বিশেষ সাক্ষাৎকার : বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. রফিকুল ইসলাম-বিডিআর বিদ্রোহের বিচার কার্যক্রম সব ধরনের প্রভাবমুক্ত

বিডিআর বিদ্রোহ, সীমান্ত সুরক্ষা, বিজিবি পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াসহ নানা বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন কালের কণ্ঠের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ওমর ফারুক
কালের কণ্ঠ : সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে আপনার ভাবনা কী? রফিকুল ইসলাম : বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের প্রধানতম দায়িত্ব হলো সীমান্ত সুরক্ষা করা। বর্তমানে সীমান্তে উত্তেজনাকর অবস্থা বিরাজ করছে না এবং বিজিবি ও বিএসএফের সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো।


ভারত ও বাংলাদেশ বন্ধুপ্রতিম ও প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্রের বন্ধুত্বের গোড়াপত্তন হয় স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনা থেকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত নীতিমালা অনুযায়ী দেশের সীমান্তে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়, তা নিয়ন্ত্রণ ও ক্রমান্বয়ে একেবারে কমিয়ে আনা; যার মধ্যে আছে অবৈধভাবে সন্ত্রাসী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সীমান্ত অতিক্রম, চোরাচালান, মাদকদ্রব্য পাচার, নারী ও শিশু পাচার ইত্যাদি। সীমান্তের সব এলাকায় একই ধরনের সীমান্ত অপরাধ সংঘটিত হয় না। সেসব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্ত এলাকায় নিয়োজিত বর্ডার গার্ড ইউনিট, কম্পানি, বিওপির (বর্ডার আউট পোস্ট) মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ, টহল ও বিশেষ অপারেশন পরিচালনা করা হয়। এ জন্য প্রতিনিয়ত বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান, ফ্ল্যাগ মিটিং এবং ব্যাটালিয়ন ও সেক্টর পর্যায়ে নানা সমস্যা সমাধানে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
কালের কণ্ঠ : বিজিবিকে কিভাবে সাজাতে চাইছেন?
রফিকুল ইসলাম : নতুন আইনের আলোকে বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো অনুমোদন সাপেক্ষে ঢাকার বাইরে চারটি রিজিয়ন সদর দপ্তর স্থাপন করা হবে। এসব রিজিয়নের প্রশাসনিক আওতায় আগের ১২টি সেক্টরের অতিরিক্ত আরো চারটি সেক্টর স্থাপন করা হবে। একটি বিওপি থেকে পার্শ্ববর্তী বিওপির দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটারে কমিয়ে আনতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিওপি স্থাপন করা হবে। প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ পাওয়া গেলে আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে বাহিনীর পুনর্গঠন সম্ভব হবে। এ ছাড়া সীমান্ত চৌকিগুলোর মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির জন্য প্রতিবছর ৪০-৫০ কি.মি. রাস্তা উন্নয়ন করা হচ্ছে। সীমান্ত এলাকায় পর্যবেক্ষণ কার্যকর ও দ্রুততর করার জন্য মোটরসাইকেলের প্রবর্তন করা হচ্ছে। এই আর্থিক বছরে এক হাজার ৭০০ অতিরিক্ত মোটরসাইকেল কেনার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন আছে।
কালের কণ্ঠ : বিএসএফের হাতে প্রায়ই বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
রফিকুল ইসলাম : এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। সীমান্তে নিরপরাধ-নিরস্ত্র যেকোনো বেসামরিক লোককে বিএসএফের গুলিতে হত্যা গ্রহণযোগ্য নয়। সীমান্তে অনাকাঙ্ক্ষিত হতাহতের ঘটনায় বিজিবি সব সময়ই কঠোর প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি বিএসএফকে নিয়মনীতি মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে আসছে। অনাকাঙ্ক্ষিত হতাহতের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে বিএসএফ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করে ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া যেকোনো ধরনের সীমান্ত অপরাধ প্রতিরোধে বিজিবির টহল কার্যক্রম আরো জোরদার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সীমান্তে এসব হত্যাকাণ্ড সাধারণত রাতে ও ভারতীয় ভূখণ্ডে হয়ে থাকে। অবৈধভাবে সীমান্তের অপর প্রান্তে গরু ব্যবসার কারণে বাংলাদেশের নিরস্ত্র লোকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থাকে। যেসব এলাকায় গরু চোরাকারবার বেশি হয়, সেসব এলাকায় পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়া বিএসএফকে আন্তর্জাতিক আইন জঁষবং ড়ভ ঊহমধমবসবহঃ মেনে চলতে এবং নিরস্ত্র লোকজনকে গুলি না চালাতে অনুরোধ করা হয়েছে। প্রাণঘাতী নয়, এমন ধরনের অস্ত্র (ঘড়হ-ষবঃযধষ বিধঢ়ড়হ) ব্যবহারের বিষয়টির ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের গত বৈঠকে কোনো সুরাহা হয়নি। সীমান্ত এলাকায় জনসাধারণের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণের জন্য বিজিবি স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : বর্ডার আউটপোস্টে (বিওপি) এখন একজন নায়েব সুবেদার কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। সীমান্ত নিরাপত্তা বিধানে লোকবল বাড়ানোর কোনো চিন্তা আছে কী?
