গাইতে গিয়ে গান
রিকশায় আমরা পাশাপাশি বসে। সে আমার হাত ধরে আছে, আমার একান্ত প্রিয়জন, যাকে নিয়ে আর কিছুদিন পর আমি সুখের ঘর বাঁধব। আকাশে গোল থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ। জীবনটাকে বড় সুখের মনে হচ্ছিল।
কিন্তু হঠাৎ করেই আমার সুখের ঘুড়িটা কাটা গেল। প্রেমিকা খুব কোমল গলায় আমাকে অনুরোধ করতে লাগল একটা গান গাওয়ার জন্য। রিকশাওয়ালাও বেশ রসিক। সেও বলতে লাগল, ‘স্যার, শুনায় দেন না একটা গান।’
আমার মনে হলো চাঁদটাকে মেঘেরা গিলে খাচ্ছে। মনের ভেতর ঝড়ের পূর্বাভাস। ভবিষ্যতের সর্বনাশ তো আছেই, আমি সেটা ভুলে অতীতে ঘুরতে গেলাম।
কলেজজীবনে হোস্টেলে থাকার সময় আমার গান খুব বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল। একবার ডাইনিং হলে গান গাওয়াতে ১০টা প্লেট ভেঙে গিয়েছিল। তারপর আমাকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হলো আমি যেন ভুলেও কখনো ‘গান’ নামক অস্ত্রটা না বের করি।
সবাই অন্তত বাথরুমে গান গেয়ে হলেও জীবনে সংগীতচর্চার আনন্দটা পাই। আমি বাথরুমে গান গাইলে কলে পানি আসা বন্ধ হয়ে যেত। সোপকেস থেকে সাবান পড়ে যেত। এ কারণে বাসায় বা হোস্টেলে কখনো ‘বাথরুম সিঙ্গার’ হওয়ারও সাহস পাইনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর একবার এক অনুষ্ঠানের জন্য গান গাওয়ার তালিকায় নাম দিলাম। অনুষ্ঠানের নির্বাচনপর্বে একটা পল্লিগীতি শুরু করলাম। গান শেষ হওয়া পর্যন্ত সবাই চুপ করেই থাকল। তবলাবাদকের চোখে দেখলাম পানি। নির্বাচকদের একজন বলে উঠলেন, ‘তোমার কণ্ঠ কোকিলের কুহুতান, তা নয়; কাকের কর্কশ ডাক, তা-ও নয়; মৌমাছির গুঞ্জন নয়; ফেরিওয়ালার ভোরবেলার হাঁক, তা-ও নয়; জ্যামে পড়া গাড়ির হর্ন নয়; সাত সুরের সমাহার নয়, মেশিনগানের গুলিবর্ষণ, তা-ও নয়; তবে যাই বলি বাবা, এটা কোনোভাবেই গান নয়।’ এক বন্ধু হেসে বলল, ‘দোস্ত, তোর আবৃত্তিটা অসাধারণ ছিল। আবৃত্তির সেকশনে নাম দিয়ে দিচ্ছি।’ শুধু এই নয়, কারও রুমে যদি তেলাপোকা, ইঁদুর বেশি থাকত, তবে আমাকে ডাকা হতো। আমি ওই রুমে দাঁড়িয়ে গান গাইতাম। একটা নজরুলগীতি গাইলে তেলাপোকা, ইঁদুর সবগুলো বেরিয়ে আসত। তারপর একটা রবীন্দ্রসংগীত গাইলে সবগুলো চলে যেত। এরপর একটা আধুনিক গান গাইতাম আমি রুমের দরজায় এসে, এতে পোকা, ইঁদুরগুলো হোস্টেল থেকে দৌড় দিত। আমাকে দুই বেলা ভরপেট খাইয়ে দিত রুমের মালিকেরা।
এই আমি যদি প্রেমিকার অনুরোধে আমার গলায় সুর তুলতে যাই, তা হলে সম্পর্ক তো পটোল তুলবেই। কিন্তু প্রেমিকা বেচারি অনুরোধ করেই যাচ্ছে। কী করে বোঝাই ওকে যে অফিসে বেতন দিতে দেরি করায় আমাকে পাঠানো হয়েছিল তাকে গান শোনাতে। বস ‘আর কখনো তুমি আমাকে খুনের চেষ্টা করবে না’ বলে আমার বেতন দিয়ে দিয়েছিল।
এর পরও যখন ও গাল ফুলিয়ে অনুরোধ করেই যাচ্ছে, তখন ওকে মনে মনে চিরবিদায় জানিয়ে আমি গান গাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এর মধ্যে রিকশা হঠাৎ থামিয়ে দিল পিস্তলধারী দুজন যুবক। অবধারিতভাবেই আমাদের সবকিছু তারা নিজেদের বলে দাবি করে সেগুলো নিয়ে নিতে চাইল। প্রেমিকা আমার হাত এক হাতে ধরে আরেক হাতে তার ব্যাগটা এগিয়ে দিচ্ছিল। আমি ওই মুহূর্তে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলাম। পিস্তলধারী দুজন কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে উল্টো দিকে দৌড় দিল।
