বাংলা নববর্ষ ১৪১৮-নবজাগরণে উদ্ভাসিত হোক
আমাদের জীবনে বাংলা সন বা মাস গণনার গুরুত্ব কী তা নিয়ে একটা সংশয় সচেতন মহলে চালু আছে। বহুকাল যাবৎ শহর-গ্রাম নির্বিশেষে এখানকার নাগরিকরা খ্রিস্টীয় সাল-তারিখেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কাজকর্মে, ব্যবসায়, বাণিজ্যে, আন্তর্জাতিক যোগাযোগে আমাদের প্রধান অবলম্বন খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডার।
পঞ্জিকা জানা গুটিকয় মানুষ বাদ দিলে সহসা কেউ বাংলা মাসের তারিখ বলতে পারেন না, সঠিক তারিখ এমনকি মাসের নাম বলতেও বাংলা দৈনিকের সহায়তা নিতে হয়। এমন যখন পরিস্থিতি, তখন বাংলা নববর্ষ নিয়ে বাংলাদেশে যে বৃহত্তম উৎসব গত এক দশকে রঙে-রূপে-বর্ণে পল্লবিত হয়ে উঠেছে তা অনেকেরই বিশেষ কৌতূহলের বিষয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যে নতুন সামাজিক-সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটেছে তাতে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণীর ঊধর্ে্ব কিছু দিন এমনকি মাসও সকলের উৎসবের উপলক্ষে পরিণত হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের স্মারক ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা যেভাবে স্মৃতি ও উৎসবের শহরে পরিণত হয়, তার তুলনা মেলা ভার। আর পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বইয়ের উৎসব তো মননশীল বাঙালির মনোযোগের কেন্দ্র এখন। ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চের মতো তারিখগুলোও সকলে মিলে পালনের দিনে পরিণত হয়েছে। এ তারিখগুলোর সঙ্গে আমাদের ইতিহাস জড়িত, রক্তস্নাত ইতিহাসের স্মৃতি এসে এ দিনগুলোতে আমাদের চেতনায় হানা দেয়। ফলে সব দিন উৎসবের মেজাজে থাকে না, অনেক সময়ই রক্তাক্ত স্মৃতির বেদনায় বিধুর হয়ে ওঠে। কিন্তু নির্মল উৎসবের কথা যদি ওঠে তবে সর্বাগ্রেই পহেলা বৈশাখের কথাই বলতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আমাদের ঈদ-পূজা ইত্যাদি ধর্মীয় উৎসব আজ সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এ উৎসবগুলো একান্তই গ্রামীণ ও পারিবারিক আবহেই উদযাপিত হয় এখনও। ঈদ-পূজা মানেই সুনসান ফাঁকা শহর, গ্রামের দিকে ফেরার তাড়া। কিন্তু যে উৎসবে শহরগুলো জমজমাট শুধু নয়, জাঁকালো হয়ে ওঠে_ শহরের রাস্তায় ভিড় জমে ওঠে সে উৎসবের নাম বাংলা নববর্ষ। আমাদের একান্ত এ উৎসব একদা গ্রাম থেকে শহরে এসেছিল, গ্রামের অনুকরণেই শহরে চৈত্রসংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখ পালন শুরু হয়েছিল। শহরে এসে তাতে নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। আর সেসব মাত্রা নিয়ে আবারও উৎসব প্রবাহিত হয়েছে গ্রাম-গ্রামান্তরে। সব মিলিয়ে আজ বাংলা নববর্ষ বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। পহেলা বৈশাখের প্রভাতে রমনার বর্ষবরণ, চারুকলার বরণ মিছিল, নানা অনুষ্ঠান-আয়োজন এখন ছড়িয়েছে দেশজুড়ে। শুধু এই আয়োজনই নয়, খাবার-দাবার, পোশাক-আশাকসহ সর্বত্র ছড়িয়েছে নববর্ষের আমেজ। বাজারে এখন শাড়ি-পাঞ্জাবি, ইলিশের বিপুল চাহিদা। ক্রেতাদের ভিড়ে সরগরম বাজার দেখে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন, এ তো ঈদ-শপিংকেও হার মানাতে চলল। খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারে অভ্যস্ত নাগরিক জীবনে বৈশাখের এই নবজাগরণের পেছনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণ নিয়ে নিশ্চয় বিস্তর গবেষণা হবে। কিন্তু বিজ্ঞজনেরা বলেন, প্রকৃতির সঙ্গে বাঙালির আত্মিক সম্পর্কের সূত্র বাংলা সন-তারিখ। গাছের পাতা হলুদ হলে, উত্তুরে হাওয়া বইলে, কি আকাশে মেঘ জমলে বাঙালি প্রথমে বাংলা মাসের কথা মনে করার চেষ্টা করে। এই আত্মিক সম্পর্কই তাকে ফিরিয়ে এনেছে বাংলা বর্ষবরণের কাছে। বাংলার প্রকৃতি ও মানুষ আজ নতুন বছরকে স্বাগত জানাচ্ছে। নতুন বছরে প্রত্যাশা থাকলেও সবকিছুর নবযাত্রা সম্ভব হয় না। কিন্তু নতুন বছর যদি নবযাত্রার প্রত্যাশাটুকু জাগিয়ে যেতে পারে, তা-ইবা কম কিসে? পুরাতন দিনের জরা, ক্ষয়, ক্ষতি পুষিয়ে নবযাত্রার প্রত্যাশা জেগে থাকুক নতুন বছরে এই কামনাই আজ সর্বাগ্রে।
No comments