রফিকুল ইসলাম : বাহিনীর জন্য প্রযোজ্য নির্দেশনামার আলোকে চিরাচরিতভাবেই এই কমান্ডাররা বিওপিতে সন্তোষজনকভাবে দায়িত্বপালন করছেন। তবে সীমান্তে টহল কার্যক্রমে আরো গতিশীলতা আনার জন্য এরই মধ্যে বিওপিগুলোতে মোটরসাইকেল প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া সীমান্তের নদী এলাকায় নৌযান সরবরাহের উদ্যোগ রয়েছে। দুর্গম সীমান্তে সড়ক ও রাস্তা উন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। বাহিনীর পুনর্গঠন সম্পন্ন হলে জনবলের ঘাটতিও পূরণ হবে।
কালের কণ্ঠ : আমরা জানি আপনারা সীমান্তে চোরাচালান রোধে ডগ স্কোয়াড ব্যবহার করতে যাচ্ছেন। এটা কতটা কার্যকর হবে বলে মনে করেন?
রফিকুল ইসলাম : এখন পর্যন্ত বাহিনীর নিজস্ব উদ্যোগেই সীমিত আকারে ডগ স্কোয়াড প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এ উদ্যোগের সফলতা পাওয়া গেলে পরবর্তী সময়ে বাহিনীর কাঠামোতে সংযোজনের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হবে।
কালের কণ্ঠ : অভিযোগ রয়েছে সীমান্তে বিজিবি ও বিএসএফ সদস্যদের যোগসাজশে চোরাচালান হয়। এ ক্ষেত্রে বিজিবিপ্রধান হিসেবে আপনি কী বলবেন?
রফিকুল ইসলাম : ঢালাওভাবে এই মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয় এবং কথাটা ঠিকও নয়। তবে কোনো অসৎ ব্যক্তির কারণে কখনো এরূপ ঘটে থাকলে বা কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শুধু এই বাহিনীর পক্ষে সীমিত জনবল নিয়ে দীর্ঘ ও দুর্গম সীমান্তে চোরাচালান রোধ সম্ভব নয়। এ জন্য স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও জনসাধারণের সহযোগিতা নিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে। আমাদের প্রতিদিনের সাফল্যও আপনাদের কাছে দৃশ্যমান। তার পরও শতভাগ চোরাচালান প্রতিরোধ সম্ভবত অকল্পনীয়।
কালের কণ্ঠ : সীমান্তপথে নারী ও শিশু পাচারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের, তা রোধে আপনাদের পরিকল্পনা কী?
রফিকুল ইসলাম : যেকোনো ধরনের সীমান্ত অপরাধের মতোই নারী ও শিশু পাচারের বিরুদ্ধেও বিজিবির তৎপরতা আপসহীন। সীমান্তে পাচারের কবল থেকে প্রায়ই নারী-শিশুদের উদ্ধার করা হচ্ছে। পাচারের সময় আটক করে আইনের হাতে সোপর্দের ঘটনাও উল্লেখযোগ্য। পাচারের শিকার হওয়া নারী ও শিশুদের প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল থেকে বিজিবি তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। পাচার প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতেও বিজিবি স্থানীয় প্রশাসন, এনজিও, জনপ্রতিনিধি ও জনগণের সঙ্গে কাজ করছে। বিজিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ সালে ৩৩৯ জন নারী ও ১৪৬ শিশুকে উদ্ধার এবং ৯ পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : আগের বিডিআর ও নবগঠিত বিজিবির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কী?