আমার গানের প্রতিক্রিয়া দেখে প্রেমিকাও খুশিতে বাগ বাগ। তবে সে কথা দিল আর কখনো এভাবে আমাকে গান গাওয়ার অনুরোধ করবে না।
সৃজনী আহমেদ
মিরপুর, ঢাকা
আমার মনে হলো চাঁদটাকে মেঘেরা গিলে খাচ্ছে। মনের ভেতর ঝড়ের পূর্বাভাস। ভবিষ্যতের সর্বনাশ তো আছেই, আমি সেটা ভুলে অতীতে ঘুরতে গেলাম।
কলেজজীবনে হোস্টেলে থাকার সময় আমার গান খুব বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল। একবার ডাইনিং হলে গান গাওয়াতে ১০টা প্লেট ভেঙে গিয়েছিল। তারপর আমাকে কড়া নির্দেশ দেওয়া হলো আমি যেন ভুলেও কখনো ‘গান’ নামক অস্ত্রটা না বের করি।
সবাই অন্তত বাথরুমে গান গেয়ে হলেও জীবনে সংগীতচর্চার আনন্দটা পাই। আমি বাথরুমে গান গাইলে কলে পানি আসা বন্ধ হয়ে যেত। সোপকেস থেকে সাবান পড়ে যেত। এ কারণে বাসায় বা হোস্টেলে কখনো ‘বাথরুম সিঙ্গার’ হওয়ারও সাহস পাইনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর একবার এক অনুষ্ঠানের জন্য গান গাওয়ার তালিকায় নাম দিলাম। অনুষ্ঠানের নির্বাচনপর্বে একটা পল্লিগীতি শুরু করলাম। গান শেষ হওয়া পর্যন্ত সবাই চুপ করেই থাকল। তবলাবাদকের চোখে দেখলাম পানি। নির্বাচকদের একজন বলে উঠলেন, ‘তোমার কণ্ঠ কোকিলের কুহুতান, তা নয়; কাকের কর্কশ ডাক, তা-ও নয়; মৌমাছির গুঞ্জন নয়; ফেরিওয়ালার ভোরবেলার হাঁক, তা-ও নয়; জ্যামে পড়া গাড়ির হর্ন নয়; সাত সুরের সমাহার নয়, মেশিনগানের গুলিবর্ষণ, তা-ও নয়; তবে যাই বলি বাবা, এটা কোনোভাবেই গান নয়।’ এক বন্ধু হেসে বলল, ‘দোস্ত, তোর আবৃত্তিটা অসাধারণ ছিল। আবৃত্তির সেকশনে নাম দিয়ে দিচ্ছি।’ শুধু এই নয়, কারও রুমে যদি তেলাপোকা, ইঁদুর বেশি থাকত, তবে আমাকে ডাকা হতো। আমি ওই রুমে দাঁড়িয়ে গান গাইতাম। একটা নজরুলগীতি গাইলে তেলাপোকা, ইঁদুর সবগুলো বেরিয়ে আসত। তারপর একটা রবীন্দ্রসংগীত গাইলে সবগুলো চলে যেত। এরপর একটা আধুনিক গান গাইতাম আমি রুমের দরজায় এসে, এতে পোকা, ইঁদুরগুলো হোস্টেল থেকে দৌড় দিত। আমাকে দুই বেলা ভরপেট খাইয়ে দিত রুমের মালিকেরা।
এই আমি যদি প্রেমিকার অনুরোধে আমার গলায় সুর তুলতে যাই, তা হলে সম্পর্ক তো পটোল তুলবেই। কিন্তু প্রেমিকা বেচারি অনুরোধ করেই যাচ্ছে। কী করে বোঝাই ওকে যে অফিসে বেতন দিতে দেরি করায় আমাকে পাঠানো হয়েছিল তাকে গান শোনাতে। বস ‘আর কখনো তুমি আমাকে খুনের চেষ্টা করবে না’ বলে আমার বেতন দিয়ে দিয়েছিল।
এর পরও যখন ও গাল ফুলিয়ে অনুরোধ করেই যাচ্ছে, তখন ওকে মনে মনে চিরবিদায় জানিয়ে আমি গান গাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এর মধ্যে রিকশা হঠাৎ থামিয়ে দিল পিস্তলধারী দুজন যুবক। অবধারিতভাবেই আমাদের সবকিছু তারা নিজেদের বলে দাবি করে সেগুলো নিয়ে নিতে চাইল। প্রেমিকা আমার হাত এক হাতে ধরে আরেক হাতে তার ব্যাগটা এগিয়ে দিচ্ছিল। আমি ওই মুহূর্তে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলাম। পিস্তলধারী দুজন কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে উল্টো দিকে দৌড় দিল।
আমার গানের প্রতিক্রিয়া দেখে প্রেমিকাও খুশিতে বাগ বাগ। তবে সে কথা দিল আর কখনো এভাবে আমাকে গান গাওয়ার অনুরোধ করবে না।
সৃজনী আহমেদ
মিরপুর, ঢাকা
No comments