চারদিক- ‘আমার কাজ বন্ধ তো দুনিয়া বন্ধ’ by সুচিত্রা সরকার

পাথরের চাকতি বনবন ঘুরছে। কাঁচিটা সেখানে লাগাতেই ফুলকি বেরোচ্ছে। আগুনের ফুলকি। দুবার, পাঁচবার, আটবার...। ব্যস, হয়ে গেল। মিনিট খানেক আগের ভোঁতা কাঁচিটায় ধার ফিরে এল। কাঁচিটা একটা কাপড়ে বেঁধে রেখে দিলেন।


তারপর হাতে তুলে নিলেন আরেকটি কাঁচি। সকাল সাড়ে নয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত বিরামহীনভাবে এ কাজ করেই চলেন হালিম শেখ।
বাড়ি পাবনার সুজানগরে। পড়ালেখা খুব বেশিদূর এগোয়নি। পঞ্চম শ্রেণী অবধি পড়েই ক্ষান্ত দিতে হলো। দিনমজুরের খাতায় নিজের নামটা লিখিয়ে নিলেন তখন থেকেই। তারপর এটা-সেটা, আরও কত কী। ঢাকায় এসে শুরু করলেন কাঁচি শাণ দেওয়ার কাজ।
সেটা কবে থেকে?
একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে যান। ভাবতে থাকেন। তারপর বলেন, ‘আমার মামা আমারে এই কাজ শিখাইছে। অন্য কোনো কাজও শিখি নাই। আগে মামার দোকানেই কাজ করতাম। নয়াবাজারে। এইখানে আইছি চাইর বছর আগে।’
‘এইখানে’ বলতে পিলখানার আবদুল আজিজ লেনের দোকানে।
দোকানটা আরেকবার দেখে নিলাম। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে কয় ফুট হবে। ১০ ফুট বাই তিন ফুট! দোকানের একটি তাকে কাঁচির যন্ত্রপাতি রাখা। মেঝেতে একটুখানি জায়গায় মোটর লাগানো লোহার চাকতি আর হালিম শেখ। আর কোনো জায়গা নেই সেখানে। তাই বসেছিলাম দোকানের বাইরে একটা টুলে।
জানতে চাইলাম, ‘দোকানটা কিনেছেন চার বছর আগেই?’
কাজ থামিয়ে হাসলেন খানিকক্ষণ। তারপর বলেন, ‘কী যে কন। ভাত খাইতে পারি না। এই দোকান আমার না। মালিকের। আমি চাকরি করি। মাসে নয় হাজার টাকা পাই। আর একবেলা খানাও দেয়।’
মুদ্রাস্ফীতির এই বাজারে এইটুকু দোকানের মালিক হওয়ার সামর্থ্যও অনেকের নেই। ভেবে বিচলিত হই।
খানিক থেমে আবারও প্রশ্ন করি, ‘কাঁচি শাণ দিতে এখানে কারা আসে?’
কাঁচিতে শাণ দিতে দিতে বলেন, ‘অনেকেই আসে। গার্মেস, জুতার কারখানা, টেইলার, সেলুনের মালিক সবাই আসে। আসলে আমার কাজ বন্ধ তো দুনিয়া বন্ধ। জুতা থেইক্যা শুরু কইরা ব্যাগ-কাপড় সবই তো কেঁচি দিয়া কাটতে হয়। আর কেঁচির ধার কইম্যা গেলে আমাগো ছাড়া গতি নাই।’ বলেই প্রাণখোলা হাসি ছড়িয়ে দেন।
প্রতিটি কাঁচি ১৫ থেকে ২০ টাকায় শাণ দেওয়া হয়। প্রতিদিন ৬০-৭০টা কাঁচি শাণ দেন তিনি।
বসে থাকতে থাকতে কেমন একটা দম বন্ধ করা গন্ধ পেলাম।
এটা কিসের গন্ধ?
হালিম শেখ বলেন, ‘পোড়া মোবিলের গন্ধ। শাণ দিতে এই তেল লাগে। আমাগো অভ্যাস হইয়া গেছে।’
কোনো অসুখ হয় না এই গন্ধে?
একটু ভেবে জবাব দেন, ‘কী জানি! তয় আজ পর্যন্ত কারও এর লাইগ্যা অসুখ হইছে বইল্যা তো শুনি নাই। আবার দেহেন না, চাকতির নিচে যেই ইটের টুকরাটা থাহে, এইটার গুঁড়ায় শরীর ভইর‌্যা যায়। ধুলায় থাহি সারা দিন।’
সত্যিই সারা শরীরে ধুলার জয়গান মেখে বসে আছেন হালিম শেখ।
জসীমউদ্দিন কাপড়ের দোকানে কাজ করেন। এসে বললেন, ‘এই কেঁচিটায় ধার দিয়া রাইখো। কাইল সকালে লইয়া যামু। ভালো কইরা দিয়ো, কইলাম!’
অনুরোধের অভ্যস্ততায় বিচলিত হন না তিনি। কাঁচিটা আলগোছে তাকের ওপর তুলে রাখেন। তারপর খানিক আগের শাণ দেওয়া কাঁচিটা তুলে নেন। চোখজোড়া এখন কাঁচির কিনারার ধার দেখছে।
‘বিয়ে করেছেন, ছেলেমেয়ে কজন?’
প্রশ্ন শুনে কাঁচির মতোই চকচক করে ওঠে চোখজোড়া।
কাজ থামিয়ে জবাব দেন, ‘আমার দুইটা বাচ্চা। বড়টা ছেলে। বয়স সাত হইব। দ্যাশের বাড়িতে পাঠাইয়া দিছি। থাহে দাদা-দাদির লগে। আর ছোটটা চাইর বছরের মাইয়া। বউ আর ছোটডারে লইয়া কামরাঙ্গীচরে থাহি।’
কামরাঙ্গীরচরের এক কামরার ঘরের ভাড়া এক হাজার ৫০০ টাকা। তাতেও সংসার চলে না। আর টাকার সঙ্গে দৌড়ে পেরে না উঠলে হয়তো ওদেরও গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে হালিম শেখের।
হালিম শেখ স্বপ্ন দেখেন অনেক। ছেলেকে কখনোই এই পেশায় আনবেন না। নিজেই বলেন, ‘নিজে না বুইঝ্যা এই কাজে আসছি। আর কোনো কাজও শিখি নাই। তয় পোলারে এই কামে আনুম না। ও লেখাপড়া করব। ভালো চাকরি করব। সরকারি চাকরি। দেহি কত দূর পড়াইতে পারি।’
দোকানে সেলুনের অনেক সরঞ্জামও বিক্রি হচ্ছে। প্রশ্ন করি, এসবও বিক্রি করেন?
খানিক বিষণ্ন হয়ে জবাব দেন, ‘সবই বিক্রি হয় এই দোকানের, আমি ছাড়া।’
আবার একটু ভেবে বলেন, ‘নাহ! আমিও বিক্রি হই। যখন মালিকের কাজ করি, তহন মালিকের কাছে। আবার যহন কাস্টমারের কাজ করি, তহন তাগো কাছে বিক্রি। তয় বেশিদিন এই কাজে আর থাকুম না। পুঁজি জোগাইতে পারলে বিদেশে চইল্যা যামু। এই কাজে থাকুম না। এই কাজে কোনো ভবিষ্যৎ নাই।’
সুচিত্রা সরকার

No comments

Powered by Blogger.