পরিকল্পিতভাবেই জনদুর্ভোগ দূর করতে হবে by এ কে এম শাহনাওয়াজ
একটি জনকল্যাণকামী সরকারের প্রধান কাজ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে জনগণের আশ্রয় হয়ে পাশে দাঁড়ানো। গণমানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। জনজীবনে দুভাবে দুর্ভোগ দেখা দিতে পারে।
একটি হচ্ছে কার্যকারণ সূত্রে আগে থেকে অনুমিত দুর্ভোগ। আর অন্যটি দৈবাৎ ঘটে যাওয়া দুর্ভোগ। যেকোনো সরকারের জন্য খুব সহজ আগে থেকে অনুমিত দুর্ভোগের মোকাবিলা করা। আবার জনকল্যাণে ব্রতী সরকার দূরদর্শিতা দিয়ে দৈবাৎ দুর্ভোগেরও প্রতিবিধানে ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের ধর্মীয় উৎসবগুলো ক্যালেন্ডারের তারিখ মেনেই বছর ঘুরে নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। তাই এসব উৎসব যাতে নির্বিঘ্নে দেশবাসী উদ্যাপন করতে পারে, যাতে কোনো রকম দুর্ভোগের শিকার না হয়, উৎসব-সংশ্লিষ্ট মানুষের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখা যায় এর জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো প্রায় এক বছর সময় পায়। এ কারণে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে উৎসবের আগে মাননীয় মন্ত্রীদের ঘর্মাক্ত হতে হয় না। কর্মকর্তাদের ছোটাছুটি করতে হয় না। সাধারণ মানুষকে নানা রকম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয় না। তার পরও আমাদের গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণকামী সরকারগুলো খুব কম সময়েই সফল হয়।
প্রতিবছরই রমজানের ঈদের আগে সড়কপথের বেহাল অবস্থা নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রীদের ছোটাছুটি করতে হয়। সারা বছরই বেহাল অবস্থা থাকে। যেহেতু সারা বছর এই পথে যারা চলাচল করে তাদের বেশির ভাগই বাংলাদেশের মানুষ তাই মন্ত্রীদের এই ছোটাছুটি যে জনকল্যাণে, তা বলা যাবে না। ছোটাছুটির বড় কারণ ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের চাপ অনেক বেশি থাকে, তাই দুর্ভোগটা সাধারণ্যে অনেক বেশি দৃশ্যমান হবে। মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হবে। মিডিয়ায় নানাভাবে প্রচার পাবে। তাই জনগণকে কষ্ট দিয়ে জনগণের টাকার বড় রকমের অপচয় করে জোড়াতালির সড়ক মেরামত করা হয়। গত রমজানে এ ধরনের জোড়াতালির কাজ করা হয়েছে দেশের নানা অঞ্চলে। সে সময়ের একটি লেখায় আমি উদাহরণ টেনেছিলাম, সাভার থেকে নবীনগর পর্যন্ত এলাকার মানুষ যদি আশুলিয়া হয়ে উত্তরা বা টঙ্গীর দিকে যেতে চায়, তবে তাদের দুটো লিংকরোড রয়েছে। একটি বিশমাইল থেকে ক্যান্টনমেন্টের পাশ দিয়ে জিরাবো পর্যন্ত, আরেকটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বিপিএটিসির কাছে সিঅ্যান্ডবি পয়েন্ট থেকে ডেইরি ফার্মের পাশ দিয়ে আশুলিয়া পর্যন্ত। প্রতিটি সাত-আট কিলোমিটারের পথ। উভয় রাস্তার পাশে রয়েছে নানা ধরনের শিল্প-কারখানা। কিন্তু বছর ধরেই উভয় রাস্তা ছোট-বড় গর্ত আর খানাখন্দে ভরা থাকে। এ পথে ছোট গাড়ি চালানো রীতিমতো বিপজ্জনক। সড়কের অবস্থা দেখে মনে হয় এটি সরকারের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত এলাকা।
গত রমজান মাসে দেখা গেল, যোগাযোগমন্ত্রীর উদ্যোগে দেশজুড়ে মেরামতির হাওয়া এই দুই সড়কেও পড়েছিল। ইটের খোয়া ও বালু দিয়ে গর্ত ভরাট করে যান চলাচলে কিছুটা স্বস্তি আনা হয়েছিল। নির্মাণ মান ও পদ্ধতি দেখে আমি সে সময় আমার একটি লেখায় মন্তব্য করেছিলাম, ঈদের আগে দু-একদিন বৃষ্টি হলে ঈদ পার করতে পারবে না সরকার। দুর্ভাগ্যক্রমে ঘটেছিলও তাই। বৃষ্টিভেজা জোড়াতালিতে ভারী যানবাহনের চাকার চাপে গর্তগুলো আবার উন্মোচিত হয়েছিল ঈদের আগেই। আর এই কোরবানির ঈদের আগে তো তা ব্ল্যাকহোলে রূপান্তরিত হয়েছে। এসব কারণে সচেতন মানুষের প্রশ্ন থেকে যায়- কী রহস্য রয়েছে সময়মতো মানসম্মত সংস্কার বা নির্মাণ না করে ঈদের আগের তড়িঘড়ি কাজ করার মধ্যে?