রফিকুল ইসলাম : বিজিবি আইন অনুযায়ী সাংগঠনিক কাঠামোর পরিবর্তন, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী উপযুক্ত শাস্তির বিধান, মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতির ব্যবস্থাসহ বাহিনীতে অনেক যুগোপযোগী পরিবর্তন সাধিত হবে। আইন অনুযায়ী প্রস্তাবিত রিজিয়ন সদর দপ্তরগুলো সীমান্ত-অপরাধ দমন, সীমান্ত সুরক্ষার জন্য অপারেশনাল ও প্রশাসনিক দায়িত্ব সব বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। তখন বর্ডার গার্ড সদর দপ্তর উচ্চপর্যায়ে উন্নয়ন ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। এ ছাড়া রিজিয়ন সদর দপ্তরগুলো বিএসএফের ফ্রন্টিয়ার সদর দপ্তরগুলোর প্রতিপক্ষ হিসেবে কার্যকর সমন্বয় করতে পারবে।
কালের কণ্ঠ : বিডিআর বিদ্রোহ বিচার কার্যক্রম রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কি না?
রফিকুল ইসলাম : সম্পূর্ণরূপে যেকোনো ধরনের প্রভাবমুক্ত। এমনকি বিদ্রোহে অভিযুক্ত বাহিনীর সদস্যদেরও এ ধরনের কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। বিদ্রোহের বিচারকাজে নিয়োজিত আদালতগুলো অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। প্রতিটি কোর্টে যে কেউ দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকতে পারে এবং মিডিয়ার সাংবাদিকরাও নিয়মিতভাবে সাক্ষীর সাক্ষ্য, আসামিদের জেরা ও আদালতের কার্যক্রম ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করছে। এ পর্যন্ত এরূপ কোনো মন্তব্য আমাদের গোচরীভূত হয়নি।
কালের কণ্ঠ : মিয়ানমার সীমান্তে বিজিবি জওয়ানরা দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, মিয়ানমার থেকে ব্যাপক হারে ইয়াবা বাংলাদেশে প্রবেশ করে বিজিবি সদস্যদের সহযোগিতায়। তা রোধে আপনারা কী ধরনের ভূমিকা রাখছেন?
রফিকুল ইসলাম : এ ধরনের অভিযোগ সত্য নয়। ইয়াবা পাচারের রুট হিসেবে মূলত কঙ্বাজার ও টেকনাফের বিস্তীর্ণ সমুদ্র অথবা নৌপথ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সীমান্তের এই বিস্তৃত পথে বিজিবির সঙ্গে কোস্টগার্ডও আমাদের সহায়তা করছে। বাহিনীর সীমিত জনবল ও লজিস্টিক নিয়েই ইয়াবার চালান এবং পাচারকারী আটকের সফলতা উল্লেখযোগ্য। ২০১০ সালে সাত লাখ ৭০ হাজার ৬৪১টি ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
কালের কণ্ঠ : মিয়ানমার সীমান্তে নাসাকা বাহিনীর সঙ্গে বিজিবির সম্পর্ক কেমন?
রফিকুল ইসলাম : সীমান্তে উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতিতে অনুসরণীয় নির্দেশনা মোতাবেক নাসাকা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হয়ে থাকে। অনেক সময় নাসাকা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগে ভাষাগত সমস্যা হলেও সীমান্ত সুরক্ষার প্রশ্নে উভয় বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বিদ্যমান।
কালের কণ্ঠ : আপনার কাছে চোরাচালানের ক্ষেত্রে কোন কোন এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। সেসব জায়গায় কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
রফিকুল ইসলাম : সীমান্তের কিছু কিছু এলাকা অধিক চোরাচালানপ্রবণ হওয়ায় সেখানে সংশ্লিষ্ট ইউনিটকে অতিরিক্ত নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া আছে। এসব এলাকার মধ্যে সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, কুমিল্লা ও জয়পুরহাট অন্যতম।
কালের কণ্ঠ : অভিযোগ রয়েছে, নিরীহ জওয়ানরাও আসামি হয়েছেন। আপনি কি তা মনে করেন?
