সমসময়-নতুন লড়াই, পুরনো সংগ্রামের গান by আতাউস সামাদ

এবারের পহেলা বৈশাখে আমার কথাগুলো শেষ করব আমাদের দেশের সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতি অঙ্গনের নেতাদের প্রতি এই অনুরোধ করে, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ করে আমাদের গণসঙ্গীত, পুরনো দিনের পল্লীগীতি ও মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো বেশি করে পরিবেশন করুন। নতুন লড়াইটার জন্য ওগুলো দরকার


আজ আমাদের পহেলা বৈশাখ। সারা বাংলাদেশজুড়ে আজকে হবে উৎসব। নতুন বছর, ১৪১৮ সাল, শুরু করার আনন্দে মাতব সবাই। যুদ্ধবিগ্রহে আক্রান্ত দেশগুলো ছাড়া অন্য যেসবখানে প্রবাসী বাংলাদেশিরা আছেন, তারাও বর্ষবরণ করবেন আজ অথবা বিদেশ-বিভুঁইয়ের নিয়মকানুন রক্ষা করে এ সপ্তাহেই তাদের কোনো ছুটির দিনে। আগামীকাল ভারত রাষ্ট্রের বাংলাভাষী নাগরিকরা তাদের পঞ্জিকা অনুসরণ করে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করবেন। প্রতিবেশী দেশটির পাঞ্জাব রাজ্যেও 'বৈশাখী' পালন করা হয় ফসলের এক উৎসব হিসেবে। কিন্তু বাংলাদেশিরাই সেই জাতি, যারা এখন বাংলা নববর্ষ উৎসব করে সারাবিশ্বে। ফলে বিদেশিরা জানতে পারছে আমাদের বছর গোনার তথ্য, 'নববর্ষ' উৎসবের খবর এবং এ দিনে আমাদের ভাবনার কথা। তাই সকল বাংলাদেশি ও বিদেশে তাদের বল্পুব্দ-বান্ধবদের আজ জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা। ১৪১৮ সনে সবার জীবন কানায় কানায় ভরে উঠুক শান্তি, সুস্বাস্থ্য, সুখ ও সমৃদ্ধিতে_ মঙ্গলময় সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা করি।
আমরা জানি, আমাদের সব আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে না। আমরা সবাই নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সচ্ছল হয়ে যাব না, সবার রোগমুক্তি ঘটবে না, সব বিরোধ নিষ্পক্তি হবে না, সব গৃহযুদ্ধ থেমে যাবে না, সব পথবাসী গৃহস্থ হবে না, সব অভুক্তের জন্যই দু'বেলা আহার নিশ্চিত হবে না, আর প্রতিটি ক্লেদাক্ত মনও একেবারে ক্লেদমুক্ত হবে না। তবু আমরা আকাঙ্ক্ষা পোষণ করি যে, এ রকম পূর্ণ সুখশান্তি বিশ্বে একদিন না একদিন বিরাজ করবে। হয়তোবা কাল অথবা পরশুই এমনটি হয়ে যাবে না। কিন্তু কাল যদি তা না হয়, এমনকি আমাদের আয়ুষ্কালেও যদি না হয় তাহলে যেন আমাদের সন্তানদের জীবদ্দশায় তা হয়। তা-ও না হলে প্রপোত্রদের সময়। মহাকালের অনন্ত যাত্রায় এক, দুই বা তিন প্রজন্মের জীবন আর কতটুকুই সময়? মানুষ বাঁচে আশা করে এবং সেই আশা পূরণ করার জন্য চেষ্টা করে বিধায়। তা না হলে সে স্থাণু হয়ে যেত। জড় হয়ে থাকত। এ মোটেও অস্বাভাবিক নয় যে, মানুষ যখন কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তার চলৎশক্তি খর্ব হয় বা লোপ পায়, তখন সে নিজের জীবনাবসান কামনা করে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্ভবত এ রকম কোনো বেদনা খুবই তীব্রভাবে অনুভব করেছিলেন যখন তিনি ১৫ বৈশাখ, ১৩২১, অর্থাৎ আজ থেকে ৯৭ বছর আগে, তার 'সবুজের অভিযান' কবিতাটি লেখেন। তাতে তিনি জরাগ্রস্ত ও স্থবির বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবে_ 'ওই-যে প্রবীণ, ওই-যে পরম পাকা_/চক্ষুকর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা,/ঝিমায় যেন চিত্রপটে আঁকা/অন্ধকারে বন্ধ-করা খাঁচায়।' একই কবিতায় তিনি প্রাণশক্তিতে ভরপুর টগবগে তরুণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন_ 'ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,/ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,/আধ-মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।' অতি কঠিন ওই কাজটি তার আমলের নবীনরা পারেনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম অনেক আশা করে লিখেছিলেন, 'ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখির ঝড়।/তোরা সব জয়ধ্বনি কর্।/তোরা সব জয়ধ্বনি কর্!' এই একই প্রলয়োল্লাস কবিতায় তিনি আরও লিখলেন, 'আসছে নবীন_ জীবন-হারা অসুন্দর করতে ছেদন।' কিন্তু 'অসুন্দর' রয়েই গেল।
