যুগের বাণী-রাজনৈতিক আমলাতন্ত্র by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
শিরোনামে ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছটি আমার চিন্তায় তৈরি হয়নি। এটা উচ্চারিত হয়েছে অর্থমন্ত্রীর সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যে_যা একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে পড়েছি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত 'ম্যানেজিং অ্যাট দ্য টপ' প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, যেকোনো গণতান্ত্রিক সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে দরকার রাজনৈতিক আমলাতন্ত্র।
তিনি শব্দগুচ্ছটির ব্যাখ্যায় বলেন, সরকারের কাজে গতিশীলতা আনার জন্য মন্ত্রীদের উপদেষ্টা বা সচিব নিয়োগ দিতে হবে রাজনৈতিক বিবেচনায়। তাঁরা বিষয়ভিত্তিক স্পেশালিস্ট হবেন। কেবিনেট তাঁদের নিয়োগ দেবে এবং সরকারের মেয়াদ শেষে তাঁদেরও চাকরি শেষ হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের দুই দফার উদ্ধৃতি দিয়ে অর্থমন্ত্রীর উপরোক্ত প্রস্তাবনাটির পর্যালোচনার কাজটি করা যাক। সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য প্রসঙ্গে সংবিধানে বলা হয়েছে, 'সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।' উপরোক্ত অনুচ্ছেদের দফাটিতে সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য ও আচরণবিধির মূল নীতিটি উল্লেখ করা হয়েছে, যার প্রাণভোমরা তিনটি সহজ প্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে। একটি হচ্ছে যথাযথ ন্যায়পরায়ণ আচরণ অর্থাৎ এমন আচরণ যা আইনের দৃষ্টিতে সন্তোষজনক এবং শারীরিক বলপ্রয়োগ নয়। অন্যটি হচ্ছে নিপীড়নমুক্ত স্বাধীন পরিবেশ, যেন সবাই বিশ্বাস করেন শক্তি দ্বারা নয়, জনগণের অনুমোদনে সরকার পরিচালিত হচ্ছে। অন্যটি হচ্ছে এমন প্রায়োগিক ব্যবস্থা যেন জনগণের অধিকার ও সরকারের ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকে।
বাস্তবে সংবিধানে নির্দিষ্ট আচরণবিধি পালিত হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলের আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাটিই বহাল আছে। এটা যে গণমুখী নয় তা ২০০ বছর আগে ১৭৯৩ সালে তৎকালীন ইংরেজ গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস ব্যবস্থাটি সংস্কার করার পক্ষে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন_সাধারণ মানুষ জেলা কালেক্টরের কাছ থেকে ন্যায়বিচারের আশা করে না; বরং ভয়েই কাছে ঘেঁষে না। ভারতে বেসামরিক শাসনব্যবস্থার ওপর এক গবেষণামূলক 'সিভিল সার্ভিস ইন ইন্ডিয়া আন্ডার দি ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি' শিরোনামে ইংরেজি ভাষায় লেখা পুস্তকে ১৯৪৪ সালে অক্ষয় কুমার বড়াল লিখেছিলেন, 'নিয়মিত সমালোচনা ও নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ব্যবস্থার অভাবে, সর্বপ্রকার দোষগুণ নিয়ে আমলাদের পরিচালিত শাসনব্যবস্থাটি খুঁটা গেড়েছে। তদুপরি পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা চালু থাকায় আমলাদের কর্মদক্ষতায় উৎসাহ না পাওয়ার কারণে চাকরির ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যম ধরনের মান বজায় রাখার মানসিকতার জন্ম দিয়েছে এবং কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে তাঁরা অনাগ্রহী থাকেন, যদি না সেটা সমাধানে চাপ দেওয়া হয় এবং সে ক্ষেত্রেও সেটা করা হয় সুবিধাবাদীর মানসিকতায়।'
