মানবতার কণ্ঠস্বর ভূপেন হাজারিকা by ফকির আলমগীর
গেল বছরের ৫ নভেম্বর ৮৬ বছর বয়সে চিরবিদায় নিলেন গানের যাযাবর ভূপেন হাজারিকা। ভূপেন হাজারিকা এক কিংবদন্তির নাম। এই শিল্পীই মানুষ ও মানবতার কথা বলার জন্য জেল খেটেছেন; কিন্তু পিছপা হননি।
গেয়েছিলেন শতাব্দীর অবিস্মরণীয় কালজয়ী সেই গান_ 'মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না।' মানুষের প্রতি কতখানি গভীর দরদ থাকলে একজন শিল্পী এমন গান গাইতে পারেন! কেবল তা-ই নয়, সব গানেই আমজনতার কথা তুলে ধরার জন্য তার গানের মধ্যে জনগণ বারবার নিজেদের খুঁজে পেত। হিন্দু ধর্মের তীর্থ পবিত্র নদী গঙ্গার কাছে তিনি ফরিয়াদ জানিয়েছিলেন, প্রশ্ন রেখেছিলেন গানের ভাষায়, 'বিস্তীর্ণ দু-পাড়ে অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও নিঃশব্দে-নীরবে ও গঙ্গা তুমি ও গঙ্গা বইছো কেন।' মানুষ আর জীবনের শিল্পী স্পস্ট প্রশ্ন রেখেছেন, দুই পাড়ের অসংখ্য নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের কষ্টের জীবনযাত্রা দেখেও কেন গঙ্গার প্রতিক্রিয়া হয় না, কেন সে শুধুই বয়ে চলে? এই বিশ্বায়নের যুগে, যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে সহানুভূতি হারিয়ে প্রায় যন্ত্র হয়ে ওঠা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন_ 'মানুষ মানুষের জন্য' গানটি গেয়ে। কেমন অসাম্প্রদায়িক গণচেতনার শিল্পী হলে গাইতে পারেন_ 'গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা, ও আমার দুই চোখে দুই জলের ধারা, মেঘনা যমুনা।' শুধু তাই নয়, নিপীড়িত মানুষের সপক্ষে তিনি শরৎ বাবুকে খোলা চিঠি দিয়েছিলেন তার মহেশ, গফুর কোথায় কেমন আছে।
১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ভারতের আসাম রাজ্যে জন্ম নেওয়া এই কিংবদন্তি গণসঙ্গীতশিল্পী কৈশোরকাল থেকেই গান লেখা, সুর করা এবং একই সঙ্গে গাইতে শুরু করেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি অসমিয়া ছবি ইন্দ্রমালতিতে গান করেন। অসমিয়া ভাষা ছাড়াও তিনি বাংলা-হিন্দিসহ ভারতের বেশ ক'টি ভাষায় গান করেছেন। সব ক্ষেত্রেই জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। তবে বাংলা ও হিন্দি ভাষাতেই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পান। খ্যাতি পান লেখক হিসেবেও। সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। আমেরিকার কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে গণযোগাযোগে পিএইচডি লাভ করা এ গণমানুষের শিল্পী এক জীবনে বহুবিধ কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। প্রযোজক-পরিচালক হয়েছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, অভিনয় করেছেন। গায়ক হিসেবে অবশ্যই তিনি উপমহাদেশের রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ পরিবেশক ছিলেন। তার বর্ণাঢ্য জীবনে পদ্মভূষণ, দাদা সাহেব ফালকে, বেস্ট রিজিওনাল ফিল্ম, সঙ্গীত, নাটক, একাডেমী পুরস্কারের পাশাপাশি অনেক আঞ্চলিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৫ সালে চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কার পান। ১৯৭৭ সালে ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। আর আসামের এই কৃতী সন্তানকে ২০০৯ সালে অসম রত্ন অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করা হয়। ওই বছরেই আসামের প্রধান শহর গৌহাটির কেন্দ্রস্থলে তার ভাস্কর্য বসানো হয়। ভাস্কর্যের আনুষ্ঠানিক পর্দা উন্মোচন নিজেই করেছিলেন। সেই গণমানুষের শিল্পী শেষবারের মতো ফিরলেন তার স্মৃতির শহর, আসামের গৌহাটিতে নিষ্প্রাণ দেহ নিয়ে। গৌহাটির বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। আসামবাসী চোখের পানিতে তাকে বিদায় জানায়। উলফা অস্ত্রবিরতি করে। আসামে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে; এই আসামেই যার জীবন শুরু হয়েছে। সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়ে লেখা গানগুলো তাকে গীতিকার হিসেবে বেশি জনপ্রিয় করে। এ ক্ষেত্রে গণসঙ্গীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হবিগঞ্জের কৃতী সন্তান হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সানি্নধ্য ও উৎসাহ তাকে অনুপ্রাণিত করে। তারই উৎসাহে ভূপেন হাজারিকা ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগদান করেন। অসমীয় বিলু ভাটিয়ালীর সুর গণজাগরণের গানে সার্থক প্রয়োগ করে তিনি হয়ে ওঠেন অসাধারণ এবং জনপ্রিয়। নিজ গুণে এ অসমীয় শিল্পী দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক জগতের অগ্রদূত হয়ে উঠেছিলেন। তার কণ্ঠ ছিল দরাজ, সুমিষ্ট এবং সুরেলা গানের বাণী ছিল আধুনিক। গায়কীর শব্দ চয়ন ছিল নান্দনিকতায় ভরা। আমি এক যাযাবর; সাগর সঙ্গমে; মেঘ থম থম করে; প্রতিধ্বনি শুনি; দোলা হে দোলা; ও মালিক