ইইউর নোবেল শান্তি পুরস্কার ২০১২ প্রাপ্তির যৌক্তিকতা কতটুকু? by ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান

এক. গত ১২ অক্টোবর ২০১২ নরওয়ের রাজধানী অসলোতে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) ছয় দশক ধরে ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়।


নোবেল কমিটি বলেছে, ইইউ ইউরোপকে 'একটি যুদ্ধের মহাদেশ থেকে শান্তির মহাদেশে' রূপান্তরিত করতে সাহায্য করেছিল। এ পুরস্কারটি এমন একসময় দেওয়া হলো, যখন ইইউ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংকট মোকাবিলা করছে, এর অনেক সদস্যরাষ্ট্র অর্থনৈতিক মন্দা আর সামাজিক অস্থিরতায় নাভিশ্বাস ফেলছে। পুরস্কার ঘোষণার সময় নোবেল কমিটির প্রেসিডেন্ট থোরবজোয়ের্ন জাগল্যান্ড অবশ্য ইইউর সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সমস্যা এবং সামাজিক সংকটের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি বলেন, পুরনো বিবাদ মিটিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে ১৯৪৫ সাল থেকে ইইউর উদ্যোগের সাফল্য একটি বাস্তবতা। কমিটি মূলত 'শান্তি ও বিরোধ নিষ্পত্তি এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার' বিষয়ে গত ছয় দশকে ইইউর ভূমিকার ওপরই মনোনিবেশ করেছে। কিন্তু তার এরূপ বক্তব্যের পরও বিশ্বজুড়ে ইইউর নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে মতামত প্রদান অব্যাহত রয়েছে।
দুই. মূলত ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত ২৭টি সদস্যরাষ্ট্রের এক অনন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইউনিয়ন হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ। এর ডি ফ্যাক্টো রাজধানী ব্রাসেলস। এটি পরিচালিত হয়ে থাকে একটি অধিজাতিক স্বাধীন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এবং সদস্যরাষ্ট্রগুলোর আন্তসরকারি সমঝোতায় গৃহীত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। ইইউর প্রধান কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হলো : ইউরোপিয়ান কমিশন, কাউন্সিল অব ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইউরোপিয়ান কাউন্সিল, কোর্ট অব জাস্টিস অব ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট এবং ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ইউরোপের নাগরিকরা ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্যদের নির্বাচন করে থাকেন। ইইউর জন্মের সঙ্গে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ইতালি, লুঙ্মেবার্গ, নেদারল্যান্ডস ও পশ্চিম জার্মানির উদ্যোগে ১৯৫১ সালে ইউরোপিয়ান কোল অ্যান্ড স্টিল কমিউনিটি (ইসিএসসি) গঠন করে। ১৯৫৭ সালে এই ছয়টি রাষ্ট্র রোম চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা আগের সহযোগিতাকে সম্প্রসারিত করে ১৯৫৮ সালে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি (ইইসি) ও ইউরোপিয়ান অ্যাটমিক এনার্জি কমিউনিটি (ইউরাটম) গঠিত হয়। ইসিএসসি, ইইসি ও ইউরাটম_এই তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ইইউ-ত্রয়ী বলা হয়। যা-ই হোক, পরে সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইইউর আয়তন বেড়ে যায় এবং এটি পলিসির ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করে আরো ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে। ১৯৯৩ সালে মাস্ট্রিখট চুক্তি সম্পাদনের পর থেকে বর্তমান ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নামে পরিচিতি লাভ করে। ২০০৯ সালে লিসবন চুক্তির মাধ্যমে এটির সংবিধান সংশোধিত হয়। বর্তমানে ইইউ একটি স্ট্যান্ডার্ডাইজড আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি একক বাজার সৃষ্টি করেছে। এই ব্যবস্থার আওতায় শেনজেন অঞ্চলের অর্থাৎ ২২ ইউ রাষ্ট্র ও