দেখা যাচ্ছে, নিম্ন প্রশাসনিক পর্যায় থেকে বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ত্রুটি অর্থমন্ত্রীর বিবেচনায় ছিল না এবং সে কারণে তিনি খেয়াল করেননি, জনগণ তাদের স্থানীয় উন্নয়নমূলক চাহিদাগুলো বাস্তবায়িত হবে এ আশায় সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিয়ে থাকেন; কিন্তু সেটা বর্তমান আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে যথাযথ কার্যকর করা সম্ভব নয় এবং সেটা সংবিধানপ্রণেতাদের বোধে ছিল। 'নির্বাহী বিভাগ' শিরোনামে বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ ভাগে মোট পাঁচটি পরিচ্ছেদ আছে। এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরিচ্ছেদকে বলা যায় রাষ্ট্রীয় নির্বাহী পরিচালনার তিনটি স্তর। যথা_স্থানীয় শাসন (ভিত্তিস্তর), প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা (মধ্যস্তর) এবং রাষ্ট্রপতি (শীর্ষস্তর); তবে এ স্তরগুলোকে স্বাভাবিক ক্রম বিন্যাসে তৃতীয়, দ্বিতীয় ও প্রথম পরিচ্ছদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্তর তিনটির পরস্পর সম্পর্ক কী হওয়া সঠিক, যা জনগণের আকাঙ্ক্ষাও, তা একটি অতি সরল উপমায় বুঝিয়ে দেওয়া যায়। তিনটি স্তর একত্রে যেন মানবদেহ যন্ত্র_যার মাথা হচ্ছে রাষ্ট্রপতি, হৃৎপিণ্ড-ফুসফুস হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা এবং শিরা-উপশিরা হচ্ছে স্থানীয় শাসন।
এ উপমাটি নড়বড়ে এই যুক্তিতে যে মানবদেহ শুধু একটি যন্ত্রই নয়, সে ক্রিয়াশীল সত্তাও বটে এবং সমষ্টিগত তাদের স্বভাব-চরিত্র ভিন্ন ও বিচিত্রও বটে। তাই নিয়মতান্ত্রিক সংবিধানে অবশ্যই এই প্রতিবিধান জরুরি যেন সমষ্টিগত ব্যক্তি-জনগণের দ্বারা, সমষ্টিগত ব্যক্তি-জনগণের জন্য ও সমষ্টিগত ব্যক্তি-জনগণের কর্তৃত্বে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডগুলো তৈরি ও পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদে স্থানীয় শাসনের নকশা দেওয়া আছে। ৫৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রশাসনিক ইউনিটগুলোকে স্থানীয় শাসনের ভার দেওয়া হবে এবং তাদের (ক) প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কাজ, (খ) জনশৃঙ্খলা রক্ষা ও (গ) অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন বিষয় সংক্রান্ত দায়িত্ব থাকবে। ৬০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন প্রয়োজনে করারোপ করতে পারবে ও বাজেট প্রস্তুতকরণসহ নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে। উল্লেখ্য, ৫৯ অনুচ্ছেদে লিখিত 'প্রশাসনিক ইউনিট' কথাটির ব্যাখ্যায় ১৫২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ৫৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্যসাধনকল্পে আইনের দ্বারা অভিহিত এলাকা। একটি দেশের নাগরিকদের সংসদে প্রতিনিধি নির্বাচিত করার ভোটাধিকারই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শেষ কথা নয়। গণতন্ত্রকে কার্যকর করার সঠিক উপায় হচ্ছে ক্ষমতাকে জনগণের হাতে রাখা পরোক্ষভাবে নয়, প্রত্যক্ষভাবে স্থানীয় শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে।
এখন মূল আলোচনায় আসা যাক। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব নিশ্চয়ই তাঁর দীর্ঘকালের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে উচ্চারিত হয়েছে। এ প্রস্তাবটি পর্যালোচনার ভূমিকা হিসেবে ফিরে যাওয়া যাক, যখন সামরিক শাসনের খপ্পরে পাকিস্তান পড়েনি, কিন্তু পাঞ্জাবি আমলাদের অর্থাৎ আইসিএস ব্যুরোক্র্যাটদের দেশের শাসনব্যবস্থায় প্রবল প্রতিপত্তি ছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং আবুল মনসুর আহমদ বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী। আবুল মনসুর আহমদের লেখা 'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর' বইটি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি : "প্রধানমন্ত্রী নাটকীয় ভঙ্গিতে বলিলেন, 'ইউ টেক হিম অ্যাজ ইউর কমার্স সেক্রেটারি।' আমি ঘাবড়াইয়া গেলাম। মি. আজিজ আহম্মদ শুধু সর্বজ্যেষ্ঠ আইসিএসই নন, মোস্ট স্টিফনেকেড ব্যুরোক্র্যাট বলিয়া তাঁর বদনাম বা সুনাম আছে। মন্ত্রীদের কোনো কথা তিনি শোনেন না। ...