রফিকুল ইসলাম : নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্তের মধ্য দিয়েই অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সাক্ষ্য-প্রমাণাদি সাপেক্ষে আইনের বিধান অনুযায়ী তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে। আদালতের কার্যক্রম, সাক্ষ্য উপস্থাপন ও আসামিদের জেরা_সবকিছুই সাংবাদিকরা পর্যবেক্ষণ করছেন, যা সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে। ঢাকায় পিলখানায় অভিযুক্ত বিজিবি সদস্য সংখ্যা চার হাজার ৯৮ জন। এখানে শুধু বিদ্রোহই হয়নি, জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড, সম্পদ লুট, অস্ত্র ও বিস্ফোরক লুট ইত্যাদি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। বিচারকাজ শুরু হওয়ার আগে প্রায় দেড় বছর ধরে তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পরই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে প্রধানত বিদ্রোহ হয়েছে সেক্টর ও ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে। কোনো বিওপিতে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেনি। এ কারণেই আসামির সংখ্যা খুব কম। এমনকি নওগাঁ ও সুনামগঞ্জে স্পেশাল কোর্র্টে আসামির সংখ্যা যথাক্রমে ১৪ ও ১০ জন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাদের বেকসুর খালাস দিয়েছেন এবং তারা চাকরি ফেরত পাবে।
কালের কণ্ঠ : বিডিআর বিদ্রোহের পর তদন্ত কমিটি এ বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে যেসব সুপারিশ করেছিল, তার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে। কেন সব সুপারিশ বাস্তবায়িত হচ্ছে না। বাধা কোথায়?
রফিকুল ইসলাম : গত বছর ৮ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন পাস এবং ২০ ডিসেম্বর মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতির মধ্য দিয়ে আইনটি কার্যকর হয়েছে। এরই মধ্যে বাহিনীর নাম, মনোগ্রাম, পোশাক, ব্যাজ পরিবর্তনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পুনর্গঠনের সাংগঠনিক কাঠামোর অনুমোদন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন আছে। নতুন প্রস্তাবনায় একবারে সবকিছুর অনুমোদন দেওয়া হবে না এবং দিলেও অবকাঠামো, জনবল, অর্থ, ভূমি অধিগ্রহণ_সবকিছু বিজিবি বা সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। আশা করা যায়, আগামী অর্থবছরে চট্টগ্রামে একটি রিজিয়ন, কঙ্বাজার ও ঠাকুরগাঁওয়ে তিন-চারটি ব্যাটালিয়নের অনুমোদন পাওয়া যাবে। আইনের বিধি প্রণয়নের কাজ চলছে। কিছু কিছু বাধা রয়েছে, যেমন_জমি অধিগ্রহণ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অভ্যন্তরীণ কিছু কাজ সম্পন্ন হয়েছে, যেমন_পদোন্নতি পলিসি পরিবর্তন করা হয়েছে, প্রশিক্ষণকে কার্যকর ও ঢ়ৎড়ফঁপঃরাব করা হচ্ছে এবং অফিসারদের সংখ্যা ও ফঁৎধঃরড়হ বাড়ানো হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : এ ধরনের বাহিনীকে সীমান্ত রক্ষার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কাজও আগে করা হতো। এখন এ রকম কাজে লাগানো যায় কি না?
রফিকুল ইসলাম : বিজিবির অন্যতম দায়িত্ব প্রশাসনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা করা। বিদ্রোহের পরপরই কিছুটা অচলাবস্থার জন্য এ ব্যবস্থা করা যায়নি। কিন্তু যেসব স্থানে বিদ্রোহ হয়নি, সেসব জায়গায় এ কার্যক্রম অনেক আগেই শুরু হয়েছে। চট্টগ্রামে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিজিবি সদস্যরা কাজ করেছেন। গত পৌরসভা নির্বাচনে ঢাকার বাইরে বিদ্রোহের বিচার শেষ হওয়ার কারণে ৬৩টি পৌরসভায় ৬৮ প্লাটুন বিজিবি-সদস্য দায়িত্ব পালন করেছেন। নবম জাতীয় সংসদের হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপনির্বাচনে ১২ প্লাটুন বিজিবি-সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে জেলা ও ডিভিশন পর্যায়ে চোরাচালানবিরোধী টাস্কফোর্সগুলো সব সময় বিশেষ অভিযানে অংশগ্রহণ করছে। ঢাকায় বিদ্রোহের মাত্রা ভিন্নতর হওয়ায় এ কার্যক্রম বন্ধ আছে। বিচার শেষ হলে ১৩, ২৪, ৩৬ ও ৪৪ ব্যাটালিয়ন অবলুপ্ত হবে। তখন বাইরে থেকে ইউনিট এনে এ ইউনিটগুলো প্রতিস্থাপন করা হবে। তখন আরো নতুন ইউনিট করা হবে।
কালের কণ্ঠ : বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় নিহত কর্মকর্তাদের পরিবারের জন্য আপনারা কী করছেন?
রফিকুল ইসলাম : এ দায়িত্ব মূলত সেনা সদর করছে। জানামতে, শহীদ প্রতি সেনা পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে। সেনাপ্রধানের তহবিল থেকে পাঁচ লাখ, পারিবারিক নিরাপত্তা প্রকল্প থেকে আট লাখ, পারিবারিক পেনশন ৫০-৬০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। প্রতি পরিবারের জন্য মিরপুর ডিওএইচএসে চার কাঠার প্লট বরাদ্দ করা হয়েছে। ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে প্রতি পরিবারের জন্য মাসিক ৪০ হাজার টাকা ১০ বছর পর্যন্ত অনুদান দেওয়া হচ্ছে। যোগ্যতা অনুযায়ী পরিবারের সদস্যদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। অনেকেই ট্রাস্ট ব্যাংকে চাকরি পেয়েছেন।
কালের কণ্ঠ : বাহিনীর অভ্যন্তরে বিদ্রোহের মতো পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী রকম প্রস্তুতি আছে?
রফিকুল ইসলাম : গত বিদ্রোহের একটি অভিযোগ ছিল, যা জাতীয় পর্যায়ে তদন্ত কমিটির সুপারিশেও ছিল, তা হচ্ছে গোয়েন্দা-ব্যর্থতার বিষয়। বর্তমানে বাহিনীর প্রতিটি কার্যক্রমে নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। পিলখানাসহ সব সেক্টর সদরে অস্ত্র ও গোলাবারুদ স্থাপনায় সিসি টিভি স্থাপন করা হয়েছে। বর্ডার গার্ড সিকিউরিটি ইউনিটের (বিজিএসইউ) কার্যক্রমে গতিশীলতা আনা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের প্রধানতম গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই এবং এনএসআইয়ের সঙ্গে সব সময় সমন্বয় করা হচ্ছে। উপরন্তু যেকোনো জরুরি অবস্থার জন্য পড়হঃরহমবহপু ঢ়ষধহ করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা গঠনের প্রস্তাব আছে।
কালের কণ্ঠ : বিদ্রোহের সময় যেসব বিডিআর সদস্য নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে শুধু সুবেদার মেজর নূরুল ইসলামের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের কথা আমরা জানি। অন্যদের কী দেওয়া হলো?
রফিকুল ইসলাম : নূরুল ইসলামের পরিবারকে হেডকোয়ার্টার থেকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। কারণ তিনি বিদ্রোহের শুরুতে প্রত্যক্ষভাবে বাধা দিয়েছিলেন। এ কারণে বিদ্রোহীরা তাঁকে পেটে ও পিঠে লোহার রড ঢুকিয়ে হত্যা করেছিল। অন্যদের কেউ কেউ ক্রসফায়ার ও বিদ্রোহীদের গুলিতে মারা গেছেন। যেমন_এডি আলাউলের ছেলে একজন মেজর। এ কারণে বিদ্রোহীরা তাঁকে হত্যা করেছে। নিহতদের প্রচলিত আইন অনুযায়ী পারিবারিক পেনশন দেওয়া হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : ভারত-পাকিস্তানের সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের খবর পাওয়া যায় না। তাহলে আমাদের সীমান্তে হত্যার কারণ কী?
রফিকুল ইসলাম : ভারত ও পাকিস্তান সীমান্তে বিএসএফ ও রেঞ্জাররা দায়িত্ব পালন করেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বৈরী মনোভাবের কারণে সীমান্তে সব সময় দুই পক্ষই সচেতন থাকে। প্রকৃতপক্ষে ভারত ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কিন্তু সীমান্ত-পরিস্থিতি শান্ত ও বন্ধুভাবাপন্ন। বিএসএফ এবং বিজিবির মধ্যে গত এক বছরে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, যাতে সীমান্ত পরিস্থিতি অশান্ত হয়েছিল। পাকিস্তান সীমান্তের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা যাবে না।
কালের কণ্ঠ : অভিযোগ পাওয়া যায় বিদ্রোহ মামলার আসামিদের ভেতরে নির্যাতন করা হয়। এ প্রসঙ্গে আপনি কী বলবেন?
রফিকুল ইসলাম : প্রথমেই আমি জিনিসটা অস্বীকার করছি এই কারণে যে বিচার চলাকালে এই আসামিরা আমাদের তত্ত্বাবধানে থাকে না, জেল কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকে। আমাদের অনুরোধে ডিসি প্রসিকিউশনের তত্ত্বাবধানে নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমে বিশেষ আদালতে হাজির করা হয়। সুতরাং এসব অভিযোগ অমূলক।
কালের কণ্ঠ : এমন অভিযোগও পাওয়া যায়, সাক্ষী যাদের নেওয়া হয়েছে তাদের নির্যাতন করে সাক্ষী বানানো হয়েছে?
রফিকুল ইসলাম : এটা একেবারেই সত্য নয়। বিচারকাজ সাংবাদিকরাও উপস্থিত থেকে দেখতে পারছেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতিনিধি থাকছেন। তাঁরাও বিচার দেখছেন। ঢালাওভাবে বিচারের রায় দেওয়া হচ্ছে না। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, তাদের খালাস দেওয়া হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : পিলখানায় থাকা আসামিদের মধ্যে প্রথম রেকর্ড উইংয়ের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এতে ১১১ জন আসামির সবাইকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের বিচারের সময় দেখা যাচ্ছে যে কোনো কোনো আসামি দোষ স্বীকার করছে। ডিজি হিসেবে আপনার কী মনে হয়?
রফিকুল ইসলাম : আগে যদি তারা মিথ্যা বলে থাকে, তাহলে এখন দোষ স্বীকার করছে। আদালত ঘোষণা দিয়েছেন, যারা দোষ স্বীকার করবে তাদের অনুকম্পা দেওয়া যেতে পারে। তবে তাদের অপরাধ কোন মাত্রায়, তা দেখা হবে। ঢাকায় বিদ্রোহের সঙ্গে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ৫৭ জন সেনা অফিসার, বিডিআর জওয়ানসহ ৭৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
কালের কণ্ঠ : বিচার কার্যক্রম চালাতে গিয়ে আপনারা কি কোনো হুমকি পাচ্ছেন?
রফিকুল ইসলাম : মাঝেমধ্যে টেলিফোনে হুমকি পাওয়া যায়। তাদের যে মানসিক অবস্থা, তাতে করে যেকোনো কর্মকাণ্ড করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে সিপাহি বাছেদের কথা বলা যেতে পারে। তার বিরুদ্ধে চার্জ পড়ে শোনানোর আগেই সে আদালতে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়েছে।
কালের কণ্ঠ : পলাতক জওয়ানদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন?
রফিকুল ইসলাম : হত্যা মামলার পলাতক আসামিদের নাম পুলিশের কাছে দেওয়া হয়েছে। ইন্টারপোলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : আমরা জানি বিদ্রোহের পর থেকে আজ পর্যন্ত ঢাকায় থাকা জওয়ানরা অস্ত্র পায়নি। কবে নাগাদ তারা অস্ত্র পেতে পারে?।
রফিকুল ইসলাম : বিচার শেষ হওয়ার পর।
কালের কণ্ঠ : বিচার কার্যক্রম কবে নাগাদ শেষ হবে বলে আশা করছেন?
রফিকুল ইসলাম : জুলাই-আগস্টের মধ্যে শেষ করতে পারব বলে মনে করছি।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
রফিকুল ইসলাম : আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.