কোরবানির ঈদ সামনে রেখেও তো জনকল্যাণের প্রয়োজনে কয়েকটি পদক্ষেপ অনেক আগে থেকেই সরকার নিতে পারে। যেমন- সড়কপথের ভয়াবহ যানজটের সংকট কমিয়ে আনা। ক্রেতাসাধারণ, পশু ও চামড়া ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। মসলার বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। এসব বিষয় সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য সরকার পুরো এক বছর সময় হাতে পায়। কিন্তু এর সদ্ব্যবহার কি সরকার করতে পারে বা চায়?
এই কোরবানির ঈদের কথাই ধরা যাক। ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ নানা সড়ক-মহাসড়কে তীব্র যানজটের কথা তথ্যমাধ্যম জানিয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে ছিল যাত্রীবাহী বাস, পণ্য ও পশুবাহী ট্রাক। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, আবার রাস্তার বেহাল দশা, নানা নামের সরকারদলীয় চাঁদাবাজ ও পুলিশি চাঁদা আদায় করতে গিয়ে পশুবাহী ট্রাক আটকে দেওয়া। প্রশাসনের নির্দেশ অমান্য করে স্থানীয় সরকারদলীয় মাস্তান কর্তৃক সড়কের পাশে যত্রযত্র পশুর হাট বসিয়ে যানজটকে আরো প্রলম্বিত করা। এসব দুর্বলতা ও অন্যায় মোকাবিলা করে জনগণকে স্বস্তি দেওয়ার কথা ছিল সরকারের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকার কি সাফল্য দাবি করতে পারে?
সরকারের অদূরদর্শিতার কারণে প্রায় বছরই পশুর হাটে পশু ব্যবসায়ী বা ক্রেতাসাধারণ গভীর সংকটে পড়ে। গেল বছর কোরবানি ঈদের আগের দিন ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে তীব্র পশু সংকট দেখা দিয়েছিল। তাই স্বল্পসংখ্যক পশু যাদের হাতে ছিল তারা তিন-চার গুণ দামে তা বিক্রি করেছে। অনেক ক্রেতা পশুর অভাবে কোরবানি দিতে পারেনি। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর কি কখনো নগরীর জনসংখ্যা ও কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্যবানদের তালিকা তৈরির জন্য কোনো পরিসংখ্যান নিয়েছে? যার আলোকে কোরবানির পশু সরবরাহের মনিটর করা যায়। দেশের অভ্যন্তরের খামারিদের গরু ও কৃষকদের গরুর হিসাব নিয়ে প্রয়োজনে পশু আমদানির চিন্তা করা যেত। এ কাজগুলো আগেভাগে করতে পারলে বাজারে ভারসাম্য তৈরি করা সম্ভব ছিল। ফলে কোরবানির হাট হঠাৎ পশুশূন্য হয়ে যাওয়ার কারণ ঘটত না। এবার তো পশু ব্যবসায়ীদের অশ্রুতে সিক্ত হয়েছে কোরবানির হাট। এবার দেশের অভ্যন্তরে সাধারণ কৃষক ও গরু-ছাগলের খামারিরা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গরু-ছাগল উৎপাদন ও প্রতিপালন করেছেন। এ হিসাবটি সরকারি দপ্তরে থাকলে তার আলোকে প্রয়োজন পড়লে বা প্রয়োজনমতো গরু আমদানির অনুমোদন দেওয়া যেত। ফলে বাজারে ভারসাম্য বজায় থাকত। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের স্বার্থ রক্ষা পেত।