যেইসব ব্যাপারে তিনি আমার সাথে একমত হইতেন না, সেইসব বিষয়ে খুব জোরের সঙ্গেই আমার সহিত তর্ক করিতেন। আমাকে অনড় দেখিলে শেষ পর্যন্ত বলিতেন : আমার উপদেশ যা দিবার ছিল, তা দিলাম। আমার কর্তব্য এখানেই শেষ। এরপর আপনি যে আদেশ দিবেন তাই বলবৎ হইবে এবং আমি অক্ষরে অক্ষরে তাই পালন করিব। বস্তুত আমাদের শিক্ষা এবং ব্রিটিশ আমলাতান্ত্রিক ঐতিহ্যই তাই।"
দেখা যাচ্ছে মন্ত্রণালয়ের একজন সচিব যিনি পদোন্নতিপ্রাপ্ত সার্ভিসের লোক হন কিংবা অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত রাজনৈতিক উপদেষ্টা বা সচিব হন, তাঁর কাজ হচ্ছে মন্ত্রীকে বিষয়ভিত্তিক অভিমত দেওয়া এবং সে অভিমতটি একমাত্র সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর বিবেচ্য হতে হবে এবং সেটায় কখনো যদি তাঁরা একমত না হন তা মন্ত্রীর অভিমতের পাশাপাশি বিবেচ্য হবে না। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে এবং সরকারি দলের সদস্য হিসেবে একজন মন্ত্রীর তাঁর মন্ত্রণালয়-সম্পর্কীয় সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত গণ্য করা হয় সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থায়। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্র জনকল্যাণকর তখনই হয়, যখন তার ভিত্তিস্তরে স্থানীয় শাসন বলবৎ থাকে। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবটি আমার মনে দাগ কাটায় উপরোক্ত সংশোধনীগুলো পেশ করলাম।
প্রিয় পাঠক, আশা করি অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবটির পাশাপাশি আমার সংশোধনীগুলো বিবেচনা করবেন। একটি দেশ তখনই উন্নতির স্বর্ণশিখরে পেঁৗছতে পারে, যখন সে দেশে গড়ে ওঠে স্বাধীন ব্যক্তিমানুষ সমন্বয়ে গঠিত ব্যক্তিসমষ্টি এবং সেটা গড়ে ওঠার একটি বাধা হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত আমলা ব্যবস্থা এবং শাসনব্যবস্থায় জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না থাকা।
লেখক : সাবেক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি,
সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ
বাংলাদেশের সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের দুই দফার উদ্ধৃতি দিয়ে অর্থমন্ত্রীর উপরোক্ত প্রস্তাবনাটির পর্যালোচনার কাজটি করা যাক। সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য প্রসঙ্গে সংবিধানে বলা হয়েছে, 'সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।' উপরোক্ত অনুচ্ছেদের দফাটিতে সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য ও আচরণবিধির মূল নীতিটি উল্লেখ করা হয়েছে, যার প্রাণভোমরা তিনটি সহজ প্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে। একটি হচ্ছে যথাযথ ন্যায়পরায়ণ আচরণ অর্থাৎ এমন আচরণ যা আইনের দৃষ্টিতে সন্তোষজনক এবং শারীরিক বলপ্রয়োগ নয়। অন্যটি হচ্ছে নিপীড়নমুক্ত স্বাধীন পরিবেশ, যেন সবাই বিশ্বাস করেন শক্তি দ্বারা নয়, জনগণের অনুমোদনে সরকার পরিচালিত হচ্ছে। অন্যটি হচ্ছে এমন প্রায়োগিক ব্যবস্থা যেন জনগণের অধিকার ও সরকারের ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকে।
