিল কারা হয় (ফৌজদারি আপিল নম্বর-৩৯৮৮/১২)। আপিল প্রাথমিক শুনানি হয় চলতি বছরের ১০ জুলাই। শুনানি শেষে আদালত পক্ষদ্বয়কে নোটিশ দেন। কিন্তু মূল শুনানি হয়নি। এ তথ্য গোপন করে গাজীপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে জামিনের আবেদন করা হয় ১৫ জুলাই। সেখানে আসামি স্নাতকোত্তর পরীক্ষার্থী বলে দাবি করা হয়।
আইনজীবীর বক্তব্য : বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে, হাইকোর্টের তথ্য গোপন করে আসামির জামিন নেওয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি মামলার প্রধান আসামি, যে ব্যক্তি স্ত্রীকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, তাকে কোনো মানবিক কারণেই জামিন দেওয়া ঠিক নয়। তবে বিচারকের জামিন দেওয়ার এখতিয়ার আছে স্বীকার করে তিনি বলেন, আসামি এখন পালিয়ে থাকলে তাঁর অনুপস্থিতিতে বিচার হবে।
বৃষ্টির বাবা বাবুল ইসলাম ও মা জরিনা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যেই অমানবিক ও পৈচাশিক হত্যাকাণ্ডের শিকার আমাদের মেয়ে, সেই মামলার প্রধান আসামির জামিন কোনো মানবিক কারণে হতে পারে না।' তাঁরা আরো বলেন, মামলা তুলে নিতে পলাতক আসামি ও অন্য আসামিরা হুমকি দিচ্ছে। এ বিষয়ে থানাকে অবহিত করা হয়েছে। তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানান।

No comments

Powered by Blogger.