শ্রদ্ধাঞ্জলি- মৃত্যুঞ্জয়ী স্বপ্না রায় by গাজীউল হক

শ্রেণীকক্ষে তিনি যখন প্রবেশ করতেন, সব মুগ্ধতা তাঁকে ঘিরেই থাকত আমাদের। তিনি কক্ষে ঢোকার পর যেন আলো এসে পড়ত আমাদের চোখে। তাঁর আলোর বিচ্ছুরণে আমরা হতাম আলোকিত।


সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর লালসালু পড়াতেন তিনি। ওই উপন্যাসের চরিত্র জমিলার চঞ্চলতা আর প্রতিবাদের কাহিনি তিনি অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরতেন। উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় বাংলা ক্লাসের প্রতি বেশ অনীহা ছিল। কিন্তু তাঁর ক্লাসের দিন শ্রেণীকক্ষ থাকত ঠাসা। এমন গুণী শিক্ষক আর নেই—খবরটা পাওয়ার পর অঝোরে কেঁদেছি। একজন মমতাময়ী শিক্ষকের বিদায় পুরো কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ পরিবারকেই নাড়া দিয়েছে। নাড়া দিয়েছে কুমিল্লা তথা সারা দেশের শিল্প, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষকেও।
বলছিলাম বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখক, কবি, গবেষক, প্রবন্ধকার, ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ড. স্বপ্না রায়ের কথা। গত শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় রাজধানী ঢাকায় হূদেরাগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকে গমন করেন তিনি।
অসম্ভব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন স্বপ্না রায় ছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের তিন দশকের জনপ্রিয় বাংলা শিক্ষক। তাঁর উপস্থাপনা, শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের বাচনভঙ্গি ছিল নান্দনিক। বৈচিত্র্যময় পাঠদান করে তিনি যুগের পর যুগ শিক্ষার্থীদের কাছে সেরা শিক্ষকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। অনিন্দ্যসুন্দরী চিরসবুজ ওই শিক্ষক অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে বরাবরই ছিলেন আপসহীন। দায়িত্ববোধ নিয়েই তিনি পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পরামর্শ দিতেন। শিক্ষার্থীরাই ছিল তাঁর প্রাণ।
১৯৫০ সালের ২৫ আগস্ট স্বপ্না রায় কুমিল্লা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালা, কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৭৩ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ২০০৭ সালে তিনি ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ হন। এরপর তিনি সেখান থেকেই অবসরে যান। অবসরের পর তিনি নিতান্তই প্রয়োজন ছাড়া কোথাও বের হতেন না। অনেকটা অন্তঃপুরেই থাকতেন। বড় অভিমানী ছিলেন তিনি। ব্যক্তিসত্তায় আঘাত লাগায় নব্বইয়ের দশক থেকে তিনি নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতেন। সারা জীবন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেকে আবদ্ধ রেখেছেন। তাঁর বাবা ননী গোপাল রায়ও (এন জি রায়) ছিলেন জনপ্রিয় শিক্ষক। স্বপ্না রায়ের স্বামী করুণ কুমার দেব গত হয়েছেন বছর খানেক আগে। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর লাকসামে সাংবাদিকতা করতেন। তাঁদের একমাত্র ছেলে সাগর একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করেন।
শেষবার কুমিল্লায় এলেন স্বপ্না রায়, ২০০৯ সালের জুলাই মাসে। অধ্যক্ষ সুবীরকুমার চক্রবর্তী স্মারকগ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে। কুমিল্লা ক্লাবে উঠলেন। আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষমাণ আমাকে দেখে স্মিত হাসি দিয়ে বললেন, ‘তোর লেখা নিয়মিত পড়ি। ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করে লিখিস। অবক্ষয়ের এই সময়ে অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরতে হবে। তা না হলে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ এরপর তাঁর সঙ্গে দুপুরের খাবার, ম্যারাথন আড্ডা হলো। বললাম, কুমিল্লায় বড় অনুষ্ঠান হলে আপনাকে আসতে হবে। তিনি বললেন, ‘আমি নেহাত প্রয়োজন না হলে কোথাও যাই না রে...। তার পরও আয়োজন কর, দেখি...।’ এর পরের সবকিছুই তো আমরা জানলাম। শুক্রবার সন্ধ্যার আগে স্মৃতি-বেদনার আরেক নামে নিজেকে জড়ালেন তিনি।
স্বপ্না রায় তাঁর সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। দেশের প্রথম শ্রেণীর প্রগতিশীল সংবাদপত্রের সাহিত্য সাময়িকীতে তাঁর লেখা গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও কবিতা সাহিত্যপ্রেমীদের নজর কেড়েছে। সঞ্চিতা স্বপ্নেভ্রূণ, সবচেয়ে কষ্টের নাম, চোখের পাতায় লঙ্কা গুঁড়ো এবং নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত গবেষণাগ্রন্থ নজরুলের দৃষ্টি ও সৃষ্টি কাব্যগ্রন্থ তাঁর রচিত। গানের গলাও ছিল তাঁর বেশ। ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে বিতর্ক পরিষদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা, কর্মস্পৃহা আর ভালো কিছু করার চেষ্টা ছিল অহর্নিশ।
কোনো কিছুর প্রতি তাঁর মোহ ছিল না। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে তাঁর প্রাক্তন শিক্ষার্থী ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল আউয়াল মজুমদার। তাঁর মতে, ‘স্বপ্না রায়ের পদের প্রতি কোনো মোহ না থাকায় তাঁকে ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত করি। কৈশোরে তিনি আমাদের বাংলা পড়াতেন। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত পাঠদান আমাকে আপ্লুত করায় কর্মজীবনে এসে প্রিয় শিক্ষককে সম্মান জানাতে পেরে নিজেই সম্মানিত বোধ করেছি।’ কুমিল্লার বিশিষ্ট সংস্কৃতিকর্মী দিলনাশি মোহসেন জানান, কুমিল্লার ‘নবধারা’ সাংস্কৃতিক সংগঠনের নাম দিয়েছেন স্বপ্না রায়। তাঁর চেহারার সঙ্গে অন্তরের সৌন্দর্যের মিল ছিল বেশ। ভেতরে-বাইরে তিনি এক ও অদ্বিতীয়। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কুন্ডু গোপীদাস বলেন, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর।
স্বপ্না রায় কেবল গুণী শিক্ষক কিংবা সাহিত্য অন্তঃপ্রাণ ব্যক্তিই ছিলেন না, ছিলেন ভালো একজন মানুষও। তাঁর প্রতি রইল অতল শ্রদ্ধা।
গাজীউল হক
gajiulhoqsohag@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.