শিক্ষকতা- স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ও গণতন্ত্রের লড়াই by নাহিদ হাসান

যেসব মেধাবীর চাকরিতে বয়স আছে, তাঁরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরির বেতনকে বেকার ভাতা মনে করেন। সর্বোচ্চ ডিগ্রি থাকার পরও মাধ্যমিক পাসের সনদ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের চাকরি নিচ্ছেন হাসতে হাসতে, কেউ বুকভরা বেদনায়, কেন? কারণ, এখনো সমাজে প্রাইমারির শিক্ষক মানেই সৎ, সহজ-সরল, বোকা ধরনের জীব অথচ বিয়ের বাজারে কদর নেই—বেদনাটা এই জায়গায়।


সংবিধানের দোহাই পেড়ে এত কথা বলছে সবাই অথচ সংবিধানের ২০(১) নম্বর অনুচ্ছেদের ‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে প্রত্যেকে কর্মানুযায়ী—এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন’—এই কথা কেউ বলছেন না।
আমরা দেখি একই ডিগ্রিধারী একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক পাখির মতো কিচিরমিচির স্বভাবের শিশুদের সাত-আট ঘণ্টা পড়িয়ে যে বেতন পান, কলেজশিক্ষক পান দুই-তিন গুণ দুই ঘণ্টা পড়িয়ে। অন্নদাশংকর রায়ের সেই বিখ্যাত ছড়া: ‘তেলের শিশি ভাংলো বলে,/ তোমরা সবাই রাগ করো/ তোমরা যে সব বুড়ো খোকা/ ভারত ভেঙে ভাগ করো, তার বেলা?’ লক্ষ-কোটি টাকা লুটপাট হয় কিন্তু জাতির মেরুদণ্ডের জায়গাটি অবহেলায় পড়ে থাকে। শ্রমিক আর শিক্ষকদের বেলায় কেবল কোষাগারে টান পড়ে।
শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষ কী অর্জন করে? অর্জন করে স্বপ্ন, আত্মমর্যাদা। কিন্তু যে শিক্ষক কোমলমতি শিশুদের মধ্যে মর্যাদাবোধ জাগাবেন, স্বপ্ন ছড়াবেন; সেই শিক্ষকই যদি দেখেন, চার পাশের অন্য পেশাজীবীরা তাঁকে সম্মান করছে না, স্বপ্নগুলো মরে যাচ্ছে, তাঁরই ছাত্ররা পুলিশ হয়ে গরম জল ছুড়ছে; তা হলে আর কী থাকে! কোথায় থাকে স্বপ্ন? আর কোথায় রইল আত্মমর্যাদা! ছাপার হরফের মানুষের চেয়ে চোখের সামনের জীবন্ত আদর্শ শিক্ষকদের দুর্বল অবস্থা দেখে তারা কী শিখবে? এখনো শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে এই ব্যাপারটা দেখা যায়, তাঁরা বড় কর্তাদেরও স্যার বলতে দ্বিধা করেন, তাঁদের ইজ্জতবোধে লাগে, শিক্ষক ছাড়া আর কাউকেই স্যার বলেন না। এ জন্যই বোধ হয় প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার মওলানা ভাসানীকে শ্রমিক-কৃষকের পক্ষে দাঁড়াতে হয় ইতিহাসে।
এখনো সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পণ্ডিত মশাই’ গল্পটি সত্য হয়েই আছে। সাংসদ থেকে শুরু করে মন্ত্রীরা পর্যন্ত বেতন-ভাতা, গাড়ি-বাড়ি বাড়িয়েই চলছেন, তা হলে কই বদলাল স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষকদের অবস্থা? রাষ্ট্রগতভাবে যদি আমরা শিক্ষকদের সম্মানজনক বেতন-ভাতা দিতে অক্ষম হই, সামনে যে ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে, তার জন্য প্রস্তুত থাকা দরকার। রেজি. প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকেরা যখন কাফনের কাপড় পরে শহীদ মিনারে দাঁড়ান, প্রাক্তন ছাত্র পুলিশদের হাতে জলকামানের নিশানা হন, সেই লজ্জা আমরা কোন কাপড়ে ঢাকব?
ম্যাক্সিম গোর্কি প্রসঙ্গ সাহিত্য গ্রন্থে আলাপচারিতায় গোর্কিকে আন্তন চেখভ আজ থেকে ১০০ বছর আগে যা বলেছিলেন, তার কতটা আজও প্রাসঙ্গিক পড়লেই বুঝতে পারব, ‘আমাদের রুশ গ্রামাঞ্চলে ভালো বুদ্ধিমান সুশিক্ষিত শিক্ষকের যে কত প্রয়োজন সে কথা যদি তুমি জানতে। রাশিয়াতে শিক্ষকদের জন্য আমাদের বিশেষ পরিবেশ ও অবস্থা সৃষ্টি করতেই হবে। এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।... শিক্ষককে নিজের কাজকে গভীরভাবে ভালোবাসতে হবে।... আর আমাদের শিক্ষকেরা হলেন অর্ধশিক্ষিত ও উদাসীন। তাঁরা যে মন নিয়ে ছোটদের শেখাতে যান, সেই মন নিয়ে তাঁরা নির্বাসনেও যেতে পারতেন। তাঁরা বুভুক্ষু, নিপীড়িত, জীবিকার পথ রুদ্ধ হওয়ার ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত। অথচ শিক্ষকের হওয়া দরকার গাঁয়ের প্রধান ও সেরা ব্যক্তি। তাঁকে চাষিদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হতে হবে, নিজের শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে চাষিদের মনে তাঁকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা সঞ্চারিত করতে হবে। কেউ যেন তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ন না করে। জনগণের শিক্ষার দায়িত্ব আমরা যাঁর ওপর ন্যস্ত করেছি—খেয়াল কর, জনগণের শিক্ষা—তাঁকে এই রকম তুচ্ছ বেতন দেওয়া এক অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য ব্যাপার। পরনে শত ছিন্ন জামাকাপড়, স্যাঁতসেঁতে জীর্ণ স্কুলঘরে হি হি করে কাঁপছেন, সারাক্ষণ সর্দিকাশি লেগেই আছে, ৩০ না পেরোতেই নানা রোগের পুঁটলি-ল্যারিঞ্জাইটিস, বাত, যক্ষ্মা—এ অসহ্য! আমাদের সবার কলঙ্ক এটা।’
স্বাধীন দেশ পেলাম, এই কলঙ্ক তো ঘুচল না।
মনে আছে, পাকিস্তান আমলে প্রথমে রাষ্ট্রব্যাপী ধর্মঘট ডেকেছিলেন এই স্কুলশিক্ষকেরাই। যে শিক্ষকেরা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই সমাজ সৃজন করেন, ইতিহাস নির্মাণ করেন; তাঁদের জেগে ওঠার সময় হয়েছে।
 নাহিদ হাসান: শিক্ষক, সভাপতি, নদীভাঙন প্রতিরোধ ও চিলমারী নদীবন্দর পুনঃ বাস্তবায়ন গণকমিটি।
nahiduttar@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.