আমাদের সরকারগুলো এতটা জনকল্যাণকামী নয় যে উদ্ভূত অবস্থায় বিপন্ন গরু ব্যবসায়ীদের চোখের জল মুছিয়ে দেবে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দেখেছি অনেক ব্যবসায়ী সুদে ঋণ নিয়ে গরু কিনেছিলেন। এখন পানির দরে বিক্রি করে সর্বস্বান্ত। জমি বিক্রি করে মহাজনের ঋণ শোধ করতে হবে। সরকার নিশ্চয়ই এই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে না।
দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন সব সময়েই দুর্বলের বিপক্ষে। এবার পশু চামড়া নিয়ে সংকট হবে আগেই আশঙ্কা করা হয়েছিল। ট্যানারি মালিকরা চামড়ার মূল্য বেঁধে দেননি। এতে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী- যাঁরা ধারদেনা করে এ সময় চামড়া সংগ্রহ করে কিছু বাড়তি আয়ের আশায় তাঁরা ঝুঁকির মুখে পড়বে। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ট্যানারি মালিক আর মধ্যস্বত্বভোগী আড়তদারদের স্বার্থ রক্ষা করতে এই সাধারণ ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ায়নি। সরকারপক্ষ ট্যানারি মালিকদের মূল্য নির্ধারণে বাধ্য করতে পারত। তা না করে বিপদগ্রস্ত করেছে খুচরা ব্যবসায়ীদের।
যথারীতি নানা হাঁকডাক করেও মসলার বাজারকে এবারও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি সরকার। জননিরাপত্তা ও জনস্বার্থ এভাবে বারবার বিঘ্নিত হয়েছে।
একটি গণতান্ত্রিক সরকারের এসব দুর্বলতা মানুষকে স্বস্তি দেয় না। প্রতি ক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য যেখানে পুরো একটি বছর হাতে পাওয়া যায় সেখানে জনকল্যাণে সরকার ব্যর্থ হবে কেন? আমরা বরাবরের মতো আবারও প্রত্যাশা করব, সরকার পূর্বপরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে আগামী ঈদের আগেই সড়ক সংস্কার করবে। দলীয় ও পুলিশি চাঁদাবাজি শক্ত হাতে বন্ধ করবে। কোরবানির পশু সরবরাহে ভারসাম্য রক্ষা করে ব্যবসায়ী ও ক্রেতার স্বার্থ রক্ষা করবে। চামড়ার বাজারে সরকারি খবরদারি আরোপিত হবে এবং নিত্যপণ্যের বাজারকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। আমরা মনে করি, সুশাসন প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় থাকলে এসবের বাস্তবায়ন খুব কঠিন নয়।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিবছরই রমজানের ঈদের আগে সড়কপথের বেহাল অবস্থা নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রীদের ছোটাছুটি করতে হয়। সারা বছরই বেহাল অবস্থা থাকে। যেহেতু সারা বছর এই পথে যারা চলাচল করে তাদের বেশির ভাগই বাংলাদেশের মানুষ তাই মন্ত্রীদের এই ছোটাছুটি যে জনকল্যাণে, তা বলা যাবে না। ছোটাছুটির বড় কারণ ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের চাপ অনেক বেশি থাকে, তাই দুর্ভোগটা সাধারণ্যে অনেক বেশি দৃশ্যমান হবে। মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হবে। মিডিয়ায় নানাভাবে প্রচার পাবে। তাই জনগণকে কষ্ট দিয়ে জনগণের টাকার বড় রকমের অপচয় করে জোড়াতালির সড়ক মেরামত করা হয়। গত রমজানে এ ধরনের জোড়াতালির কাজ করা হয়েছে দেশের নানা অঞ্চলে। সে সময়ের একটি লেখায় আমি উদাহরণ টেনেছিলাম, সাভার থেকে নবীনগর পর্যন্ত এলাকার মানুষ যদি আশুলিয়া হয়ে উত্তরা বা টঙ্গীর দিকে যেতে চায়, তবে তাদের দুটো লিংকরোড রয়েছে। একটি বিশমাইল থেকে ক্যান্টনমেন্টের পাশ দিয়ে জিরাবো পর্যন্ত, আরেকটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বিপিএটিসির কাছে সিঅ্যান্ডবি পয়েন্ট থেকে ডেইরি ফার্মের পাশ দিয়ে আশুলিয়া পর্যন্ত। প্রতিটি সাত-আট কিলোমিটারের পথ। উভয় রাস্তার পাশে রয়েছে নানা ধরনের শিল্প-কারখানা। কিন্তু বছর ধরেই উভয় রাস্তা ছোট-বড় গর্ত আর খানাখন্দে ভরা থাকে। এ পথে ছোট গাড়ি চালানো রীতিমতো বিপজ্জনক। সড়কের অবস্থা দেখে মনে হয় এটি সরকারের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত এলাকা।
গত রমজান মাসে দেখা গেল, যোগাযোগমন্ত্রীর উদ্যোগে দেশজুড়ে মেরামতির হাওয়া এই দুই সড়কেও পড়েছিল। ইটের খোয়া ও বালু দিয়ে গর্ত ভরাট করে যান চলাচলে কিছুটা স্বস্তি আনা হয়েছিল। নির্মাণ মান ও পদ্ধতি দেখে আমি সে সময় আমার একটি লেখায় মন্তব্য করেছিলাম, ঈদের আগে দু-একদিন বৃষ্টি হলে ঈদ পার করতে পারবে না সরকার। দুর্ভাগ্যক্রমে ঘটেছিলও তাই। বৃষ্টিভেজা জোড়াতালিতে ভারী যানবাহনের চাকার চাপে গর্তগুলো আবার উন্মোচিত হয়েছিল ঈদের আগেই। আর এই কোরবানির ঈদের আগে তো তা ব্ল্যাকহোলে রূপান্তরিত হয়েছে। এসব কারণে সচেতন মানুষের প্রশ্ন থেকে যায়- কী রহস্য রয়েছে সময়মতো মানসম্মত সংস্কার বা নির্মাণ না করে ঈদের আগের তড়িঘড়ি কাজ করার মধ্যে?
কোরবানির ঈদ সামনে রেখেও তো জনকল্যাণের প্রয়োজনে কয়েকটি পদক্ষেপ অনেক আগে থেকেই সরকার নিতে পারে। যেমন- সড়কপথের ভয়াবহ যানজটের সংকট কমিয়ে আনা। ক্রেতাসাধারণ, পশু ও চামড়া ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। মসলার বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। এসব বিষয় সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য সরকার পুরো এক বছর সময় হাতে পায়। কিন্তু এর সদ্ব্যবহার কি সরকার করতে পারে বা চায়?
এই কোরবানির ঈদের কথাই ধরা যাক। ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ নানা সড়ক-মহাসড়কে তীব্র যানজটের কথা তথ্যমাধ্যম জানিয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে ছিল যাত্রীবাহী বাস, পণ্য ও পশুবাহী ট্রাক। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, আবার রাস্তার বেহাল দশা, নানা নামের সরকারদলীয় চাঁদাবাজ ও পুলিশি চাঁদা আদায় করতে গিয়ে পশুবাহী ট্রাক আটকে দেওয়া। প্রশাসনের নির্দেশ অমান্য করে স্থানীয় সরকারদলীয় মাস্তান কর্তৃক সড়কের পাশে যত্রযত্র পশুর হাট বসিয়ে যানজটকে আরো প্রলম্বিত করা। এসব দুর্বলতা ও অন্যায় মোকাবিলা করে জনগণকে স্বস্তি দেওয়ার কথা ছিল সরকারের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকার কি সাফল্য দাবি করতে পারে?