বাস্তবে সংবিধানে নির্দিষ্ট আচরণবিধি পালিত হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলের আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাটিই বহাল আছে। এটা যে গণমুখী নয় তা ২০০ বছর আগে ১৭৯৩ সালে তৎকালীন ইংরেজ গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস ব্যবস্থাটি সংস্কার করার পক্ষে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন_সাধারণ মানুষ জেলা কালেক্টরের কাছ থেকে ন্যায়বিচারের আশা করে না; বরং ভয়েই কাছে ঘেঁষে না। ভারতে বেসামরিক শাসনব্যবস্থার ওপর এক গবেষণামূলক 'সিভিল সার্ভিস ইন ইন্ডিয়া আন্ডার দি ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি' শিরোনামে ইংরেজি ভাষায় লেখা পুস্তকে ১৯৪৪ সালে অক্ষয় কুমার বড়াল লিখেছিলেন, 'নিয়মিত সমালোচনা ও নিয়ন্ত্রণ করার কোনো ব্যবস্থার অভাবে, সর্বপ্রকার দোষগুণ নিয়ে আমলাদের পরিচালিত শাসনব্যবস্থাটি খুঁটা গেড়েছে। তদুপরি পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা চালু থাকায় আমলাদের কর্মদক্ষতায় উৎসাহ না পাওয়ার কারণে চাকরির ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যম ধরনের মান বজায় রাখার মানসিকতার জন্ম দিয়েছে এবং কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে তাঁরা অনাগ্রহী থাকেন, যদি না সেটা সমাধানে চাপ দেওয়া হয় এবং সে ক্ষেত্রেও সেটা করা হয় সুবিধাবাদীর মানসিকতায়।'
দেখা যাচ্ছে, নিম্ন প্রশাসনিক পর্যায় থেকে বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ত্রুটি অর্থমন্ত্রীর বিবেচনায় ছিল না এবং সে কারণে তিনি খেয়াল করেননি, জনগণ তাদের স্থানীয় উন্নয়নমূলক চাহিদাগুলো বাস্তবায়িত হবে এ আশায় সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিয়ে থাকেন; কিন্তু সেটা বর্তমান আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে যথাযথ কার্যকর করা সম্ভব নয় এবং সেটা সংবিধানপ্রণেতাদের বোধে ছিল। 'নির্বাহী বিভাগ' শিরোনামে বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ ভাগে মোট পাঁচটি পরিচ্ছেদ আছে। এর মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরিচ্ছেদকে বলা যায় রাষ্ট্রীয় নির্বাহী পরিচালনার তিনটি স্তর। যথা_স্থানীয় শাসন (ভিত্তিস্তর), প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা (মধ্যস্তর) এবং রাষ্ট্রপতি (শীর্ষস্তর); তবে এ স্তরগুলোকে স্বাভাবিক ক্রম বিন্যাসে তৃতীয়, দ্বিতীয় ও প্রথম পরিচ্ছদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্তর তিনটির পরস্পর সম্পর্ক কী হওয়া সঠিক, যা জনগণের আকাঙ্ক্ষাও, তা একটি অতি সরল উপমায় বুঝিয়ে দেওয়া যায়। তিনটি স্তর একত্রে যেন মানবদেহ যন্ত্র_যার মাথা হচ্ছে রাষ্ট্রপতি, হৃৎপিণ্ড-ফুসফুস হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা এবং শিরা-উপশিরা হচ্ছে স্থানীয় শাসন।
এ উপমাটি নড়বড়ে এই যুক্তিতে যে মানবদেহ শুধু একটি যন্ত্রই নয়, সে ক্রিয়াশীল সত্তাও বটে এবং সমষ্টিগত তাদের স্বভাব-চরিত্র ভিন্ন ও বিচিত্রও বটে। তাই নিয়মতান্ত্রিক সংবিধানে অবশ্যই এই প্রতিবিধান জরুরি যেন সমষ্টিগত ব্যক্তি-জনগণের দ্বারা, সমষ্টিগত ব্যক্তি-জনগণের জন্য ও সমষ্টিগত ব্যক্তি-জনগণের কর্তৃত্বে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডগুলো তৈরি ও পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদে স্থানীয় শাসনের নকশা দেওয়া আছে। ৫৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রশাসনিক ইউনিটগুলোকে স্থানীয় শাসনের ভার দেওয়া হবে এবং তাদের (ক) প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কাজ, (খ) জনশৃঙ্খলা রক্ষা ও (গ) অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন বিষয় সংক্রান্ত দায়িত্ব থাকবে। ৬০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন প্রয়োজনে করারোপ করতে পারবে ও বাজেট প্রস্তুতকরণসহ নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে। উল্লেখ্য, ৫৯ অনুচ্ছেদে লিখিত 'প্রশাসনিক ইউনিট' কথাটির ব্যাখ্যায় ১৫২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ৫৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্যসাধনকল্পে আইনের দ্বারা অভিহিত এলাকা। একটি দেশের নাগরিকদের সংসদে প্রতিনিধি নির্বাচিত করার ভোটাধিকারই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শেষ কথা নয়। গণতন্ত্রকে কার্যকর করার সঠিক উপায় হচ্ছে ক্ষমতাকে জনগণের হাতে রাখা পরোক্ষভাবে নয়, প্রত্যক্ষভাবে স্থানীয় শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে।