চারটি ইইউ-বহির্ভূত রাষ্ট্রের পাসপোর্টের নিয়ন্ত্রণ বিলোপ করা হয়েছে। ইইউর অন্যতম নীতি হলো মানুষ, পণ্য, সেবা ও পুঁজির অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা; ন্যায়বিচার ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আইন প্রণয়ন করা এবং বাণিজ্য, কৃষি, মৎস্য ও আঞ্চলিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সাধারণ নীতি বহাল রাখা। ১৯৯৯ সালে অভিন্ন মুদ্রা 'ইউরো' চালুর মাধ্যমে ইইউ ১৭টি সদস্যরাষ্ট্রের সমন্বয়ে ইউরোজোন নামে একটি মুদ্রা ইউনিয়ন গঠন করেছে। অভিন্ন বৈদেশিক ও নিরাপত্তা নীতি গ্রহণ করে ইইউ বৈদেশিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে নিজের একটি ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইইউ স্থায়ী কূটনৈতিক মিশন প্রতিষ্ঠা করেছে। জাতিসংঘ, ডাব্লিউটিও, জি-৮, জি-২০-তে ইইউর প্রতিনিধি রয়েছে। মাত্র ৫০ কোটি জনসংখ্যা-সমৃদ্ধ ইইউর জিডিপি ২০১১ সালে ছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ তথা ১৭.৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তিন. ইইউর নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্তিকে যৌক্তিক মনে করে মি. জাগল্যান্ড বলেন, ইইউর প্রচেষ্টার কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিগত দশকগুলোয় ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যকার বৈরিতার স্থলে বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে এবং সত্তরের দশকে তাদের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের পর স্পেন, পর্তুগাল ও গ্রিসকে ইইউ তার অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাঁর মতে, ক্রোয়েশিয়া ইইউর সদস্যপদ প্রাপ্তির খুব কাছাকাছি রয়েছে। বর্তমানে ইইউর শান্তি প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম বলকান দেশগুলোয় সম্প্রসারিত হয়েছে। তুরস্কের ইইউর সদস্যপদ প্রাপ্তির সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল। সংস্থাটি সে দেশে 'গণতন্ত্র বিকাশে ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা'য় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হ্যারমেন ভ্যান রমপাই মন্তব্য করেন, 'ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী' হিসেবে ইইউ এই স্বীকৃতি পেল। আবার ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট জোসে ম্যানুয়েল ব্যারোসো উল্লেখ করেন, এটি একটি 'বিশাল সম্মান'। তিনি আরো বলেন, 'নোবেল কমিটি ইইউ'কে পুরস্কার ঘোষণা করে বলেছে যে ইউরোপিয়ান প্রজেক্টকে ইউরোপ ও ইউরোপের বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই প্রশংসা করা উচিত। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জন্য এটি যৌক্তিক। কারণ এটি শান্তি প্রতিষ্ঠায় স্বীকৃতি লাভ করেছে শুধু মহাদেশটির একত্রীকরণের জন্য নয়, বরং ইউরোপের বাইরেও শান্তির পথ প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্যও।' জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল বলেন, তিনি এই নোবেল প্রাপ্তিকে বিগত ছয় দশক ধরে ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি 'ব্যক্তিগত প্রণোদনা' হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি বলেন, 'আমরা কখনোই ভুলে যাব না যে শান্তি, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য আমাদের আরো বেশি বেশি কাজ করে যেতে হবে।' ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কোই হল্যান্ডের বলেন, 'আমরা সম্মানিত ও গর্বিত। সেই সঙ্গে এখন আমাদের সামনে অনেক দায়িত্ব রয়েছে।'