সারাজীবন; মানুষ মানুষের জন্য; বিস্তীর্ণ দু'পাড়ে; গঙ্গা আমার মা; শরৎবাবু_ খোলা চিঠি দিলাম; আমায় একটি সাদা মানুষ দাও, যার রক্ত সাদা; একটি কুঁড়ি দুটি পাতা; এ শহর প্রান্তর; আমায় ভুল বুঝিস না; মোর গাঁয়ের সীমানায়; জয় জয় নবজাত বাংলাদেশ; তার সুরারোপিত গান বিমূর্ত এই রাত্রিসহ অসংখ্য গান শুনলেই তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তার চিরবিদায়ের সময় পাশে ছিলেন ৩৯ বছরের সঙ্গীত চলচ্চিত্রকার কল্পনা লাজমি। ভূপেন হাজারিকা একজন মানবদরদি শিল্পী হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন তার ভক্তদের হৃদয়ে। মুক্তিযুদ্ধে তার বিশেষ অবদানের কথা বাঙালি জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য তাকে চিরস্মরণীয় রাখবে।
ফকির আলমগীর :সভাপতি গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ
১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ভারতের আসাম রাজ্যে জন্ম নেওয়া এই কিংবদন্তি গণসঙ্গীতশিল্পী কৈশোরকাল থেকেই গান লেখা, সুর করা এবং একই সঙ্গে গাইতে শুরু করেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি অসমিয়া ছবি ইন্দ্রমালতিতে গান করেন। অসমিয়া ভাষা ছাড়াও তিনি বাংলা-হিন্দিসহ ভারতের বেশ ক'টি ভাষায় গান করেছেন। সব ক্ষেত্রেই জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। তবে বাংলা ও হিন্দি ভাষাতেই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পান। খ্যাতি পান লেখক হিসেবেও। সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। আমেরিকার কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে গণযোগাযোগে পিএইচডি লাভ করা এ গণমানুষের শিল্পী এক জীবনে বহুবিধ কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। প্রযোজক-পরিচালক হয়েছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, অভিনয় করেছেন। গায়ক হিসেবে অবশ্যই তিনি উপমহাদেশের রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ পরিবেশক ছিলেন। তার বর্ণাঢ্য জীবনে পদ্মভূষণ, দাদা সাহেব ফালকে, বেস্ট রিজিওনাল ফিল্ম, সঙ্গীত, নাটক, একাডেমী পুরস্কারের পাশাপাশি অনেক আঞ্চলিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৫ সালে চলচ্চিত্রে জাতীয় পুরস্কার পান। ১৯৭৭ সালে ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। আর আসামের এই কৃতী সন্তানকে ২০০৯ সালে অসম রত্ন অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করা হয়। ওই বছরেই আসামের প্রধান শহর গৌহাটির কেন্দ্রস্থলে তার ভাস্কর্য বসানো হয়। ভাস্কর্যের আনুষ্ঠানিক পর্দা উন্মোচন নিজেই করেছিলেন। সেই গণমানুষের শিল্পী শেষবারের মতো ফিরলেন তার স্মৃতির শহর, আসামের গৌহাটিতে নিষ্প্রাণ দেহ নিয়ে। গৌহাটির বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। আসামবাসী চোখের পানিতে তাকে বিদায় জানায়। উলফা অস্ত্রবিরতি করে। আসামে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে; এই আসামেই যার জীবন শুরু হয়েছে। সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়ে লেখা গানগুলো তাকে গীতিকার হিসেবে বেশি জনপ্রিয় করে। এ ক্ষেত্রে গণসঙ্গীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হবিগঞ্জের কৃতী সন্তান হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সানি্নধ্য ও উৎসাহ তাকে অনুপ্রাণিত করে। তারই উৎসাহে ভূপেন হাজারিকা ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগদান করেন। অসমীয় বিলু ভাটিয়ালীর সুর গণজাগরণের গানে সার্থক প্রয়োগ করে তিনি হয়ে ওঠেন অসাধারণ এবং জনপ্রিয়। নিজ গুণে এ অসমীয় শিল্পী দক্ষিণ এশিয়ার সাংস্কৃতিক জগতের অগ্রদূত হয়ে উঠেছিলেন। তার কণ্ঠ ছিল দরাজ, সুমিষ্ট এবং সুরেলা গানের বাণী ছিল আধুনিক। গায়কীর শব্দ চয়ন ছিল নান্দনিকতায় ভরা। আমি এক যাযাবর; সাগর সঙ্গমে; মেঘ থম থম করে; প্রতিধ্বনি শুনি; দোলা হে দোলা; ও মালিক সারাজীবন; মানুষ মানুষের জন্য; বিস্তীর্ণ দু'পাড়ে; গঙ্গা আমার মা; শরৎবাবু_ খোলা চিঠি দিলাম; আমায় একটি সাদা মানুষ দাও, যার রক্ত সাদা; একটি কুঁড়ি দুটি পাতা; এ শহর প্রান্তর; আমায় ভুল বুঝিস না; মোর গাঁয়ের সীমানায়; জয় জয় নবজাত বাংলাদেশ; তার সুরারোপিত গান বিমূর্ত এই রাত্রিসহ অসংখ্য গান শুনলেই তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তার চিরবিদায়ের সময় পাশে ছিলেন ৩৯ বছরের সঙ্গীত চলচ্চিত্রকার কল্পনা লাজমি। ভূপেন হাজারিকা একজন মানবদরদি শিল্পী হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন তার ভক্তদের হৃদয়ে। মুক্তিযুদ্ধে তার বিশেষ অবদানের কথা বাঙালি জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য তাকে চিরস্মরণীয় রাখবে।
ফকির আলমগীর :সভাপতি গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ
No comments