এখন মূল আলোচনায় আসা যাক। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব নিশ্চয়ই তাঁর দীর্ঘকালের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে উচ্চারিত হয়েছে। এ প্রস্তাবটি পর্যালোচনার ভূমিকা হিসেবে ফিরে যাওয়া যাক, যখন সামরিক শাসনের খপ্পরে পাকিস্তান পড়েনি, কিন্তু পাঞ্জাবি আমলাদের অর্থাৎ আইসিএস ব্যুরোক্র্যাটদের দেশের শাসনব্যবস্থায় প্রবল প্রতিপত্তি ছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং আবুল মনসুর আহমদ বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী। আবুল মনসুর আহমদের লেখা 'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর' বইটি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি : "প্রধানমন্ত্রী নাটকীয় ভঙ্গিতে বলিলেন, 'ইউ টেক হিম অ্যাজ ইউর কমার্স সেক্রেটারি।' আমি ঘাবড়াইয়া গেলাম। মি. আজিজ আহম্মদ শুধু সর্বজ্যেষ্ঠ আইসিএসই নন, মোস্ট স্টিফনেকেড ব্যুরোক্র্যাট বলিয়া তাঁর বদনাম বা সুনাম আছে। মন্ত্রীদের কোনো কথা তিনি শোনেন না। ...যেইসব ব্যাপারে তিনি আমার সাথে একমত হইতেন না, সেইসব বিষয়ে খুব জোরের সঙ্গেই আমার সহিত তর্ক করিতেন। আমাকে অনড় দেখিলে শেষ পর্যন্ত বলিতেন : আমার উপদেশ যা দিবার ছিল, তা দিলাম। আমার কর্তব্য এখানেই শেষ। এরপর আপনি যে আদেশ দিবেন তাই বলবৎ হইবে এবং আমি অক্ষরে অক্ষরে তাই পালন করিব। বস্তুত আমাদের শিক্ষা এবং ব্রিটিশ আমলাতান্ত্রিক ঐতিহ্যই তাই।"
দেখা যাচ্ছে মন্ত্রণালয়ের একজন সচিব যিনি পদোন্নতিপ্রাপ্ত সার্ভিসের লোক হন কিংবা অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত রাজনৈতিক উপদেষ্টা বা সচিব হন, তাঁর কাজ হচ্ছে মন্ত্রীকে বিষয়ভিত্তিক অভিমত দেওয়া এবং সে অভিমতটি একমাত্র সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর বিবেচ্য হতে হবে এবং সেটায় কখনো যদি তাঁরা একমত না হন তা মন্ত্রীর অভিমতের পাশাপাশি বিবেচ্য হবে না। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে এবং সরকারি দলের সদস্য হিসেবে একজন মন্ত্রীর তাঁর মন্ত্রণালয়-সম্পর্কীয় সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত গণ্য করা হয় সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থায়। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্র জনকল্যাণকর তখনই হয়, যখন তার ভিত্তিস্তরে স্থানীয় শাসন বলবৎ থাকে। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবটি আমার মনে দাগ কাটায় উপরোক্ত সংশোধনীগুলো পেশ করলাম।
প্রিয় পাঠক, আশা করি অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবটির পাশাপাশি আমার সংশোধনীগুলো বিবেচনা করবেন। একটি দেশ তখনই উন্নতির স্বর্ণশিখরে পেঁৗছতে পারে, যখন সে দেশে গড়ে ওঠে স্বাধীন ব্যক্তিমানুষ সমন্বয়ে গঠিত ব্যক্তিসমষ্টি এবং সেটা গড়ে ওঠার একটি বাধা হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত আমলা ব্যবস্থা এবং শাসনব্যবস্থায় জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না থাকা।
লেখক : সাবেক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি,
সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ
No comments