সরকারের অদূরদর্শিতার কারণে প্রায় বছরই পশুর হাটে পশু ব্যবসায়ী বা ক্রেতাসাধারণ গভীর সংকটে পড়ে। গেল বছর কোরবানি ঈদের আগের দিন ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে তীব্র পশু সংকট দেখা দিয়েছিল। তাই স্বল্পসংখ্যক পশু যাদের হাতে ছিল তারা তিন-চার গুণ দামে তা বিক্রি করেছে। অনেক ক্রেতা পশুর অভাবে কোরবানি দিতে পারেনি। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর কি কখনো নগরীর জনসংখ্যা ও কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্যবানদের তালিকা তৈরির জন্য কোনো পরিসংখ্যান নিয়েছে? যার আলোকে কোরবানির পশু সরবরাহের মনিটর করা যায়। দেশের অভ্যন্তরের খামারিদের গরু ও কৃষকদের গরুর হিসাব নিয়ে প্রয়োজনে পশু আমদানির চিন্তা করা যেত। এ কাজগুলো আগেভাগে করতে পারলে বাজারে ভারসাম্য তৈরি করা সম্ভব ছিল। ফলে কোরবানির হাট হঠাৎ পশুশূন্য হয়ে যাওয়ার কারণ ঘটত না। এবার তো পশু ব্যবসায়ীদের অশ্রুতে সিক্ত হয়েছে কোরবানির হাট। এবার দেশের অভ্যন্তরে সাধারণ কৃষক ও গরু-ছাগলের খামারিরা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গরু-ছাগল উৎপাদন ও প্রতিপালন করেছেন। এ হিসাবটি সরকারি দপ্তরে থাকলে তার আলোকে প্রয়োজন পড়লে বা প্রয়োজনমতো গরু আমদানির অনুমোদন দেওয়া যেত। ফলে বাজারে ভারসাম্য বজায় থাকত। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের স্বার্থ রক্ষা পেত।
আমাদের সরকারগুলো এতটা জনকল্যাণকামী নয় যে উদ্ভূত অবস্থায় বিপন্ন গরু ব্যবসায়ীদের চোখের জল মুছিয়ে দেবে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দেখেছি অনেক ব্যবসায়ী সুদে ঋণ নিয়ে গরু কিনেছিলেন। এখন পানির দরে বিক্রি করে সর্বস্বান্ত। জমি বিক্রি করে মহাজনের ঋণ শোধ করতে হবে। সরকার নিশ্চয়ই এই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে না।
দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন সব সময়েই দুর্বলের বিপক্ষে। এবার পশু চামড়া নিয়ে সংকট হবে আগেই আশঙ্কা করা হয়েছিল। ট্যানারি মালিকরা চামড়ার মূল্য বেঁধে দেননি। এতে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী- যাঁরা ধারদেনা করে এ সময় চামড়া সংগ্রহ করে কিছু বাড়তি আয়ের আশায় তাঁরা ঝুঁকির মুখে পড়বে। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ট্যানারি মালিক আর মধ্যস্বত্বভোগী আড়তদারদের স্বার্থ রক্ষা করতে এই সাধারণ ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ায়নি। সরকারপক্ষ ট্যানারি মালিকদের মূল্য নির্ধারণে বাধ্য করতে পারত। তা না করে বিপদগ্রস্ত করেছে খুচরা ব্যবসায়ীদের।
যথারীতি নানা হাঁকডাক করেও মসলার বাজারকে এবারও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি সরকার। জননিরাপত্তা ও জনস্বার্থ এভাবে বারবার বিঘ্নিত হয়েছে।
একটি গণতান্ত্রিক সরকারের এসব দুর্বলতা মানুষকে স্বস্তি দেয় না। প্রতি ক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য যেখানে পুরো একটি বছর হাতে পাওয়া যায় সেখানে জনকল্যাণে সরকার ব্যর্থ হবে কেন? আমরা বরাবরের মতো আবারও প্রত্যাশা করব, সরকার পূর্বপরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে আগামী ঈদের আগেই সড়ক সংস্কার করবে। দলীয় ও পুলিশি চাঁদাবাজি শক্ত হাতে বন্ধ করবে। কোরবানির পশু সরবরাহে ভারসাম্য রক্ষা করে ব্যবসায়ী ও ক্রেতার স্বার্থ রক্ষা করবে। চামড়ার বাজারে সরকারি খবরদারি আরোপিত হবে এবং নিত্যপণ্যের বাজারকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। আমরা মনে করি, সুশাসন প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় থাকলে এসবের বাস্তবায়ন খুব কঠিন নয়।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments