মিশন আলোর দ্বীপ by রেজা শাওন
উপকূলে ক'দিন আগে একটি ঘূর্ণিঝড় হয়ে গেল। ঝড়ের আগেও বিশেষ কোনো সতর্কতার বার্তা সংবাদমাধ্যমগুলোতে আসেনি। সত্যি বলতে কি, ঝড়ের পরও সেভাবে কোনো খবর আমার চোখে পড়েনি। এ ঝড়ের ফলে আড়াই হাজার খেটে খাওয়া মানুষ এখনও নিখোঁজ রয়েছে।
আসলে এ ধরনের নিখোঁজ সংবাদের গুরুত্বটা প্রচারমাধ্যমে আসে মানুষগুলো গোলার্ধের কোন অংশে নিখোঁজ হচ্ছে তার ওপর। বস্তুত আমরা পৃথিবীর মানচিত্রের যে অংশটা সবসময় করুণার ছায়ায় ঢেকে থাকে, সে অংশের। মানুষের এই দেশটায়, মানুষ হারিয়ে যাওয়ার খবরগুলো হয়তো আমাদের নিজেদের কাছেই খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়_ এটাই বাস্তব।
কিন্তু এই বাস্তবতা কতদিন ধরেইবা আর মেনে নেওয়া যায়? মাঝে মধ্যে চিন্তা করি, আসলে জাতি হিসেবে কোন বিশেষ সময়টায় আমাদের হতাশ হওয়া উচিত? সংসদে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আবহমানকালের কাদা ছোড়াছুড়ি এখনও জারি রাখছে তাই? দাতাগোষ্ঠীগুলো ঋণ দেবে না বলে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে তাই? নাকি ব্যস্ত নগরীতে জ্যামে আটকে থেকে, আমাদের দিনের অর্ধেকটাই যখন হারিয়ে যাচ্ছে, তখন? মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ খুঁজে বেড়ানোর অঙ্কটা আমাদের সবার জানা। এ দেশে মুদ্রার পিঠ বদলাবে, দেশ তো আর বদলাবে না। বিশ্বাসটাও সেভাবে গেঁথে গেছে মনে, তাই মানুষ হারিয়ে যাওয়ার খবরগুলো আমাদের নাড়া দেয় না। চোখ বুজতে আমাদের সমস্যা হয় না, আমার সঙ্গে আর কারও পিঠ ঠেকে নেই। মানুষ হারিয়ে গেলে কার কীইবা আসে যায়?
গত মাসের দশ তারিখ রাতে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রলয়ঙ্করী ঝড় তাণ্ডব চালিয়ে যায়। পরদিন দেশের সবগুলো সংবাদমাধ্যমে সীমিত আকারে খবর আসতে শুরু করেছে। মৃত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সংখ্যাটা আর কতটুকু বাড়তে পারে, কিংবা ক্ষয়ক্ষতি কতটুকু হয়েছে_ সেসব পরিসংখ্যানে যায়নি তারা। খুব দ্রুত সামাজিক যোগাযোগের সাইট ফেসবুকে 'মিশন হাতিয়া : কান্নাভেজা এ এক মুখের জন্য যুদ্ধ' শিরোনামে একটি ইভেন্ট খোলে একদল তরুণ। আর এই ইভেন্টটি তৈরির পরপরই মুহূর্তেই আয়োজক ণড়ঁঃয ভড়ৎ ঢ়বধপব ্ উবসড়পৎধপু-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েও যায় বহু মানুষ। সবার অভূতপূর্ব সাড়া নিয়ে ১৮ অক্টোবর ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে দলটি। উদ্দেশ্য হাতিয়া উপজেলার সবচেয়ে দুর্গম জনপদ নিঝুম দ্বীপে সাহায্য নিয়ে পেঁঁৗছানো।
পথের দুর্গমতা কিংবা সরকারি সাহায্যের অপ্রতুলতাকে ছাড়িয়েও নিঝুম দ্বীপের যে সমস্যাটা ওদের চোখে, সবার চোখে প্রথমে ধরা পড়ে, সেটা হলো বিশ হাজার জনগোষ্ঠীর একটা এলাকায় কেবল একটা আধা-সরকারি প্রাইমারি স্কুল। ওরা গিয়েছিল ত্রাণ সহায়তা দিতে, কিন্তু ত্রাণ তো সাময়িক। এমন একটা কিছু করা দরকার যাতে অনেক অনেক বছর পরে হলেও এই জনপদটাকে যেন কেন্দ্রের করুণার অপেক্ষায় এভাবে বসে থাকতে না হয়। ওদের ক্ষণিকের সে ভাবনাটা পূর্ণতা পায় এলাকাবাসীর অভাবনীয় ভালোবাসায়। মুহূর্তেই তারা রাজি হয়ে যায় স্বপ্নের সে স্কুলটার জন্য প্রয়োজনীয় এক একর জমি দিতে। সেদিনের সঁাঁঝের আলোয় নিঝুম দ্বীপে দ্বিতীয় স্কুলটির ভিত্তিপ্রস্তর রচিত হয়। নিঝুম দ্বীপ পায় নতুন একটা স্বপ্নকে। এ স্বপ্নের নাম 'আলোর দ্বীপ'। 'আলোর দ্বীপ' হচ্ছে সে স্বপ্নের নাম, যে স্বপ্নটা শুধু একটা স্কুলে থেমে থাকবে না। এ স্কুলকে ঘিরে দ্বীপের নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য কুটির শিল্পের শিক্ষা দেওয়া হবে, দ্বীপের সহজ-সরল মৎস্যজীবী মানুষগুলোকে শেখানো হবে_ কীভাবে আড়তদারদের একচেটিয়া
গ্রাস থেকে বের হয়ে নিজের পায়ে
দাঁড়াতে হয়।
লেখার শুরুতে একটা ভাঙনের গল্পের কথা বলেছিলাম। এ ভাঙন হচ্ছে, আমাদের আবহমান চিন্তা আর বিশ্বাসের ভাঙন। যে ভাঙনটা অল্প অল্প করে শুরু হয়েছে। কারও করুণা আর অনুগ্রহের অপেক্ষায় না থেকে, আমরা চাইলে নিজেরাই পারি, আলোর দ্বীপের মতো হাজারো দ্বীপের এক বাংলাদেশ গড়তে। আমাদের শুধু স্বপ্নটা দেখতে-শিখতে হবে।
siddique1237@gmail.com
কিন্তু এই বাস্তবতা কতদিন ধরেইবা আর মেনে নেওয়া যায়? মাঝে মধ্যে চিন্তা করি, আসলে জাতি হিসেবে কোন বিশেষ সময়টায় আমাদের হতাশ হওয়া উচিত? সংসদে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আবহমানকালের কাদা ছোড়াছুড়ি এখনও জারি রাখছে তাই? দাতাগোষ্ঠীগুলো ঋণ দেবে না বলে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে তাই? নাকি ব্যস্ত নগরীতে জ্যামে আটকে থেকে, আমাদের দিনের অর্ধেকটাই যখন হারিয়ে যাচ্ছে, তখন? মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ খুঁজে বেড়ানোর অঙ্কটা আমাদের সবার জানা। এ দেশে মুদ্রার পিঠ বদলাবে, দেশ তো আর বদলাবে না। বিশ্বাসটাও সেভাবে গেঁথে গেছে মনে, তাই মানুষ হারিয়ে যাওয়ার খবরগুলো আমাদের নাড়া দেয় না। চোখ বুজতে আমাদের সমস্যা হয় না, আমার সঙ্গে আর কারও পিঠ ঠেকে নেই। মানুষ হারিয়ে গেলে কার কীইবা আসে যায়?
গত মাসের দশ তারিখ রাতে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রলয়ঙ্করী ঝড় তাণ্ডব চালিয়ে যায়। পরদিন দেশের সবগুলো সংবাদমাধ্যমে সীমিত আকারে খবর আসতে শুরু করেছে। মৃত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সংখ্যাটা আর কতটুকু বাড়তে পারে, কিংবা ক্ষয়ক্ষতি কতটুকু হয়েছে_ সেসব পরিসংখ্যানে যায়নি তারা। খুব দ্রুত সামাজিক যোগাযোগের সাইট ফেসবুকে 'মিশন হাতিয়া : কান্নাভেজা এ এক মুখের জন্য যুদ্ধ' শিরোনামে একটি ইভেন্ট খোলে একদল তরুণ। আর এই ইভেন্টটি তৈরির পরপরই মুহূর্তেই আয়োজক ণড়ঁঃয ভড়ৎ ঢ়বধপব ্ উবসড়পৎধপু-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েও যায় বহু মানুষ। সবার অভূতপূর্ব সাড়া নিয়ে ১৮ অক্টোবর ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে দলটি। উদ্দেশ্য হাতিয়া উপজেলার সবচেয়ে দুর্গম জনপদ নিঝুম দ্বীপে সাহায্য নিয়ে পেঁঁৗছানো।
পথের দুর্গমতা কিংবা সরকারি সাহায্যের অপ্রতুলতাকে ছাড়িয়েও নিঝুম দ্বীপের যে সমস্যাটা ওদের চোখে, সবার চোখে প্রথমে ধরা পড়ে, সেটা হলো বিশ হাজার জনগোষ্ঠীর একটা এলাকায় কেবল একটা আধা-সরকারি প্রাইমারি স্কুল। ওরা গিয়েছিল ত্রাণ সহায়তা দিতে, কিন্তু ত্রাণ তো সাময়িক। এমন একটা কিছু করা দরকার যাতে অনেক অনেক বছর পরে হলেও এই জনপদটাকে যেন কেন্দ্রের করুণার অপেক্ষায় এভাবে বসে থাকতে না হয়। ওদের ক্ষণিকের সে ভাবনাটা পূর্ণতা পায় এলাকাবাসীর অভাবনীয় ভালোবাসায়। মুহূর্তেই তারা রাজি হয়ে যায় স্বপ্নের সে স্কুলটার জন্য প্রয়োজনীয় এক একর জমি দিতে। সেদিনের সঁাঁঝের আলোয় নিঝুম দ্বীপে দ্বিতীয় স্কুলটির ভিত্তিপ্রস্তর রচিত হয়। নিঝুম দ্বীপ পায় নতুন একটা স্বপ্নকে। এ স্বপ্নের নাম 'আলোর দ্বীপ'। 'আলোর দ্বীপ' হচ্ছে সে স্বপ্নের নাম, যে স্বপ্নটা শুধু একটা স্কুলে থেমে থাকবে না। এ স্কুলকে ঘিরে দ্বীপের নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য কুটির শিল্পের শিক্ষা দেওয়া হবে, দ্বীপের সহজ-সরল মৎস্যজীবী মানুষগুলোকে শেখানো হবে_ কীভাবে আড়তদারদের একচেটিয়া
গ্রাস থেকে বের হয়ে নিজের পায়ে
দাঁড়াতে হয়।
লেখার শুরুতে একটা ভাঙনের গল্পের কথা বলেছিলাম। এ ভাঙন হচ্ছে, আমাদের আবহমান চিন্তা আর বিশ্বাসের ভাঙন। যে ভাঙনটা অল্প অল্প করে শুরু হয়েছে। কারও করুণা আর অনুগ্রহের অপেক্ষায় না থেকে, আমরা চাইলে নিজেরাই পারি, আলোর দ্বীপের মতো হাজারো দ্বীপের এক বাংলাদেশ গড়তে। আমাদের শুধু স্বপ্নটা দেখতে-শিখতে হবে।
siddique1237@gmail.com
No comments