মৃত্যুপুরী ত্রিপোলি! by রবার্ট ফিস্ক

অন্তত ১৫ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু লিবিয়ার ত্রিপোলি বিমানবন্দরে অবরুদ্ধ হয়েছিল গতরাতে। তারা কিছু বিমানে আসন পাওয়ার জন্য চিৎকার করছিল। যাদের প্রত্যেকেই মুয়াম্মার গাদ্দাফির এই পশ্চাৎপদ নগরী থেকে বেরিয়ে যেতে উদগ্রীব। আর তারা টিকিট কাউন্টার পর্যন্ত আসতে গিয়ে লিবিয়ার পুলিশদের ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিয়ে এসেছে। তাদের কেউ কেউ আবার লিবিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে নিগৃহীতও হয়েছে।


তাদের মধ্যে অনেকে আছে মুয়াম্মার গাদ্দাফির অনুসারী। তারা মিসরীয়। তারা বিমানবন্দরে দুইদিন ধরে বিনা খাদ্যে দিনাতিপাত করছে। তাদের প্রস্রাব-পায়খানার সুযোগও সীমিত। জায়গাটা প্রস্রাব ও পায়খানার দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে যাওয়ার মতো। বিমানে মাত্র ৪৫ মিনিট দূরত্বে যাওয়ার নগরী এসব মানুষের কাছে এখন স্বপ্নের মতো।
আশপাশে গ্রেট লিডার মুয়াম্মার গাদ্দাফিবিরোধী কাউকে তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। তরুণদের বেশকিছু গ্রুপ সেখানে কালাসনিকভ রাইফেল নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। রাস্তার অদূরে তারা ব্যারিকেড দিয়ে সেখানে বসে আছে। কিন্তু তারা হচ্ছে গাদ্দাফির অনুসারী বাহিনী, 'নেইবারহুড গার্ড'। মাসখানেক আগেও আমি কায়রোতে তাদের দেখেছিলাম। তখনো তাদের জামার বুকে তাদের নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির গ্রিনবুকের ছবি দেখেছিলাম।
ত্রিপোলিতে এখন খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। এটা গ্রিন স্কয়ার থেকে কিছুটা ঢালে। কিন্তু কোনো ট্যাংক, সশস্ত্র কোনো ব্যক্তিকেও দেখা যাচ্ছে না এখানে। কোনো সেনাসদস্যও নেই। আকাশে কোনো যুদ্ধবিমানও চোখে পড়ে না। কয়েকজন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে দেখা যায় সেখানে পদচারণ করছেন। আর দুয়েকজন পুলিশ চোখে পড়ে। পশ্চিমের মানুষের জন্য দুঃখজনকই বলতে হবে, বিশেষ করে বেনগাজিতেও এমন অবস্থা বিরাজ করছে, যা নাকি কোনো স্বৈরশাসকই পছন্দ করতে পারে না।
একধরনের মোহাচ্ছন্ন ভাব বিরাজ করছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। ত্রিপোলির বাইরের অনেক জায়গাতে গাদ্দাফির পক্ষ ও বিপক্ষের শক্তির মধ্যে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত আছে। বিশেষ করে নওফ্রিন জেলায় সরকার পক্ষ গত রবিবার ২৪ ঘণ্টা ধরে মেশিনগান থেকে শুরু করে পিস্তল পর্যন্ত ব্যবহার করছে প্রতিবাদী মানুষের বিরুদ্ধে।
জানা গেছে, অন্তত ৩০ হাজার তুর্কি রাজধানী ত্রিপোলি ত্যাগ করেছে। যাদের সঙ্গে অন্তত ১০ হাজার শ্রমিক রয়েছে। তারা প্রকৌশল শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল। আমি যে বিমানে করে আসছিলাম, সেই বিমানেই কথা হয়েছে জাপানি, জার্মান, ইতালীয়, পোলিশ ও ইউরোপীয় অনেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তাঁরা আমাকে জানিয়েছেন, সপ্তাহকাল আগেই তাঁদের প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন। গাদ্দাফির জন্য দুসংবাদ হচ্ছে, লিবিয়ার সম্পদশালী এলাকা বিশেষ করে ইউরেনিয়াম, তেল ও কেমিক্যাল শিল্পগুলোর প্রায় সবই দক্ষিণে অবস্থিত। গাদ্দাফির ক্ষুধার্ত ত্রিপোলি শুধু পানিসম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে।
সাধারণ মানুষ মনে করে, গাদ্দাফি তো এমনিতেই শেষ হয়ে যাওয়ার পথে। কিন্তু তাঁর ছেলে সাইফ আল ইসলামকে নিয়ে তারা খুবই বিরক্ত। তাদের মতে, সাইফ আল ইসলাম নৃশংসতা ও অমানবিক আচরণের দিক থেকে তাঁর বাবাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে গোটা লিবিয়ায়। কারণটাও স্পষ্ট। আমার সঙ্গে বিমানবন্দরে যাঁদের কথা হয়েছে তাঁদের একজন ছিলেন টোকিওর গাড়ি ব্যবসায়ী। তাঁকে এমনভাবে পেটানো হয়েছে যে তাঁর মাথা ফুলে গেছে।
ত্রিপোলির বিমানবন্দরে আমি কথা বলার পরও আমার চোখে পড়েছে, সেখানে থাকা মানুষগুলোও বলছে, ত্রিপোলির রাজপথে কোনো ট্যাংক নেই। বেনগাজি এবং অন্য কয়েকটি শহরে বিমান হামলা হয়েছে। কিন্তু রাজধানীতেও এখনো তেমন হয়নি। যারা লুটপাট করছে তাদের বিশ্বাস, বেনগাজি ও কয়েকটি শহরে গাদ্দাফির অনাস্থা কার্যকর হওয়াতে প্রমাণ হয়ে গেছে যে তাঁর যুগের অবসান হয়ে গেছে।
নগরের কেন্দ্রস্থল ঘনবসতিপূর্ণ। সেখানকার সব বিদেশি অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক বিমান অফিসগুলোও আছে। বেকারিগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে গাদ্দাফির পরিবারের সদস্যরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। দুইরাত আগে বৈরুত বিমানবন্দরে একটি উড়োজাহাজ অবতরণ করেছিল। তাদের গন্তব্যের বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেই উড়োজাহাজের আট যাত্রীর খবর পেয়ে বৈমানিকরা নাকি যাত্রীদের বহন করতে অস্বীকার করে বসে। গতরাতে গাদ্দাফির মেয়ে আইশাকে নিয়ে একটি উড়োজাহাজ দেশত্যাগ করলেও শেষ গন্তব্যে গিয়ে সে অবতরণ করতে পারেনি। সে গিয়েছিল মাল্টাতে। কিন্তু তাকে সেখানে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
গাদ্দাফির ব্যাপারে মুসলিম অনেক দেশেরও বিরক্তি আছে। তাঁর বিরুদ্ধে সেসব দেশের অভিযোগ হচ্ছে, তিনি ইমাম মুসা সদর নামের শিয়া সম্প্রদায়ের এক নেতাকে খুন করেছেন।
তবে বিমান আসছে, তাদের যাত্রীদেরও অনেকেই মুয়াম্মার গাদ্দাফির অনুসারী। কেউ কেউ তাদের নেতা গাদ্দাফির পক্ষে জিন্দাবাদ ধ্বনিও দিচ্ছে।
লেখক : মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক সংবাদ বিশ্লেষক।
দি ইন্ডিপেনডেন্ট থেকে ভাষান্তর মোস্তফা হোসেইন

No comments

Powered by Blogger.