চার. ইইউর নোবেল শান্তি পুরস্কারের বিপক্ষে কঠোর যুক্তি তুলে ধরে ব্রিটেনের ইনডিপেনডেন্ট পার্টির নেতা নিজেল ফারাজে বলেন, 'স্নায়ুযুদ্ধ ছিল ন্যাটো ও পরমাণু যুদ্ধ নিরোধক বিষয়। প্রকৃত সত্য হলো, ১৯৯২ সালে পুরোপুরিভাবে তৈরি হওয়ার আগে ইইউর পক্ষে রাশিয়ার আগ্রাসন মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে কিছু করার ছিল না। আজ ইইউ জাতিরাষ্ট্র ভিত্তিক গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে। ইউরোজোন, ইউরোপের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা তৈরির পরিবর্তে, ইউরোপকে উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত করেছে; ইউরোপের রাস্তায় রাস্তায় এখন সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। আমার মতে, আমরা একটি বিপজ্জনক পথে পা বাড়িয়েছি। বলকান অঞ্চলের দিকে তাকিয়ে দেখুন, ১৯২০ সালে জরাজীর্ণ ধারণা নিয়ে আমরা কয়েকটি স্বতন্ত্র জাতিরাষ্ট্র না হতে দিয়ে যুগোশ্লাভিয়ার পতাকার অধীনে একত্র করেছিলাম। এটি যেমন ভয়াবহ পরিণতি ডেকে এনেছিল, ইইউ দুঃখজনকভাবে সেই ট্র্যাজিক ভুলটিই এখন সেখানে করছে।' ইইউর আরেক সমালোচক, লন্ডনভিত্তিক ওপেন ইউরোপ থিঙ্কট্যাঙ্কের পরিচালক, ম্যাটস পারসন বলেন : 'ইইউর মাধ্যমে ফ্রান্স-জার্মান সম্পর্ক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে_এটি ইউরোপের জন্য ইতিবাচক দিক। কিন্তু ইউরোপ তো ফ্রান্স-জার্মান অক্ষশক্তির চেয়ে অনেক বড় বিষয়। কূটাভ্যাস হচ্ছে, আদর্শ দ্বারা পরিচালিত অপরিপক্ব ইউরো এই মহাদেশের কয়েকটি রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গ্রিস, স্পেন ও পর্তুগালের বিরোধপূর্ণ অভ্যন্তরীণ রাজনীতির উন্নয়নে ইইউকে ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। কিন্তু ইইউর ত্রয়ী প্রতিষ্ঠান ও ইউরোপিয়ান কমিশনের মাধ্যমে সেখানকার জনগণের মধ্যে ইউরো এখন যন্ত্রণার কারণ হয়েছে। ইইউর এঙ্টারনাল অ্যাকশন সার্ভিস (ইএএস) ইরান ও বলকান অঞ্চলে অনুমোদন দানের মতো কিছু ভালো কাজ করেছে, কিন্তু বসনিয়ার যুদ্ধে মার্কিনিদের হস্তক্ষেপের সুযোগ দিয়েছিল এবং আরব আলোড়নের শুরুর দিকে ইইউ ভুল অবস্থান নিয়েছিল। সামনে তুরস্ক বড় ইস্যু হিসেবে আসবে_দেশটি ইউরোপের দিকে না এসে পূর্বদিকে সরে গেলে ভবিষ্যতে অনেক বড় সমস্যার সৃষ্টি হবে।'
পাঁচ. ইইউর নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে খোদ ইউরোপের নেতাদের বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। প্রথমত, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন একটি শান্তি প্রকল্প। ইইউকে পুরস্কারটি এমন একসময়ে দেওয়া হয়েছে, যখন ইউরোর ব্যর্থতার কারণে ইইউ তার আস্থার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন অবস্থায় রয়েছে। দ্বিতীয়ত, বলকান অঞ্চলের শান্তি ফিরিয়ে আনার বিষয়টি ইইউর আওতাধীন, তাই প্রশ্ন করা যায়, যদি ইইউ না থাকত তাহলে সেখানে এখন কে উদ্যোগ নিত? এরূপ একটি বিরোধপূর্ণ ভূখণ্ডে ইইউই একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যার মাধ্যমে ব্যাপকভিত্তিক শান্তি-প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনো পারত না। তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক বিরোধ সমাধানে ফ্রান্স ও জার্মানি এখন আর যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। আগের শতাব্দীগুলোয় করলেও ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের মাধ্যমে এসবের মীমাংসা হয়েছে। চতুর্থত, ইউরোপে ন্যাটো শুধু সামরিক জোট, সেটি প্রতিষ্ঠান গঠনে কাজে আসে না; ইইউর বেলায় যা প্রযোজ্য নয়। পঞ্চমত ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ইইউ তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে জাতি, রাষ্ট্র বা জাতিরাষ্ট্রের সীমা অতিক্রম করে পলিটি গঠন করলে এবং সেখানে মানুষ, পণ্য, সেবা ও পুঁজির অবাধ প্রবাহ সৃষ্টি করলে মানবজাতি যুদ্ধের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বিসিএস শিক্ষা

No comments

Powered by Blogger.