আমাদের আমলে দুর্দমনীয় যুবকরা অনভ্যস্ত হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। বলা যায়, সেই তরুণ-তরুণীরা ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের 'যৌবন-জল-তরঙ্গ'। কিন্তু তারা এবং আমরা আজও পারিনি হটাতে সেই তাদেরকে, বিদ্রোহী কবি যাদেরকে চিনিয়েছেন এই বলে_ 'ওরাই কাফের, মানুষের ওরা তিলে তিলে শুষে প্রাণ-রুধির।' তাই 'জীর্ণ গাথায়' বসে থাকা এই 'শকুনিদের' তাড়ানোর জন্য আর সে সঙ্গে তাদের যত পাপ, যা আমাদের এ মুহূর্তটিতেও অন্ধকারে ছুড়ে ফেলতে চাইছে, সেগুলোকে ভস্ম করার জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রাম আমাদের করতেই হবে। এই পহেলা বৈশাখে সবার জন্য মঙ্গল কামনা করার সঙ্গে সঙ্গে এই অতি প্রয়োজনীয় যুদ্ধে নামার জন্য অনুরোধ করছি। সে সঙ্গে আহ্বান জানাচ্ছি দিন দিন শঠতা, প্রতারণা, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, অন্যায়, লুণ্ঠন ও রক্তপাত প্রবল থেকে প্রবলতর যে ধারায় পরিণত হয়েছে, সেটিকে রুখে দেওয়ার জন্য একতাবদ্ধ হতে। তা করতে না পারলে আমরা এবং আমাদের বংশধররা হবো অন্ধকারে বন্দি আর অন্ধকারে জীবেরা সেখান থেকে সোল্লাসে বেরিয়ে এসে 'এক সাগর রক্তের বিনিময়ে' অর্জন করা আমাদের আশা-ভরসার স্বাধীন বাংলাদেশে প্রেতনৃত্য করবে অবিরত।
অতিসম্প্রতি শেয়ারবাজারে পর্বতপ্রমাণ জোচ্চুরির মাধ্যমে লাখ লাখ সাধারণ মানুষের সামান্য সম্বলটুকুও যেভাবে হাতিয়ে নিল গুটিকয় লোক, সেই প্রতারণা আমাদের আশঙ্কা যে সত্য তা প্রমাণ করে। লক্ষণীয় যে, ওই লুটেরাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন দেশের অর্থনীতি সুস্থ রাখার জন্য যাদের সরকার থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তারাও। এই একটি ঘটনাই আমাদের দেশের বর্তমান দুরবস্থার প্রতীক হতে পারে অনায়াসে।
আমরা নিরাশাবাদী নই। বিশেষ করে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে দেশের মানুষ নিজ মাটিতে দ্বিধাহীনভাবে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে শত্রুর ঘাড়ে সওয়ার মৃত্যুরে চোখে চোখ রেখে দিবারাত্রি অতিক্রম করেছে নয়টি মাস, তারা স্বাভাবিকভাবেই আশাবাদী। তবু আজকে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কাছ থেকে ধার করে বলতে হচ্ছে, 'জীবন ললিত নয় আজকে/ঘুচেছে সকল নিরাপত্তা,/বিফল স্রোতের পিছুটানকে/ধারণ করেছে ভীরু সত্তা।/তবু আজ রক্তের নিদ্রা,/তবু ভীরু স্বপ্নের সখ্য:/সহসা চমক লাগে চিত্তে/দুর্জয় হলো প্রতিপক্ষ।' (অদ্বৈধ)
আজ পহেলা বৈশাখে রাজধানী ঢাকা দেখবে বিস্ময়কর এক দৃশ্য। ভোর হতেই লাখ লাখ নর-নারী নতুন অথবা ভালো পোশাক পরে পথে বেরিয়ে পড়েছে। তাদের অনেকে হাঁটছেন শিশুসন্তানদের কাঁধে নিয়ে অথবা তাদের নরম আঙুল মুঠিতে ধরে। নারীদের খোঁপায় ফুল এবং গলায় ফুলের মালা, কব্জিতে পুষ্পডোর। বেশিরভাগেরই গন্তব্য রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অথবা জাতীয় জাদুঘর থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত পথের পাশের মেলা। এবার ঢাকার নানা জায়গায় বসছে আরও বহু মেলা। সূর্যোদয়ের সময় রমনা বটমূলে ছায়ানট প্রতিষ্ঠানটির যে ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতানুষ্ঠানের শুরু হয়, তা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও জনস্রোত ওই পথে ধাবিত হতে থাকবে। আজকে এই পথচলাই ঢাকাবাসীর পহেলা বৈশাখ উৎসবের বড় আনন্দ।
এই জনারণ্যে বলতে গেলে কেউই দু'চারজনকে ছাড়া আর কাউকে চেনেন না। কেউ অন্য যে কারও দিকে চোখ পড়লেই যে বলছেন 'নববর্ষের শুভেচ্ছা' তা-ও নয়। তবে ঠোঁটে লেগে থাকা মৃদু হাসিটিই শুভেচ্ছার বার্তা পেঁৗছে দিচ্ছে সবার কাছ থেকে সবার কাছে। এখানে হৃদয়ের ব্যঞ্জনাই আসল। তবু আমাদের মতো সেকেলেদের মনে একটু অতৃপ্তি থেকে যায়। মনে প্রশ্ন জাগে, 'আধুনিক নাগরিকতা কি আমাদের একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে না? এই বিচ্ছিন্নতা যদি চূড়ান্ত বা নিরেট হয়ে যায় তাহলে কি আমরা সৎ, সুস্থ, ন্যায়নিষ্ঠ ও নিরাপদ সমাজ এবং দেশের জন্য সংগ্রাম করতে পারব? তদুপরি পারব কি আমরা আমাদের দেশটিকে নানামুখী বৈদেশিক আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা করতে?'
ঢাকা শহরের বাইরে যৎকিঞ্চিৎ ভিন্ন চিত্র লক্ষ্য করেছি, বিশেষ করে দরিদ্রদের মধ্যে। দেখেছি, সেসব জায়গায় পহেলা বৈশাখে তারা উৎসব করতে বের হন দলবদ্ধভাবে। তাদের শহরে মেলা ও সঙ্গীতানুষ্ঠান থাকলে ভালো কথা। না হলে শুধুই এ-পাড়া ও-পাড়ায় বল্পুব্দ ও আত্মীয়দের কাছে বেরিয়ে আসেন। মফস্বলে ও গ্রামীণ ব্যবসাকেন্দ্রগুলোতে এখনও হালখাতা ও মিষ্টিমুখ করানোর ঐতিহ্য চালু রয়েছে। এ ধরনের অনুষ্ঠান অর্থনৈতিক ও সামাজিক বন্ধন বাড়ায়।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একবার সাপ্তাহিক 'এখন' পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রস্তাব করেছিলেন, 'পহেলা বৈশাখ হোক বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অর্থবছরের প্রথম দিন। এই দিন থেকেই সরকার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বার্ষিক হিসাব-নিকাশ শুরু হোক। ইংরেজি বছরের ১ জুলাই থেকে অর্থবছর শুরু করতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই_ দেশীয় আইন বা রীতিতে না। কোনো আন্তর্জাতিক আইনেও না।' তার যুক্তি হলো, আমাদের দেশের অন্ধ পল্লীবাসী মানুষ, বিশেষ করে কৃষকরা এখনও কাজকর্ম, ফসল বোনা-তোলা এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখেন বাংলা সন মোতাবেক_ যার শুরু পহেলা বৈশাখ। এই পল্লীবাসী দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। তাদের জীবনাভ্যাস ও ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধা দেখানো রাষ্ট্রের কর্তব্য। দেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ীও পহেলা বৈশাখে হালখাতা করেন। তাহলে সরকারের অর্থবছর পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করতে অসুবিধা কোথায়? বরং এভাবে পহেলা বৈশাখের মূল্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করলে স্বাজাত্যবোধ্য বাড়ত। সরকারকে অনুরোধ করছি, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রস্তাবটি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করতে।
এবারের পহেলা বৈশাখে আমার কথাগুলো শেষ করব আমাদের দেশের সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতি অঙ্গনের নেতাদের প্রতি এই অনুরোধ করে, পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ করে আমাদের গণসঙ্গীত, পুরনো দিনের পল্লীগীতি ও মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো বেশি করে পরিবেশন করুন। নতুন লড়াইটার জন্য ওগুলো দরকার। তাছাড়া এসব তো আমাদের কয়েক প্রজন্মের হৃদয়ের কাছের গান।

আতাউস সামাদ : সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.